• ক্রিকেট

দিকভ্রষ্ট দ্বীপরাষ্ট্র

পোস্টটি ৫৯৩১ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

IMG_20200720_222556_041

শ্রীলঙ্কা, দ্বীপ বেষ্টিত অনন্য সুন্দর একটি দেশ।অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঠাসা সুন্দর এই দেশটি একসময় গৃহযুদ্ধের দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল।ক্রমশ দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠলে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মত জেগে ওঠে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট।১৯৮১ সালে অষ্টম দেশ হিসেবে টেস্ট স্ট্যাটাস লাভ করে শ্রীলঙ্কা।এরপর থেকে শুধুই এগিয়ে যাওয়ার পালা।

বিশ্ব ক্রিকেটকে একের পর এক সেরা ক্রিকেটার উপহার দিতে থাকে শ্রীলঙ্কা।প্ৰথম যে দু'জন ক্রিকেটার নজর কাড়ে তারা হল রয় ডায়াস আর দুলিপ মেন্ডিস।রয় ডায়াস প্রথম শ্রীলঙ্কান হিসেবে টেস্টে ১০০০ রান সংগ্রহকারী।হালকা পাতলা গড়নের এই ডানহাতি স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান শৈল্পিক ভঙ্গিতে ব্যাট করে সবার নজর আসে।অন্যদিকে মেন্ডিস ছিল ডায়াসের বিপরীত।মোটাসোটা চেহারার মেন্ডিস পাওয়ার ব্যাটিং দিয়ে ভারত-পাকিস্তানকে কাঁদিয়ে ছেড়েছে।১৯৮৪সালে লর্ডসে তার বিস্ফোরক ইনিংসটি অনেক ক্রিকেরপ্রেমীর হৃদয় জিতে নিয়েছিল।সেরা ইনিংসগুলো সে ভারতের জন্য জমিয়ে রাখত।১৯৮২ সালে মাদ্রাজ(বর্তমান চেন্নাই) টেস্টের উভয় ইনিংসে শতরান করে প্রথম শ্রীলঙ্কান হিসেবে টেস্টের উভয় ইনিংসে শতরান করার কৃতিত্ব অর্জন করে।আর ১৯৮৫ সালে ক্যান্ডি টেস্টে ভারতের বিরুদ্ধে সেই ম্যাচ বাঁচানো শতরান বিখ্যাত হয়ে আছে শ্রীলঙ্কার প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ের ইনিংস হিসেবে।সেই সিরিজ জয়টা কতটা আবেগঘন ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।ক্রিকেটারদের কাছে সেই জয় ছিল বিশেষ কিছু,যা শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটকে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসার টনিক হিসেবে কাজ করেছিল।মেন্ডিসের ইনিংসের উপর ভর করে সেদিনের সেই জয় অর্জুনা রানাতুঙ্গা,অরবিন্দ ডি-সিলভাদের লড়াই করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছিল।তাইতো ডায়াস-মেন্ডিস শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের প্রথম ব্যাটিং আইকন হিসেবে আজও স্মরণীয়।

