• ক্রিকেট

ক্রিকেট-কাননে অমলিন ধোনীর সৌরভ-সুবাস ও রঙ

পোস্টটি ২৩০১ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

কোনো পুষ্প-বৃষ্টি নয়। ফুলেল সম্ভাষণ নয়। আবেগ, আদিখ্যেতা, আতিশয্যের বাড়াবাড়ি নেই। লোকের হুল্লোড় নেই। আবেগঘন স্মৃতিচারণা নেই। হলভর্তি সাংবাদিক নেই, প্রশ্নবান নেই, স্তুতিগাথা নেই। জলে চিকমিকি চোখ, রুমাল দিয়ে মুছে নেয়া অশ্রু, ধরে আসা কন্ঠস্বর; নেই, কিচ্ছু নেই। উষ্ণ উদযাপনের বিদায় মঞ্চ অনুপস্থিত। সুযোগই দেয়া হয়নি। বিশ্বক্রিকেটের অন্যতম প্রভাবশালী এক চরিত্র বিদায় বললেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। আচমকা, অভিনব, আচানক, অকস্মাৎ।
যেন যোগীন্দর শর্মার হাতে তুলে দেয়া শেষ ওভার, যেন চমকে দেয়া ফিল্ড সেটিং, যেন তার খুব পরিচিত সেই পরিকল্পিত ও ক্যালকুলেটিভ ব্যাটিং।
ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান, জনতার অন্যতম প্রিয় চরিত্র- মাহেন্দ্র সিং ধোনী, বিদায়ের ‘মাহেন্দ্রক্ষণ’ এ আয়োজন করে বিদায় জানানোর কোনো সুযোগই দিলেন না। একটা পোস্ট, স্রেফ একটা পোস্টেই বললেন- বিদায়!
*****

যে কিশোর খেলার মাঠে থাকেন ‘দুধভাত’, না পায় বোলিং, ব্যাটিংয়ে সুযোগ মেলে সকলের শেষে কদাচিৎ, ফিল্ডিংয়ের অবস্থান মাঠের সবচেয়ে অগুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। তার জন্য ধোনী হতে পারেন উদ্দীপনার অন্য নাম। যে তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়ে রিটেকের গ্যাঁড়াকলে হাবুডুবু খায়, হাতখরচা জোটাতে হিমশিম খায়, বন্ধুদের আড্ডা সরগরমে অপটু। ধোনী-চরিত্র তার জন্য উৎসাহব্যঞ্জক হতে পারে। যে যুবকের চাকরি জোটে না, হতাশার অতল গভীরে যার বসবাস, ধোনী তার জন্য হতে পারেন ভেঙ্গে না পড়ার উদাহারণ। প্রমোশন-হীন, কাজের চাপে পিষ্ট কর্তার জন্য ধোনী হবেন শত-চাপে হাল না ছাড়ার উপমা।
হতাশাগ্রস্থ বা জীবনের তরে আশাহীন যে কারো জন্য ধোনী হবেন অন্তহীন অনুপ্রেরণা। ঝাড়খন্ডের ছোট্ট শহর হতে উঠে এসে বিশ্বক্রিকেটের সম্রাট বনে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। সুযোগের সদ্ব্যবহার ও মগজের সুচতুর ব্যবহারে সাধারণ কেউ কতটা অসাধারণ হতে পারে, যেন তার আদর্শ উপমা তিনি।

তুমি যদি দক্ষ হও, উপরে উঠার তাড়না অনুভব করো, ঘটে যদি থাকে বুদ্ধি, সেই বুদ্ধির চাতুর্যময় ব্যবহার যদি জানো, বরফ-শীতল মস্তিষ্কে পরিস্থিতি সামাল দিতে যদি হও পটু, আর নিজের উপর যদি থাকে অগাধ আস্থা– পৃথিবীর কেউ তোমার তরতর করে এগিয়ে যাওয়া আটকাতে পারবে না। সফলতা তোমার চরণে চুমু খাবে, সৌভাগ্য তোমার কোলে লুটোপুটি খেলবে আহ্লাদে। পৃথিবী তোমার বশ মানবে। তুমি হবে সম্রাট। তুমি হবে ক্ষমতাবান। তুমি হবে ম্যাজিশিয়ান। যেখানে হাত দেবে সোনা ফলাবে তুমি।
এমএস ধোনী সোনা ফলাতেন।
*****

