কবিতার একাদশ
পোস্টটি ৬৮৭৬ বার পঠিত হয়েছেইংরেজ ক্রিকেট লিখিয়েরা বেশ কয়েকটা পোকা ঢুকিয়ে দিয়েছেন মাথায়। একটা হচ্ছে ক্রিকেট সাহিত্য। ক্রিকেট নিয়ে গল্প। আর অন্যটা হচ্ছে কবিতা। তো পোকাদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে কয়েকটা কবিতা কিভাবে কিভাবে যেন লেখা হয়ে গেছে! অবসরে সেসব নাড়াচাড়া করতে গিয়ে আশ্চর্য্য হয়ে লক্ষ্য করলাম- কবিতার একটা একাদশ দাঁড় করিয়ে ফেলা যাচ্ছে! মানে কবিতার মূলকেন্দ্র ঘিরে থাকা মানুষ হয়ে গেছে এগারো জন। এটা কাকতাল নাকি কোকিলতাল, কে জানে!
আরো একটা মজার কান্ড আছে, এই একাদশে কোনো উইকেট কিপার নেই। পেস-স্পিন এ্যাটাক সামলে যাবে হয়তো, ওপেনার দাঁড়িয়ে গেছে তিনজন। অলরাউন্ডার একগাদা। নয় নাম্বারেও থাকছে জেনুইন ব্যাটসম্যান। নেহায়েৎ ঝোঁক উঠেছে, নইলে এই পাগলামি প্রকাশের কোনো কারণ নেই।
বিজ্ঞ পাঠকমহল আমার অত্যাচার আগেও কম সহ্য করেননি, এবারও খানিকটা করলেন না হয়!
__________________________________________________________
সাঈদ আনোয়ার-শচীন টেন্ডুলকার-অ্যালেস্টার কুক
১৯৪-এর রুপকার
বাবার মুখে গল্প শুনে আপনাকে চেনা হয়েছিল তখন
শৈশবের অলি-গলিতেও ছিল, আপনার খানিক বিচরণ।
বাঁহাতি ব্যাটিংয়ে আভিজাত্য আর আগ্রাসনের সঙ্গে-
প্রাচীন-সাবেকী ঘরানা মেশানো অনুপম মুগ্ধতার রঙে,
বিমুগ্ধ চোখের স্মৃতিচারণায় ভাসে আপনার ব্যাটিং-স্টাইল
আপনার ব্যাটিং দেখতে বুঝি হাঁটা যায় মাইলের পর মাইল!
শচীনের সঙ্গে সেঞ্চুরী-রঙে কতদিন ইঁদুর-বেড়াল খেলা-
অনেকটা দৌঁড়ে পরে পথ হারিয়ে বহু-ক্রোশ পিছিয়ে পড়া!
প্রকৌশল শিক্ষা আর ক্রিকেট-দীক্ষা, আপনাতে ছিল একাকার
দুনিয়াবিমুখ হয়ে সুখ পেয়েছেন ধর্মে, করছেন দ্বীন-প্রচার।
আপনাকে ঘিরে কত গল্প-স্মৃতি, ‘৯৯ এর সেই ব্যাক টু ব্যাক,
কিংবা ‘সুপার’ সেঞ্চুরীয়নের মহারণে, সর্বশেষ সেই একশো এক।
চেন্নাইয়ের তপ্ত গরম উপেক্ষা করে সেই একশো চুরানব্বই-
হয়তো হার মানাবে আজকের আধুনিক অনেক দ্বিশতককেও!