ডায়াস-মেন্ডিসদের পরবর্তী প্রজন্মের ক্রিকেটার হিসেবে যে দুজন সবচেয়ে বেশি চর্চিত ছিল তারা হল অর্জুনা রানাতুঙ্গা আর অরবিন্দ ডি সিলভা। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট থেকেই তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দিয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রকৃতিগত শক্তি অর্জুনাকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছিল।মাঠে তার সাবলীল পদচারণা দেখে মনে হত ক্রিকেট যেন তার শরীরের প্রতিটি কোষে মিশে আছে।ফিটনেস নামক বস্তুটিকে পাত্তা না দিয়ে দীর্ঘ ১৮ বৎসর আন্তর্জাতিক স্তরে সাফল্যের সাথে খেলে যাওয়া কোন মামুলি ব্যাপার না।আর এই ১৮ বছরের মধ্যে আবার ১১বছর শ্রীলঙ্কা দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন।শ্রীলঙ্কাকে অতি সাধারণ দল থেকে অসাধারণ দলে পরিণত করার পেছনে ছিল অর্জুনার ক্ষুরধার মস্তিষ্ক।সেইসাথে তার তরুণ বয়সে পরিণত মস্তিকের ব্যাটিংও ছিল দলের সাফল্যের অন্যতম স্তম্ভ।সে তার নেতৃত্ব গুন দিয়ে শ্রীলঙ্কাকে একটি দল হিসেবে খেলতে শিখিয়েছিল।তার অভিনব অধিনায়কত্ব বিশ্ব ক্রিকেটে নতুন ধারণার জন্ম দিয়েছিল।ওয়ানডে ম্যাচের প্রথম ১৫ ওভারে ফিল্ডিংয়ের বিধিনিষেধকে ব্যবহার করে সর্বোচ্চ রান তুলে নেয়ার কৌশলটি ছিল অর্জুনার মস্তিষ্ক প্রসূত।সনৎ জয়সুরিয়ার আর রুমেশ কালুভিথরানাকে দিয়ে ওপেন করিয়ে সারা বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল।সেসময় প্রথম ১৫ ওভারে ৫০/৬০ তুলতে পারলে যেকোন দল তুষ্ট থাকত।কিন্তু তার এই কৌশলটি কাজে লাগিয়ে শ্রীলঙ্কা অনায়াসে তিন শতাধিক রান তাড়া করতে সক্ষম হয়।আজকের T20 যুগে ওয়ানডেতে সাড়ে তিনশ রানও নিরাপদ নয় কিন্তু তখন আড়াইশ রান প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল।অর্জুনার ওই সিদ্ধান্ত প্রতিপক্ষদের এতটাই ভড়কে দিয়েছিল যে অপ্রত্যাশিতভাবে শ্রীলঙ্কা ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ জিতে নেয়।তার প্রথম ১৫ ওভারে মারকুটে ব্যাটিং কৌশল ওয়ানডে ম্যাচে নিয়ে আসে নতুন আমেজ যা আজও বলবৎ আছে।

অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গার হাত ধরে এক এক করে প্রতিভা উঠে আসতে থাকে।রবি রত্নায়েক, রুমেশ রত্নায়েক শ্রীলঙ্কার প্রথম দিকের জোরে বোলার।নামের পদবিতে মিল থাকলেও তারা কিন্তু সহোদর না।রবি বেশ গতিতে বল করত আর রুমেশের হাতে ছিল দারুণ আউট সুইং।আশান্তা ডি মেল,ব্রেনডেন কুরুপ্পু বেশকিছু দিন সাফল্যের সাথে খেলে গিয়েছে।শুরুর দিকে সেরকম বড় তারকা না থাকলেও ব্যাটিংয়ে আসঙ্ক গুরুসিংহা পরবর্তীতে রোশান মহানামার মত খেলোয়াড় দারুন কিছু ইনিংস উপহার দেয়।সেই সময় অপেক্ষা দ্বীপরাষ্ট্রটি অপেক্ষায় ছিল একজন কিংবদন্তি ব্যাটসম্যানের যে একাই ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে।সেই অপেক্ষা পূরণ হয় অরবিন্দ ডি সিলভার আগমনের মধ্য দিয়ে।একজন জাত ব্যাটসম্যান বলতে যা বোঝায় অরবিন্দ ছিল একদম তাই। নিখাদ প্রতিভা ছিল তার। সব ধরনের বোলিংয়ের বিরুদ্ধে স্বচ্ছন্দে ব্যাট করার দারুণ ক্ষমতা ছিল তাই প্রতিপক্ষের কাছে তার উইকেটটা ছিল বিশেষ কিছু।তবে খেলোয়াড়ি জীবনের শুরুর দিকে রান করতে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছিল তার।মাত্র ১৮ বছর বয়সে অরবিন্দ ডি সিলভার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ক্রিকেটের সূতিকাগার হিসেবে খ্যাত লর্ডসে টেস্ট অভিষেক ঘটে।কিশোর বয়সের ব্যাটসম্যান হিসেবে অল্প কিন্তু দ্রুত রান তোলার জন্য পরিচিত ছিল।যাহোক,সময়ের সাথে সাথে তার ব্যাটিয়ে পরিপক্কতা আসে।ক্রমশঃ সে বিশ্ব ক্রিকেটে কিংবদন্তী হয়ে ওঠে।১৯৯৬ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ভারতের মাটিতে ভারতের বিরুদ্ধে দল যখন চাপে তখন ৪৭ বলে ৬৬ রান ছিল ম্যাচজয়ী ইনিংস।আর ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে তো একাই হারিয়ে দিয়েছিল অরবিন্দ।প্রথমে বল হাতে তিন উইকেট সাথে দুটি ক্যাচ।আর ব্যাট হাতে তার অপরাজিত ১০৭ রান শ্রীলঙ্কাকে বিশ্বকাপ পাইয়ে দেয়।পরবর্তীতে ফাইনালে তার শতরান একদিনের ক্রিকেটে অষ্টম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটিং পারফরমেন্স হিসেবে উইজডেনের স্বীকৃতি পায়।

সঠিক প্রতিভা তুলে আনার বিশেষ গুন ছিল অর্জুনার।তাইতো শ্রীলঙ্কার সোনালী যুগের অধিকাংশ সেরা খেলোয়াড় তার ছায়ায় বেড়ে ওঠে।মারভান আতাপাত্তু,হাসান তিলেরত্নে,থিলান সমারাবীরা,তিলকরত্নে দিলশান,সনৎ জয়সুরিয়ার,মুত্তিয়া মুরালিধরন,মহেলা জয়াবর্ধনে,চামিন্দা ভাস এদের সবার অভিষেক ঘটে অর্জুনার অধিনায়কত্বে।এক ঝাঁক প্রতিভাবান খেলোয়াড় শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটকে নিয়ে যেতে থাকে সোনালী যুগে।মূলত ১৯৯০র দশকের শুরু থেকে শ্রীলঙ্কা দেশের মাটিতে আধিপত্য বিস্তার করে খেলতে শুরু করে।তারই ধারাবাহিকতায় সবচেয়ে বড় সাফল্য ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ জয়।এরপর থেকে বিশ্ব ক্রিকেটের বড় শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয় একসময়ের ক্ষীণ শক্তির শ্রীলঙ্কা। ব্যাটিং বরাবরই শক্তিশালী ছিল।ক্রমশঃ কিছু বিশ্বমানের বোলার উঠে আসায় শ্রীলঙ্কা আরও বেশি ম্যাচ জিততে থাকে।ফাস্ট বোলিংয়ে চামিন্দা ভাস টেস্ট,ওয়ানডে উভয়ক্ষেত্রে সমানতালে উইকেট নিতে পটু ছিল।আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাড়ে সাতশরও বেশি উইকেট রয়েছে তার দখলে।তাকে যোগ্য সহযোগিতা করে গিয়েছে নুয়ান জয়সা,দিলহারা ফার্নান্ডোজ,পারভেজ মাহরুফরা।১৯৯২ সালে মুথাইয়া মুরালিধরন অভিষেক হওয়ার পর থেকে শ্রীলঙ্কার বোলিং ভয়ঙ্কর রূপ নেয় বিশেষ করে উপমহাদেশের পিচে।তার বিষাক্ত স্পিনের ছোবলে বিশ্বের সেরা সেরা ব্যাটসম্যান কুপোকাত হতে থাকে। সম্পূর্ণ বোলিংয়ের ভার তার নিজের কাঁধে নিয়ে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটকে সোনালী জগতের মধ্যগগনে পৌঁছে দেয় মুরালিধরন।

অর্জুনার অবসরের সাময়িকভাবে অগ্রযাত্রা কিছুটা ব্যাহত হলেও পরবর্তী অধিনায়করা সামলে নিয়ে শ্রীলঙ্কার সোনালী দৌড় অব্যাহত রাখে।অরবিন্দ ডি সিলভা,হাসান তিলকরত্নে এদের অবসরের পরবর্তী সময়ে শ্রীলঙ্কার ব্যাটিং শক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কুমারা সাঙ্গাকারার মত আরেক বিরল প্রতিভা সেই ক্ষতি  দ্রুতই পুষিয়ে দেয়।অরবিন্দ,জয়সুরিয়া পরবর্তী যুগে দিলশান,জয়াবর্ধনে,সাঙ্গাকারা ব্যাটিংয়ে মূল ভরসা হয়ে ওঠে।অলরাউন্ডার এঞ্জেলা ম্যাথুস ব্যাটে বলে দলে ভারসাম্য এনে দেয়।আর লাথিস মালিঙ্গার ইয়র্কার ব্যাটসম্যানদের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়।এই সময়ের মধ্যে ২০০৭ ও ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের পরপর দুইবার রানার্সআপ এবং ২০০৯ সালের T20 বিশ্বকাপেও রানার্সআপ হয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে তাদের প্রভাব বজায় রাখে।এছাড়া ২০০২ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভারতের সাথে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হয়।১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ পরবর্তী বড় সাফল্য ২০১৪ সালের T20 বিশ্বকাপ জয়।

