• ক্রিকেট

উন্মুক্ত চাঁদঃ একটি ভিডিও এবং আমার আক্ষেপ

পোস্টটি ৩২২২ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

২০১২ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে উন্মুক্ত চাঁদের ১১১ রানের অপরাজিত দারুণ এক ইনিংসের বদৌলতে বিশ্বকাপ জিতে নেয় ভারত। দুর্ভাগ্যবশত সেই ইনিংস সরাসরি টিভিতে দেখা হয়নি। উনিশ না পেরোনো ক্রিকেটারদের খেলা আগ্রহ সহকারেই খুজে দেখি আমি। আর এভাবেই একদিন উন্মুক্ত চাদের ১১১ রানের সেই ইনিংসটিও দেখেছিলাম ইউটিউবে। ঐ ইনিংসের ভিডিও দেখে আমি পুরোই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। যতটা না মুগ্ধ হয়েছিলাম তার চেয়ে বেশি অবাকই হয়েছিলাম, আক্ষেপ করছিলাম।

এত প্রতিভাবান একজন ব্যাটসম্যান যার কিনা বর্তমানে ভারত জাতীয় দলে খেলার কথা ছিল, সেই তিনি আইপিএলেও নিয়মিত খেলতে পারছেন না। তাইতো খুজতে থাকি কোথায় আছেন, এখন কি অবস্থা সেই ব্যাটসম্যানের। মনে প্রশ্ন জাগে, এত প্রতিভাবান ব্যাটসম্যানের কেন এ অবস্থা? কি হলো উন্মুক্ত চাঁদের! আফসোস করি। ইশ! যদি উন্মুক্ত চাঁদের একটা সাক্ষাৎকার নিতে পারতাম। অনেক কিছুই যে আমি জিজ্ঞেস করতে চাই তাঁকে, অনেক কিছু জানতে চাই তাঁর সম্পর্কে। হয়তো তাঁকে সরাসরিই প্রশ্ন করে ফেলতাম, আপনি কেন জাতীয় দলে নেই?

                unmukt chand 4

 

একসময় কোহলির সঙ্গে তুলনা করা হত তাঁকে। দিল্লিতে বেড়ে উঠা কোহলি ও উন্মুক্ত চাঁদ দুজনেই জিতেছেন অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ এবং দুজনেই ছিলেন বিশ্বকাপজয়ী দলের অধিনায়ক। ২০০৮ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ভারতীয় দলের অধিনায়ক ছিলেন বিরাট কোহলি আর ২০১২ বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন উন্মুক্ত চাদ। কিন্ত আজ একজন দায়িত্ব পালন করছেন ভারত জাতীয় ক্রিকেট দলের এবং অপরজন খেলার সুযোগ না পেয়ে পাড়ি জমিয়েছেন এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে। 

ভারতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে বিশ্বকাপ জিতে রাতারাতি তারকা বনে যান উন্মুক্ত ভারত চাঁদ ঠাকুর। ধোনি-কোহলিদের সাথে বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি ৬টি ব্র্যান্ডের সাথে চুক্তিও করেন তিনি। কিন্ত সেই তারকা খ্যাতি ধরে রাখতে পারেননি বেশিদিন, সেটি বাজে ফর্মের কারণেই হোক বা অন্য কারণে। ভারতের হয়ে ২০১৪, ২০১৬, ২০১৮ এমনকি ২০২০ সালের অনেকেই ইতিমধ্যে পরে ফেলেছেন ভারত জাতীয় দলের জার্সি, কয়েকজন নিয়মিত খেলছেন ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটের পাশাপাশি এ দলের হয়ে। অনেকেই আছেন ভালো অবস্থানে, আছেন জাতীয় দলের আশেপাশে। উন্মুক্ত চাঁদেরই নেতৃত্বে খেলা হানুমা বিহারি ও সান্দিপ শর্মারও অভিষেক হয়ে গেছে জাতীয় দলে। আর চাঁদ সর্বোচ্চ যেতে পেরেছেন ভারত-এ দল পর্যন্তই।

চাঁদকে বলা হতো বড় ম্যাচের খেলোয়াড়। বলা হবেই না-বা কেন? সেমিফাইনাল-ফাইনাল এলেই যে জ্বলে উঠতেন ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। ২০১২ সালে ভারত, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্টিত টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৯৪ ও ফাইনালে স্বাগতিক অজিদের বিরুদ্ধে খেলেছিলেন অপরাজিত ১১২ রানের ঝলমলে এক ইনিংস। সেই সিরিজে ৫ ম্যাচেই চাঁদ করেছিলেন ২৮১ রান। একই বছর জুনে অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপের সেমিফাইনালে ১১৬ ও ফাইনালে ১২১ রান করেন উন্মুক্ত চাঁদ। মাত্র ৩ ম্যাচে সেই টুর্নামেন্টে ২৮৬ রান করেন তিনি। ২০১২ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালেও সেঞ্চুরি (১১১*) হাকান চাঁদ। 