১৯৪-এর রুপকার আপনি, রোমাঞ্চকর এক গল্পের মহানায়ক-
কত ক্রিকেট-প্রশ্নে ছিলেন বহুদিন, যেনো আপনি ১৯৪-এর সমার্থক।
ক্রিকেট-রঙে রঙকেলির সময়টাতে একটা রঙ ছিল আপনারও
স্মৃতির ধূলি-ধূসরিত পাতায়, তাই আপনি চির-অমলিন আজও।
এই এতটা বছরেও ধূসর হয়নি আপনার রঙে রাঙা স্মৃতি-ক্যানভাস
শৈশব-রাঙানো সেই মানুষটার জন্য আজকের এই খানিক পদ্য-উচ্ছ্বাস।
৬ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮
শচীন বন্দনা
আপনার বন্দনা দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে পড়তে পড়তে
কখনো কখনো কিঞ্চিত বিরক্ত বোধ করেছি।
নাক-চোখ কুঁচকে, মুখ বাঁকিয়ে ভাবনার দোরে টোকা দিয়ে ভাবতে বসেছি-
একটা মানুষকে তুলতে তুলতে কতটা উঁচুতে তুললে
মানুষটার সবকিছুই বিরক্তিতে পরিণত হয় বা হতে পারে!
নিঃসন্দেহে প্রশংসা আর সম্মান, বন্দনা বা স্তবগান সবই আপনার প্রাপ্য
তাই বলে কাঁহাতক আর সহ্য হয়। বলেন?
সহ্যেরও একটা সীমা-পরিসীমা আছে।
কিছু রাখঢাক তো রাখা চাই।
নাকি?
চামিন্দা ভাসকে আপনি নীরব অহংয়ে শিখিয়েছিলেন ‘স্ট্রেইট ড্রাইভ’ কত
প্রকার হতে পারে।
ষোলো’র কৈশোরে ওয়াকারের চোখ চোখ রেখে রক্ত মুছে মৌন পৌরুষত্বে
জানান দিয়েছিলেন, আত্মমর্যাদা কেমন হয়!
ওয়ার্নের মধ্যরাতের দুঃস্বপ্নে হানান দিয়েছিলেন নিশ্চুপ ব্যাটিং শৌর্যের সৌন্দর্য্যের পসরা সাজিয়ে।
শোয়েবের বাউন্সারে বিনয় মাখানো দম্ভ মিশিয়ে আপার কাট-এ
দেখিয়েছিলেন সীমানা দড়ির উড়াল পথ।
শতকোটি মানুষের চাওয়া আর আপনার বাসনা মিলেমিশে হয়েছিল
একাকার।
আপনি শুধু ব্যাটিং-শিল্পেই মহান নন আপনি মহান হয়েছেন মনুষত্বেও।
আপনার বিদায়ী আয়োজনে নিজে কেঁদেছেন, কাঁদিয়েছেন আমাদেরও।
আপনাকে আমরা অকপটে মেনে নিয়েছি আধুনিক ক্রিকেটের অবিসংবাদিত গ্রেট হিসেবেও।
কিন্তু লেবুর অতি কচলানো-তে যে তিতকুটে স্বাদ বেরিয়ে আসে তা
বোধকরি মনে নেই আমাদের অনেকেরই!
তাই আপনার বন্দনার নামে যা করা হয় তাতে মাঝে মধ্যে বিরক্তি ভাব আসে আমাদের।
অপরাধ নেবেন না, প্লীজ!
তবে মজার ব্যাপার কি জানেন? ওই বিরক্তি ভাবটুকু উবে যায় ক্ষণকাল
পরেই
আমরা আবার আপনার অসাধারণত্বে বুঁদ হই, মুগ্ধ হই।
শত শতকের অধিকারীর জন্য নত না হই অনায়াসে অবিরত হাততালি
বরাদ্দ করি
সবচেয়ে বেশীবার দৌঁড়ানো মানুষটির জন্য সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াই অন্তত
একবার।
হ্যাঁ, তিতকুটে স্বাদ ভুলে গিয়ে আমরা আপনার অসাধারণত্বেই ফিরে আসি বারবার।
আপনার অনবদ্য ব্যাটিংয়ে যে মিষ্টান্নের স্বাদ একবার পেয়েছি
আপনার বিনয় আর নম্রতায় যে ক্রিকেট-মনুষ্যের স্বরুপ দেখেছি
তাতে শত তিতকুটে স্বাদ সত্ত্বেও আপনার প্রতি অন্তহীন মুগ্ধতার বুঝি শেষ
নেই।
কক্ষনো নেই।
২৪শে এপ্রিল, ২০১৮
তেত্রিশেই কেনো
চল্লিশেও কেউ কেউ চালশে হয় না,
ফর্মহীনতায়ও শেষ বলে না-
দাঁতে দাঁত চাপা চেষ্টায়
হার না মানা প্রতিজ্ঞায়
একটা শেষ প্রচেষ্টা অন্তত চালিয়ে যায়।
আর সেখানে কী-না,
মাত্র তেত্রিশেই হাল ছেড়ে দিয়ে
আপনি ইতি টেনে দিলেন!
বললেন, চললাম!
জানালেন, বিদায়!
আচমকা যদি জানাতেন-
টেস্ট আর খেলবেন না।
সমস্ত মনোযোগ দেবেন টি-টুয়েন্টিতে,
ঘুরে ঘুরে খেলবেন, ফ্রাঞ্জাইজি লীগগুলি।
অথবা যদি উল্টো পাল্টা ব্যাট চালাতে দেখতাম আপনাকে-
তাহলেও হয়তো এতটা চমকে যেতাম না!
মাত্র তেত্রিশেই হঠাৎ ‘যতি’ ঘোষণায়,
কতো ইতিহাস, কীর্তি, স্বপ্ন আর সম্ভাবনার দুয়ারে
যে নিজ হাতে তালা দিয়েছেন!
ধ্যানী কোনো ঋষির মতো-
ধীর, শান্ত ও স্থিতধি আপনার হাঁটা চলা।
আপনার ব্যাটিংয়ে কেউ যদি আপনাকে
ব্যাটিং-সাধক বলে বসেন,
তাতে নিশ্চয় অবাক হওয়ার কিছু নেই!
আপনার স্থির-নিশ্চল ব্যক্তিত্ব,
আপনার ধীরস্থির প্রতি পদক্ষেপ,
আমাদের জানিয়ে দেয়-
হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার মানুষ আপনি নন।
অবসর নেয়া-ভাঙা-ফেরার গল্প,
হয়তো আপনার দ্বারা হবে না।
হবে কী?
জেনে, বুঝে, ভেবে তবেই এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে
উপনীত হয়েছেন আপনি।
তাই তো আরো প্রশ্ন জাগে-
কেনো? কেনো? কেনো?
তেত্রিশেই কেনো?
কাকে জায়গা ছেড়ে দিতে দাঁড়ালেন সরে?
সুযোগ্য উত্তরাধিকার কে আছেন, আপনার পরে?
সাময়িক এই রান-খরা, এই ফর্মহীনতা কাটিয়ে,
ক'দিন বাদেই হয়তো
আপন আলোয় ঠিক উদ্ভাসিত হতেন,
অথবা হতেন না।
কিন্তু চেষ্টা তো করতে পারতেন।
লড়াইটা অন্তত চালিয়ে যেতেন!
শেষ টেস্টের এই ফর্ম, এই রান যে
ক্ষণস্থায়ী ‘রান-খরা’-তে যতিচিহ্ন দিয়ে
দীর্ঘ সময়ের জন্য রানে ফেরার ইঙ্গিত নয়,
তা কে বলবে?
আপনি বুড়িয়ে যাওয়ার আগেই
গুটিয়ে গেলেন।
একদিন যখন সত্যিই বুড়িয়ে যাবেন,
আমরাও যাবো বুড়িয়ে,
সেদিনও, হ্যাঁ সেদিনও-
এই প্রশ্নটি থাকবে।
কেনো?
তেত্রিশেই কেনো?
৯ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮
রাহুল দ্রাবিড়-জ্যাক ক্যালিস-হাবিবুল বাশার
রাহুল ‘দ্য ওয়াল’ দ্রাবিড়
ফোর্থ স্ট্যাম্প থেকে কব্জী ঘুরিয়ে
ফ্লিক করে মারা চার-
এক-দুইবার নয় দেখি বারবার,
মুগ্ধতা প্রতিবার।
আপনি যেন ক্রিকেট মাঠের
মকবুল ফিদা হুসেইন,
রঙ তুলির আঁচড়ের মতো-
ব্যাটের পরশে যেনো মনে হয়,
অদ্ভুত ঘোরের কোনো বিভ্রম আঁকেন।
ফ্রন্টফুটে গুচ্ছ শটে
বাহারী রঙের ড্রাইভ...
