• ক্রিকেট

গল্পে-কল্পে ঘরোয়া ক্ল্যাসিক : সাগরিকার সাগর তীরে পদ্মার অবাক রোমাঞ্চ-ঢেউ

পোস্টটি ৩৮৯৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

পিচ হতে কাভার সরানোর আগে...

বাংলাদেশ দলপতি মুশফিকুর রহীম। বড্ড মনোকষ্টে আছেন তিনি। মনোকষ্টে আছে পুরো বাংলাদেশ ক্রিকেট। শ্রীলংকার বিপক্ষে সর্বশেষ টেস্টটা দারুণ ছিল, ড্র হলেও মুমিনুল, শামসুর-ইমরুল, সাকিবদের মতো ক্রিকেটাররা হেসেছেন ভালোই। অধিনায়ক হিসেবে মুশফিকুরও হেসেছেন বটে, তবে ব্যাটের আড়ষ্টতা কাটানো হয়নি তাঁর।

দুঃস্বপ্নের মতো গেছে এশিয়া কাপ, আফগানিস্তানের বিপক্ষে জুটেছে লজ্জার পরাজয়। শ্রীলংকার বিপক্ষে দ্বিপাক্ষিক সিরিজটাও ভালো যায়নি। জিততে জিততে হেরে যেতে হয়েছে। শ্রীলংকার বিপক্ষে দুই-দুইবার ঘটেছে এই ব্যাপার কয়েকদিনের ব্যবধানে। ঘটেছে পাকিস্তানের বিপক্ষে। আফগানিস্তানের বিপক্ষেও জয় অসম্ভব মনে হয়নি, জেতা সম্ভব ছিল ভারতের বিপক্ষেও। কিন্তু জয়ের কক্ষপথ থেকে বারংবার ঘটছে কক্ষবিচ্যুতি। যেনো কোনো বদ নজর পড়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেটে। অথচ আগের বছরই তো কত্ত ভালো গেছে!

দেশটার গতিপ্রকৃতিও কেমন যেন! ভয়, আতঙ্ক আর সংশয়ের আবর্তে গোটা সময়। চারপাশ মনমরা। জনমনে নেই স্বস্তি, নেই শান্তি। রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ দেখে কখনো কখনো হেঁয়ালি আশরাফুলের কথা মনে পড়ে। কার্যের ক্রম ও পরিণতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন তারা। সাধারণ মানুষ নিতান্তই অসহায়। 

মন খারাপ করা এক পরিবেশ আর বাংলাদেশ ক্রিকেটের বিষণ্ণতার দায় কাঁধে নিয়ে চট্টগ্রাম পৌঁছলেন মুশফিকুর রহীম। মাস খানেক আগে এই চট্টগ্রামেই সতীর্থরা তাঁকে ড্র উপহার দিয়েছে, শ্রীলংকার বিপক্ষে। তিনি আবার তাঁর বিভাগীয় দল, রাজশাহী বিভাগেরও অধিনায়ক। উইকেটের পেছনটাও অনুমিতভাবে সামলান সেখানটায়। চট্টগ্রামে তাঁর রাজশাহী খেলবে, ঢাকা মেট্রোপলিটনের বিপক্ষে।

শিরোপা নির্ধারণ হয়েই গেছে একপ্রকার। এই পর্বের ম্যাচ বলতে গেলে আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার। ঢাকা বিভাগের শিরোপা-জয় ঠেকিয়ে, নিজেদের জয়ের সম্ভাবনা টিকিয়ে রাখতে অনেক ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’ আছে। এতসব পেরিয়ে মনে হয় না এবার আর পদ্মা পাড়ের দলটির চ্যাম্পিয়ন হওয়া সম্ভব। তাই এবারের মতো জাতীয় ক্রিকেট লীগের পর্দা নামার পূর্বে, শেষ ম্যাচের পর্দা তুলতে টস করতে নামলেন মুশফিকুর রহীম। অপর দিকের সঙ্গী মেহরাব হোসেন জুনিয়র। তিনি স্বভাবতই আছেন ঢাকামেট্রোর নেতৃত্বে।

