• ফুটবল

রবার্ট লেভানডস্কি : দ্য মুভি

পোস্টটি ৯৩৭ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

কিছুদিন আগে, ঘুম ভাঙ্গার পর পেছন ফিরে দেখলাম, আমার বালিশের পাশে অদ্ভুত কিছু একটা পড়ে আছে।

 

আপনি কি জানেন যখন আপনি সত্যিই ভাল একটি ঘুমের পর জেগে ওঠেন, তখন সবকিছু স্বপ্নের মতন মনে হয়? ঠিক তাই, এই জিনিসটি দেখার পর আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল অনেকটা এমন- কি? এটি এখানে কিভাবে এল?

একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার এবং পুরষ্কার গ্রহনের কিছু আবছা স্মৃতি আমার ছিল। তবে তখন মনে হচ্ছিল, বিষয়টি খুব উদ্ভট।

 

তারপর আমি ওটা হাতে তুলে নিলাম এবং নিজেকে বললাম, বাহ ... এটি কোনও স্বপ্ন ছিল না, এটি ছিল সত্য।

তারা তোমাকে বিশ্বের সেরা ফুটবলারে ভূষিত করেছে এবং তুমি ট্রফিটি নিজের বিছানায় নিয়ে এসেছো!

হা হা হা। 

 

আমি কি অর্জন করেছি তা অনুধাবন করতে আমাকে সত্যই ট্রফিটির দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়েছিল। আসলে না, এটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। সত্যি বলতে কি, আমি এখনও এটি পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারিনি। আমার ভাবনায় শুধু আসছিল-

Robert-lewondwski-childhood_1463389350

   "পোল্যান্ডের বাচ্চাদের বিশ্বসেরা হওয়ার কথা নয়"

     - রবার্ট লেভানডস্কি

 

আমাকে পোলিশ লোকজন সম্পর্কে কিছু ব্যাখ্যা করতে দিন। তারপর সম্ভবত আপনি বুঝতে পারবেন। অনুষ্ঠানের পূর্বে, আমি জানতাম বায়ার্ন মিউনিখের সাথে আমার একটা দূর্দান্ত বছর কাটবে। আমি জানতাম আমি এই পুরষ্কার জিততে পারি। সম্ভবত এটা আমার প্রাপ্য। তবে পোল্যান্ডে আমাদের এই হীনমন্যতাজনিত জটিলতা রয়েছে। আমরা কখনো দেশের কারো নাম বিশ্বসেরা খেলোয়াড়দের কাতারে দেখিনি। যখন আপনি শিশু, আপনার সামনে অনুসরণ করার মত কোন মহাতারকা নেই। স্কাউটরা সর্বদা এই জাতীয় কথা বলে, "সে ততটাই দক্ষ যতটা একটা পোলিশ খেলোয়াড়ের হতে হয়।"  সুতরাং আমাদের এই অনুভূতি রয়েছে যে আমাদের কেউ কখনো যথেষ্ট ভালো নয়- আমাদের মধ্যে কেউ সেরাদের সেরা হতে পারবে না।

 

পোল্যান্ডের শিশুদের বিশ্বসেরা হওয়ার কথা নয়। এটা ঠিক হওয়ার কথা হয়। যখন আমি ট্রফিটি পেলাম, আমি এটা বিশ্বাস করতে পারিনি। আমি জানি লোকে এটিকে ক্লিশে হিসেবে মনে করবে, তবে সত্যিই আমার পুরো জীবন চোখের সামনে ভেসে উঠতে শুরু করে। বলের সাথে আমার প্রথম পদক্ষেপগুলো, প্রথম কাদায় খেলা এবং যে সমস্ত ব্যক্তি আমাকে এই পর্যায়ে পৌছাতে সাহায্য করেছিল। এটি ছিল একটি সিনেমার মত। পুরো সিনেমাটি নিজেকে তিনটি অঙ্কে ভাগ করে নিয়েছিল, এবং আমি আপনাকে এই সিনেমাটির কাহিনী বলতে চাই। কারণ আমি জানি এই মুহূর্তে পোল্যান্ডে অথবা পৃথিবীর অন্য কোথাও অন্তত একটি শিশু রয়েছে, যে স্বপ্ন দেখার সাহস করেনা।

