• ক্রিকেট

কেমন করে ক্রিকেট লিখ, হে গুণী!

পোস্টটি ২৬৪৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

এখানে নেই আলোর ঝলকানি। চারপাশ জুড়ে ঝলমল করছে না রঙ-বেরঙের বাতি, নেই সহস্র ওয়াটের আলোকসজ্জা। বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতি নেই, মঞ্চজুড়ে বাহারী আয়োজন নেই। সম্মাননা প্রদর্শনে অবিশ্রান্ত করতালির বড্ড অভাব। বিনম্র শ্রদ্ধায় উঠে দাঁড়ানো সকল উপস্থিত সুধী মন্ডলী; দৃশ্য অবতারণার নেই উপায়। সম্মান প্রাপ্ত বিশেষ ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের আপ্লুত বিনয়ী বচন শোনার সুযোগও নেই আমাদের এখানে।

আমাদের এই সম্মাননায় নেই প্রচলিত ও পরিচিত আয়োজন। সেই সামর্থ্যই নেই যে! আমাদের ক্ষুদ্রগন্ডীর সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার এই আয়োজনে থাকছে- শব্দের অবারিত উল্লাস, বাক্যের অন্তহীন উচ্ছ্বাস এবং আমাদের নিখাঁদ শ্রদ্ধা ও আন্তরিক অনুভূতি।

 

মধ্যমাঠে মাইক্রোফোনের বকবক...

শিরশির করছে গা। দাঁড়িয়ে গেছে গায়ের লোম। বহুকাল আগে মর্ত্য-ত্যাগী মানব ক’জন দারুণ ছন্দ তুলে নড়ছেন আপনার সামনে। আপনি দেখছেন তাদের। মৃদুমন্দ অঙ্গুলি সঞ্চালন, পায়ের দ্রুততর সঞ্চারণ, মস্তিষ্কের নিপুণ ব্যবহার, গায়ের অসম্ভব জোর আর ক্ষিপ্রতা... সব ঘটছে আপনার চোখের সামনে। আপনি দেখছেন। বুঝছেন। আছেন তাদের সঙ্গে।

গ্যাবার গ্যালারীতে বসে আছেন আপনি, স্যার ফ্র্যাংক ওরেল যেন আপনার সামনেই স্যার ওয়েস হলকে ডেকে বলছেন- ‘আর যাই করো, খবরদার, ভুলেও নো বল করো না! তাহলে কোনোদিন আর বার্বাডোজ ফেরা হবে না তোমার।’

আপনি হয়তো আবার চলে গেছেন, লন্ডনের দ্য ওভালে; বিয়ার পানরত ইংরেজ দর্শকদের সঙ্গে সেখানে বিলেতি গ্রীষ্ম উপভোগ করছেন। অবাক বিস্ময়ে দেখছেন হলিসের ‘নিরীহ’ বলের বেল ফেলে দেয়া। স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের চোখে কিছু পড়লো বুঝি! শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম ক্রিকেটারটি অদ্ভুত এক রহস্য সঙ্গী করে শেষবারের মতো ছাড়ছেন মাঠ। যে রহস্য ‘আনকোডেড’ এখনো।

রহস্যের নাম বলতে হবে?

নিরানব্বই দশমিক চুরানব্বই!

তারও প্রায় সাড়ে চার দশক আগে সেই দ্য ওভালে বসেই গিলবার্ট জেসপের তান্ডব দেখছেন আপনি! আরো দুই দশক পিছিয়ে দেখছেন স্পফোর্থ নামের একজনকে। যার চোখে মৃত্যুর ছায়া দেখতে পেতেন ব্যাটসম্যান-সমাজ। ফ্রেডেরিখ ‘দ্য ডেমন’ স্পফোর্থের রক্তচড়া মাথায় ভর দিয়ে শতাব্দী প্রাচীন এক লড়াইয়ের সূচনার সাক্ষী হচ্ছেন আপনি। অথবা আপনার সম্মুখে ব্যাটসম্যানের বুক-মুখ-মাথা বরাবর ছোঁড়া হচ্ছে একের পর এক বল নামের গোলা, লেগ সাইডে অর্ধবৃত্ত সাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, গোটা সাত-আট জন দু’পেয়ে। আপনার সামনেই চলছে কানাকানি-ফিসফাস-ষড়যন্ত্র। হাঁটছে-দৌঁড়ছে-বলছে-দেখছে-শুনছে; ইংরেজ ক্রিকেটের নিকৃষ্ট ক্রিকেট কূটচালীর রুপকার ডগলাস জার্ডিন ও তাঁর দুই অস্ত্র- লারউড ও ভোস।