দুটো ইনিংস, ১৪৮ ও ১৮৩; বিশাখাপত্তম ও জয়পুর, নিজের সক্ষমতার উজ্জ্বলতম উপস্থাপনা ছিল যেখানে। তারপর ভারতের মিডল অর্ডারে জমাট-ভরসা হয়ে থিতু হওয়া। ঝড়ের গতিতে চলে তার মস্তিষ্ক, বুঝি কোনো ক্যালকুলেটর রাখা আছে মগজে। আস্কিং রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যাট ও মগজ চলে তার। নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় অনায়াস ঢঙ্গে ম্যাচ পুরেন পকেটে। তিনি হয়ে উঠেন ইন্ডিয়ান ক্রিকেটের নির্ভরতা, হয়ে উঠেন ভবিষ্যৎ। হয়ে উঠেন ইন্ডিয়া’স মোস্ট ডিজায়ারেবল। এলিজিবল ব্যাচেলর লিস্টে উপরের দিকে থাকে তার নাম। ঝাড়খন্ডের ঝাঁকড়া চুলের তরুণ জয় করে নেন গোটা ভারত, এবং বিশ্বক্রিকেটেরও মনযোগও কেড়ে নেন অকপট।
তারপর তার জীবনে এলো দুঃস্বপ্নের মতো এক উইন্ডিজ সফর। ঢিল পড়ল ঘরে, পুড়লো ছবি। বাইরে বেরোনোও হয়ে উঠল বিপজ্জনক।
কে জানত, সেটা ছিল উপন্যাসের মাঝের ক’টা পাতা মাত্র। যা ভুলে যেতে হয় বা তড়িঘড়ি করে পড়ে যেতে হয়। কয়েক পাতা পরই উপন্যাসের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অধ্যায়। ভারতীয় ক্রিকেটের গতিপথ তো বটেই, বিশ্বক্রিকেটের ঢিমেতালে এগোনোটাতে এক তুড়িতে তড়িৎ গতি সঞ্চার করে। পাল্টে যায় সব। ক্রিকেট, ইন্ডিয়ান ক্রিকেট এবং মাহেন্দ্র সিং ধোনী।
*****

সৌভাগ্যের পরশ পাথর ছিল কিনা জানা নেই। তবে সৌভাগ্যকে বশ করার মন্ত্র জানা ছিল তার। তিনি জানতেন, সৌভাগ্য সহজে ধরা দেয় না। সাহসী হতে হয়, ঝুঁকি নিতে হয়, ভয় পাওয়া চলে না। তিনি নির্ভীক ও সাহসী ছিলেন, ঝুঁকি নিতেন। সৌভাগ্য তাই তার কোলে বসে আদর খেতো। যোগীন্দর শর্মা তাকে কুড়ি-কুড়ি ট্রফি এনে দেন, রবি অশ্বিন তাকে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি এনে দেন, তিনি নিজে ‘ইনফর্ম’ যুবরাজকে পাঁচে ঠেলে উঠে আসেন চার-এ। বিশ্বকাপ-কে তিনি সম্মোহন করেন কোনো এক জাদুবলে। তার সাহস, তার সিদ্ধান্ত, তার কৌশল; বরাবরই কেমন যেন! চমকে দেয়, অবাক করে, মুগ্ধতা বিলায়।
দেড় দশকের ক্যারিয়ারে তিনি যখন চল্লিশের দুয়ারে কড়া নাড়ছেন, তখনো শতকোটি চোখ তার দিকে তাকিয়ে স্বপ্নমগ্ন। এই ভদ্রলোকই পারবেন। অসম্ভবকে সম্ভব করবেন। শেষবেলায় আরো একবার রাঙিয়ে যাবেন বিশ্বকাপ ও ভারতের ক্রিকেট আঙিনা।
সেই সময় হয়তো কারো মনে ফিরে আসছিল ক্যারিবিয়ান ভূখন্ডে শ্রীলংকার বিপক্ষে জয়টা, অথবা আইপিএলের কোনো এক ম্যাচে ৩ বলে ১৬ রান- চার, ছয়, ছয়; অবিশ্বাস্য দক্ষতায় বের করে আনা ম্যাচটা। এমন আরো কত কত ম্যাচ। গুগল-ইউটিউবে সার্চ দিলেই দেখা মেলে ভুরিভুরি রেজাল্ট।
সেদিনও ক্রিকেটে মগ্ন শতকোটি জনতার স্বপ্ন-দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল তার পানে। দেড়যুগ ধরে যেমন বয়ে নিয়েছেন প্রত্যাশার ভার নিরুদ্বেগ ও নিঃসীম দৃঢ়তায়, তেমনি শান্ত ও আত্মপ্রত্যয়ী তিনি। কিন্তু গাপটিলের থ্রো সমস্ত রোমাঞ্চ ও উত্তেজনায় ঢেলে দিল পানি। বয়সটাকে চালশে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তবুও দৌড়ান সেই পঁচিশের মতো। হয়তো কোথাও শরীরের কলকব্জা ঠিক সায় দেয়নি মনের মতো। অথবা গাপটিলই ছিলেন অতিমাত্রায় অসাধারণ। নির্ভুল, ইঞ্চি-মাপা থ্রো। ক’ইঞ্চির হেরফেরে শেষ, সব শেষ।
সৌভাগ্য এবার বুড়ো আঙুল দেখায় তাকে। উঁহু, মোটেই না। বরং সময়টা তার ছিল না যে! নইলে ওসব ভাগ্য-টাগ্য পক্ষে আনা ‘ছু মন্তর ছু’ ব্যাপার।
সেই শেষ। শেষবারের মতো ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করা, শেষবারের মতো তেরঙা-বুকে নামা, শেষবারের মতো ছেড়ে আসা ২২ গজের প্রাঙ্গন। সেই প্রাঙ্গণ, যা কিনা দেড়যুগে তাকে সাধারণ থেকে উন্নীত করেছে অসাধারণ পর্যায়ে।
*****

