• ক্রিকেট

ঝড় সামলে অমর টেস্ট

পোস্টটি ৩৩৯৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

নতুন এই শতাব্দীর শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দেওয়ার বহুমুখী উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে।ক্রিকেটকে আরও জনপ্রিয় করে তুলতে নিয়ম নীতিতে বড়সড় পরিবর্তন এসেছে।ক্রিকেটের সাথে জড়িত অর্থনৈতিক বিষয়াদির বিবর্তন ঘটানো হয়েছে।নতুন এই শতকে অনেক আর্থিক পদ্ধতির সংযুক্তি ঘটানো হয়েছে ক্রিকেটের সাথে।ক্রিকেটের সংস্কারের সাথে এই সংযুক্তি সম্পর্ক রয়েছে।দ্রুতগতির ক্রিকেটের এই যুগে ব্যাটসম্যানরাই অগ্রাধিকার পায়। যেখানে বোলারদের বিশেষ করার কিছু নেই কারন পিচ তৈরি করা হয় ব্যাটসম্যানদের স্বাচ্ছন্দ্যের কথা মাথায় রেখে। তাই T20 তে টেস্ট ক্রিকেটের মত ব্যাট-বলের সমান সমান লড়াই অনুপস্থিত।T20 ম্যাচ শেষে সাধারণত ব্যাটসম্যানদের মুখেই শেষ হাসিটি শোভা পায়।

টেস্ট ক্রিকেট ১৪৩ বছর বয়সেও সুস্বাস্থ্য নিয়ে টিকে রয়েছে।T20 এর বিশ্বব্যাপী প্রসারের পরেও ভক্তদের কাছে টেস্ট তিনটি ফর্ম্যাটের "সেরা" হিসাবে আজও সমাদৃত।বিশ্বজুড়ে T20 লীগের আগ্রাসী হানার পর থেকে অস্ট্রেলিয়া,ইংল্যান্ড,ভারতের বাইরে টেস্ট ম্যাচের জন্য দর্শক সংখ্যা ক্রমশঃ হ্রাস পাচ্ছে।ফলে দীর্ঘ ফর্ম্যাটের ভবিষ্যতটি বিশেষ বিতর্কের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে।টেস্ট ক্রিকেটের ক্রমহ্রাসমান দর্শকের কারণে খেলাটিকে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার অন্যতম চ্যালেঞ্জ।আন্তর্জাতিকভাবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার আলোর নীচে টেস্ট ক্রিকেটের চারপাশে অন্ধকার ঘিরে রয়েছে।তাই বির্তকটি ক্রিকেট জগতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

T20 ক্রিকেটের বিশ্বব্যাপী উত্থান খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।স্বল্প সময়ের মধ্যে টেস্ট,ওয়ানডে ক্রিকেটেকে ছাপিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে।প্রতিদ্বন্দ্বীতা থাকলেও ফলাফলের জন্য দীর্ঘ পাঁচদিন বসে বসে টেস্ট খেলা দেখার লোকের সংখ্যা দিন দিন কমেই যাচ্ছে।ফলে  টেস্ট ক্রিকেট দেখার জন্য স্টেডিয়ামে দর্শক পদচারনা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাচ্ছে।যারফলে ক্রিকেট বোর্ড ও টেস্ট ক্রিকেটের সাথে জড়িত সবধরনের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন।তবুও টেস্ট ক্রিকেটকে দূরে সরিয়ে রাখা উচিত নয়।কারণ টেস্ট ক্রিকেট রয়েছে সর্বাগ্রে এবং এর সাথে ক্রিকেটের সব ফরম্যাটের জন্মের সম্পর্ক।

gettyimages-1017555-612x612

T20 এর সূচনা গত ৪০ বছরে ক্রিকেটের সবচেয়ে উদ্ভাবনী ও প্রভাবশালী বিকাশ। এর প্রতি বলে বলে রয়েছে উত্তেজনা আর উন্মাদনা।আর সেইসাথে চরম নাটকীয়তা।ক্রিকেটের উত্তেজনাকে বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে মাত্র তিন ঘণ্টার এই খেলা।খেলোয়াড়রাও দলকে জেতাতে নিজেদের দক্ষতাকে বাড়িয়ে নিয়েছে। যারফলে দর্শকদের কাছে T20 হয়ে উঠেছে ভরপুর বিনোদন।বিশ্বের ক্রীড়া অঙ্গনে এটি একটি বিরাট সূচনা,বিনিয়োগ।সর্বোপরি,প্রচুর সংখ্যক ভক্তদের আগমন ও একটি নতুন প্রজন্মকে ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে।কিন্তু ক্রিকেটের অস্তিত্ব রক্ষায় টেস্ট অত্যাবশ্যকীয়।কারন ক্রিকেট প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনেক গৌরবময় ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে টেস্টের সঙ্গে।সেই গৌরব উত্তরাধিকারসূত্রে হালের T20 ক্রিকেট পেয়েছে।তাই বিশ্বজুড়ে টেস্ট ক্রিকেটকে আরও ভাল প্রচার ও প্রসার নিশ্চিত করার জন্য কিছু রূপান্তর গ্রহণ করা দরকার।যাতে টেস্ট ক্রিকেট প্রজন্ম T20 এর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে। দ্রুত অর্থের লোভে দেশে দেশে বেশ কিছু T20 বিশেষজ্ঞ তৈরি হয়েছে যারা ফ্রিল্যান্সাররের মত বিশ্বব্যাপী খেলে চলেছে।এসব খেলোয়াড়দের শুধুমাত্র সাদা বলের ক্রিকেটে দেখতে পাওয়া যায়।লাল বলের ক্রিকেটে তাদের অনাগ্রহ দেখা যায়।অনেক অতি উৎসাহী ক্রিকেটার T20 লীগে পূর্ণমাত্রায় সময় দেয়ার জন্য জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর পর্যন্ত নিয়ে নেয়।এই প্রবণতা ক্রিকেটের জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর।