 

শূণ্যে কয়েন, কয়েনে দৃষ্টি

আকন্ঠ বিস্তৃতি হাসি মুশফিকুর রহীমের। ইদানীং টস তাঁর পক্ষেই কথা বলছে। প্রায়ই হাসার সুযোগ হচ্ছে তাঁর। কখনো অবশ্য বেশ চাপের মনে হয় এটা। কারণ, টসে জিতলেই আসে সিদ্ধান্ত জানানোর দায়। কোনো কারণে সিদ্ধান্ত ব্যাকফায়ার করলে, ব্যস! অধিনায়কত্ব নিয়ে টানাটানি। টস জেতা তো নয়, যেনো সাধ করে চাপের অগ্নিকুন্ড মাথায় তোলা।

অবশ্য এখানে অত চাপের কিছু নেই। ঘরোয়া ক্রিকেট। প্রথম শ্রেণির ম্যাচ। ওসব নিয়ে আলোচনার সময় কার আছে? মোটামুটি স্বস্তি আছে। নির্ভার মুশফিকুর রহীম তাই বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত জানাতে দেরী করলেন না মোটেও।

শ্রীলংকার বিপক্ষে ড্র হওয়া ম্যাচটাতে কিন্তু শ্রীলংকা টস জিতে নিয়েছিল ব্যাটিং। প্রথম ইনিংসে বিনির্মাণ করেছিল ৫৮৭ রানের পাহাড়। কুমার সাঙ্গাকারা পেয়েছিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম ও একমাত্র ট্রিপল সেঞ্চুরি। ভদ্রলোক বাংলাদেশকে পেলেই নিষ্ঠুর হয়ে যেতেন খুব। বাংলাদেশের বিপক্ষে একই টেস্টে যুগল সেঞ্চুরি, পরপর দুই টেস্টে অপরাজিত দ্বিশতক, ট্রিপল সেঞ্চুরির ম্যাচেও পরের ইনিংসে সেঞ্চুরি তুলে নিয়ে একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে দু’বার উভয় ইনিংসে সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েন তিনি।

তারও বছর ৭-৮ আগে, ২০০৬ সালে দক্ষিন আফ্রিকার বিপক্ষে খুব কাছে গিয়েও ৩০০ থেকে ১৩ দৌঁড় দূরে ঘটেছিল স্বপ্নযাত্রার পরিসমাপ্তি। সেবার তাঁর বন্ধু মাহেলা জয়াবর্ধনে পেয়েছিলেন ট্রিপল, করেছিলেন ৩৭৪। দুই বন্ধুতে প্রায় দুইদিন ব্যাটিং করে ১৫৭ ওভারে জমা দিয়েছিলেন রেকর্ড ৬২৪ রান। যা এখনো বিশ্বরেকর্ড হয়ে টিকে আছে প্রবল প্রতাপে। গত ১৩ বছরে এর কাছাকাছি জুটি হয়েছে আর একটিই। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হোবার্টে শন মার্শ ও এ্যাডাম ভোজেস একসঙ্গে দৌঁড়েছিলেন ৪৪৯ বার!

চট্টগ্রামের উইকেট ব্যাটিং স্বর্গ বলে জানে সবাই। ব্যাপারটা নিশ্চয় অজানা নয় মুশফিকুর রহীমেরও। তারপরও তাঁর সিদ্ধান্ত বোলিংয়ের। কেন?