অথচ শেষটা অস্ট্রেলিয়ায় হতে পারত। স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেমিফাইনালে পরাজয়, শিরোপা ধরে রাখার মিশনে সলিল সমাধি। আক্ষেপভরা কন্ঠে বলে উঠেন, আর হয়তো ফিরবো না বিশ্বকাপের এই রঙ্গমঞ্চে। পাশ থেকে দ্রুত মাইকেল ক্লার্ক যেন বলতে চান, শোনো কথা অভিমানী ছেলের! বয়সই বা কত তোমার? অবশ্যই পরের বিশ্বকাপ খেলবে তুমি।
তখন নেতৃত্বে ছিলেন। পরেরবার খেললেন শুধুই ‘অভিজ্ঞ’ সদস্য হয়ে। নেতৃত্ব ছাড়ার আগে-পরে কী দারুণ অভিজ্ঞতা তার! নেতৃত্ব-হীন খেলতে নামবেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তার আগে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচ। প্রতিপক্ষ ভারত-এ দল। সেই ‘এ’ দলের অধিনায়ক ঘোষিত হয়েছেন ধোনী। দলে দলে মানুষ ছোটে মুম্বাইয়ের ব্রাবোর্ন স্টেডিয়াম। তাদের প্রিয় ‘মাহি’ শেষবারের মতো অধিনায়কত্ব করবেন, কেউই মিস করতে চান না তা। গ্যালারীজুড়ে সুর উঠে ‘মাহি মাহি’ বা ‘ধোনী ধোনী’। তিনি সেই ভালোবাসার প্রতিদান দেন ঝড়ো ইনিংসে, দারুণ ফিনিশিং দিয়ে। সেই সিরিজে কটক-এ আরো বড় প্রতিদান তোলা ছিল। ২৫ রানে টপ অর্ডার হারানো ভারতের স্কোরবোর্ডে চতুর্থ উইকেটে যুবরাজের সঙ্গে জুড়লেন ২৫৬ রান।
ভারত ২০১৯-বিশ্বকাপ দল সাজাতে বাদ দিল অশ্বিন-জাদেজা, বাদ গেলেন যুবরাজ এবং আরো কেউ। তবে রয়ে গেলেন ধোনী, টিকে গেলেন তিনি। ভারতের যে ধোনীর মগজটা প্রয়োজন তখনো!
*****