     unmukt chand 2

ভারত অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে ২১ ম্যাচে প্রায় ৬৮ গড়ে করেছিলেন ১১৪৯ রান। হাকিয়েছিলেন সমান সংখ্যক শতক ও অর্ধশতক, পাঁচটি। নজরকাড়া এসব পারফর্মেন্সের সুবাদে মাত্র ১৮ বছর বয়সে ২০১১ সালের আইপিএলে দিল্লি ডেয়ারডেভিলসের হয়ে অভিষেক হয় উন্মুক্ত চাঁদের। আইপিএল সিজন-৬, ২০১৩ সাল পর্যন্ত ডেয়ারডেভিলসেই খেলেন তিনি। কিন্ত চাঁদ ছিলেন পুরোপুরিই ব্যর্থ। ৭ ম্যাচে করেছিলেন মাত্র ৬১ রান, আর তাইতো তাঁকে ছাড়তে বাধ্য হয় দিল্লি। এরপর ৬৫ লাখ রুপির বিনিময়ে আইপিএল সিজন ছয়ে তাঁকে লুফে নেয় রাজস্থান রয়েলস। এরপরের সিজনে তাঁকে দলে নেয় মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স। দুই সিজন মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের স্কোয়াডে থেকেও নিয়মিত খেলার সুযোগ না পেয়ে স্বেচ্ছায়ই তিনি ছেড়ে দেন মুম্বাইকে। 

২০১৬ সালে মুম্বাইয়ের হয়ে পাঞ্জাবের বিপক্ষে শেষ আইপিএল ম্যাচ খেলেছিলেন উন্মুক্ত চাঁদ। প্যাভিলিয়নে ফিরেছিলেন শুন্য রান করে, আইপিএল অভিষেকেও ফিরেছিলেন শুন্য রানে। তবে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩ বছর ভারত এ দলের দলপতি হিসেবে খেলে গেছেন তিনি, পারফর্মও করছিলেন। ২০১৭ সালের আইপিএলে মুম্বাইয়ের হয়ে এক ম্যাচও খেলতে পারেননি তিনি। খেলার সুযোগ পেতেই মুম্বাইকে ছেড়ে অন্য ফ্রাঞ্চাইজিতে যেতে চেয়েছিলেন চাঁদ। কিন্ত তখনই তাঁর জীবনের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে। ২০১৮ সালের আইপিএলের নিলামের চারদিন আগে ঘোষণা করা হয় দিল্লির রঞ্জি ট্রফি স্কোয়াড, বাদ পড়েন তিনি। এরপর আইপিএলেও সুযোগ পাননি কোন দলে। দিল্লি দল থেকে বাদ পড়াই আইপিএলে দল না পাওয়ার একটা কারণ বলেও মনে করেন তিনি। এর আগেও তিনি একই ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলেন ২০১৬ সালে, তখন সৈয়দ মুশতাক আলি ট্রফির জন্যে দিল্লির টি-২০ দল থেকে বাদ পড়েন তিনি। অথচ সেই টুর্নামেন্টের আগের সিরিজে ভারত-এ দলের হয়ে সর্বোচ্চ স্কোরার ছিলেন তিনি। ২০১৮ সালে আকস্মিকভাবে দিল্লি দল থেকে বাদ পড়ে অনেক হতাশ হয়ে চাঁদ পাড়ি জমান নিজ জন্মভূমি উত্তরখন্ডে। বর্তমানে উত্তরখন্ডের দলের অধিনায়কত্বও করছেন তিনি।

        unmukt chand 3

১৮ বছর ১৫ দিন বয়সে আইপিএলে অভিষেক হয়, মাত্র ১৬ বছর বয়সেই রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক হয় চাঁদের। এত কম বয়সে আইপিএল, রঞ্জি ট্রফি খেলা তো আর সহজ ব্যাপার না। নিশ্চয়ই তাঁর প্রতিভা ছিল অনেক। তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী খেলতে না পারায় কেউ কেউ আবার প্রশ্ন তুলছেন তাঁর ব্যাটিং সামর্থ্য, টেকনিক নিয়ে। কিন্ত এতদুর যে পৌছতে পেরেছে তাঁর টেকনিক নিয়ে কথা বলার কিছু নেই। আর টেকনিকের চেয়েও যখন পারফর্মেন্স বড় হয়ে উঠে তখন টেকনিকের কথা এক পাশে রেখে দেয়াই ভাল। এত কম বয়সে এত রান, আইপিএলে খেলা। এসবই তাঁর সামর্থ্যের প্রমাণ।

তিনি হতে পারতেন বিশ্ব ক্রিকেটের এক তারকা, হয়তো বিরাট কোহলিদের সাথে তাঁর খ্যাতিও ছড়িয়ে পড়ত সবখানে। কিন্ত তিনি পারেননি। সেটা যে কারণেই হোক। তবে এখনও ফুরিয়ে যাননি চাঁদ। বয়স ২৭। বর্তমানে নিয়মিতই খেলছেন ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে। যদিও তেমন ফর্মে নেই তিনি। হয়তো চাঁদ আবারো সেই অনূর্ধ্ব-১৯ দলে থাকাকালীন ফর্মে ফিরবেন এবং ভারতের জার্সি পরে নামবেন মাঠে। আমি সেই ম্যাচ দেখব টিভিতে হয়তোবা সরাসরি মাঠে বসে। আর ম্যাচ শেষে প্রেস কনফারেন্সে তাঁকে জিজ্ঞেস করবো নানান প্রশ্ন।

বিঃদ্রঃ উন্মুক্ত চাঁদ ২৬ মার্চ, ১৯৯৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন।