• ফুটবল

ইংল্যান্ড বনাম আর্জেন্টিনা ১৯৮৬ বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল: ফুটবলের ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত ম্যাচ

পোস্টটি ৪৮৬৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

 

১.

সব ফুটবল ম্যাচ মাঠে নব্বই থাকে একশ বিশ মিনিটেই শেষ হয়ে গেলেও এমন কিছু ম্যাচ আছে যা মানুষ হাজার বছরেও ভুলতে পারবে না।

 


৮৬ বিশ্বকাপের ইংল্যান্ড বনাম আর্জেন্টিনার  কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচটিও এই রকম একটি ম্যাচ। 

এটি এমন এক ম্যাচ ছিল যে ম্যাচে ফুটবল ইতিহাসের দুটি বিখ্যাত গোল হয়েছিল; দুটি গোলই করেছিলেন ম্যারাডোনা।ম্যাচটিকে অনেকেই ফুটবলের ইতিহাসের একত্রে সবচেয়ে বিখ্যাত এবং কুখ্যাত ম্যাচ হিসেবে মনে করে এবং নিঃসন্দেহে এটি ফুটবলের ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত ম্যাচ।

 

২. 

 

- ১৯৬৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে বিখ্যাত ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে নব্বই হাজারের অধিক দর্শকের উপস্থিতিতে মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ড ও আর্জেন্টিনা। ম্যাচের ৩৫তম মিনিটে আর্জেন্টিনার মিডফিল্ডের প্রাণ এবং অধিনায়ক আন্তোনিও র‌্যাত্তনকে আর্গুমেন্টের কারনে জার্মান রেফারি রুডলফ ক্রেইটলিন মাঠ ছাড়ার আদেশ দেন (তখনও লাল,হলুদ কার্ডের প্রচলন হয়নি।)।রিপোর্ট অনুসারে জার্মান রেফারি র‌্যাত্তনকে মাঠ ছাড়ার আদেশ দেন কারণ র‌্যাত্তনের দৃষ্টিভঙ্গি তার পছন্দ হয়নি বলে, যদিও বৃটিশ মিডিয়া অনুযায়ী “রেফারিকে গালি দেওয়ার কারনে র‌্যাত্তনকে মাঠ ছাড়তে বলা হয়।” কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় কারণ র‌্যাত্তন জার্মান বলতে পারত না আর ক্রেইটলিন স্পানিশ বুঝত না।রেফারির নির্দেশের পরও র‌্যাত্তন মাঠ না ছাড়লে তাকে পুলিশ দিয়ে মাঠ থেকে বের করা হয়। ম্যাচের ৭৮তম মিনিটে জ্যাফ হ্যাস্টের গোলে ইংল্যান্ড লিড নিলেও আর্জেন্টাইনরা সেটিকে অফসাইড দাবি করে। এতে আর্জেন্টিনা কাছে এইটা পরিষ্কার হয়ে যায় ইংল্যান্ড এবং জার্মানি তাদের বিরুদ্ধে যৌথ ভাবে কাজ করছে।ম্যাচটি ১-০ স্কোর লাইনেই শেষ হয়।ম্যাচ শেষে উল্টে প্রেস কনফারেন্সে ইংল্যান্ডের ম্যানেজার এল্ফ রামসেই আর্জেন্টাইনদের “পশু” বলে আখ্যায়িত করে। 

 

- ১৯৮২ সালে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে আর্জেন্টিনা ও ইংল্যান্ড অঘোষিত যুদ্ধ জড়িয়ে পরে,যুদ্ধে আর্জেন্টিনা শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয় এবং আর্জেন্টিনার প্রায় ৬৫০ সন্য নিহত হয়।

 

৩.

