মাশরাফি বিন মর্তুজা : প্যারাসুটবিহীন উড়ন্ত এক ব্যক্তিত্ব
পোস্টটি ৩৮৯৬ বার পঠিত হয়েছেঅফ ষ্ট্যাম্পের বাইরের বল ডিফেন্স করতে গিয়ে ইনসুইংয়ে ব্যর্থ শেওয়াগ। পেছনে তাকিয়ে দেখলেন ষ্ট্যাম্পের মাথায় বেল নেই। হাত দুটো আকাশে তুলে পিচের উপর দৌঁড় দেওয়া ছেলেটার নাম মাশরাফি বিন মর্তুজা।আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের ষষ্ঠ জয় এলো এই মাশরাফির হাত ধরেই ঢাকার বঙ্গবন্ধু ষ্টেডিয়ামে। বলছিলাম ২০০৪ সালে ভারতের বিপক্ষে এবং নিজেদের মাঠে প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ জয়, ও তার নায়কের কথা। ২০০৫ সালে কার্ডিফে অষ্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ জয়ের জন্যে আশরাফুল কে বন্দনা দেওয়া হলেও, প্রথম ওভারে গিলক্রিষ্ট কে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলে অষ্ট্রেলিয়ার বুকে প্রথম কাঁপুনিটা এই মাশরাফি-ই ধরিয়ে দিয়েছিলো।
২০০৭ সাল। চমক সেই মাশরাফির কল্যাণেই। অফ ষ্ট্যাম্পের বাইরের বল ইনসুইং করে ভেতরে ঢুকছিলো, আর ফুটওয়ার্ক বিহীন স্কয়ার কাট খেলতে গিয়ে ব্যাট ইনসাইড এজে ষ্ট্যাম্প হারালেন শেওয়াগ। বাম পাশের গ্যালারী তে আঙুল উঁচিয়ে শুরু হয়ে গেলো বিশ্বকাপের সেই ট্রেডমার্ক সেলিব্রেশন। নিজ হাতে ৪ উইকেট নিয়ে একাই ভেঙে দেন ভারতের ব্যাটিং অর্ডার। ভারতের বিপক্ষে নিজেদের দ্বিতীয় জয়ে আবারো ম্যান অব দ্যা ম্যাচ মাশরাফি।
এই ম্যাচ জয়ের মাধ্যমে মধ্যরাতে যেমন গোটাজাতি আনন্দে ভেসেছিলো, ঠিক তেমনি ম্যাচ শুরুর আগে মাশরাফির প্রিয় বন্ধু আরেক ক্রিকেটার মানজারুল ইসলাম রানার মৃত্যুর সংবাদে শোকের ছায়া ড্রেসিংরুমে। কিন্তু, সেখান থেকেই শোক কে শক্তিতে পরিণত করে বাইশ গজে কলার উঁচিয়ে দৌঁড়ে গেলেন ভারতের বিপক্ষে মাশরাফি।
আশরাফুলের কাছ থেকে অধিনায়কত্ব নিয়ে ভার দেওয়া হলো সহ-অধিনায়ক মাশরাফির কাছে। কিন্তু, ওয়েষ্ট-ইন্ডিজের মাঠে প্রথম টেষ্টেই বোলিং করতে গিয়ে পিচের উপর পড়ে গিয়ে, চিরচেনা ইনজুরির সাথে সাক্ষাতে একটানা সাড়ে সাত মাস দলের বাইরে। এসেই দিলেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম জয়ের স্বাদ, তাও কিনা ইংল্যান্ডের মাটিতেই। ব্যাট এবং বল দুটোতেই সেদিন সক্রিয় ছিলেন ম্যাশ।
২০১০ সাল। যেই সিরিজে ইতিহাস গড়েছিলো বাংলাদেশ কিউইদের ৪-০ তে বাংলাওয়াশ করে। সেই সিরিজের প্রথম ম্যাচে আবারো পিচের উপর পড়ে গিয়ে ইনজুরি তে দলের বাইরে মাশরাফি। সবচাইতে কষ্টের সময়টা ২০১১। ঘরের মাঠের বিশ্বকাপে দলে জায়গা হলোনা। আক্ষেপটা ঝাড়লেন মিডিয়ার ক্যামেরার সামনে চোখের জলে।
মাঝে ক্যারিয়ারে নানা উত্থান-পতন চলছিলো। ২০১৪ সালে ঘরের মাঠে শ্রীলংকা সিরিজে, মুশফিকের অনুপস্থিতিতে দুই টি-২০ তে অধিনায়কত্ব করে ক্লোজ দুটো ম্যাচে পরাজিত হন। যদিও প্রথম ম্যাচে শেষ বলে বিজয়ের আউট হওয়া বল নিয়ে আছে নো-বলের বিতর্ক। এশিয়া কাপে দলের সাথে থাকলেও ভারতের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচের পর আবারো দলের বাইরে মাশরাফি। ২০১৪ তে এক দুর্বিষহ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলো দেশের ক্রিকেট। একের পর এক পরাজয়ে প্রায় ভেঙে পড়া বাংলাদেশ দলটার অধিনায়কত্বের ভার দেওয়া হয় মাশরাফির কাঁধে। ২০১৫ বিশ্বকাপের আগ মূহুর্তে ২০১৪ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শেষ সিরিজে অধিনায়কত্বের ভার নিয়ে, নিজের প্রথম এসাইনমেন্ট জিম্বাবুয়ে কে হোয়াইটওয়াশ করে দল কে চাঙ্গা করে তোলেন বিশ্বকাপের জন্য। তার নেতৃত্বে-ই রচিত হয় ২০১৫ বিশ্বকাপে এডিলেড কাব্য। প্রথমবারের মত বিশ্বকাপের কোয়ার্টারে পা রাখা।
