ক্রিকেট গল্প : সভাপতি
পোস্টটি ৭৬৩১ বার পঠিত হয়েছেআমি প্রথমে ঘরোয়া ক্রিকেটের খোলনলচে বদলে দেব। এভাবে হবে না। একটা দেশের অবকাঠামো শক্তপোক্ত করতে হলে, ক্রিকেটের ভিত জমাটি করতে হলে, শক্তিশালী ক্রিকেট নেশন হতে গেলে ঘরোয়া ক্রিকেট হতে হবে ধুন্ধুমার। একজন ক্রিকেটার তার বিভাগীয় দলে নিজের জমিন খুঁজে পেতেই বুঝে যেতে হবে, এই জায়গা ঠাট্টা-মশকারার জায়গা নয়। যদি পরিশ্রম ও নিবেদন না থাকে তবে অন্যপেশা বেছে নাও। আর যদি তুমি হও অদম্য, পরিশ্রমী, অনলস; তাহলে লেগে যাও ভিত জমাটি করার কাজে।
এতটুক বলে থামলেন তারেক মামা। তিনিও লম্বা ইনিংস খেলার জন্য লম্বা একটা দম নিলেন বোধহয়। তারেক মামার চারপাশ ঘিরে শীতে কাঁপছি আমরা কয়েকজন ছোকরার দল। নানাবাড়ির উঠোনে বসেছে গল্পের আসর। এই উঠোনে ব্যাডমিন্টনের কোট করেছি আমরা বিস্তর খাটাখাটনি করে। কিন্তু এখন র্যাকেট, টিন ভর্তি শ্যাটলকক সব পড়ে আছে। আমরা বুঁদ হয়ে গেছি ক্রিকেটে। তারেক মামা আসলে এমনই হয়। মামা এত সুন্দর করে গল্প বলেন ক্রিকেটের, আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনি সবাই। কোন মান্ধাতা আমলের গল্প থেকে নিয়ে টন্টনে লিটনের চুরানব্বই পর্যন্ত; পটপট সব গল্প বলে যান, আমরা শুনি তন্ময় হয়ে। আমাদের দেখা ক্রিকেটের গল্পও এত সুন্দর করে গুছিয়ে বলেন! তারেক মামা মানে শুধুই ক্রিকেট নিয়ে গল্প। অন্য কোনো খেলা মামা দু’চক্ষে সহ্য করতে পারেন না। যেখানে ব্যাডমিন্টন কোর্ট করেছি আমরা সেখানেই হয়তো নাইট-টেস্ট খেলতে নেমে যাবো আমরা। তারেক মামা টেস্টই ভালো খেলেন, নির্দিষ্ট ওভারের খেলা ভালো লাগে না উনার। এলবিও থাকে না আমাদের খেলায়। পা দুটো দিয়ে পুরো স্ট্যাম্প ঘিরে বসে থাকেন, কি যে কষ্ট উনাকে আউট করা! আমরা তো খানিক খেললেই বিরক্ত হয়ে মারতে যাই, কিন্তু উনি মারেনও না মরেনও না। মজাও আছে, আছে কিঞ্চিৎ বিরক্তিও।
এবার মামাকে পেয়েই আমরা ধরলাম খুব, বাংলাদেশ ক্রিকেটে কি হচ্ছে না হচ্ছে, ভবিষ্যৎ কি এসব নিয়ে কথা বলার জন্য। মামা তা না করে বলতে শুরু করলেন তিনি সভাপতি হলে কি করবেন সে-ই নিয়ে!