সিনেমাটি ছিল অনেকটা এমনঃ-

 

dataimagejpegbase649j4QBsRXhpZgAASUkqAAgAAAADADEBA-8381693a86e931ca832739c0e9e5a36e

প্রথম অঙ্কঃ শেষ ভোজসংক্রান্ত উৎসব

 

আমার ছোটবেলায়, স্থানীয় গীর্জায় আমার প্রথম 'খ্রিস্টের শেষ ভোজনসংক্রান্ত' উৎসব হয়েছিল। যারা ক্যাথলিক ধর্মের সাথে পরিচিত নন, তাদের জন্য এটি একটি বিশেষ দিন। এই উদযাপন চার্চে উপস্থিত জনসমাগমে শুরু হ, এবং এরপর আমরা পারিবারিকভাবে উদযাপন করি।

একটি সমস্যা ছিল, চার্চের সমাগম অনুষ্ঠানের পরপরই আমার একটি ম্যাচ পূর্বনির্ধারিত ছিল এবং এটি ছিল বেশ দূরে।

 

সুতরাং, উৎসবের আগে আমার বাবা ক্রিজিসটোফ পুরোহিতের সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলেন। এটি ছিল আমার শহর লেস্নো, ওয়ারশোর ৪০ মিনিট পশ্চিমে ছোট্ট গ্রাম, তাই বাবা সেখানকার সবাইকে চিনতেন। তিনি বললেন, "ফাদার,আমরা কি আধঘন্টা আগে অনুষ্ঠানটি শুরু করতে পারি? সম্ভবত শেষ দশ মিনিট বাদ দিয়ে? দেখুন, আমরা ছেলের একটি খেলা রয়েছে।" এটা শুনে কিছুটা অদ্ভুত মনে হতে পারে, কিন্তু পুরোহিত আমাকে ভালোভাবেই চিনতেন, তিনি প্রস্তাবটি সম্পর্কে কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, "হ্যা, নিশ্চয়, কেন নয়? আমরা জানি সে ফুটবল কতটা ভালোবাসে, আমরা দ্রুত শেষ করবো।"

তো, যেই মুহূর্তে উৎসব শেষ হলো, আমি ও বাবা দ্রুত গাড়ীতে গিয়ে উঠলাম, হা হা 

এবং হ্যা, আমরা খেলাটি জিতেছিলাম।

 

 

আমার মনে হয়, এই গল্পটিই আমার শৈশবকে তুলে ধরে, সাথে আমার বাবাকেও।

1273381636.0

যখন পাঁচ বছর বয়সে আমি ফুটবল শুরু করি, তখন লেসনোতে আমার বয়সীদের জন্য কোনও দল ছিলনা। তাই আমাকে দুবছরের বড় বাচ্চাদের সাথে খেলতে হয়েছিল। এটি কঠিন ছিল, কারণ আমি খুব লাজুক ও চর্মসার ছিলাম এবং এইসময়ে দুবছর ব্যবধান অনেক বড় বিষয়। বেশ কয়েকবছর আমি ওয়ারশোর একটি দলের হয়ে খেলেছিলাম এবং প্রশিক্ষণে যাতায়তে প্রতিবারে আমার প্রায় একঘন্টা করে সময় লাগতো।

 

আমাকে সেখানে পৌছে দেওয়ার মতো বাবা মা যদি আমি না পেতাম, আমার ফুটবল স্বপ্ন শুরুর আগেই শেষ হয়ে যেত। তারা উভয়েই শারীরিক শিক্ষার(পি. ই.) শিক্ষক ছিলেন, এবং বাবা ছিল আমার পি. ই. শিক্ষক। স্কুল শেষে বাবা গাড়ী চালিয়ে আমাকে প্রশিক্ষণে  নিয়ে যেতেন, আমার সেশন শেষ হওয়া পর্যন্ত দুঘন্টা অপেক্ষা করতেন এবং এরপর আমাকে বাড়ি নিয়ে আসতেন। ক্লাবের কোন পোশাক পরিবর্তন কক্ষ ছিলোনা, তাই প্রায়ই বৃষ্টিতে খেলা শেষে আমি কাদামাখা অবস্থায় গাড়ীতে উঠে পড়তাম। এরপর আমরা অন্ধকারে গাড়ী চালিয়ে বাড়ী ফিরতাম, রাত দশটায়।

