• ফুটবল

কিভাবে ফুটবল বাঁচাল ভিক্টর মোসেসের জীবন!

পোস্টটি ১৫৪৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

আসুন একটু ভাবনার জগতে ঘুরে আসি।ভাবুন তো একবার,আপনার বয়স ১১,খুবই আনন্দের সাথে দিন কাটাচ্ছেন,স্বপ্ন দেখছেন বড় কিছু হবেন,সেই স্বপ্নের জাল বুনছেন।হঠাৎ জানতে পারলেন আপনার মা-বাবাকে খুন করা হয়েছে এবং আপনাকেও খুন করার জন্য আপনার খোঁজ করা হচ্ছে।হঠাৎ করেই আপনি এতিম হয়ে গেলেন।এমন সময় যদি প্রশ্ন করি আপনি আপনার স্বপ্ন পূরণের জন্য কতটা প্রস্তুত?আপনার স্বপ্ন যদি একটি বিবেকসম্পন্ন প্রাণী হত সেও এই প্রশ্ন শুনে খিলখিল করে হেসে উঠত।যার বেঁচে থাকাটাই হুমকির মুখে,দুবেলা অন্নজলের উৎস যেখানে অনিশ্চিত,সেখানে স্বপ্ন দেখা ও তা পূরণের কথা ভাবা পাপের সমান।আসুন আজ একটা গল্প শুনাই।যে গল্পের হিরো আপনাকে অনুপ্রাণিত করবে এমন পরিস্থিতির মাঝে কিভাবে নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে হয়।যার ধ্যানজ্ঞান সবটা জুড়েই ছিল ফুটবল।শত বাধার সামনে যিনি স্বপ্ন পূরণে এক পা পিছু হটেন নি।যিনি প্রমাণ করেছে,মানুষ তার স্বপ্নের চেয়ে বড়।

নাম ভিক্টর মোসেস(Victor Moses)।যিনি বর্তমানে উইঙ্গার হিসেবে ইতালির ক্লাব ইন্টার মিলানে খেলছেন।১৯৯০ সালের ১২ ডিসেম্বর নাইজেরিয়ার লাগোস শহরে জন্মগ্রহণ করেন।তার বাবা ছিলেন একজন ধর্মযাজক এবং তার মা তার বাবার কাজে সাহায্য করতেন।তার খুবই সুন্দর এবং আনন্দের শৈশব কাটছিল।খালি পায়ে রাস্তায় ফুটবল খেলা তার কাছে ছিল নেশার মত।সেই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয় নি।

984530698.jpg.0

২০০২ সাল,তখন তার বয়স মাত্র ১১ বছর।হঠাৎ নাইজেরিয়ার কাদুনায় শুরু হয় ধর্মীয় দাঙ্গা।দাঙ্গাবাজরা তাদের বাড়িতে আক্রমণ করে তার বাবা-মাকে খুন করেছিল।অন্যদিনের মত সেদিনও সে রাস্তায় ফুটবল খেলছিল।খেলার মাঝে হঠাৎ এই খবর তার কানে আসে এবং জানতে পারে খুন করার জন্য তারও খোঁজ চলছে।এক সপ্তাহ বন্ধুরা তাকে লুকিয়ে রাখে।তার আত্নীয়রা আশ্রয়ের জন্য যুক্তরাজ্যে প্রেরণ করতে অর্থ প্রদান করে।তাকে দক্ষিণ লন্ডনের একটি পালিত পরিবারের সাথে রাখা হয়েছিল।১১ বছর বয়সী ভিক্টরের জন্য বিষয়টি ছিল খুব কষ্টের কারণ ছেলে হিসেবে সে খুবই লাজুক প্রকৃতির এবং সেখানে তার পরিচিত কেও ছিল না।যুক্তরাজ্যে সে নাইরেজিয়ার সাথে সামাজিক সংস্কৃতির ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করে।সে বুঝতে পারে এই নতুন দেশে বন্ধু জোগানো হবে দুষ্কর।সে সিদ্ধান্ত নেই নিজের নামকে ছড়িয়ে দিতে হবে যাতে সকলেই এক নামে চেনে।