ধোনীর মগজে কখন কি চলে বুঝতে পারে না কেউ। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিবি সিরিজ। তরুণ দল নিয়ে তিনি উপস্থিত তাসমান সাগর পাড়ে। কেউ বলবেন শচীন টেন্ডুলকারের নাম, প্রায় পঁয়ত্রিশ তখন তার।
কিন্তু তাকে যে ‘চিরসবুজ’ বা ‘চিরতরুণ’ ভাবা হতো! সৌরভের ‘টিম ইন্ডিয়া’ ধোনীর হাতে পড়ে ‘মহাভারত’ হয়নি তখনো, কেবলই ‘ইয়াং ইন্ডিয়া’।
অস্ট্রেলিয়ার সাদা পোষাকের শ্রেষ্ঠত্বে ততদিনে দাগ দিয়ে ফেলেছে ইংল্যান্ড, দক্ষিন আফ্রিকা, তারও আগে ভারত। তবে তখনো সাদা বলের ক্রিকেটের অবিসংবাদিত সম্রাট অস্ট্রেলিয়াই। টানা তিনবারের চ্যাম্পিয়ন, দাপট-প্রতাপে ন্যুনতম উচ্চবাচ্যও করতে পারে না কেউ। অসহায় আত্মসমর্পণই নিয়তি। অস্ট্রেলিয়ার বিজয়ই চূড়ান্ত।
ধোনী ভাবলেন ভিন্ন কিছু। তার ধুরন্ধর মগজ হতে বেরিয়ে এল এক ‘মাস্টারক্লাস’ সিদ্ধান্ত। অস্ট্রেলিয়ার দারুণ দাপটে ফোঁস করতে হবে। চোখে চোখ রেখে জানিয়ে দিতে হবে, মঞ্চে আর তোমরা একলা নও।
এসেছে নতুন শক্তি,
তাকে ছেড়ে দিতে হবে অবস্থান।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয়ের পর উদযাপন হবে সাদামাটা। যেন ওরা বোঝে, ওরা অন্যগ্রহের কোনো দল-টল নয়। ওদের বিপক্ষে জয়ে বাড়াবাড়ি উচ্ছ্বাসের কিছু নেই। আর দশটা জয়ের মতোই। কাজে দিল তা। অস্ট্রেলিয়ার সর্বজয়ী অহং ধাক্কা খেল যেন কিছুটা। সেই ধাক্কা আর কাটিয়ে উঠা হয়নি। বেস্ট অব থ্রী’র দুটোতেই জিতে সিবি সিরিজ জয়ের মাধ্যমে, ধোনী বছর-তিনেক বাদে ভারতের বিশ্বজয়ের ভিত্তিপ্রস্তর দিলেন।
যার চূড়ান্ত রুপ দেখা গেল মুম্বাইয়ে। ওয়েংখেড়ের রোমাঞ্চকর রাতে তার ব্যাটের সিনেম্যাটিক দোলনে, সিনেম্যাটিক সমাপ্তিতে ২৮ বছর বাদে ভারতের জুটল বিশ্বচ্যাম্পিয়ন তকমা। সেই বিশ্বজয়ের সিনেম্যাটিক প্রতিরুপও চিত্রায়িত হয়েছে রুপালী পর্দায়। যিনি ছিলেন মূল ভূমিকায়, তার জীবনের বিষণ্ণ পরিসমাপ্তি ঘটে গেছে। ধোনীর দ্বিতীয় অধ্যায় রুপালী পর্দায় চিত্রায়িত হবে কি আর? হলেও সুশান্ত সিংয়ের মতো পারবেন কেউ?
*****