ক্ষণজন্মা হানিফ মোহাম্মদের ক্ষুদ্রাকৃতির দেহাবয়বের বৃহদাকৃতির সংযম, জর্জ হ্যাডলির আকাশ সমান ব্যাটসম্যানশীপ, রিচি বেনোর লেগ স্পিন, সিডনী বার্নসের ‘সাপের ছোবল’ মারার মতো বোলিং... আপনি দেখছেন তো দেখছেনই। আপনার দেখার কোনো শেষ নেই।

উত্তেজনায় ক্ষণে ক্ষণে কাঁপছেন। মুগ্ধতার নানান শাখা-প্রশাখা ঘুরে মর্ত্য ছেড়ে মোহময় এক গ্রহে ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রতিনিয়ত। আপনার দেহের রক্ত এই উঠছে এই নামছে। ক্রিকেটলোকের সুন্দরতম অধ্যায়গুলোর চিত্রপট আপনার সম্মুখে, মোহাবিষ্ট না হয়ে উপায় কি?

না, আপনার হাতে রেয়ার কোনো ভিডিও ফুটেজ এসে পড়েনি। অবাক কোনো ভিডিও চিত্রের সচিত্র প্রতিবেদনের সাক্ষীও হননি আপনি। তাহলে কীভাবে চোখের সামনে পরপর সাজছে চিত্রপট? চিত্রায়িত হচ্ছে দৃশ্যাবলী?

লেখকের কলম নামের তুলি দিয়ে আঁকা রঙিন চিত্র আপনার সামনে যে! সুন্দরতম শব্দে সাজানো সুন্দরতম বাক্যের সম্মিলন যে আপনার হাতে! অসম্ভব প্রতিভাধর লেখকের একটি বইয়ে বুঁদ হয়েছেন যে আপনি!

দৃশ্যরা আপনার চোখের সামনে জীবন্ত না হয়ে উপায় কি?

 

২.

টসের আগে মধ্যমাঠে দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোন হাতে খানিকক্ষণ আলোচনা চলে না? এতক্ষণের বকবকটাকে সেরকমই ভাবুন না! এবার আসছি সিদ্ধান্ত ঘোষণায়। মানে টস টাইম। আমাদের যাত্রাপথের সড়ক ও সড়কের ম্যাপচিত্র দেখবো আমরা এবার।

বুদ্ধিমান পাঠক নিশ্চয় বুঝে গেছেন আমাদের বিষয়বস্তু। তারপরও খোলাসা করছি। যে মহান কীর্তিমানদের কল্যাণে ক্রিকেট আমাদের কাছে হয়ে উঠে জীবন্ত দৃশ্যপট, যে মহান মনুষ্যরা আমাদের বিমূর্ত অনুভূতির চিত্রকর, যারা শব্দগুচ্ছের অকপট বর্ণনায় সাজান সুন্দরতম সচিত্র প্রতিবেদন, সেই মহান ক্রিকেট লিখিয়েদের কয়েকজন থাকছেন আমাদের আজকের আলোচনায়। এই শব্দমালায় সাজানো গরীবী ও অনুজ্জ্বল সম্মাননায়।

আরো একটা ব্যাপার, এখানে কোনো ভিনভাষী কেউ থাকছেন না। থাকবেন আমাদেরই ভাষাভাষী কয়েকজন। বাংলা ভাষার ক্রিকেট লিখিয়ে। যাদের কল্যাণে ‘বিদেশী খেলা ক্রিকেট’ আমাদের কাছে হয়ে উঠেছে একান্ত আপন। যারা আমাদের জানিয়েছেন ক্রিকেট কেবল খেলা নয়, তার চেয়েও বড় কিছু। আমাদের বুঝিয়েছেন, কবিতার সঙ্গে ক্রিকেটের সংযোগ। সাহিত্যপাড়ায় ক্রিকেটের অবারিত প্রবেশটাও আমরা জেনেছি তাদের মারফত।

আমাদের শৈশব, আমাদের কৈশোর, আমাদের ক্রিকেট প্রেমের অনিন্দ্য সময় উপহার দেয়া মুহূর্তগুলোর প্রতিদান দেয়া সম্ভব নয় কিছুতেই। সেই দুঃসাহসও করছি না। আমরা শুধু আমাদেরই মতোন করে শব্দ-ফুলে মালা গেঁথে, সেই মালায় তাদের সাজানোর সামান্য প্রয়াস নিয়েছি।

প্রয়াসের গুরু-ভার অধমের হাতে। অথর্ব হাতের অক্ষমতায় ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি ও উদার প্রশ্রয় আশা-ই অধমের একমাত্র কাম্য।

 

৩.