কারণটা খানিক বাদে জানালেন তাঁর বোলিং ডিপার্টম্যান্ট।

 

ঢাকামেট্রোর নড়েবড়ে দেয়াল, দেলোয়ারে ভেঙ্গে চুরমার   

দেলোয়ার হোসাইন। ডানহাতি মিডিয়াম পেসার। সে আসরে শীর্ষ উইকেট সংগ্রাহকদের একজন। পেসারদের মধ্যে সাজেদুল ইসলামের পর তাঁর গড়ই ভালো সবচেয়ে। ১৯ দশমিক ৮৩। ৫ ম্যাচে ১৮ উইকেট, ইনিংসে ৫ উইকেট একবারই। আর সেইবারের শিকারই ঢাকামেট্রো।

সাগর তীর থেকে ধেয়ে আসা বাতাস, কন্ডিশনের খানিক সুবিধা আর প্রতিপক্ষের ভুল, সবগুলোকে একসূত্রে গেঁথে সাফল্যের দারুণ রেসিপি বানিয়ে নেন দেলোয়ার। অধিনায়কের সিদ্ধান্তের যথার্থতা প্রমাণের দায় সব’চে তাঁরই ছিল বুঝি! ম্যাচের তৃতীয় আর নিজের দ্বিতীয় ওভারে, সৈকত আলীকে দিয়ে শুরু, তারপর একে একে তুলে নেন আসিফ ও আরমানকেও। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে মাত্রই দ্বিতীয় ম্যাচ খেলতে নামা ছোট্ট সাদমান ইসলাম বনে যান মুক্তার আলীর শিকার। প্রথম ঘন্টা শেষ না হতেই মেট্রোর দশা শোচনীয়। ২৯ রানে নেই চার-চারজন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান। অধিনায়ক মেহরাব হোসেন জুনিয়র যোগ দেন মার্শাল আইয়ুবের সঙ্গে।

ঘরোয়া ক্রিকেটে মার্শালের ধারাবাহিক দুরন্ত ফর্ম, তাঁর জন্য খুলে দেয় শ্বেত আঙিনার অভিজাত উঠোনের আন্তর্জাতিক মঞ্চ। কিন্তু সেভাবে আলো চড়ানোর সুযোগ হয় না সেখানে। মাস কয়েক আগে শ্রীলংকার বিপক্ষে খেললেও কিছু করা হয়নি আইয়ুবের। পরিচিত আঙিনায় ফিরে নিজেকে আবার ফিরে পাওয়ার উপায় অনুসন্ধানে ব্যস্ত তিনি। মেহরাব দীর্ঘদিন নেই জাতীয় দলে, ফেরবার প্রক্রিয়াও একরকম বন্ধ হয়ে গেছে তাঁর, ঘরোয়া ক্রিকেটই একমাত্র সম্বল। 

দু’জনের ব্যাটে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা শুরু হতে না-হতেই শেষ। এবারে আঘাত আরেক লড়াকুর। ফরহাদ রেজা। ঘরোয়া ক্রিকেটের অভিজ্ঞ সেনানী। বহুবার রাজশাহীর জন্য কন্টাকাকীর্ণ মনে হওয়া পথ সহজ করেছেন তিনি, পথের কাঁটা উপড়ে ফেলেছেন কতবার; এবারে আরো একবার তাঁর সবচেয়ে নিবেদিত সন্তানদের একজনকে পেলো রাজশাহী। পরের বলে আঘাত আবারো।  উদীয়মান তরুণ আল আমিন ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে। অভিষেকটা মোটেই সুখকর হলো না তরুণের। তবে পরের আসরগুলোয় দারুণ ক্রিকেট উপহার দিয়ে অভিষেকে শূণ্যের শোকটা নিশ্চয় ভুলিয়ে দিয়েছেন তিনি।

লাঞ্চের আগেই প্রায় আধমরা অবস্থা ঢাকা মেট্রোর।

দেলোয়ারের আরেক স্পেল গুড়িয়ে দিল মেট্রোর টিমটিম করে জ্বলা আশার প্রদীপটাও। একই ওভারে মার্শাল আইয়ুবের সঙ্গে ফিরলেন আবু বকর। ৮৩ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে, একশোর নীচেই গুটিয়ে যাওয়ার শংকা। মোহাম্মদ শহীদ ও ইলিয়াস সানি মিলে সে শংকা কাটালেও, ১২৬ রানের বেশি টেনে নেয়া গেল না।

লাঞ্চ হতে ফেরার একটু পরই শেষ ঢাকামেট্রো। মধ্য দুপুরেই ব্যাটিংয়ে রাজশাহী। টস জিতে বোলিং নেয়ার সিদ্ধান্তে, তৃপ্তির বিশাল ঢেঁকুর নিয়ে ড্রেসিংরুমে গা-টা এলিয়ে দিলেন মুশফিকুর রহীম। আসলেই কি?

 

তথৈবচ রাজশাহী

দুপুরবেলা ভাতঘুম দেয়ার অভ্যেস হয়তো নেই মুশফিকুর রহীমের। তবে দিনের অর্ধেকটা কিপিং করার সামান্য ক্লান্তি আর প্রতিপক্ষকে অল্পতেই গুটিয়ে দেয়ার তৃপ্তি মিলিয়ে যদি গা-টা খানিক এলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন, তাতে তাঁকে দোষ দেয়া যায় না নিশ্চয়! কিন্তু সে সুযোগ আর পেলেন কই তিনি? মাত্র সপ্তম ওভারেই ব্যাড-প্যাড পরে মধ্যমাঠে প্রবেশ করতে হলো তাঁকে। ১৬ রানেই, ১-২-৩ উইকেট হারিয়ে বেকায়দায় পড়ে গেল রাজশাহী। সেখান থেকে টেনে তুলতে মুশফিকুরের জন্য ছিলেন অপর প্রান্তে তরুণ সেনসেশন সাব্বির রহমান। বিপিএল মাতিয়েছেন, বয়স ভিত্তিক দলগুলোতেই ভালোই করেছেন। তাঁর উপর নির্বাচকদের নজর তো আছেই, জাতীয় দলের অধিনায়কও জানেন তাঁকে। ভালো খেলতে পারলে জাতীয় দলে খেলার পথ সুগম হয় তাহলে।

সাব্বির খেললেন ভালোই। অন্তত ম্যাচ পরিস্থিতিতে তো অবশ্যই। মুশফিকুর ফিরলেও একপ্রান্তে তিনি অটল ছিলেন। দিনের খেলা শেষের মিনিট কয়েক আগে লেফট আর্ম আবু বকরের বলে মনসংযোগ হারালে, প্রায় তিন ঘন্টার ইনিংসটার মৃত্যু ঘোষণা হয়। তাঁর ৬৪ রানের মধ্যে ৯টি চার ছিল। ফরহাদ রেজা ফিরেছেন আগেই। রাজশাহী প্রথম দিন শেষে ১৩৯ রানে দাঁড়িয়ে, ১৩ রান লিড পেলেও উইকেট আছে মাত্র তিনটি। তার চেয়েও বড় কথা কাগজে কলমে শিরোপার যে ন্যুনতম সম্ভাবনা ছিল, সেটাও আর নেই তখন। মুক্তার আলী আর সানজামুল ইসলাম ক্রিজে ছিলেন বটে, তবে রুপকথা কি আর হয় সবসময়?

দিন কয়েক আগে, আগের ম্যাচেই ফরহাদ রেজা-সানজামুল ইসলাম-মুক্তার আলী ত্রয়ী মিলে লিখেছিলেন রাজশাহীর জন্য প্রত্যবর্তনের সুন্দরতম এক গল্প। চট্টগ্রামের বিপক্ষে ম্যাচটার সাক্ষী ছিল বিকেএসপিএর তিন নাম্বার মাঠ। সেই গল্পের পূর্ণাঙ্গ অবতারণা স্বভাবতই এখন এখানে সম্ভব নয়। তবে যথাসময়ে কিঞ্চিৎ আলাপ হবে অবশ্যই। রেজা তো ১২ করেই ফিরে গেছেন, মুক্তার-সানজামুল আর করবেন কতটা? প্রশ্নচিহ্ন রেখেই সূর্যাস্তের সঙ্গে মাঠ ছাড়লেন তাঁরা।