 

৬৬ বিশ্বকাপে অবিচারের শিকার হওয়া এবং যুদ্ধে পরাজয়ের দগদগে ক্ষত নিয়ে ১৯৮৬ সালে ২২ জুন মেক্সিকো সিটির এস্তাদিও আসতেকা স্টেডিয়ামে একলক্ষ চৌদ্দ হাজার পাঁচশ আশি জন দর্শকের উপস্থিতিতে আবারও বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ড মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা। ম্যাচের আগেই ইংল্যান্ডের সাপোর্টাররা অ্যাগরেসিভ হতে থাকে,একজন অফিশিয়াল টিভির দেওয়া সাক্ষাত্কারে বলে,“আমরা কোন চাপে থাকব না,তার চাপে থাকবে কারন তারা যুদ্ধ হেরেছে।আমার রাজা, আমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন।”

দু'পক্ষের দর্শকরা কয়েকবার সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়ে। অতঃপর ম্যাচ শুরু হয়.....

 

আর্জেন্টিনা ৩-৫-২ ফর্মেশনে ম্যাচ শুরু করে।অ্যাটাকিং ডুও ভালদানো এবং ম্যারাডোনা।তাদের পিছনে গিয়াস্টি,বুরুচাগা এবং বাতিস্তার মিডফিল্ড ট্রিও।রাইট সাইজে ওয়াইড মিডফিল্ডে এনরিকে এবং লেফ্ট সাইডে উইং ব্যাক হিসেবে জুলিও অ্যালারিটোসিয়া।থ্রি ম্যাচ ব্যাক লাইনে ছিল কুইফুফো, ব্রাউন এবং রুগেরি এবং গোলে ছিল পাম্পিডো।দলের পুর ক্রিয়েটিভিটি নির্ভরশীল ছিল দলের হার্টবিট দিয়েগো আরমান্দ ম্যারাডোনার উপর।

 

ইংল্যান্ড বেটার সাইড হিসেবে ম্যাচ শুরু করে কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে ইংল্যান্ডের ডিফেন্সের রাইট সাইড নড়বড়ে হয়ে থাকে,যেটা ম্যারাডোনার সাইড।ম্যারাডোনা বেশ কিছু ভাল সুযোগ তৈরি করলেও গোলশূন্য সমতায় প্রথম অর্ধ শেষ হয়।দ্বিতীয় অর্ধের শুর থেকেই দুই দলই আক্রমণ প্রতিআক্রমণ করতে থাকে।দ্বিতীয় অর্ধের ষষ্ঠ মিনিটেই ম্যারাডোনা তাঁর কুখ্যাত গোল “হ্যান্ড অফ গড” করেন এবং প্রথম গোলের চার মিনিট পর তাঁর বিখ্যাত গোল “গোল অফ দা সেঞ্চুরি” করে।ম্যাচের শেষ ভাগে গ্যারি লিনেকার ইংল্যান্ডের পক্ষে এক গোল শোধ দিলেও ২-১ ব্যবধানে ইংল্যান্ড পরাজিত হয়।

 

৩.

 

gettyimages-1064052402-2048x2048- হ্যান্ড অফ গড:

 

ম্যাচের দ্বিতীয় অর্ধের ষষ্ঠ মিনিটের খেলা চলতেছে.... 

ম্যারাডোনা বল নিয়ে আক্রমণে এগিয়ে যায় কিন্তু সুবিধাজনক স্পেস না পেয়ে ভালদানোর সাথে ১-২ খেলার উদ্দেশ্যে পাস দেয় কিন্তু ভালদানো বল ঠিক মত কন্ট্রোল করতে না পারায় বল চলে যায় ইংলিশ মিডফিল্ডার স্টিভ হডজের পায়ে;হডজ বল ঠিক মত ক্লিয়ার না করতে পারলে বলটি পেনাল্টি বক্সের ভিতরে চলে যায়।বক্সের ভিতর শুধু ম্যারাডোনা এবং ইংলিশ গোলকিপার পিটার শিলটন ছিল।শিলটনের উচ্চতা ১.৮৫ মিটার এবং ম্যারাডোনা ১.৬৫। কিন্তু ম্যারাডোনা ছামহাও নিজের থেকে ২০ সেন্টিমিটার (৮ ইঞ্চি) লম্বা শিলটনের মাথার উপর দিয়ে বল জালে পাঠাতে সক্ষম হয়।শিলটন সহ ইংলিশ প্লেয়াররা হ্যান্ড বলের দাবি করলেও তিউনেশিয়ান রেফারি আলি বিন নাসের গোল দিয়ে দেয়।ম্যাচ শেষে ম্যারাডোনা হ্যান্ড বলের কথা স্বীকার করে এবং বলে, “A little with the head of Maradona and a little with the hand of God”2008