শুরুটা হোক একজন প্রবাদ প্রতিম ক্রিকেট-পন্ডিত দিয়ে। শ্রদ্ধেয় জালাল আহমেদ চৌধুরী। বাংলা বেতারের ধারাবিবরণী অনুসারে তিনি ইনিংসের উদ্বোধনে আছেন। বর্ষীয়ান এই ক্রিকেট লিখিয়ে আমাদের কত সময় যে রাঙিয়েছেন! শব্দের ব্যবহারে, উপমার আভিজাত্যে, বাক্যের বিন্যাসে মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমরা তাঁর বইয়ের পাতায় আটকে থাকি চুম্বকের মতো। যেনো কোনো বাগানের সবচেয়ে সুন্দর ফুলগুলি বেছে বেছে নিয়ে সবচেয়ে মনোহর মালা গাঁথার ভার পেয়েছেন তিনি। অথবা শব্দ-বাগানের রাজকীয় অংশবিশেষ নিয়েই তাঁর পরিমন্ডল। একটা শব্দও, একটা বাক্যও, দীন-হীন নয় তাঁর, প্রত্যেকটা শব্দ সগর্বে ঘোষণা করে রাজকীয় গরিমা।

খুব একটা বই লেখা হয়নি তাঁর, অধমের হাতে পড়েছে কেবল ‘বিশ্বকাপ ও কয়েকছত্র ক্রিকেট’ আদ্যিকালের বইটি। যেন বাংলা ভাষার ক্রিকেট বইয়ের রাজ্যে একখানা বনেদী সম্ভার। কত লেখা ইংরেজ ক্রিকেট লিখিয়ে হতে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছেন। অথচ নিশ্চিত জানি, ইংরেজ ভদ্রলোকও অতটা মাধুর্য মেশাতে পারেননি, যতটা পেরেছেন আমাদের বর্ষীয়ান ক্রিকেট-পন্ডিত।

অসামান্য ক্রিকেট-জ্ঞান আর অভিজ্ঞতার সঙ্গে প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার দুর্দান্ত সমন্বয়, একই সাথে শব্দরাজ্যের একচ্ছত্র অধিকার, লেখনীর সহজবোধ্যতা ও বনেদিয়ানা তাঁকে দিয়েছে উঁচুদরের ক্রিকেট সাহিত্য সৃষ্টির অনন্য মুন্সিয়ানা। আন্তরিক বিনয় ও নিরহংকার সবুজ মননে তিনি ও তাঁর ব্যক্তিত্ব হয়েছে অসাধারণ থেকে অতি-অসাধারণ। তাঁর লেখনীর মুগ্ধ পাঠককুলের গভীর হাহাকার ও আন্তরিক আফসোস, এত উপাদেয় ও সুসাহিত্য কেন বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য খুব একটা এল না?

শ্রদ্ধেয় জালাল আহমেদ চৌধুরী! কেন এল না?

 

৪.      

শঙ্করীপ্রসাদ বসু। আরেকজন কিংবদন্তী। যার কলমের ডগায় লূটোপুটি খেলে শব্দেরা, বাক্যিরা যার নিব-তলে শোরগোল তোলে প্রবল দাপটে। যার কলম-নীচে বশ মেনে ধন্য হয় ছন্দ-ভাষা-সুর। বুঝি কোনো অর্কেস্ট্রা হাতে নেমেছেন, শব্দের সুর তুলে মোহাবিষ্ট করবেন!