 

প্রত্যবর্তনের গল্প    

মুক্তার আলী আগের ম্যাচের দুরন্ত ফর্মের পুরোটা না হলেও, সিকি-অংশ রুপান্তর ঘটাতে সক্ষম হলেন জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে। সানজামুল ১৮, দেলোয়ারের ৯ আর তাইজুলের অপরাজিত ৬ রান সহ, মুক্তার আলীর ৫৮ বলে ৩৯। যাতে ৫টি চারের সঙ্গে ২টি ছয়ও ছিল। ফলে স্কোরবোর্ডে জমা পড়লো আরো ৬৮। তাতে লীড হলো ৮১, রাজশাহীর ২০৭।

রাজশাহী যদি লেজের প্রত্যবর্তন লিখে থাকে, তাহলে ঢাকামেট্রো লিখলো দুই তরুণের অবাক উদ্বোধন। যেখানে প্রথমদিনে পড়েছে ১৭ উইকেট, পরের দিন প্রথম ঘন্টাতেই তিন। সেখানেই পরের প্রায় তিন ঘন্টায় পড়লো না একটিও উইকেট। অপরিসীম মনসংযোগ আর অধ্যাবসায়ের অনন্যতায় ঢাকামেট্রোর জন্য সাদমান ইসলাম ও সৈকত আলী দিলেন দেড়শো ছাড়ানো জমাট ভিত্তি। সেই ভিতে দাঁড়িয়ে ভবন যেমনটা উঁচুতে দাঁড় করানো যেত, তেমনটা করা গেল না। মিডল অর্ডারের ব্যর্থতা আর তাইজুলের উইকেট টু উইকেট বোলিং ধারাবাহিকতা, লাগাম টানলো মেট্রোর স্বপ্নরথের যাত্রায়।

সৈকত আলী ও সাদমান ইসলামের জুটি কোনো বোলারের কারণে ভাঙেনি। ভেঙেছে সৈকতের অসুস্থতা বা ইনজুরিতে। তিন নাম্বারে নামা উইকেট কিপার আরমান ডাক-এ ফিরে গেলে প্রথম উইকেটের দেখা পায় রাজশাহী। সানজামুলের বাঁহাতি স্পিনে বোল্ড হন আরমান। আসিফ ও সাদমান তারপরও টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন ভালোই। প্রায় পৌনে চারঘন্টার পরিশ্রম, ১৯৫ বলের অধ্যাবসায়ে জল ঢেলে দিতে প্রয়োজন হলো হাবিবুর রহমানের একটি নিরীহ দর্শন অফব্রেকের। তিলে তিলে সযতনে গড়ে তোলা ৮৫ রানের ইনিংসটা থেমে যায় হাবিবুরের ভেতরে ঢোকা একটি বলে, লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়েন সাদমান। ব্যস! ওতেই ঢেলে আনেন দুর্যোগ। মার্শাল, মেহরাব, আল আমিন অনুসরণ একে অপরকে। তাইজুল-সানজামুল লেফটি স্পিন-যুগল মোটামুটি ভেঙ্গে দেন মেট্রোর কোমর। ঢাকামেট্রো দিন শেষ করে ২৫৩-তে, ৫ উইকেট নেই তখনই।

 

ইলিয়াস সানি দিবস         

একদা অভিষেকেই ৬ উইকেট নিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন শোরগোল। সেই শুরুর স্বপ্নমুখর অভিযাত্রা দুঃস্বপ্নে রুপান্তরিত হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। চার টেস্টের ক্যারিয়ারে শ্রীলংকার বিপক্ষে সর্বশেষ গল টেস্টে কুড়ি-কুড়ি চল্লিশ ওভার উইকেটহীন এবং সঙ্গে ১৬৫ রান অকাতরে বিলিয়ে, জাতীয় দল থেকে ছিটকে পড়ার সমস্ত বন্দোবস্ত সারা হয় তাঁর। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে একদমই অন্যরকম তিনি, খুব পরিচিত মুখ ও অভিজ্ঞ সেনানী প্রায়সময় দাঁড়ান বুক চিতিয়ে দলের বিপদে। দাঁড়ালেন এদিনও।

দিনের আধঘন্টা না পেরোতেই চার-চারজন ব্যাটসম্যান হাওয়া। ২৫৩ থেকে মাত্র ২৬৮ পর্যন্ত গেছে স্কোর, লীড মোটে ১৮৭; লীড বড় করার দায়িত্ব ছিল যার, ভরসা ছিল যার উপর সবচেয়ে বেশি, সেই আসিফ ফিরেছেন তাইজুলকে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে। আবু বকর-মোহাম্মদ শহীদও ফিরে গেলে অনন্যোপায় হয়ে মাঠে নামেন আগের দিনের রিটায়ার্ড হার্ট সৈকত আলী। কিন্তু তিনিও মিনিট কয়েকের মধ্যে বিদায় নিলেন। সেই ৯৫-তেই। সেঞ্চুরি তো পেলেনই না, দলেরও কোনো কাজে আসতে পারলেন না। সেখান থেকে ইলিয়াস সানি শুরু করলেন পালটা লড়াই। আরেক পুরনো সহযোদ্ধা তালহা জুবায়েরকে নিয়ে রাখলেন, হার না মানা লড়াইয়ের অনন্য সাক্ষর। একসঙ্গে প্রায় ত্রিশ ওভার ও পৌনে দুই ঘন্টা কাটিয়ে স্কোরবোর্ডে জমা দিলেন আরো ৮৪ রান। লীদ গিয়ে দাঁড়ালো ২৭১-এ।

অন্য কোনো উপায় না পেয়ে অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম বল তুলে দেন অকেশনাল লেগ স্পিনার সাব্বির রহমানের হাতে। তাতেই বাজিমাৎ। সাবলীল তালহা ভুল করে ফেললেন হঠাৎ। সাব্বিরকে উইকেট উপহার দিয়ে তাঁর ৭৪ বলে ৩৬ রানের মহামূল্যবান ইনিংসটার পরিসমাপ্তি ঘটলেও, দারুণ সতর্ক ইলিয়াস সানি অপরাজিত থাকেন ৫৫ রানে।

কে জানতো তখন, দুর্দান্ত এক ম্যাচের চিত্রনাট্যের কিছুটা অংশ তাঁরা লিখেছেন মাত্র; অন্য অংশটা পড়ে আছে রাজশাহীর দুই কৃতি সন্তানের জন্য? 

হয় হার, নয় জিৎ। ড্রয়ের কোনো অপশনই নেই। পড়ে আছে অঢেল সময়। ধীরে-সুস্থে ঠান্ডা মাথায় যদি খেলতে জানো, ম্যাচ তোমার পকেটে। রাজশাহীও এগোচ্ছিল ‘স্লো এন্ড স্টেডি উইন দ্য রেস’ আত্মস্থ করে। আসিফের সাধারণ অফস্পিন আর ইলিয়াস সানির মুহূর্তের ম্যাজিক ৫২-০ থেকে রাজশাহীকে পরিণত করল ৭৫-৩ এ। ভেঙ্গে গেল রাজশাহীর টপ অর্ডার। চার ও পাঁচের সাব্বির ও মুশফিকুর ধরলেন হাল, কিন্তু মুশফিকুর বাঁহাতি আবুবকরের আর্মার মিস করে গেলেন। ফাঁদে পড়লেন লেগ বিফোরের। বিকেলের মরে আসা আলোয় মোহাম্মদ শহীদ হয়ে উঠলেন ভয়ংকর। পরপর দুই ওভারে তুলে নিলেন জুবায়ের আহমেদ ও সানজামুল ইসলামকে। দিনের বাকি থাকা মিনিট পনেরো-কুড়ি দাঁতে দাঁত চেপে কাটিয়ে দিলেন ফরহাদ রেজা ও সাব্বির রহমান। সাব্বির ১৭, আর ফরহাদ ০।

সূর্য মিলিয়ে যাওয়ার আগে অবিশ্বাস্য রোমাঞ্চের খানিক আভাস রেখে গেল কি?