 

অর্থাৎ, বাবার জন্য এটি ছিল চার ঘন্টার ভ্রমণ, শুধুমাত্র আমি যাতে শিখতে পারি। 

অন্য বাবা-মায়েরা আমার বাবাকে খ্যাপাটে ভাবতো, সত্যিই। তারা প্রায়ই বাবা মাকে জিজ্ঞেস করতো, "আপনারা কেন এতসব করছেন?" তারা বলতেন রবার্টের একটি স্বপ্ন রয়েছে এবং সে খেলাটিকে ভালোবাসে। বিষয়টা কখনোই এমন ছিল না, "ওহ, আমরা রবার্টের জন্য সবকিছু করবো যাতে সে সুদক্ষ খেলোয়াড় হয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে যেতে পারে এবং আমরা ধনী হতে পারি।"

কখনোই না।

যখন ছোট ছিলাম, তখন থেকেই কিছু মানুষ মনে করতো আমি এই পর্যায়ে আসার জন্য খুবই ছোট এবং চর্মসার। হেটার্স, যেটা এখনকার শিশুরা বলে আরকি। কিন্তু বাবা-মা আমাকে সবসময় অন্যদের সমালোচনা উপেক্ষা করে নিজেকে নিয়ে চিন্তায় উৎসাহিত করেছে। তারা সবসময় আমাকে এই একটি কথা বলতো, যা আমি বেশ কয়েক বছর পর ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম।

 

তারা বলতো, "রবার্ট তোমার প্রবৃত্তির ওপর বিশ্বাস রাখো।"

 

এটি একজন স্ট্রাইকারের জন্য, কিংবা যে কারো জন্যই খুব ভাল একটি শিক্ষা।

 

GettyImages-972430478.0.0

দ্বিতীয় অঙ্কঃ প্রত্যাখ্যান

 

আমার ষোল বছর বয়সে বাবাকে হারাই, দীর্ঘদিন তিনি ছিলেন অসুস্থ। এটি আমার জন্য কতটা কঠিন ছিল, তা বর্ণনা করা এখনও আমার পক্ষে কঠিন। ছেলেদের জন্য, কিছু নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু রয়েছে যা নিয়ে শুধু বাবার সাথেই আলোচনা করা যায়। বেড়ে ওঠা, মানুষ হওয়া এধরণের বিষয়গুলো।

 

তাঁর মৃত্যুর পর আমি প্রায়ই তাঁর সাথে এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে চাইতাম। এমন অনেক সময় ছিল যখন আমার ইচ্ছা হতো আমি শুধুই তাকে ফোন করি। এমনকি দশ মিনিটের জন্য হলেও, কিন্তু পারিনি।

মা তার সাধ্যমতো আমাকে সাহায্য করেছিলো, এবং আমি তা সবসময় শ্রদ্ধাভরে স্মরণে রাখব। তাঁকে একইসাথে মা এবং বাবা হতে হয়েছিলো।

 

আমি তখন পোল্যান্ডের অন্যতম বৃহত্তম দল লেগিয়া ওয়ার্সো এর রিজার্ভ দল লেগিয়া ওয়ার্সো-২ এর হয়ে খেলছিলাম। তৃতীয় বিভাগে। একবছর পর, ২০০৬ সালে, আমার চুক্তিটি প্রায় সমাপ্ত এবং ক্লাবকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল তারা আমার সাথে চুক্তির মেয়াদ আরো একবছর বাড়াবে কিনা। দূর্ভাগ্যক্রমে, আমি মাত্রই গুরুতর হাটুর ইনজুরি থেকে ফিরেছিলাম, এবং ক্লাবের কিছু ব্যক্তি মনে করেনি যে আমি কখনোই আমার সেরা রূপে ফিরতে পারবো। এটি ছিল একটি ভয়ংকর সময় এবং আমি ক্লাবের কাছে জানতে চাইলাম তারা কি করতে চায়। তারা এমনকি কোচ অথবা টেকনিক্যাল ডিরেক্টকেও আমার কাছে পাঠানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। তারা সচিবকে পাঠিয়েছিলেন, যিনি আমাকে বলেছিলেন যে তারা আমাকে ছেড়ে দেবে।

 