বিজয় হাজারে ব্যাটিংয়ে, ভিনু মানকড় বোলিংয়ে। সে বর্ণনা পড়েই দেখুন না, তাঁর লেখনীতে—

আকাশের দিকে একটি সুন্দর লাল জিনিস ছুঁড়ে দেওয়া হোল। তাতে অঙ্গুলির বিশেষ পেষণে কি যেন মৃদু ছলনা জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বল উঠছে তো উঠছে। আকাশ ছুঁই ছুঁই। অতটা না ক’রে, শেষ পর্যন্ত টুক করে খসে পড়ল হাজারের ব্যাটের সামনে। সেখানে পড়েই রাগে লজ্জায় একটু এঁকে একটু বেঁকে ‘ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না সখা’ করে পালিয়ে গেল এলোমেলো।

ইডেনে শীতের দুপুর, পৃষ্ঠা—১৭  

ক্রিকেট কেবল খেলা-মাত্র নয়, আকার ও আঙিক জুড়ে রয়েছে বেশ কাব্যি কাব্যি ভাব। পরতে পরতে রয়েছে অনিশ্চয়তার অনিন্দ্য সুন্দর গল্প, পাঁচদিন জুড়ে ঐ ২২ গজে ম্যাড়ম্যাড়ে কোনো অবসর কাটানো হয় না, বরং সেখানে বসে অদ্ভুত আনন্দ কোলাহলের চিত্ত হরণ করা সৌন্দর্য। বিলেতি ভদ্রলোকদের অবসর উপভোগের ক্রিকেট বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে এত আপন আর কাছের মনে হওয়ার মূলে তো— শঙ্করীপ্রসাদ বসুর রেখে যাওয়া, ইডেনে শীতের দুপুর, লাল বল লারউড, রমণীয় ক্রিকেট, বল পড়ে ব্যাট নড়ে’র মতো সুউচ্চ সাহিত্য-মান সমৃদ্ধ ক্রিকেট গ্রন্থগুলো!

পরিসংখ্যান দিয়ে কি ছাইপাশ বোঝা যায়, খটমটে ইংরেজী পড়েই-বা সাধারণের কি এমন হাতিঘোড়া বোধগম্য হয়, বরং মায়ের ভাষায় ভিনদেশী ক্রিকেটটা যখন ভাষার অলঙ্কারে, বাক্যের পরিপূর্ণ সুবাসে, শব্দ-বাগের সর্বোৎকৃষ্ট মালির হাত দিয়ে আমাদের সম্মুখে উপস্থাপিত হয়—তখন, হ্যাঁ তখনই অপার্থিব এক মুগ্ধতায় আমাদের অন্তরের অন্দরজুড়ে উঠে এক অবাক আনন্দ হিল্লোল। শ্রীযুক্ত শঙ্করীপ্রসাদ বসু! বাংলার ক্রিকেট সাহিত্য আপনাকে কোনোদিন ভুলবে না। ভুলতে পারে না।

 

৫.

এবার এই সময়ের একজনের গল্প হোক। উৎপল শুভ্র। বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যে সময়ের অন্যতম উজ্জ্বল ধ্রুবতারা। তাঁর কল্পনাশক্তি যেমন অনন্ত, বর্ণনার ভঙ্গিটাও তেমনি মনকাড়া। কারো কারো কাছে তাঁকে পড়া আর মুগ্ধতা হয়ে গেছে সমার্থক। উদাহারণ স্বরুপ দূরে যাওয়ার দরকার নেই, অধমই তাঁর একজন গুণমুগ্ধ।

একটা ছোট্ট উদাহারণ দেয়া যাক। ধরুন, পানি পানের আদব ও শিষ্টাচার বোঝাবেন তিনি, সুকৌশলে পাঠককে বলে যাবেন পরপর—পানি কিন্তু বাংলা নয়, বাংলায় বলা হয় জল। সুকুমার রায়ের বিখ্যাত একটা গল্প আছে, অবাক জলপান। সুকুমার রায় কে জানেন তো? তিনি হচ্ছেন উপেন্দ্রকিশোর রায়ের ছেলে, সত্যাজিৎ রায়ের বাবা। সত্যাজিৎ রায় একটি বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন, ফেলুদা। বাংলা ভাষায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কাকাবাবু’ হচ্ছে তেমনি একটি বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র। সুনীল গাঙ্গুলি ছিলেন সব্যসাচী লেখক। তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা আছে, কেউ কথা রাখেনি…

ঠিক এভাবে এক গল্প বলতে গিয়ে তিনি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেন অনেক অনেক গল্পের, সুতো ধরিয়ে দেন নানান ঘটনা ও রটনার, আগ্রহ জাগিয়ে দেন কত! পাঠক মুগ্ধ হয়, পাঠক উৎসুক হয়, পাঠক পাঠ-সুখ পেয়ে আপ্লুত হয়। অসম্ভব শক্তিধর এই লেখক ক্রিকেট ছাড়া অন্য খেলা নিয়েও লিখেন, তবে ক্রিকেট আর অন্যসবে যেন কত ব্যবধান!