ঘটে গেছে ধোনীর ক্যারিয়ারের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তিও। সাদা পোষাক তোলা ছিল আগেই, এবার রঙিন পোষাকও তুলে রাখলেন। রঙিন ক্রিকেটের পাশে আশ্চর্য ‘সাধারণ’ তার টেস্ট ক্যারিয়ার। যেন বাংলা সিনেমার সেই দুই ভাই, যেখানে এক ভাই বিলেতি ডিগ্রী-টিগ্রী নিয়ে বড্ড কেউকেটা বনে গেছেন, সেখানে অন্য ভাই নিতান্ত সাধারণ গোবেচারা। রঙিন পোষাকে এক দশক ছুই ছুই নেতৃত্ব দিলেও, লাল বলের ক্রিকেটে তা বছর ছয়েক মাত্র। সেও বিকল্প কেউ ছিল না বলে, যেই ভিরাট কোহলি ‘লায়েক’ হয়েছেন, তখনি কাঁধটা হালকা হয়ে গেল তার।
ভারতীয় ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ দুই সন্তান, শচীন ও সৌরভ। দু'জনেরই শেষ ম্যাচের দলনেতা ছিলেন ধোনী। তাদের বিদায়ে দিয়েছিলেন অভিনব ও অভূতপূর্ব সম্মান। সৌরভকে ছেড়ে দিয়েছিলেন নেতৃত্ব। আর শচীনের জন্য লম্বা লাইনের গার্ড অব অনার। গুটিকয় ক্রিকেটার মিলে মধ্যমাঠ থেকে বাউন্ডারি পর্যন্ত যেভাবে সারি করে 'গার্ড অব অনার' দিলেন তার জুড়ি মেলা ভার। অথচ তার শেষটাতে কোনো অধিনায়ককেই কোনোরকম সম্মাননা প্রদানের সুযোগ দিলেন না। না টেস্টে, না রঙিন পোষাকের ক্রিকেটে।
অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চার-চার করে আট-শূণ্য রেজাল্ট নিয়ে ফিরেছিলেন। অস্ট্রেলিয়াকে স্বদেশে এনে জবাবটা ফিরিয়ে দেয়া গেলেও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সম্ভব হয়নি। উল্টো স্বদেশেও হেরেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ধোনী-আলোচনায় তাই টেস্ট ক্রিকেট ঠিক সমাদর পায় না। বা আগ্রহ জাগে না।

যিনি দশহাজারী ক্লাবের সম্মানিত সদস্য, যার শো-কেসে যত ট্রফি জেতা সম্ভব, আছে সমস্তই। যার ক্ষুরধার মস্তিষ্ক, সুনিপুণ মাঠ-নেতৃত্বে চমকে যেতে হয় বারবার। যিনি অবিশ্বাসে চোখ ছানাবড়া করিয়েছেন কত কত বার, তার প্রসঙ্গে ‘সাদামাটা’ কিছু আসলে ঠিক জমে না। তিনি সাদা বলের কিংবদন্তি হয়েই থাকুন। আমরা তার সাদা পোষাকের ক্যারিয়ারের বদলে সাদা বলের ক্যারিয়ারটাই মনে রাখতে চাই।
মন খারাপের নানান গল্পে কত আনন্দময় গল্পের যোগান দিয়েছেন তিনি, কেন শুধু শুধু নিরানন্দের স্মৃতি বুকে বেঁচে থাকা! আমাদের সৌভাগ্য একজন ম্যাজিশিয়ান, একজন এন্টারটেইনার চাক্ষুষ করেছি। কত কত কিশোর হতে চেয়েছে তার মতো! নেতৃত্ব দেবে তার মতো, হাসবে তার মতো, কথা বলবে তার মতো, ব্যক্তিত্ব হবে তার মতো। কত কতজন এখনো হতে চায়!
এমএস ধোনী অসংখ্যা মনকে রাঙিয়ে দেয়া একজন সফল চিত্রকর।
*****

এই পৃথিবীর পরে
কত ফুল ফোটে আর ঝরে
ক্রিকেট কাননে বহু ফুল ফোটে। আবার ঝরেও পড়ে। মাঝখানের এই সময়টায় সুবাসে-সৌরভে-সুগন্ধে মাৎ করে দেয় ক্রিকেটাঙ্গন। হরেক পদের ফুল, নানান রঙ। রঙে রঙে রঙিন ও বর্ণিল বাগানটায় কোনো কোনো ফুলের রঙ যেন একটু বেশীই উজ্জ্বল, একটু বেশীই মনকাড়া। মুগ্ধকর, মনোহর।
ধোনীর ব্যাটিংয়ে শিল্পীর আঁচড় নেই, শটে নেই তুলির টান। তবুও যেন তিনি শিল্পী। হয়তো তার চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র মনে হবে না, সেখানে দাগ বা কলঙ্ক আছে হয়তো। হয়তো ফুলের মতো তুলতুলে নন তিনি। তারপরও ক্রিকেট বাগিচার ইতিহাসে সুরভীতে মাতাল করা অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফুল হিসেবেই বিবেচিত তিনি।

তিনি শেষ বলেছেন, ইতি টেনেছেন। দেড় দশক পূর্বে ফোটা ফুল ঝরে গেলেও, ইতিহাসের পাতায় তার সুবাস-সৌরভ ও বাহারী রঙ দারুণ দাপটে ২২ গজে তার বিচরণের বিবরণ লিখে রাখবে।