এটি ছিল আমার জীবনের অন্যতম খারাপ দিন। বাবা মারা গিয়েছেন। এখন আমার ক্যারিয়ারও ভেঙ্গে পড়ছে। খবরটি শোনার পর, মা যেখানে গাড়ীতে অপেক্ষা করছিল সেখানে গেলাম। তিনি তৎক্ষনাৎ বললেন যে, কিছু একটা ভুল হয়েছে। আমি এটা নিতে পারলাম না, কাঁদতে শুরু করলাম। তাকে সব খুলে বললাম। তিনি অনেক শক্ত ছিলেন। বললেন, "ঠিক আছে, আমাদের কাজ শুরু করতে হবে। অতীত নিয়ে ভেবে কোন লাভ নেই। কিছু একটা করতে হবে।"

 

তখন তিনি জিনিক্জ প্রস্কুউয়ের সাথে যোগাযোগ করলেন। একই বিভাগ। অনেক ছোট একটি ক্লাব। আসলে তারা কয়েকমাস আগে আমাকে চুক্তিবদ্ধ করতে চেয়েছিল এবং আমি ছিলাম এরকম, "প্রশ্নই ওঠেনা! কেন আমি লেগিয়া ছেড়ে জিনিক্জ প্রস্কুউ যাব?" কিন্তু এখন আমি এটাতেই খুশি যে তারা এখনো আমাকে চায়। এরপর আমি সেখানে নিজেকে পুনরুদ্ধার করা শুরু করলাম এবং আমি এতটাই খারাপ অবস্থায় ছিলাম যে দৌড়াতেও পারতাম না। একটি পা অন্যটির পেছনে পরে থাকতো, যেন আমার গোড়ালিতে রয়েছে সিমেন্টের ব্লক। এটা হাস্যকর, তাইনা?

1325092781.0

ভাবুনতো আমি যদি নিন্দুকদের কথায় কান দিতাম। হয়ত সেই ইনজুরিই আমাকে শেষ করে দিত। চিন্তা করে দেখুনঃ বড় প্রতিভারা ইতিমধ্যেই বায়ার্ন, বার্সা, ম্যানচেস্টারের মতো ক্লাবে খেলছিল। আর এখানে আমি, পোল্যান্ডের তৃতীয় বিভাগে, কিভাবে দৌড়াতে হয় তা মনে করার চেষ্টা করছিলাম।

 

চারবছর পর, পোলিশ ফুটবল ছাড়ার অফার আমার দিকে বোমার মত বর্ষিত হচ্ছিল।

 

অনেক গুজব ছিল, অনেকেই আমাকে কি করতে হবে বলছিল। আমি অনেক জায়গায়ই যেতে পারতাম। কিন্তু মা-বাবার সেই পাঠটি আমি মনে রেখেছিলামঃ "তোমার প্রবৃত্তির ওপর বিশ্বাস রাখো।" আমার গভীর থেকে আমি জানতাম, কোথায় যেতে চাই।

 

জার্মানি আমাকে ডাকছিলো।

 

LewandowskiMobile-1

তৃতীয় অঙ্কঃ বাজি

 

একবার আমি ইয়ুর্গের ক্লপের সাথে বাজি রেখেছিলাম।

 

এটা ছিল ২০১০, আমি কয়েকমাস বরুশিয়া ডর্টমুন্ডে ছিলাম। সত্যিই এটি ভীষণ কঠিন ছিল। যখন গেলাম, আমি শুধু একটি জার্মান শব্দই জানি। ডাংকে। ধন্যবাদ।

 

যদি আমি এক প্রশিক্ষণ সেশনে ১০ গোল করি, তিনি আমাকে ৫০ ইউরো দেবেন। যদি তা না পারি, তবে আমি তাকে ৫০ ইউরো দেব।

 

প্রথম কয়েক সপ্তাহে, আমাকে প্রায়ই হারতে হতো। তিনি হাসতেন। তবে কয়েকমাস পর, টেবিল ঘুরে গেল৷ আমি নগদ টাকায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠলাম। তো একদিন সে বললো, "থামো, এটাই যথেষ্ট। তুমি এখন প্রস্তুত।"

 

সেই মৌসুমে আমি প্রায়শই বেঞ্চে কাটাতাম। মৌসুমের দ্বিতীয় ভাগে আমি বেশকিছু ম্যাচ খেলেছিলাম। দশ নাম্বার হিসেবে, স্ট্রাইকারের পেছনে। তবে আমার প্রিয় পজিশন ছিল নয় নাম্বার।  এরপরও, আমি ইয়ুর্গেনকে ধন্যবাদ দিতে চাই সেই ছয়টি মাসের জন্য। আমি অনেক কিছুই শিখেছিলাম, কিভাবে গভীরভাবে খেলতে হয় এবং স্ট্রাইকারদের পেছনে খেলোয়াড়দের নড়াচড়া কেমন হওয়া উচিত। 

 

দ্বিতীয় মৌসুম যখন শুরু হয়, আমি তখনও লড়াই করছিলাম। সম্ভবত ইয়ুর্গেন আমার কাছ থেকে কিছু চেয়েছিল, আমি তা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি। চ্যায়িম্পন্স লীগে মার্সেইয়ের বিপক্ষে ৩ - ০ গোলের বাজে হারের পর, আমি তার কাছে গেলাম। বললাম, "ইয়ুর্গেন, শোন। আমাদের কথা বলা দরকার। আমাকে শুধু এটা বল যে তুমি আমার কাছ থেকে কি চাও।"

 

সে কি বলেছিল তা পুরোপুরি মনে নেই- আমি জার্মান তখনও আয়ত্ত্ব করতে পারিনি- তবে আমার জানা অল্প কিছু শব্দ এবং তার বাচনভঙ্গির মাধ্যমে, আমরা একে অপরকে বুঝে ফেললাম। আলাপটি ছিল অতুলনীয়।

 

তিনদিন পর, আমি হ্যাটট্রিকসহ চার গোল করলাম অসবার্গের বিপক্ষে। ৪-০ গোলে জেতা সেই ম্যাচটিই ছিল আমার ঘুরে দাড়ানোর মুহূর্ত। 

আমি তখন বুঝতে পারিনি। তবে এখন মনে হয় ইয়ুর্গেনের সাথে আমার আলাপটি ছিল অনেকটা তেমন যেমন আলাপ আমি বাবার সাথে করতে চাইতাম। এমন একটি আলাপ যা আমি অনেক অনেক বছর কারো সাথে করিনি। আমি ইয়ুর্গেনের সাথে যেকোন বিষয়ে কথা বলতে পারি। তাকে বিশ্বাস করতে পারি, সে অনেকটা পারিবারিক মানুষ। অপরের বিভিন্ন দূর্দশা নিয়ে তার ছিল গভীর সহানুভূতি। 

 

ইয়ুর্গেন আমার কাছে কেবল পিতাই ছিলেন না, কোচ হিসেবে তিনি ছিলেন 'খারাপ' শিক্ষকের মতো। অবশ্যই শব্দটির সর্বোত্তম অর্থে।

স্কুলে আপনার মনে পড়ে খারাপ শিক্ষকটিকে, যে আপনার প্রতি কঠোর ছিল। যে আপনার ভেতরের সেরাটা বেরিয়ে আনার জন্য সবসময় চাপ দিতো। সেই শিক্ষকই আপনার সবচেয়ে উপকার করেছেন, তাই না? আর ইয়ুর্গেনও ছিল সেই শিক্ষক যিনি আপনাকে বি গ্রেড শিক্ষার্থী হিসেবে নয়, এ+ শিক্ষার্থী হিসেবে চেয়েছিলেন। আর তিনি এটা তার জন্য নয়, আপনার জন্যই চাইতেন।

 

তিনি আমাকে অনেককিছু শিখিয়েছিলেন। যখন ডর্টমুন্ডে পৌছাই, আমি সবকিছু দ্রুত করতে চেয়েছিলামঃ শক্ত পাস, কেবল একটি স্পর্শ। ইয়ুর্গেন আমাকে দেখিয়েছিলেন শান্ত হওয়া - দরকার হলে দুটি পাস নেওয়া। এটি ছিল সম্পূর্ণ আমার প্রকৃতি বিরুদ্ধ, তবে দ্রুতই আমি আরো গোল দিতে লাগলাম। যখন আমার গতি হ্রাস পেল তখন তিনি আবার গতি বাড়ানোর চ্যালেন্জ দিলেন।