বেশ কয়েকটা গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। তবে ‘কল্পলোকে ক্রিকেটের গল্প’ বইয়ে অভাবনীয় এক কান্ডের কান্ডারী হন তিনি। কল্পনাশক্তির সঙ্গে তাঁর ক্রিকেট-জ্ঞান, পরিসংখ্যানের সাবলীল বর্ণনা সব মিলেমিশে একাকার। গল্প করতে করতে কবে ক্রিকেট ইতিহাসের বিশাল এক পথ পরিভ্রমণ করা হয়ে যায় তা টেরই পাওয়া যায় না।

সুপ্রিয় উৎপল শুভ্র! বহুদিন ‘ভেজা উইকেট’ গ্রন্থের মতো চমৎকার সেইসব গল্পের দেখা নেই। কবে নাগাদ আবার ‘অবাক এক ম্যাচের গল্প’ বা ‘স্বপ্নের একদিন’ বা ‘জেসপ বন্দনা’ গল্পগুলোর মতো নতুন কোনো গল্প শোনাবেন?

 

৬.

মতি নন্দী আরেক শক্তিমান লিখিয়ে। তবে এক ‘জীবন অনন্ত’ পড়ে তাঁকে সেভাবে বোঝার সুযোগ হয়নি, তাই ইচ্ছে থাকলেও উনার আলোচনা টেনে নেয়ার সাধ্যি নেই। আলোচনা টেনে নিতে পারছি না, আরেক শক্তিমান লেখক ও দীর্ঘদিন আনন্দবাজার পত্রিকার খেলার পাতায় কাজ করা—গৌতম ভট্টাচার্য নিয়েও। ভদ্রলোকের গুণমুগ্ধ হলেও ‘স্টীভের অন্তরাগে’ বা ‘বডিলাইনের যুদ্ধে’ বা ‘দাদাতন্ত্র’ বা ‘নতুন বলের মুখে’ তাঁর এরকম কোনো গ্রন্থ পড়ার উপায় যে হয়নি! একই কারণে প্রবল ইচ্ছে সত্ত্বেও সুযোগ নেই, প্রবাদ প্রতিম লেখক প্রয়াত রণজিৎ বিশ্বাস-কে নিয়ে দু’কথা পাড়ার। অথচ তাঁর শব্দকোষ বা ভাষার শৈলী এক গল্প করার মতো অধ্যায়।

রণজিৎ বিশ্বাসের বাংলা ভাষায় দখল বোঝাতে একটি বিদেশী শব্দের দ্বারস্থ হতেই হচ্ছে—এলিগেন্ট! ধরুন, মাহেলা জয়াবর্ধনে ও কুমার সাঙ্গাকার ব্যাট করছেন একই সঙ্গে। দু’জনই আছেন ফর্মের সপ্তচূড়ায়। তাদের চোখ জুড়ানো কাভার ড্রাইভে বল ছুঁয়ে যাচ্ছে মাঠের প্রতিটি সবুজ ঘাস। তারপরও দেখবেন, মাহেলা যতটা সহজবোধ্য, সাঙ্গাকারা ততটা নন। সর্বসাধারণ সাঙ্গাকারাকে বুঝবে না হয়তো, তবে যারা বুঝবেন তাঁরাই জানেন—মধ্যামাঠের ঐ বাঁহাতি একজন বিশুদ্ধ প্রতিভা। খাঁটি বিলেতি ভাষায় যাকে বলা যায়—এলিগেন্ট!

রণজিৎ বিশ্বাসের লেখনী সর্বসাধারণের জন্য বোধ্য না হলেও, যারা বুঝতেন তাঁরা জানেন, কি একখান সোনা ফলানো কলম ছিল তাঁর! তাঁর লেখনীজুড়ে শব্দের একটা আড়ম্বর থাকত। অথচ এমন সব দামী লেখাগুলো পত্রিকার কলাম ভরিয়ে, কোন তলানীতে যে হারিয়ে গেল!

প্রয়াত রণজিৎ বিশ্বাস! আপনার কলাম হারিয়ে গেলেও, আমরা জানি- আপনি কোন মাপের জিনিয়াস ছিলেন, আমাদের মধ্য থেকে হারাবেন না আপনি!

 

৭.    