দেশে ফিরে দলকে উপহার দিলেন একের পর এক সিরিজ জয়। এবার আর একা জিম্বাবুয়ে নয়। ভারত-পাকিস্তান-আফ্রিকা কেউ বাদ পড়েনি মাশরাফির শিকারী চোখ থেকে। ২০১৫ সালে খেলা সকল সিরিজে-ই জয় বাংলাদেশের। সে বছর-ই প্রথমবারের মত পেলো চ্যাম্পিয়ন'স ট্রফিতে খেলার নিশ্চয়তা।
২০১৬ তে এশিয়া কাপের ফাইনাল ছাড়া তেমন কোনো বড় কীর্তি রঙিন পোষাকে না থাকলেও, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মিরপুরে সিরিজ বাঁচানোর ম্যাচে একাই ৪ উইকেট আর ব্যাট হাতে এক অসাধারণ ইনিংসে ভেঙে দিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের কোমড়। ছোটো টার্গেটেও জেতা সম্ভব, এই বিশ্বাস সবার বুকে সঞ্চার করে দেন সবার প্রিয় ম্যাশ।
২০১৭ তে চ্যাম্পিয়ন'স ট্রফির সেমিফাইনাল। শ্রীলংকার বিপক্ষে সিরিজ ড্র। সব-ই মাশরাফির হাত ধরে। সেই সিরিজেই নিলেন আকষ্মিক টি-২০ থেকে বিদায়। টানলেন সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে ক্যারিয়ারের ইতি।
২০১৮ সাল। সুন্দর করে শুরু করলেও শ্রীলংকার কাছে মিরপুরে ফাইনালের ক্ষত রয়ে গেছে। আফগানদের কাছে টি-২০ সিরিজের পর, উইন্ডিজিদের মাটিতে যখন টেষ্ট সিরিজ হেরে জর্জরিত বাংলাদেশ, সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে দলকে তুলে এনে দিলেন সিরিজ জয়। নিজেও রাখলেন অসামান্য অবদান। এশিয়া কাপে পেয়েছেন ক্যাপ্টেন অফ দ্যা টূর্ণামেন্টের খেতাব।
২০১৯ বিশ্বকাপের প্রস্তুতিমূলক উইন্ডিজ-আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ত্রি-দেশীয় কাপে সপ্তমবারের মত ফাইনালের শিকল থেকে মুক্তি পেয়েছিলো বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথমবারের মত কোনো ফাইনালে জয়লাভ করে বাংলাদেশ।
মাশরাফির ক্যারিয়ারের সবচেয়ে কঠিন সময় সম্ভবত ইঞ্জুরির কবলে পড়ে দলের বাইরে থাকা সময়টুকু। দু-একবার নয়, সবমিলিয়ে মোট সাতটা অপারেশন নিয়েও তিনি দল কে সেবা দিয়ে গেছেন। লাল-সবুজের জার্সির জন্য বুক চিতিয়ে লড়ে গেছেন। একবারের জন্যেও থেমে যাননি, হতাশার মাঝেও নিজেকে মেলে ধরেছিলেন। নিজের নেতৃত্বগুণে তুলে এনেছেন বহু তরুণ ক্রিকেটার কে।
এত বড় ক্যারিয়ারে অর্জনের গল্পটা বেশীরভাগ কিন্তু অধিনায়কত্বের ভার ঘাড়ে আসার পরেই। দূর্ভাগ্যবশত সবচেয়ে বড় দুঃখের সময়টাও এই অধিনায়ক থাকাকালীন এসেছে। গোটা জাতি এবং খোদ ক্রিকেটারেরা যখন বিশ্বাসী ছিলেন, ২০১৯ বিশ্বকাপে সেমিতে খেলার ব্যাপারে, তখন-ই অধিনায়ক হিসেবে ব্যর্থ মাশরাফি। তার জৌলুসহীন বোলিং ও অধিনায়কত্ব ভুগিয়েছে বাংলাদেশ কে শেষ বিশ্বকাপে। তখন থেকেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে মাশরাফির দলে থাকা নিয়ে। বিশ্বকাপের পর আর খেলা হয়নি লাল-সবুজ জার্সি গায়ে। জিম্বাবুয়ে সিরিজেই হতে যাচ্ছে অধিনায়কত্বের ইতি যা আগেই জানিয়েছিলো বিসিবি।
বাংলাদেশ ক্রিকেটে মাশরাফি এমন একটা নাম যে কিনা প্যারাসুট বিহীন উড়ে বেড়ায় আকাশের বুকে। ক্যারিয়ার শেষে ৩৫০-৪০০ উইকেট নয়। সুস্থতা কামনা করি ক্রিকেট মাঠের যোদ্ধা অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার।
এত অর্জনের ভেতরেও ক্যারিয়ারে কিছু বাজে সময়ও ছিলো। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শেষ ওভারে ১৭ রান দিয়ে বাংলাদেশের ম্যাচ হারার পেছনে সবচাইতে বড় অবদান রেখে খলনায়ক হয়ে গিয়েছিলেন মাশরাফি। আইপিএলে শেষ ওভারে ২৬ দিয়ে আরেকবার খলনায়ক হয়েছিলেন মাশরাফি।
কিন্তু, ভুল গেলে চলবে না এই মাশরাফি-ই ২০০৬-০৭ সেশনের ক্রিকেট বিশ্বে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী। ক্যারিয়ার শেষে পরিসংখ্যান কে মুখ্য না ভেবে এই ভাঙাচোরা ফিটনেস টাকে নিয়ে আরো কিছুদিন দৌঁড়ে যাক মাশরাফি বাংলাদেশের জন্যে।
- 0 মন্তব্য