স্কুল ক্রিকেট ঠিক করার বিকল্প নেই। ভারত-শ্রীলঙ্কায় প্রায়ই শুনে থাকবি স্কুল ক্রিকেটারদের কীর্তিমালা বেরোয়। কিন্তু আমাদের সে সুযোগ নেই। ক্রিকেটার আসবে কোত্থেকে? আসমান থেকে? স্কুল ক্রিকেটে নিয়মিত লংগার ভার্সনের ক্রিকেট হতে হবে। সব সময় ক্রিকেট নিয়ে পড়ে থাকলে সবাই তোদের মতো লবডঙ্কা মারবে। তখন জাতির কি হবে? সেজন্য একটা নির্দিষ্ট সময়ে হবে স্কুল ক্রিকেটের টেস্ট ম্যাচ। এমন একটা ক্যালেন্ডার তৈরী করবো যাতে পড়াশোনা ও ক্রিকেটের মধ্যে সমন্বয় হয়।
বাছাই করা কয়েকটা স্কুল নিয়ে হবে চূড়ান্ত টেস্ট। সেটা দেবো এরকম শীতকালে। সবার বার্ষিক পরীক্ষা শেষ, ছুটির মেজাজে ফুরফুরা এমন সময়ে। কোচ, ম্যাচ সমাপনী, টসের আনুষ্ঠানিকতা কিছু ব্যাপার সুনির্দিষ্ট করে দেবো। যাতে বাচ্চারা ছেলেবেলা থেকেই মাইক্রোফোনে কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। সিস্টেমে খাপ খাইয়ে যায়।
তারপর আসবে তো প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট। বর্ষাকাল ছাড়া আর সারা বছর মাঠে ক্রিকেট রাখবো। লংগার ভার্সনের কমপক্ষে তিনটা টুর্নামেন্ট হবে। প্রতি বছর টেস্ট নিয়ে নতুন নতুন আয়োজন করবো। যাতে দেশের ক্রিকেটে টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে সাড়া পড়ে। টেস্ট নিয়ে যেন কথা হয়। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে যেন আলোচনা হয়। থাকবে নির্দিষ্ট ক্রিকেট মৌসুম। এটা হতে পারে অক্টোবর-নভেম্বর থেকে জুন-জুলাই বা জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত। থাকবে নির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডারও। ধর, জানুয়ারি থেকে এপ্রিল-মে পর্যন্ত দলগুলো সফর করবে বাংলাদেশে। এখনকার মতো যখন তখন না। মাঠগুলো ডেভেলপ করে তুলব। কয়েকটা স্টেডিয়াম হবে পুরোপুরি গতিময়। যে অঞ্চল থেকে লম্বা ও বলশালী ফাস্ট বোলার বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা আছে, সে অঞ্চলে হবে গতিময় উইকেট। তাহলে বিভাগীয় দলগুলোও তাদের শক্তি অনুযায়ী উইকেট পাবে। হোমের ফায়দাটা তুলতে পারবে। স্বায়ত্বশাসন দিয়ে দেবো সবগুলো বিভাগীয় দলকে। ৭ বিভাগের ৭ দল আর আরেকটা ঢাকামেট্রো। যেখান থেকে স্পিনার উঠে আসার সম্ভাবনা সেখানকার উইকেট স্পিনিং, একইভাবে হবে ব্যাটিং উইকেট। দলগুলো অন্য অঞ্চলে সুবিধা করতে পারার মতো তৈরী করবে নিজের দল। কারণ, তারা জানবে- শুধুমাত্র স্বাগতিকের সুবিধা নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া যাবে না। চ্যাম্পিয়ন হতে গেলে তোমাকে ছড়ি ঘুরাতে হবে পরের মাঠেও। সুতরাং তোমার থাকতে হবে তেমন মাস্তান, যারা অন্যের মাঠে গিয়েও মাস্তানি করতে পারবে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য দলগুলো মরিয়া হবে, কারণ, চ্যাম্পিয়নের জন্য পুরষ্কারও থাকবে লোভনীয়। শেফিল্ড শিল্ড ও রঞ্জি ট্রফির চ্যাম্পিয়নের সঙ্গে টুর্নামেন্ট আয়োজন করবো। অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের সঙ্গে প্লেয়ার বা প্রতিভা বিনিময় করবো। আমাদের ক্রিকেটাররা খেলতে যাবে ঐখানে, আর ওরা চাইলে ওদের ক্রিকেটাররাও আসতে পারে এইখানে।