দেখতে শুধু,
হেঁটে যাওয়া যায়-
মাইলের পর মাইল।
তিনটে কাঠ-কাঠিকে যক্ষের ধনের মতো
সযতনে আগলে রাখার সাধনা,
কে করেছে কবে
আপনার পরে বা আগে
আপনিই গুড-বেটার-বেস্ট; আর কেউ না।
আপনি নেই বলে...
এসব এখন আর দেখা হয় না।
চক্ষে আঁধার দেখা ধাঁধার মতো
গুগলি বা দোসরা
ক্ষণে ক্ষণে ভ্রম এঁকে দেয়া ঘূর্ণি,
ভেঙে যাওয়া পিচে স্পিন সামলে,
হার না মানা মনে
ঠাঁই টিকে থাকা,
আজকাল আর দেখি না।
দেখি না,
টিকে থাকার সেই মরণপণ সাধনা।
অফ স্ট্যাম্প ধরে টানা বল করে যাওয়া
একটার পর একটা লুপ-ফ্লাইট,
শরীর তাক করা শর্ট পিচ বা বাউন্সারে,
ড্রাইভ, কাট, হুক বা পুল করার
স্বতঃস্ফূর্ত কামনা;
নিজেই গলা টিপে আওড়ে যাওয়া
কেবল টিকে থাকার মন্ত্রণা-
আপনি নেই বলে,
আজকাল এসব আর দেখা হয় না।
একটু প্রতিভার সঙ্গে অনেকটা পরিশ্রম মেশালে
সাধারণ কেমন হয়ে উঠে অসাধারণ
অনন্য সাহস-বলে!
স্বপ্নের পথে সবটা নিবেদিত হলে
সাফল্য কেমন লূটায় পা-য়
জেনেছি তা-ই,
আপনাকে জানার পরে।
নিখুঁত থেকে নিখুঁততর হয়েছেন আপনি
সযতনে সাজিয়েছেন খাঁদহীন সোনায়
নিজেকে,
রেখেছেন ছাপ দিয়েছেন দীক্ষা,
কীভাবে নিজেরে ভেঙে-
আবার নতুন করে গড়ে!
আপনি নেই বলে
সেই ভাঙা-গড়া,
দলের জন্য নিজেকে উজার করা,
এখন আর দেখি না।
মাঠের ভেতর শান্ত-নম্র, ভদ্র-সভ্য
নিপাট ভালো মানুষটি-
আজকাল আর ড্রোন ক্যামেরাতেও
ধরা পড়ে না,
আপনি নেই বলে
শান্ত লোকের মিষ্টি হাসিও আর
চোখে পড়ে না...।
১১ই জানুয়ারী, ২০১৯
একজন তপস্বী ক্রিকেটার
মোটকু মরদ, টুকে টুকে খেলার মাস্টার-
ব্যাটিংয়ে দেখলেই বিরক্তি জাগে,
শেষ বলে সিঙ্গেল হলে,
ওহ নো! এই ব্যাটা, আবার?
ব্যাটিংয়ে নেই সহজতা সৌন্দর্য্য, নেই গ্ল্যামার
পুল-ড্রাইভ-ফ্লিক-গ্ল্যান্সে চোখের প্রশান্তিটাই বা কোথায়?
যেমনটা শচীনের ব্যাটে দেখি, কিংবা পন্টিংয়ের পুলে-
অথবা লারার কবিতার মতো হাই ব্যাকলিফটের সেই কাভার ড্রাইভে...
আর ফাস্ট বোলিংটাই বা কী?
কোন হাতিঘোড়া?
কোথায় সেই শোয়েবের মতো তেজস্বী দৌঁড়?
ম্যাকগ্রার মতো রক্তচোখের নাচানাচি কিংবা ডোনাল্ডের মতো হুংকার?
ধুর! যাচ্ছে-তাই একজন,
মহা বিরক্তির, স্লো ব্যাটিংয়ের কারিগর
নিরামিষ এক পেসার।
বিশাল বপু নিয়ে এখনো খেলছেন কেনো?