এরপর থেকে গোলটি “হ্যান্ড অফ গড” নামে পরিচিতি লাভ করে।

 

gettyimages-1064052252-2048x2048- ম্যাচের পঞ্চান্নতম মিনিটে খেলা চলছে.....

চার মিনিট আগে হওয়া “হ্যান্ড অফ গড” এর ক্ষত তখনও ইংলিশদের মন থেকে শুকায় নি.. ম্যারাডোনা নিজের হাফ থেকে বল কন্ট্রোল করে এবং তাকে প্রেস করা তিনজন ইংলিশদের কোনো প্রকার কষ্ট ছাড়ই কাটিয়ে যায় এবং প্রায় পুর রাইট ফ্লাংক ফাকা পেয়ে যায়.... কোনো ইংলিশ প্লেয়ার ম্যারাডোনার দ্রুতিকে ছুতে পারেনি এবং শেষে পিটার শিলটানকে বিট করে জালে বল পাঠিয়ে দেয় এল দিয়েগো। ১১ সেকেন্ডে ইংল্যান্ডের প্লেয়ারদের কাকতাড়ুয়ার বানিয়ে করে ফেলেন বিশ্বকাপে ইতিহাসের সর্ব কালের সেরা গোল যা পরবর্তীে “গোল অফ দা সেঞ্চুরি” নামে পরিচিতি লাভ করে।

এই ম্যাচের স্প্যানিশ ধারাভাষ্য করছিলেন উরুগুয়ের ভিক্টর হুগো মোরালেস। ঐ গোলের সময় তিনি যেই ধারাভাষ্য করেছিলেন সেটাকে অনেকে স্পোর্টস এর ইতিহাসের সবচেয়ে ইমোশনাল ধারাভাষ্য বলে থাকে। উনার কণ্ঠের সেই আবেগ আমার লেখায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তবে শুধু উনার কথাগুলোর ইংরেজি এবং বাংলায় অনুবাদ দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করছি মাত্র।

 

“He(Enrique) passed it to Diego,there goes Maradona with it, two men on him, Maradona steps on the ball, there goes down the right flank, the genius of world football!

He leaves the wing(3rd man) and he can pass it to Burruchaga... 

Always Maradona! 

Genius! Genius! Genius! Ta-ta-ta-ta-ta-ta-ta-ta ...  

Goaaaaaaaal! Goaaaaaaal! 

 

I want to cry! Holy God! Long live football!

 

Golaaazooo! Diegoooool!Maradona!...This makes me cry, excuse me!

 

 

 

Maradona, in an unforgettable run, in the best play of all times! 

 

Cosmic Kite! What planet did you come from to leave all those British on their way? To make a whole nation scream as one!? Argentina 2-0 England.

 

Diegoal, Diegoal, Diego Armando Maradona! Thank you, God, for football, for Maradona, for these tears, for this Argentina 2, England 0."

 

"সে (এনরিকে) দিয়েগো কে পাস দিল।

 

 ম্যারাডোনার বল নিয়ে এগিয়ে চলল। তাঁর দিকে দু'জন খেলোয়া ছুটে আসছে।

 

সে বল নিয়ে ডান দিক দিয়ে কাটিয়ে গেল, বিশ্বের ফুটবল প্রতিভা!

 

সে তৃতীয় জনকে পিছনে ফেলল, বুরুচাগাকে পাস দিতে পারে।

 

চিরতরে ম্যারাডোনা!

 

জিনিয়াস, জিনিয়াস, জিনিয়াস!