 

গগণে-পবনে রোমাঞ্চের কানাকানি

ফরহাদ রেজা আগের ম্যাচেই খেলেছেন ২৫৯ রানের মাস্টারক্লাস। ৭৭/৬ থেকে তিনি ও সানজামুল করেছিলেন ৩৪৭ রানের রেকর্ড পার্টনারশিপ। মুক্তার আলীর সঙ্গে অষ্টম উইকেট জুটিতে গড়েছিলেন আরো ২২৪। অবাক গল্প রচনায় ফরহাদ রেজার পটুতা সম্পর্কে ধারণা তাই ছিলই। নীচে তাঁর রচনার দুই যোগ্য সারথী তখন ব্যাট-প্যাড পরে অপেক্ষমান। সানজামুল ও মুক্তার। ১৫২ রান করা কি এমন হাতিঘোড়া তাহলে?

সুপ্রিয় পাঠক! ভুলে যাবেন না আমরা চারদিনের ম্যাচে শেষ দিন ও শেষ ইনিংসের গল্প বলছি। প্রতিপক্ষের আছে দুই বাঁহাতি- আবু বকর ও ইলিয়াস সানি। আছে তালহা জুবায়ের ও মোহাম্মদ শহীদের মতো দুই অভিজ্ঞ পেস-সেনানী। মেহরাব-আসিফ-আল আমিনদের মতো পার্টটাইমারদেরও মনে রাখা প্রয়োজন। অন্যদিকে রাজশাহীর হাতে আছে মাত্র চার উইকেট। ফরহাদ-মুক্তার-সানজামুল ব্যাট করতে পারেন বটে, তবে কেউই জেনুইন ব্যাটসম্যান নন। সে হিসেবে জেনুইন খেতাবধারী ব্যাটসম্যান আছেন মাত্র একজন, তরুণ সাব্বির রহমান। সাব্বিরের হিটিং সক্ষমতা, কব্জীর জোর, ক্লিন হিটিংয়ের পারদর্শীতা সকলেই জানে, তবে লাল বলের শেষদিনে ওসব অর্থহীন; এও জানা আছে সবার। এখানে ঐসব ক্লিন হিটিংয়ের চেয়েও জরুরী, দূর্ভেদ্য রক্ষণ দেয়াল তুলে টিকে থাকা। সাব্বির ও ফরহাদ-মুক্তার-সানজামুলদের সে সামর্থ্য আছে কি?

পদ্মার অবাক ঢেউয়ের পলিমাটিতে জন্ম নেয়া এক ক্ল্যাসিক

সাব্বির ও ফরহাদের ট্রেন-বাস-প্লেন ধরার তাড়া নেই কোনো। ঢিমেতালে এগোলেও যায় আসে না কিছু। অঢেল সময় হাতে আছে। অবসরের সার্থক ব্যবহারে অরুচি নেই তাদের। চট্টগ্রামের উইকেট ফিরে গেছে তার চিরায়ত রুপে। নিজ থেকে উইকেট না বিলালেই হলো। প্রতিপক্ষের বোলিংয়েও তেমন কোনো ‘এক্স-ফ্যাক্টর’ চোখে পড়ছে না। আরামসে খেলে গেলেই হয়। কেউ দিব্যি দেয়নি চার-ছক্কার ফুলঝুরি বসাতে হবে, ম্যাচটা অত সময়ের মধ্যে শেষ করা লাগবে, বসে থাকতে থাকতে কারো যদি ঝিমুনি আসে তো আসুক, গায়ে-পায়ে গিঁট যদি পড়ে তো পড়ুক, ওসব দেখার সময় হচ্ছে না দুই অপরাজিত ব্যাটসম্যানের। তাঁরা মুক্ত আনন্দে অবারিত সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহারে মগ্ন। নিবিষ্ট মনে পাখির চোখ করেছেন ওই ২৭২। অসম্ভব লক্ষ্যটা একটু একটু নাগালে আসলেও তাঁরা একটুও হঠকারী হন না, আপ্লুত হন না। সাধকের মতো সাধনা করে যান, যেমন করছিলেন তেমন।