অবসরে যাবেন কখন?
কোনো পণ-টন করেছেন বুঝি,
মরলে মরবেন বাইশ গজেই...!
মিথ্যে বলবো না মোটেই,
মাঝে মাঝে এমন প্রশ্ন যে
উঁকি দেয়নি-
তা নয়।
সেই ‘৯৯ বিশ্বকাপে সোনালী চুলের তরুণটাকে-
প্রথম দেখে
কোনো ভাবান্তর না-হলেও
তাঁকে ঘিরে আলোচনাটা আগ্রহ
জাগিয়েছিল সত্যি!
আরো ক’জন ছিলেন তখন-
তার চেয়ে ক্লুজনার বা আব্দুল রাজ্জাকে
আরো বেশী মজেছিলাম।
প্রতিভা বা পরিশ্রমে দারুণ হলেও
সকলের সেরা হয়ে উঠার সব গুণ থাকলেও
সম্মোহনী ক্ষমতা-টা যে ছিল না তাঁর!
ক্যালিসের দেড়যুগে তাঁকে সেভাবে ভালো না বাসলেও
শ্রদ্ধা আর সম্মানের জায়গাটা বরাবরই বরাদ্দ ছিল তাঁর জন্য।
স্ট্যাট বলে অনেক কিছুই,
তাঁর রান-সেঞ্চুরী, উইকেট-ক্যাচ...
যুগিয়ে দেয় জমজমাট এক তর্ক-আড্ডা
কে সর্বকালের সেরা?
সোবার্স না ক্যালিস?
তবে স্ট্যাট কখনোই বলতে পারে না-
তাঁর দেড়যুগের নিখাঁদ নিবেদন,
তাঁর কঠিন-কঠোর পরিশ্রম,
নিজেকে অনন্য উচ্চতার অমন উঁচুত্বে তুলতে
তাঁর সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়া,
তাঁর নিঃসীম ত্যাগ আর একাগ্রতা।
তপস্বী কোনো ঋষির মতো একমনে, একধ্যানে
নিজের কাজটুকু নিরলস ধারাবাহিকতায় করে যাওয়া...।
১৭ই অক্টোবর, ২০১৮
বাশার-স্মরণে
দুঃসময়ের চোরাবালিতে অতলে তলিয়ে যাওয়ার প্রাক-কালে,
দায়িত্বভার কাঁধে তুলে ছন্নছাড়া দলটাকে দিয়েছিলেন বদলে।
বছর পাঁচেকের খরা কাটানো আট রানের জয় দিয়ে শুরু-
যেনো কেটে গেল কোনো ভীষণ ফাঁড়া কিংবা শনির গেরো,
তারপর কত ইতিহাস আর রুপকথা, কত আনন্দ উপাখ্যান!
ক্রিকেট ফুলে-ফলে দিলেন ভরিয়ে, আমাদের এই শূণ্য উদ্যান।
স্বদেশের টেস্ট-অভিষেকে আপনাকে প্রথম-উপেক্ষার জবাবে
সেরা ব্যাটসম্যান হয়ে যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছিলেন পরের একযুগে।
চারপাশে অধারাবাহিকতার ধারা-তে স্বদেশ যখন মরছিল ধুঁকে-
টানা ফিফটি করে 'মিঃ ফিফটি' ডাকনাম ছড়িয়েছিলেন যে লোকমুখে।
প্রথম টেস্ট-ফিফটির পর কত প্রথম যে এসেছে আপনার হাত ধরে-
স্বদেশের তরে দু'হাত ভরে নিজের সর্বস্ব দিয়েছেন যে উজার করে!
দারুণ মজার এক গল্প শুনেছিলাম আপনার বিয়েকে ঘিরে-
পাত্রীর পিতা নাকি জিজ্ঞেস করেছিল, ‘পাত্র ক্রিকেট ছাড়া আর কি করে?’