সময় পেরিয়েছে অনেক।২০১৪ সালের বিশ্বকাপ T20 ফাইনালে পরাক্রমশালী ভারতকে হারিয়ে শিরোপা জয়ের পর বহমান নদীর ন্যায় অনেক জল বয়ে গেছে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটে।সেই লঙ্কাকাণ্ডের নায়করা এক এক করে বিদায় নিয়েছে ক্রিকেটের বাইশ গজ থেকে।এখনও মনে পড়ে সে সময়টা শ্রীলঙ্কার দুই ব্যাটিং মেরুদণ্ড সাঙ্গাকারা-জয়বর্ধনের কথা।আর ইনিংসের শুরুতে তিলকরত্নে দিলশানের সাহসী সব শট আজও চোখের সামনে ভাসে।তার উদ্ভাবিত সেই “দিলস্কুপ” হয়ে উঠল ক্রিকেটের সর্বাপেক্ষা উপভোগ্য শট।আরও পেছনের দিকে নজর দিলে অর্জুনা,অরবিন্দ ছাড়াও রোশন মহানামা,মারভান আতাপাত্তুর মত কেতাবী ঢংয়ে খেলা ব্যাটসম্যানদের শৈল্পিক ইনিংসগুলো ভোলার নয়।বোলিংয়ে চামিন্ডা ভাসের বাঁ হাতের দুর্ধর্ষ আউট সুইং আর রিভার্স সুইংয়ের যাদুতে বিশ্বের সেরা সেরা ব্যাটসম্যান কুপোকাত হয়েছে।

বর্তমান শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ১৯৯৬ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন  শ্রীলঙ্কার তুলনা তো করার কথা ভাবই যায় না। ২০০৭,২০১১ সালের বিশ্বকাপ রানারআপ হওয়া দলের সাথেও আজকের শ্রীলঙ্কা তুলনার যোগ্য না।এমনকি ২০১৪ সালের T20 বিশ্বকাপ জয়ী দলের সাথে ২০২০ সালের শ্রীলঙ্কাকে মাপা যায় না।সেইসব স্মৃতি রোমন্থন করতে গেলে মনে হবে সাজানো চিত্রনাট্য, মনে হবে অতীতের দেয়ালে বাঁধানো কিছু ছবি ছাড়া আর কিছুই না।ক্রিকেটে সোনালী দিন হারিয়েছে ১৯৯৬ সালের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা।সেই সঙ্গে সমর্থকরা হারিয়েছে দারুণ একটি দল।বর্তমান শ্রীলঙ্কা তাদের অতীত ক্রিকেটীয় সাফল্যের চূড়া থেকে টেনে নামিয়েছে চোরাবালিতে। সেই চোরাবালি থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য শক্তিশালী,ব্যক্তিত্ববান ক্রিকেটারকে খুঁজে ফিরছে।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদর্পনের পর থেকে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট শুধু সামনের দিকেই এগিয়েছে।এখনকার দলের মত দুর্বল শ্রীলঙ্কাকে আগে দেখা যায়নি।আসলে সব দলেরই সাফল্যের চুড়ায় নিয়ে যাওয়া খেলোয়াড়রা অবসর নিয়ে নিলে একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়।কিংবদন্তি এইসব খেলোয়াড়দের শূন্যতা পূরণ করাও খুব সহজ ব্যাপার নয়। একটা সময় ছিল যখন প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের লম্বা লাইন লেগে গিয়েছিল।রানাতুঙ্গা থেকে সাঙ্গাকারা,অরবিন্দ থেকে মহেলা একের পর এক কিংবদন্তি ক্রিকেটার উঠে এসেছিল।যারফলে প্রতিভার শূন্যতা চোখে পড়েনি বিগত দিনগুলোতে।কিন্তু জয়াবর্ধনে-সাঙ্গাকারার পর বিশেষ প্রতিভা আর উঠে আসেনি যার উপর নির্ভর করে শ্রীলঙ্কা এগিয়ে যাবে।মুরলিথরণ অবসর নেওয়ার পর রঙ্গনা হেরাথ স্পিন বিভাগে অনেকটাই অভাব মিটিয়েছে।রহস্য যতদিন দুর্ভেদ্য ছিল অজন্তা মেন্ডিসও হেরাথকে যোগ্য সহায়তা করে গিয়েছে।কিন্তু যে ব্যাটিংটা বরাবরই লঙ্কানদের শক্তির জায়গা।সেখানে জয়বর্ধনেদের অভাব পূরণ হয়নি।এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কায় সেভাবে ক্রিকেটার তৈরি হচ্ছে না। আর যেসব ক্রিকেটার উঠে আসছে তাদের মান সন্তোষজনক নয়।গত কয়েকবছরে দীনেশ চান্ডিমাল বা কুশল মেন্ডিস ছাড়া ভরসা করার মত কাউকে উঠে আসতে দেখা যায়নি।ব্যাট আর গ্লাভস হাতে দীনেশ চান্ডিমালকে পরবর্তী সাঙ্গাকারা হিসেবে ভাবা হত।কিন্তু ধারাবাহিকভাবে রান করার ক্ষেত্রে আজও অনেক পেছনে।কুশল মেন্ডিসের  ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।তাই ব্যাটিংয়ের সমস্ত ভার আজও এঞ্জেলা ম্যাথিউসের কাঁধেই।ব্যাটিংয়ের ন্যায় জোরে বোলিংও আজ মেধাহীন হয়ে পড়েছে।ইয়র্কার সম্রাট লাথিস মালিঙ্গার পরবর্তী প্রজন্মের ফাস্টবোলাররা তেমনভাবে জ্বলে উঠতে পারেনি।তাই টেস্ট থেকে অবসর নিলেও সীমিত ওভারের ক্রিকেটে এখনও মালিঙ্গাই ভরসা।ভাসের মতো সুইং না থাকলেও মালিঙ্গা আজও কিন্তু কিংবদন্তী।তাকে কিংবদন্তী করে তুলেছে তার মারাত্মক অস্ত্র ইয়র্কার।ক্রিকেট বিশ্বকে চোখে আঙুল দিয়ে মালিঙ্গা দেখিয়েছিল যে ইয়র্কার নামক বস্তুটিকেও নিখুঁত অধ্যবসায়ের মাধ্যমে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