অনেক প্রাক্তন ওয়েস্টইন্ডিজ তারকা T20 ক্রিকেটকে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের "গোলযোগ" হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।ক্যারিবিয়ান টেস্ট ক্রিকেট দলের দূর্বল অবস্থার জন্য T20 কে দায়ী করা হয়। বর্তমানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সব তারকা খেলোয়াড়রা অর্থের পেছনে ছুটছে।দেশের হয়ে খেলা নিয়ে তারা ভাবে না। উদাহরণটি হিসেবে তিনি আন্দ্রে রাসেলের কথা বলা যায়। মাত্র ১৯ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলা শুরু করে আজ অবধি মাত্র ১৭টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন।আর ২০১০ সালে টেস্ট অভিষেক হওয়ার পরে আর কোন টেস্টে অংশ নেয়নি।মাত্র ৫১টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে খেলেছে।অথচ এই সময়ের মধ্যে তিনশতাধিক T20 খেলা হয়ে গিয়েছে তার।অথচ টেস্ট ক্রিকেট খেলতে চায় না আঘাতপ্রাপ্ত হাঁটুর কারনে।রাসেলের মত দুর্দান্ত এক প্রতিভার অপচয় হচ্ছে বলে মনে করা হয়।কারন সে এমন একজন আকর্ষণীয় ক্রিকেটার যার খেলা দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে।আর সে ক্রিকেটের সব ফরম্যাটে জন্য কার্যকরী এক ক্রিকেটার।কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের টেস্টের  চিরস্মরণীয় ইনিংসের তালিকায় রাসেলের নাম থাকবে না।ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটে অনেক প্রতিভাবান ক্রিকেটার রয়েছে যাদের হয়ত T20 এর ক্ষণস্থায়ী কয়েকটি মুহূর্ত ব্যতীত আর কিছু জুটবে না।

T20 ক্রিকেট - তা ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক লীগ বা আন্তর্জাতিক স্তরের হোক - এর জনপ্রিয়তার আলাদা জায়গা রয়েছে।তবে T20 এর কতগুলি ব্যক্তিগত নৈপুণ্য দর্শকদের মনে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে ?নিজের সন্তানদের কাছে বলার মত কয়টি সেরা মুহূর্ত আছে যা স্মরণ করা যায় ? কিংবা আগামী বছরগুলিতে স্মরণীয় কয়টি  ঘটনা সম্পর্কে লেখা হবে? কয়টি বিপিএল কিংবা আইপিএল ম্যাচের কথা আমাদের মনে গেঁথে আছে ? ঘরোয়া লীগ তো দূরের কথা আন্তজার্তিক T20 এর কয়টি কালজয়ী ম্যাচের কথা দর্শক মনে করতে পারে ? অন্তর্জালে না খুঁজে সর্বশেষ T20 বিশ্বকাপ কে জিতছে সাধারণ দর্শকদের উত্তর দেয়াটা বেশ কঠিন।পক্ষান্তরে সর্বশেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপ কে জিতেছে এর উত্তর কিন্ত অনেকেরই জানা।মুরালিধরন টেস্টে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী কিংবা শচীন টেন্ডুলকারের সবচেয়ে বেশি রান - এসব তথ্য দর্শকদের অজানা নয়। কিন্তু T20 তে কার উইকেট বেশি ,কে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক - অনেকেই বলতে পারবে না।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী T20 ক্রিকেটের ঝা চকচকে বিজ্ঞাপন দেখে মনে হতে পারে টেস্ট ক্রিকেটের দিন কি তাহলে শেষ হয়ে যাচ্ছে ?এমন একটি আশঙ্কা ১৯৭১ সালে ওয়ানডে ক্রিকেট আন্তর্জাতিকভাবে প্রবর্তনের পড়েও করা হয়েছিল।সেই সময়ে বিশ্বব্যাপী ওয়ানডে ক্রিকেট প্রশাসক,খেলোয়াড় ও সমর্থকদের মনে বিশাল উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলে। সমর্থকদের ওয়ানডে ক্রিকেটের প্ৰতি এই উন্মাদনা দেখে অনেকেই টেস্ট ক্রিকেটেকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছিল।১৯৭৫ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপ শুরুর মধ্য দিয়ে, দু'বছর পরে ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট তৈরির মাধ্যমে এবং সর্বশেষ T20 এর আগমনের মধ্য দিয়ে টেস্ট ক্রিকেট বিগত পাঁচ দশকে একের পর এক ধেয়ে আসা তীরের আঘাতে জর্জরিত।তবুও নানান ঝড় ঝাপ্টা সামলে প্রায় দেড় শতাব্দী প্রাচীন টেস্ট তার কালজয়ী নানা মুহূর্তকে সঙ্গে নিয়ে আজও স্বমহিমায় ক্রিকেট প্রেমীদের মনে জায়গা করে বেঁচে আছে।আর অধিকাংশ খেলোয়াড় ও ক্রিকেটমোদীদের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে অমর হয়ে থাকবে টেস্ট ক্রিকেট।

 

Images courtesy: www.gettyimages.com                                       www.shutterstock.com