সেই যুগের ক্রিকেটার আপনি, খেলাটার পুরোটা জুড়ে যখন ছিল সততার ভাষা-
অর্থ, যশ, খ্যাতির বদলে কেবলই নিষ্ঠা, নিবেদন, আগ্রহ আর ভালোবাসা।
ছোট্ট একটি চারাগাছ, খানিক পরিচর্যা আর যোগ্য মালিতে কেমন হয়ে উঠে-
সে আমরা বুঝেছি, দেখেছি ও জেনেছি আপনার সুযোগ্য নেতৃত্বে!
অদ্ভুত সারল্য মুখে-চোখে, যেনো পাশের বাসার সহজ সরল ছেলেটি-
বিদ্রোহী হয়ে নিষিদ্ধ-লীগে খেলে, ক্যারিয়ারে যদিও পড়েছে ছোট্ট দাগটি!
তাতে খুব একটা কালিমা পড়েনি আপনার নিবেদন আর অবদানের বহরে,
বাংলাদেশ ক্রিকেট জুড়ে আপনার কীর্তি আছে আজো লেখা স্বর্ণাক্ষরে!
আজকের অনেক ক্রিকেট-মহাতারকার অবিসংবাদিত প্রথম নেতা আপনি-
তারা তো বটেই, আমাদের মতো অনেক দর্শকও যে আপনার কাছে চির-ঋণী!
১৭ই আগস্ট, ২০১৮
বেন স্টোকস-সাকিব আল হাসান-মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ
বেন স্টোকস, আপনাকে অভিবাদন!
সমস্ত গ্যালারী আর বিশ্বক্রিকেট
কেবল আপনাকেই চতুর্দিক থেকে ঘিরে-ঘিরে
একটানা অভিনন্দনে অভিবাদন জানাবে,
স্তুতিবানের শব্দকোষ শেষ হয়ে যাবে, তবু-
ফুরোবে না আপনাকে অভিনন্দন প্রক্রিয়া...
গ্রীষ্ম মিলিয়ে শীতের প্রকোপ বাড়বে
গাছে গাছে ডালে ডালে হারাবে সুন্দরের গান,
কিন্তু হারাবেন না আপনি,
গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত কিংবা যে কাল আসুক
কালের গহ্বরে হোক গত
আপনি এবং আপনার এই লীডসের মহাকীর্তি
চিরটা কাল হবেন অভিনন্দিত।
অভিবাদন, অভিবাদন, এবং অভিবাদন
বেন স্টোকস, আপনাকে অভিবাদন।
এবারকার ইংলিশ গ্রীষ্মের অবিসংবাদিত সম্রাট!
আপনাকে অভিনন্দন। আপনাকে অভিবাদন।
২৬শে আগস্ট, ২০১৯
ইউ ক্যান এভরিথিং এন্ড অল...
আপনাকে যদি পেতেন নেভিল কার্ডাস,
অথবা পিটার রোবক
কিংবা ক্যারিবিয়ানের ঐ বুড়োটা-
সি আর এল জেমস!
হয়তো সম্ভব সর্বোচ্চ শব্দের বুননে
কথাশিল্পের সমস্ত শিল্প-আয়োজনে
কবির ছন্দের ঠাস-বুনটে
ভাষার চাতুর্য্য ব্যবহারে
মাধুর্যময় হয়ে উঠতেন আরো আপনি,
আর আপনার কীর্তি!
হি ক্যান ব্যাট, হি ক্যান বোল
হি ক্যান ফিল্ড
হি ক্যান লীড
হি ক্যান এভরিথিং এন্ড অল...
ও হ্যাঁ, আপনি তো লিখেনও ভালো,
বলেন কম বটে
তবে সেখানেও প্রমাণ করেন-
আপনার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব।
টুকটাক ছাইপাশ লেখা আমার মতো
ক’জন গোবেচারা
থাকি ভয়ে ডরে
আপনি যদি ‘সিরিয়াসলি’ নিয়ে বসেন
আপনার ঝোঁকের বশে ঐ হাত নাড়াচাড়া
ঐ লেখাঝোঁকা!
মাঠের সবুজে অনেক কাজের কাজী
সেখানে এখনো কাজ বাকি অনেক!