সময়ের অসংখ্যা ও অগণিত ক্রিকেট লিখিয়ের কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব। কিন্তু এই ক্ষুদ্র পরিসরে সম্ভব নয় তা। আরেকদিন বা অন্যকোনো সময় নিশ্চয় আলোচিত হবেন তাঁরাও। তবে বিদায়ের আগে তিনটি নাম না বলে যাওয়া ঠিক সমীচীন বোধ হচ্ছে না।

সাইফুল্লাহ বিন আনোয়ার। অসম্ভব প্রতিভাধর এই তরুণ একজন বিশুদ্ধ প্রতিভা। পিওর জিনিয়াস। স্যার ব্র্যাডম্যান বা জর্জ হ্যাডলির মতোই অসম্ভব প্রতিভা। আমি তাঁকে পড়ি, এবং পড়ি, বারবার পড়ি। এখনো কোনো বই বের হয়নি তাঁর, কেন? কে জানে!

রিজওয়ান রহমান সাদিদ। বয়সে বেশ ক’বছরের ছোটো হবেন। অথচ লেখনীতে আশ্চর্য পরিণতবোধ! ক্রিকেট সাহিত্যের ক্ল্যাসিক্যাল ঘরানা যেন তাঁর হাতেই আরো প্রস্ফুটিত হতে চায় খুব। বাংলা ক্রিকেট সাহিত্যের উজ্জ্বলতর নক্ষত্র হয়ে উঠবেন হয়তো কোনো একদিন।

আর তৃতীয়জন, নাহিদ নেওয়াজ হৃদয়। পেশায় দন্ত-বিশেষজ্ঞ। ডেন্টিস্ট। কিন্তু ক্রিকেটের পরিসংখ্যান যেমন তাঁর নখদর্পনে, ‘ক্রিকেটক্লোপিডিয়া’ বললে অত্যুক্তি হবে না মোটেও। আশা করি, আমাদের পরের প্রজন্ম আক্ষেপ রাখবে না তাঁর ব্যাপারে, যেমনটা আমরা রাখি প্রয়াত রণজিৎ বিশ্বাসের ব্যাপারে।

 

৮.

আরো অনেক নাম বেরিয়ে আসতে চাইছে কী-বোর্ড ঠেলে। কিন্তু আজ আর নয়। অন্য কোনোদিন। ক্রিকেট মাঠে কত ঘটনার ছড়াছড়ি, কখনো মাঠের বাইরেও। দেখে আর কি ‘ছাই’ বোঝা যায়! লেখনীতে যেভাবে উঠে আসে ক্রিকেট, তেমনটা আর কোথায় পাওয়া যায়? সময় বয়ে যায়, প্রজন্ম হারায় প্রজন্মান্তরে, ক্রিকেট মাঠের শব্দকুশীলবরাও বিদায় নেন একে একে। একখানা গ্রন্থ প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম, কাল থেকে কালে যেভাবে ক্রিকেট টেনে নিয়ে যায়, যেভাবে একজন লেখককে বাঁচিয়ে রাখে, যেভাবে মুগ্ধ করে পাঠককে, তেমনটা আর সম্ভব কীসে?

প্রতিভাবান ক্রিকেট লিখিয়েরা যদি তা বুঝতেন! তাঁরা শুধু নিজেদেরই বঞ্চিত করেন না, উপাদেয় ক্রিকেট-পাঠ থেকে বঞ্চিত রাখেন আগ্রহী পাঠকসমাজকেও।  

সকল ক্রিকেট লিখিয়ে ও ক্রিকেট পাঠকদের প্রতি রইলো আন্তরিক শুভকামনা।

ক্রিকেট মাঠের সুনিপুণ বর্ণন

সুচারুশব্দের প্রয়োগে

অদেখা ক্রিকেটে জাগে শিহরণ

অদ্ভুত পাঠ-সুখ সংযোগে।

বুঝি শব্দরাজ্যের রাজাধিরাজ!

শব্দেরা নেহাৎ ভৃত্য

রাজার ডাকে শব্দের সাঁজ

সে এক সুন্দরতম চিত্র!

মুগ্ধতার সীমা-রেখা নেই

পাঠ-সুখ সুখ-পাঠ

মোহাগ্রস্থতার প্রমাণ এই-

রেখে যাই নিখাঁদ;

কিঞ্চিৎ শুধিবার প্রচেষ্টা

কত যে আছি ঋণী!

দেখি অপলক, ক্রিকেট-লেখা

তোমাতে মুগ্ধ, হে গুণী!