মোট কথা, একটা প্লেয়ারের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাওয়া যতটা না কঠিন হবে তার চেয়ে ঢের কঠিন হবে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলা। টেস্ট ক্যাপের মাহাত্ম্য বুঝবে ওরা। থাকবে সেসব নিয়ে প্রশিক্ষণও। লংগার ভার্সন নিয়ে যেমন কয়েকটা টুর্নামেন্ট হবে ঠিক তেমনি ওয়ানডে ক্রিকেট নিয়েও হবে বেশ কয়েকটা টুর্নামেন্ট। তবে বিপিএল হবে একটামাত্র টি-টুয়েন্টির টুর্নামেন্ট। বিভাগীয় দলগুলোর আয়োজনে নানান টুর্নামেন্ট আয়োজন হতে পারে, তবে বিসিবির অধীনে শুধু সেটিই হবে একমাত্র টি-টুয়েন্টি টুর্নামেন্ট। বিপিএলের মতো প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ও লিস্ট-এ ক্রিকেটও দেখানো হবে সরাসরি। বিপিএল করে তুলবো আরো জৌলুস ও অর্থপূর্ণ। বিপিএল বা শর্টার ফরম্যাট খেলা আহামরি কিছু নয়, আচানক বা এ্যাকসিডেন্টাল যেকোনো কিছু এখানে সম্ভব। কিন্তু টেস্ট সেরকম নয়। তাই টেস্ট ক্রিকেটের জন্য রাখবো আলাদা যত্ন, অন্যরকম পরিচর্যা। নির্দিষ্ট কিছু ব্যাটসম্যান ও বোলার আলাদা করে ফেলবো, যারা শুধু টেস্ট ক্রিকেট খেলবো। এই যে তাসকিন-এবাদাত আছে; এরকম কিছু বোলার লাগবে, লম্বা ও গতিশীল, ওদের গায়ে চড়িয়ে দেবো সাদা পোষাক আর হাতে ধরিয়ে দেবো লাল বল।
ঢোক না গিলে আমরা শুনছি সব। আমাদের একটুও মনে হচ্ছে না এসব অবিশ্বাস্য বা অসম্ভব। বরং আমাদের মনে হচ্ছে খুব সম্ভব। আমার খুব ইচ্ছে হয়, জিজ্ঞেস করি- মামা, আপনি সভাপতি হবেন কীভাবে? কিন্তু সাহস হয় না। হয়তো সবার সামনে একটা অপমানজনক কিছু বলে বসবেন যা শুনলে কেঁদে দিতে ইচ্ছে হবে। আবার এই জনসমক্ষে কাঁদতেও পারবো না। অথবা বলে দিতে পারেন, আরে ধুর! ও নিয়ে চিন্তা নেই। বর্তমান সভাপতিকে ল্যাঙচা মেরে ফেলে দেবো। ব্যস! টুপ করে বসে পড়বো সভাপতির চেয়ারে। চেয়ার খেলার মতো।
তারেক মামার পক্ষে সব সম্ভব। তিনি সব বলতে পারেন। সব করতে পারেন। আমাদের বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, তিনি যা যা বলছেন সমস্তই করতে পারবেন। শুধু একবার সভাপতি হতে পারলেই হয়।
তারেক মামার একটা কথা কানে লেগে থাকে আমাদের- বিসিবির সভাপতি যদি হতে পারি, দেখিস, বাংলাদেশ ক্রিকেটের চেহারাই বদলে দেবো।
আমাদের খুব ইচ্ছে হয়, বাংলাদেশ ক্রিকেটের বদলানো চেহারা দেখতে। সভাপতির চেয়ারটায় তারেক মামাকে দেখতে।
- 0 মন্তব্য