কত কিংবদন্তী খেলোয়াড় খেলে গেছেন ওই নীল-হলুদ জার্সি গায়ে।কিন্তু আজ সেই জার্সিকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়ার মত ক্রিকেটারের বড্ড অভাব দেখা দিয়েছে দ্বীপরাষ্ট্রটিতে।এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কায় সেভাবে ক্রিকেটার তৈরি হচ্ছে না। এর আসল কারণ দক্ষতাসম্পন্ন কোচের অভাব। একজন ভাল ক্রিকেটার মানেই যে সে ভাল কোচ হবে, এই ধারণা সঠিক নয়।আবার অধিক বেতনের বিদেশী কোচ নিলেই যে রাতারাতি দলের চেহারা পাল্টে যাবে এমন কোন কথা নেই। তারকা কোচ ছাড়াই শ্রীলঙ্কা থেকে আগে কিন্তু অসাধারণ ক্রিকেটার উঠে এসেছে।যেমন মাইকেল থিসেরা, অনুরা তেনেকুন, দিলীপ মেন্ডিস, রয় ডায়াস, সনৎ জয়সূর্য, অরবিন্দ ডি’সিলভারা।এরা সকলেই কিন্তু উঠে এসেছে স্কুল, কলেজ ক্রিকেট থেকে।অতীতে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটার উঠে আসত এই স্কুল–কলেজ থেকে।স্কুল–কলেজগুলোতে দেশীয় কোচ দিয়ে খুব ভাল কোচিং হত এছাড়াও ইংল্যান্ড,অস্ট্রেলিয়া থেকে বিশেষজ্ঞ কোচ আসত।যদিও এই কোচ আনার ব্যাপারে সেসময়ে নামের দিকে নজর না দিয়ে তার সক্ষমতাকে প্রাধান্য দেয়া হত।ফলস্বরূপ ভাল মানের ক্রিকেটার পেয়েছে।আর এখন শ্রীলঙ্কা নামী দামী কোচের পেছনে ছুটছে।ফলে শুধুই অর্থের অপচয় হচ্ছে।কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না।সেভাবে ভাল ক্রিকেটার উঠে আসছে না।প্রকৃত ভাল মানের ক্রিকেটার তুলে নিয়ে আসতে গেলে শ্রীলঙ্কাকে আবার কোচিংয়ের পুরনো প্রথায় ফিরে যেতে হবে।অযথাই নামকরা কোচদের পিছনে না ছুটে স্কুল ক্রিকেটকে শক্তিশালী করে তুললে ভাল ক্রিকেটার খুঁজে পাওয়া সম্ভব।তৃণমূল পর্যায়ে ভাল কোচিংয়ের ব্যবস্থা না হলে ক্রিকেটার উঠে আসবে না।১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ জয়ের আগ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার কোচ ডেভ হোয়াটমোর কিন্তু অখ্যাতই ছিল।খ্যাতি না থাকলেও তার সঠিক পন্থার কোচিং শ্রীলঙ্কাকে ক্রিকেটের অন্যতম পরাশক্তিতে পরিণত করে।আজকের শ্রীলঙ্কার জন্য আবারও হোয়াটমোরের মত নামী বা দামী নয় অথচ খুবই কার্যকরী এমন একজন কোচের খুবই প্রয়োজন যে প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের আন্তর্জাতিক স্তরে সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঠিক শিক্ষাটা দিতে পারে।

শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট এখন খুব কঠিন সময় পার করছে।সোনালী সময় পেরিয়ে দ্বীপরাষ্ট্রটি এখন গভীর সাগরে দিকভ্রষ্ট জাহাজের মত পথ খুঁজে ফিরছে।সমর্থক, নীতিনির্ধারক ও ক্রিকেটার - সবাই এখন সঠিক পথের দিশা পেতে তীর্থের কাক হয়ে বসে আছে।এই কঠিন পরিস্থিতিতে সবাইকে একসঙ্গে হয়েই এই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য দলের পাশে সমর্থকদের অবশ্যই থাকতে হবে।কারন সমর্থক খেলোয়াড়দের ভাল খেলতে অনুপ্রাণিত করে। নীতিনির্ধারক যারা আছেন, তাদেরকে তাদের কাজটা সৎভাবে করতে হবে।এমনিতেই কয়েকবছর যাবৎ শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।তাই সাফল্যের ধারায় ফিরতে হলে মাঠের বাইরের যাবতীয় অনৈতিক কর্মকান্ড কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।এক্ষেত্রে ক্রিকেট বোর্ড ও নীতিনির্ধারকদের সততা, দূরদর্শিতা প্রমাণ করাটা খুব জরুরি।ক্রিকেটার থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারক সবাইকে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের সোনালী অতীত থেকে অনুপ্রাণিত হতে হবে।

এই দলটি তার সোনালী সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে খেলে ক্রিকেটপ্রেমীদের অনেক আনন্দ দিয়েছে।কিন্তু বর্তমানে অল্পবিস্তর যা সাফল্য তা শুধুই দেশের মাটিতে।এই পরিস্থিতিতে খেলোয়াড়দের ভীত না হয়ে সাহসের সঙ্গে সুদিন ফেরানোর চেষ্টা করাই উত্তম।বর্তমান দল নিয়ে দ্বীপবাসীর প্রত্যাশাও পরিমিত।এ মুহূর্তে কেউই আশা করে না যে এই দল বিদেশের মাঠিতে টেস্ট জিতবে কিংবা ওয়ানডে ক্রিকেট রাঙ্কিংয়ে শীর্ষে উঠে আসবে।শ্রীলঙ্কার হারানোর মত সম্পদ আর অবশিষ্ট নেই।তাই তারা নির্দ্বিধায় ভয়-ডরহীন ক্রিকেট দিয়ে লড়াই করে পুরনো খ্যাতি পুনরুদ্ধারের সামর্থ্য রাখে।ইতিবাচক অভিপ্রায় নিয়ে ক্রিকেটাররা যদি প্রত্যাশানুযায়ী নির্বিঘ্নে খেলে নিজেদের মেলে ধরতে পারে তবে সমর্থকদের জন্য অন্তত এমন একটি দল হিসেবে গড়ে উঠবে যারা উপভোগ্য ক্রিকেট খেলতে সক্ষম হবে।

 

Image courtesy : shutterstock.com