শচীন-হেইডেন দূরে নয় খুব
আর কিছুটা এগুলেই হবে,
এদিকে কপিল-বোথামদের পেরিয়ে যাওয়ার পরে
সামনে ইমরান-লী বা ডোনাল্ড-ভেট্টরী...
ঐ যে তাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন, হাত-ছোঁয়া দূরত্বে।
ওদিকে আবার মাহেলা-সনাৎ-গেইল-গিলি-এবি
আরেকটু টেনে নিলেই পেছনে যাবেন পড়ে,
ক্যালিসকে পেরিয়ে, যাবেন নাকি-
আরো অনেক অনেক উঁচুতে?
উঁচুত্বের নেই কোনো ঠিকানা
শীর্ষ রেখার নেই কোনো সীমানা
আপনি উঠুন, কেবলই উঠুন
উঠতেই থাকুন;
ক্রিকেট মানচিত্রের আকাশজুড়ে
জ্যোতিতে, দ্যুতিতে
উজ্জ্বলতর মহাতারকা হয়ে জ্বলজ্বল করে
জ্বলতেই থাকুন।
২৪শে জুন, ২০১৯
আড়ালের তিনি
প্রচারের আলোটাকে সযতনে দূরে রেখে
নীরবে, নিভৃতে, নিরলে
আপন কাজ করে যাওয়াতেই তাঁর আনন্দ।
অনন্ত স্তুতি থাক দূরে পড়ে
নিজেরে উজারেই তিনি তৃপ্ত।
তাঁর ফাইফার ঢাকা পড়ে
সাকিবের ছক্কার চাদরে,
শফিউলের খ্যাপাটেপনায় যায় মিলিয়ে
সময়ের উপযোগে তাঁর নিঃসীম সংযম!
রুবেলের 'ভাইঙ্গা' দেয়া স্ট্যাম্প
ভুলিয়ে দেয়,
কঠিন সময়কে জয় করে
তাঁর প্রথম 'তিন অঙ্ক' ছোঁয়া!
যুগল সেঞ্চুরীর দিনে সাকিবের বুনো আগ্রাসনে
চাপা পড়ে যায়
তাঁর নিরলস নীরব কীর্তিটা।
তাঁর দিন-টা বা কীর্তিটা
চাপা পড়ে
অন্য কোনো ঘটনে
বা আরেকজনে।
তাতে নেই সামান্যতম আফসোস তাঁর,
বরং ঠোঁটের কোণে ঝুলানো হাসিতে,
বিনয়ের অবতার যেন!
নির্ভেজাল নিবেদনের দৃঢ় প্রত্যায়
আর আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান
এক দ্বীপ্তিমান সাহসী পুরুষ তিনি!
স্তুতিবান প্রয়োজন নেই তাঁর,
নিজেরে উজারেই তিনি খুশী।
আজকের পাতা হয়তো আলোচনার আসরে
সেভাবে স্বাগতম জানায় না তাঁকে,
করে না সমাদর সেরকম।
তবু নিশ্চিত জানি,
আগামীর পাতা জুড়ে থাকবেন তিনি
হবে তাঁর সত্যিকার মূল্যায়ন।
ইতিহাস তাঁকে নমস্য জানবে,
ক্রিকেট পুরুষোত্তম মেনে
সাজাবে প্রশংসা-ডালি।
লুকিয়ে-চুরিয়ে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা তাঁর
ব্যর্থ হবে জানি।
আজকের পাতায় হয়তো তিনি
জ্বলেন না
টিমটিমে বা মিটিমিটি করেও।
তবে ইতিহাসের পাতায় জ্বলবেন তিনি
উজ্জ্বলতর হয়ে ঝলমল করে,
ঔজ্জ্বল্য-চ্ছটায় ছড়াবেন দ্যুতিও।
আড়ালের দেয়াল ভেঙ্গে
আগামীর পাতায়,
জানি-
প্রচারের আলোর সবটা ঘিরে থাকবেন তিনি!
২রা নভেম্বর, ২০১৮
মাশরাফি মর্তুজা-রঙ্গনা হেরাথ
যদি কখনো হয় দেখা-
আজীবন পঙ্গুত্বের ভয় ভুলে,
একরোখা, জেদী দৌঁড়; কলার তুলে,
হুটহাট, লাফঝাঁপ, নেই কোনো পরোয়া,
দেশ-দেশ বলে শুধু নিজেকে নিংড়ে দেওয়া।
এমন নিবেদন যাঁর; তিনি আসলে মানুষ কি?
যদি কখনো হয় দেখা, দেখবো কেটে চিমটি!
যদি কখনো হয় দেখা তাঁর সাথে-
দেবো তবে চিমটি কেটে তাঁর হাতে,
দেখবো তিনি ‘আহ, উঁহ’ করেন কি-না!
তিনি রক্তমাংসে গড়া মানুষ? নাকি না!
দূর থেকে জেনে গেছি তাঁর নানাদিক,
ক্রিকেটার ছাড়াও তিনি এক মহান দার্শনিক!
তিনি মহাত্মা-মানব, পুরুষোত্তম; মানুষের বিরল প্রজাতি-
যদি কখনো হয় দেখা, কাঁধে কাঁধ মেলানো যাবে কি?
৯ই জানুয়ারী, ২০১৮
বাঁহাতি বুড়ো
চেহারা বা বোলিংয়ে নেই গ্ল্যামারের কোনো অস্তিত্ব
প্রথম দর্শনেই আগ্রহী হওয়ার কারণ নেই বিন্দুমাত্র।
তবু মনোযোগের সমস্ত দখলে হয়েছেন শ্রদ্ধার পাত্র
নিরলস চেষ্টায় একরোখা প্রতিজ্ঞায় ছুঁয়েছেন শৃঙ্গ-ছত্র।
তিনি আহামরি কিছু নন, নন বিপজ্জনক কেউ
তাঁর নেই টার্ন-গুগলি বা দোসরার বাড়াবাড়ি ঢেউ।
এক জায়গায় বল ফেলে যান, হয়তো একঘেঁয়ে-বিরক্তির
সেই একগুঁয়ে স্বভাবেই তিনি অনন্য-স্বয়ম্ভর।
নিতান্ত সাধারণ হলেও অনলস অভিলাষ গুণে-
সমীহ আদায়ে বসেছেন তিনি ত্রাসের কেন্দ্রীয়-আসনে।
তাঁকে ঘিরেই গড়ে উঠে প্রতিপক্ষের পরিকল্পনা যত
ভাঙাচোরা দলটা তাঁর বয়েসী-কাঁধে সওয়ার হয়েছে কত!
আপাত নিরীহ-দর্শন লেফট আর্ম স্পিন
তাঁর ছোঁয়ায় বিষ-ছোবলে হয়েছে ভয়ংকর-রঙিন।
ভেট্টরী বা ওয়াসিম পেছনে পড়েছেন তাঁর-
সসম্ভ্রম কুর্ণিশে বিশ্বজোড়া তাঁরই জয়জয়কার।
অহমিকার ছিঁটেফোটা নেই এত এত অর্জনে
মাটির মানুষ যেন মাটিতেই থাকেন বিনয়-ভূষণে।
অনাড়ম্বর আয়োজনেই ওই শিখর উচ্চতা-
লূটিয়ে পড়েছে পদতলে তাঁর মেনেছে বশ্যতা।
বয়সের ছুঁতো-ছাতা তুড়িতেই উড়িয়ে,
দিয়েছেন দেখিয়ে যাননি তো বুড়িয়ে,
খাঁটুনীর গাঁথুনিতে জয় করেছেন বিশ্ব
প্রমান করেছেন পুনর্বার, সাফল্য পরিশ্রম-সর্বস্ব।
সময়ের সাথে বয়েসী হাঁড়ে যত হয়েছেন পরিণত
বাঁহাতের লালচে গোলকে উজ্জ্বলতর হয়েছেন তত।
গোধূলি বেলার সূর্য যেমন রঙকেলিতে ঔজ্জ্বল্য ছড়ায়,
তেমনি করে রঙে রঙে রাঙিয়েছেন ক্রিকেটাকাশ-
তাঁর পড়ন্ত বেলায়!
৯ই নভেম্বর, ২০১৮
- 0 মন্তব্য