একটিমাত্র স্পর্শ। ব্যাং। গোল। 

আমার গতি বাড়ানোর জন্য তিনি আমার গতি হ্রাস করে দিয়েছিলেন। বিষয়টি সহজ শোনালেও, এটি ছিল অসাধারণ, সত্যিই।

 

ইয়ুর্গেন কখনো ভোলেননি যে আমরা প্রথমে মানুষ, এরপর ফুটবলার। আমার মনে আছে, একবার সাপ্তাহিক ছুটি শেষে আমরা ড্রেসিংরুমে ছিলাম। আপনি হয়ত কৌশলটি জানেন, একজন খেলোয়াড় যখন মদ্যপানের করে, পরদিন ভোরে ক্লাবে ফিরে খুব রসুন খায় যাতে দম এর সাথে দূর্গন্ধ বের না হয়। তো ইয়ুর্গেন প্রশিক্ষণের আগে এসে হঠাৎই চারপাশের গন্ধ শোঁকা শুরু করলেন। অনেকটা শিকারী কুকুরের মতো। একসময় বললেন, "আমি কিছুর গন্ধ পেয়েছি ... এটি কি রসুন?"

 

অবশ্যই তিনি জানতেন এটা রসুন এবং আমরা জানতাম যে তিনি জানতেন। কিন্তু প্রশ্নটি বাতাসে ঝুলিয়ে রেখেই তিনি বাইরে চলে গেলেন, আর কিছু না বলেই। একমুহূর্ত নিরব থাকার পর,আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসতে শুরু করি। হা হা হা!

17986354_401

উপদেশঃ ইয়ুর্গেন ক্লপকে কখনোই বোকা বানানোর চেষ্টা করবেন না, লোকটি খুব চতুর।

 

অবশ্যই, ইয়ুর্গেনই একমাত্র নন যে আমাকে আরো ভাল হতে সহায়তা করেছে। বায়ার্নে যাবার পর, আমি জুপ হেইনকিস, পেপ গার্দিওলা, কার্লো আনচেলত্তি এবং হ্যান্সি ফ্লিকের মতো কোচদের কাছ থেকে অনেক কিছুই শিখেছি। কেবলমাত্র বায়ার্নের হয়ে খেলাই একটি শিক্ষা। কারণ প্রচুর চাহিদা এবং ক্লাবের সংস্কৃতিটাই এত পেশাদার যে- আপনি নিজের মান উন্নয়নে বাধ্য। এরপরও, আমি সেইসব কাছের লোকদের সাহায্য ছাড়া এতদূর আসতে পারতাম না। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি আমার স্ত্রী, অ্যানা।

 

আমার জীবনে ঘটে যাওয়া অতীতের দিকে যখন ফিরে তাকাই, যখন সিনেমাটি আমার চিন্তায় চলতে থাকে তখন বুঝতে পারি যে আমি কতটা ভাগ্যবান। আপনি একা কখনো শিরোপা জিততে পারবেন না। আমার হাতে উচিয়ে ধরা বা বাসায় নিয়ে আসা সকল ট্রফি- সবগুলোই অর্জিত হয়েছে আমার সতীর্থদের সহায়তায়, যারা আমাকে আরও উন্নতি করতে সহায়তা করেছিলো। আমি শৈশবের বন্ধুদেরও অন্তর্ভুক্ত করবো। আমার কোচ, আমার বোন। সেই পুরোহিত যিনি আমাকে সময়ের আগেই উৎসব ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। আমার মা, যিনি আমার সর্বনিম্ন স্তরে আমার পাশে ছিলেন।

 

এবং অতি অবশ্যই, আমার বাবা। তিনি আমাকে পেশাদার ফুটবলার হিসেবে দেখে যেতে পারেননি, যদিও আমি মনে করি তিনি এখন উপরে বসে আমার সবগুলো খেলা দেখেন। তিনিই আমার পায়ের কাছে বল রেখেছিলেন এবং তিনিই আমাকে কখনো ভুলতে দেননি কেন আমি ফুটবল খেলছি।

ট্রফির জন্য নয়। টাকার জন্য নয়। গৌরবের জন্য নয়। না, আমরা এটি খেলি কারণ আমরা এটি পছন্দ করি।

 

তোমাকে ধন্যবাদ, বাবা।

 

ফুটবল

 

এটাই। এটাই স্মৃতি। সেরা স্মৃতি।