লাঞ্চে গেলেন, লক্ষ্যটা প্রায় হাত ছোঁয়া দূরত্বে তখন। কিন্তু নির্বিকার তাঁরা। কোনো তাড়াহুড়ো নয়। প্রায় তিন ঘন্টারও অধিক সময়ে দু’জনে যোগ করলেন ১৫৫ রান, একসঙ্গে খেললেন পঞ্চাশ ওভারেরও বেশি। একজন ২০৪ বলে লিখলেন ১৩ চারে ৮০ রানের হার না মানা অনবদ্য ইনিংসের গল্প। অন্যদিকে সাব্বির রহমান ধ্যানী কোনো ঋষির মতো, পাঁচ ঘন্টা আর ২১৬ বলের অখন্ড সংযমে গড়ে তুললেন তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম এক ক্ল্যাসিক। ১৪টি চারের সাহায্যে যেখানে জমা রেখেছেন তিনি ৮৫টি রান।

সাব্বির রহমান ও ফরহাদ রেজা, চাইলে সেদিন অনায়সে হতে পারতেন পদ্মা পাড়ের উত্তাল ঢেউ। কিন্তু তাঁরা সেদিন অস্থির ও উত্তাল হওয়ার বদলে হলেন বৃক্ষের মতো স্থির ও শান্ত। যেনো নদীগর্ভ থেকে উঠে আসা পলিমাটিতে জন্ম নেয়া কোনো বৃক্ষ। যা শুধুই একটি জয় নয়, উপহার দেয় বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের অনন্য এক ক্ল্যাসিকও।

 

পরিশিষ্ট

মেহরাব হোসেন জুনিয়রের অধিনায়কত্বের অনভিজ্ঞতা, বোলিং ইউনিট ব্যবহারে মুন্সিয়ানার অভাব, দক্ষ হাতে মাঠের পরিস্থিতির সঞ্চালনার ব্যর্থতা; উইকেটের ব্যাটিং-ফ্রেন্ডলি আচরণসহ আরো অনেক কথা বলা যায়। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্যি, যেকোনো পিচ-কন্ডিশন ও প্রতিপক্ষ বিচারে ৪র্থ ইনিংসে মাত্র চার উইকেট হাতে রেখে শেষ দিনে ১৫২ রান তোলা মুখের কথা নয়। সাধুবাদ ও অভিনন্দন দুটোই প্রাপ্য, দু’জনের। একটা আফসোসও একই সাথে মাথাচাড়া দেয়। কি দারুণ বিচক্ষণতা আর পরিস্থিতি সামলানোর সুনিপুণ দক্ষতার প্রমাণ রেখেছিলেন সাব্বির রহমান! অথচ পরে আর সেই ধারা তাঁর পক্ষ থেকে রাখা সম্ভব হয়নি।

একজন ক্রিকেটার খেয়ালি হয়ে শুধুই কি নিজের বিপদ ঢেকে আনেন? স্বদেশের ও দলের কতটা ক্ষতি করেন, জানেন কি? বোঝেন কি?

 

সংক্ষিপ্ত ম্যাচ বিবরণ

রাজশাহী বিভাগ বনাম ঢাকা মেট্রো; এপ্রিল ১৯-২২, ২০১৪

টস- রাজশাহী (বোলিং)।

ঢাকা মেট্রো : ১২৬ ও ৩৫২

রাজশাহী : ২০৭ ও ২৭৫/৬

ম্যাচসেরা : সাব্বির রহমান