 

তা-তা-তা-তা-তা.....

 

গোওওওওওওল! গোওওওওওওল!

 

আমি কাঁদতে চাই!পবিত্র সৃষ্টিকর্তা! চিরজীবী হোক ফুটবল!

 

গোলালালাজোজো(অসাধারন গোল)!দিয়েগোলললল!ম্যারাডোনা!...এটি আমাকে কাঁদিয়ে তুলছে,দুঃখিত!

 

ম্যারাডোনা, অবিস্মরণীয় দৌড়ে,  সর্বকালের সেরা খেলায়!

 

মহাজাগতিক ঘুড়ি!তুমি কোন গ্রহ থেকে এসেছেন সব ব্রিটিশদের তাদের পথে পাঠাতে(এলিমিনেট করতে)?পুর দেশকে এক হয়ে চিত্কার করাতে!?

 

গিয়েগোল!দিয়েগোল!দিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা! ধন্যবাদ,সৃষ্টিকর্তা,ফুটবলের জন্য,ম্যারাডোনার জন্য, এই আনন্দ অশ্রুজলের জন্য এবং এই স্কোরলাইনের জন্য,আর্জেন্টিনা ২ ইংল্যান্ড ০।"

 

৪.

 

ম্যারাডোনার অতিমানবিক প্যারফর্মেন্স:

 

এই ম্যাচে ম্যারাডোনা ৭৮ বার বল টাচ করেছিল।

১৯ বার ড্রিবল attempt করেছিল এবং ১২ বার সফল হয়ে ছিল যা তার নিকট তম প্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টাইন টিম মেট এনরিকের(৪ বার ড্রিবল attempt করেছিল) থেকে প্রায় ৫ গুন।মোট ৩৩ টা ডুয়েলের ভিতর ২৩ টা জিততে সক্ষম হয়। তাঁর পাসিং একুরেসি ছিল ৮৪.৪%।মোট ৫ টা গোল স্কোরিং সুযোগ তৈরি করেছিল এবং মোট ৭টি শর্ট নেয় যার ভিতর ৩ টা অন টার্গেটে ছিল।

 

 

৫. 

 

লেগেছি:

 

২০১৯ সালের এক ডকুমেন্টারিতে ম্যারাডোনা বলেছিল, “ আমি জানতাম ঐটা আমার হাত ছিল।ঐটা আমার কোনো প্লান ছিল না কিন্তু পুর ঘটান এত দ্রুত ঘটে যে লাইন্সম্যান আমাকে হাত তুলতে দেখতে পেয়েছিল না।রেফারি আমার দিকে তাকায় এবং বলে ‘গোল’।এই ভেবে ভালই লাগতেছিল যে এটা ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে একধরনের প্রতিশোধ ছিল।"

 

১৯৮৬ ইংল্যান্ড টিমের প্রধান তারকা গ্যারি লিনেকার গোল অফ দা সেঞ্চুরির প্রসঙ্গে বলে, “ম্যারাডোনার ব্যাপারে আমি কিই বা বলতে পারি,মানুষটি ফুটবলিং জিনিয়াস।আমাদের বিপক্ষে তাঁর গোলের কারনে আমার পুর ক্যারিয়ারে একমাত্র একবাইর মনে হয়েছিল আমাদের বিপক্ষে করা গোলের জন্য  প্রসংশা করি।”

 

ম্যাচটির বয়স ৩৪ বছর হলেও এখন ম্যাচটি নিয়ে ফুটবল ভক্তের আগ্রহ এবং অলোচনা পরিমাণ বিন্দুমাত্রও কমেনি।

 

হয়ত আরও শত বছর ম্যাচটি নিয়ে আলোচনা করা হবে,করা হবে ম্যারাডোনার প্রসংশা এবং সমালোচনা। 

 

১৮/৩/২০

মো. রাকিব হোসেন

 

বিঃদ্রঃ এইচএসসি কারনে লেখালিখ অফ করে দিছি। প্রায় ৬-৭ মাস পরে প্রথম লেখলাম, সবাই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।