সে ইংল্যান্ডের অপেশাদার মাঠগুলোতে ফুটবল খেলতে শুরু করে এবং এখানে সে এভাবেই আলো ছড়ায় যতটা সে নাইজেরিয়াতে ছড়িয়ে এসেছে।এসময় সে দক্ষিণ নরউইডের স্ট্যানলে টেকনিক্যাল হাই স্কুলে(বর্তমানে হ্যারিস একাডেমী নামে পরিচিত)পড়াশোনা শুরু করে।স্থানীয় ট্যান্ড্রিজ লীগে কসমস ৯০ এফসির হয়ে ফুটবল খেলার সময় সে ক্রিস্টাল প্যালেসের নজরে আসে।ক্রিস্টাল প্যালেস তাকে হুইটগিফট স্কুলে সুপারিশ করেছিল, যেখানে আর্সেনাল এবং চেলসির তারকা কলিন প্যাটস স্কুল ফুটবল দলের কোচিং করছিলেন। প্যালেসের অনূর্ধ্ব -১৪ দলের হয়ে ৫০ গোল করার পরে মোসেস প্রথম শীর্ষে এসেছিল। হুইটগিফট এবং প্রাসাদ উভয় জায়গাতেই তিন বছর খেলে মোসেস 100 টিরও বেশি গোল করেছে এবং হুইটগিফ্টকে জাতীয় কাপ সহ অনেকগুলি স্কুল কাপ জিততে সহায়তা করেছিল, যেখানে লিসারের ওয়াকার স্টেডিয়ামে গ্রিম্বির হিলিং স্কুলের বিরুদ্ধে ফাইনালে মোসেসের পাঁচটি গোল আছে।

800px-FWC_2018_-_Group_D_-_NGA_v_ISL_-_Photo_37

মোসেসের ক্রিস্টাল প্যালেসের হয়ে চ্যাম্পিয়নশিপে অভিষেক ঘটে মাত্র ১৬ বছর বয়সে ৬ নভেম্বর ২০০৭ সালে কার্ডিফ সিটির বিপক্ষে।ঐ ম্যাচটি ১-১ ড্র হয়।২০০৮ সালের ১২ মার্চ সে ওয়েস্ট ব্রমউইচ অ্যালবায়নের সাথে প্রথম গোলটি করে যার সুবাধে ম্যাচটি ১-১ ড্র হয়।২০০৭-৮ মৌসুমে মোসেস ১৬টি ম্যাচ খেলে।মৌসুমের শেষের দিকে, সে সেলহার্স্ট পার্কে একটি নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করে, ম্যানেজার নীল ওয়ার্নক বলেছিলেন, "ভিক্টরের চুক্তি সই ক্লাবের পক্ষে একটি বিশাল অভ্যুত্থান; আমি ভিক্টরকে বলেছি যে সে যেতে পারে যতটা উচ্চতায় সে নিজেকে নিতে চাই। সে প্রতিদিন উন্নতি করছে এবং আমি আনন্দিত যে সে খেলোয়াড় হিসাবে সে ভালো থেকে আরো ভালো হবে বলে সে এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করেছে।"

৩১ জানুয়ারি,২০১০ সালে ২.৫ মিলিয়ন পাউন্ড ট্রান্সফার ফি এর বিনিময়ে উইগান অ্যাথলেটিকে যোগ দেয়।দুই মৌসুম ভাল খেলার পুরস্কার স্বরূপ চেলসির নজর পড়ে তার উপর।৪ বার ব্যার্থ চেষ্টার পর অবশেষে চেলসি ২৩ আগস্ট,২০১২ সালে উইগান এর দাবি করা ট্রান্সফার ফি দিতে রাজি হয়। উইগান চেলসিকে মোসেসের সাথে কথা বলার সুযোগ দেয় এবং ২৪ আগস্ট চেলসি মুসার স্থানান্তর সম্পন্ন হয়েছে বলে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়।১৫ সেপ্টেম্বর পশ্চিম লন্ডনের প্রতিদ্বন্দ্বী কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্সের বিপক্ষে মোসেস চেলসির হয়ে প্রথম খেলাটি খেলেন।

এই একমৌসুম শেষে পরের ৩ মৌসুম মোসেস চেলসি থেকে ধারে বিভিন্ন দলে খেলেন।
২০১৩-১৪ মৌসুমের জন্য মোসেস ধারে লিভারপুলে যোগ দেন,২০১৪-১৫ মৌসুমের জন্য ধারে স্টক সিটেতে ও পরবর্তী ২০১৫-১৬ মৌসুমে ধারে ওয়েস্টহেম ইউনাইটেডে খেলেন।

চেলসির নতুন ম্যানেজার আন্তোনিও কন্টিকে মুগ্ধ করার ফলে ২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ মৌসুম চেলসির হয়ে খেলেন।এর পরবর্তী মৌসুম থেকে মোসেস আবার ধারে খেলা শুরু করে।২০১৮-১৯ মৌসুমে তুরষ্কের ক্লাব ফেনারবাহির পক্ষে ১৮ মাসের চুক্তিতে তাকে ধার নেওয়া হয়।ফেনারবাহির চুক্তি শেষ হওয়ার পরে ছয় মাসের চুক্তিতে বর্তমান ২০১৯-২০ মৌসুমের জন্য ইতালির ক্লাব ইন্টার মিলানে যোগ দেয়।

1024px-Victor_Moses_Fabio_Santos_2012_FIFA_Club_World_Cup

জন্মসূত্রে নাইজেরিয়ান হলেও মোসেস ইংল্যান্ডের হয়ে অনূর্ধ ১৬,১৭,১৮,১৯ দলে খেলেন।পরবর্তীতে ২০১১ সালে সে নাইজেরিয়া জাতীয় দলের জন্য খেলার ডাক পায়।১ নভেম্বর, ২০১১ সালে ফিফা মোসেসকে নাইজেরিয়ার হয়ে খেলার অনুমতি দেয়।২০১৪ বিশ্বকাপে মোসেস আর্জেন্টিনার বিপক্ষে দুটি দুর্দান্ত গোল করে।২০১৮ বিশ্বকাপ কোয়ালিফাইং ম্যাচে আলজেরিয়ার বিপক্ষে দুটি গোল করে যার সুবাধে নাইজেরিয়া বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলার সুযোগ পায়।২০১৮ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে মেসির করা গোল তিনি শোধ করেন।মেসি গোল করার পর পরই তিনি সেই গোল শোধ করেছেন।মেসির সাথে পাল্লা দিয়ে ২০১৪ ও ২০১৮ বিশ্বকাপে গোল করেন তিনি।বিশ্বের সেরা তারকার সাথে পাল্লা দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন সহজে হার মানার পাত্র তিনি নন,তিনিও সেরাদের মত খেলতে পারেন।

২০১৮ বিশ্বকাপের পর ১৫ আগস্ট,২০১৮ সালে মোসেস আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসরের ঘোষণা দেন।তবে তার ক্লাব ক্যারিয়ার এখনো থেমে থাকে নি।

তিনি এমনই এক উজ্জ্বল মিডফিল্ডার যিনি তার সমস্ত মন দিয়ে খেলেন।অনেকে বলে,ফুটবল আক্ষরিক অর্থেই মোসেসের জীবন বাঁচিয়েছে,নিজের জন্য একটি নাম তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।আজ তার মা-বাবা যেখানেই থাকুক না কেন,ছেলের জন্য গর্বিত হবেন।হয়ত দূর থেকে ছেলেকে শুভকামনা জানাচ্ছেন।তিনি এক দীর্ঘ পাথুরে পথ পাড়ি দিয়ে আজকের ভিক্টর মোসেসে পরিণত হয়েছেন।শত বাধায় তিনি থামেন নি,কোথায় গিয়ে থামবেন তা আমার জানা নেই,তবে তার গল্পটা আমি এখানেই থামালাম।তার গল্প শুনে আরো অনেকে অনুপ্রাণিত হোক,দেশের হয়ে বিশ্বে পতাকা উড়াক,এই কামনা রইল।