পিএসএলে বাংলাদেশ এবং লাহোর কালান্দার্স
পোস্টটি ১৩১২ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।
ব্লগের নীতিমালা
ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
১.
সোজাসাপ্টা একটা প্রশ্ন। পিএসএল দেখেন? উত্তরে 'হ্যা' 'না' এর সমর্থন জাগাতে আসবে আরও নানান কথা। তবে অধিকাংশ সোজাসাপ্টা উত্তরই আসবে 'না'। কিছু 'না' ভালোই।
এই যেমন আপনি পিএসএল দেখেন না, যদি দেখতেন এবং লাহোর কালান্দার্সের সমর্থক হতেন, তাহলে একে একে আপনাকে চার মৌসুম অপেক্ষা করতে হতো পিএসএলে আপনার দলকে প্লেঅফে দেখতে। ২০১৬ সালে শুরু হওয়া পাকিস্তান সুপার লীগের ৪ মৌসুমের একটিতেও যে গ্রুপ পর্ব পাড়ি দিতে পারেনি লাহোর কালান্দার্স! সব মৌসুমেই ছিল পয়েন্ট টেবিলের তলানীতে, কালান্দার্সের ভক্ত হয়ে যা দেখা ছিল অবশ্যই বেদনাদায়ক। তারপর একসময় আপনার দল প্লেঅফে যায়, তখন আপনি শিরোপা হাতে দেখতে চান আপনার প্রিয়দের। এরপর বাধা হয়ে আসে অতিমারী করোনা। বন্ধ হয়ে আবার ৮ মাস পর পিএসএল ফিরলে আপনার দলকে চ্যাম্পিয়ন হতে হলে জিততে হয় টানা তিন ম্যাচ। দুই ম্যাচ জিতে আপনার দল, এরপর ফাইনালে গিয়ে হেরে যায়। আবার আপনার পরিচয় হয় বেদনাদায়ক সেই অনুভুতির সঙ্গে৷ আপনার সে অনুভুতির স্বাদ পান তামিম ইকবালও।
২.
চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগের আট আসর হয়ে গেছে, জনপ্রিয়তার তুঙ্গে সে লীগ। পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফেরাতেও দারুণ মাধ্যম হতে পারে এরকম একটা লীগ। ২০১৬ সালে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড শুরু করলো তাদের লীগ। তবে প্রথমবার পাকিস্তানের মাটিতে পাকিস্তানের এই লীগকে নিতে পারেনি পাকিস্তান, আরব আমিরাতের দুবাই ও শারজায়ই হল সবগুলো ম্যাচ।
আইপিএলের নবম আসর শুরু হওয়ার আগে শুরু হল পিএসএলের প্রথম আসর। সে আসরে বাংলাদেশের চারজন পেলেন খেলার সুযোগ, তাদের মধ্যে মুস্তাফিজ খেললেন না। তামিম খেললেন পেশোয়ারে, মুশফিক ও সাকিব করাচি কিংসে। করাচি কিংস ৮ ম্যাচে দুই জয়ে নেট রান রেটে এগিয়ে লাহোর কালান্দার্সের সমান ৪ পয়েন্ট নিয়েও চলে গেল প্লেঅফে। তবে প্লেঅফের আগেই সাকিব ৮ ম্যাচ ও মুশফিক ৩ ম্যাচ খেলে চলে আসলেন। তামিমও গ্রুপ পর্বের ৬ ম্যাচ পরে চলে এলেন।
বন্ধু সাকিব ও তামিম দুজন দুজনার মুখোমুখিও হলেন একবার। সাকিবের ৪ বলে একটি বাউন্ডারিসহ ৮ রান আনতে পারলেন তামিম। সে ম্যাচে সাকিব ২ ওভারেই দিয়েছিলেন ২৬ রান, তামিম করেছিলেন ৩৫। তবে তামিম সে মৌসুমেই ছিলেন দুর্দান্ত, ৬ ইনিংসে ২৬৮ রান করে ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকায় পঞ্চম। সাকিব ব্যাট হাতে প্রথম তিন ইনিংসে ৮৮ রান করার পরে পরের পাঁচটি মিলে করতে পারলেন মাত্র ৩৮ রান। বল হাতেও সাকিব ছিলেন খরুচে, ৭.৯৫ ইকোনমিতে বল করে উইকেট নিতে পেরেছিলেন মাত্র ৩টি। মুশফিক সর্বোচ্চ ৩৩ রানের ইনিংস সহ তিন ম্যাচে খেলে করেছিলেন মোটে ৪৯ রান।
৩.
প্রথমবার সুন্দর সমাপ্তি শেষে ফেব্রুয়ারীতে পিএসএলের দ্বিতীয় মৌসুমও শুরু হল আরব আমিরাতে। এবারও খেললেন চার বাংলাদেশী। তবে এবার আর দুই বন্ধুর মোকাবিলা হল না, তামিমের সঙ্গে সাকিবও যোগ দিলেন পেশোয়ার জালমিতে। কোয়েটার স্কোয়াডে শুরু থেকে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ থাকলেও মৌসুমের শেষ দিকে এলেন এনামুল হক বিজয়। শেষ দিকে পিএসএলও চলে গেল পাকিস্তানে। পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের ফেরাতে উপলক্ষ্য হিসেবে ভাবা পিএসএলে বিদেশী অনেকে নিরাপত্তা শঙ্কায় যেতে রাজি হল না। নিরাপত্তার কথা ভেবে কিংবা না ভেবে তাদের বদলি হিসেবে গেলেন অনেকে, এদের মধ্যে একজন এনামুলও। ২০১৭ সালের সে মৌসুমের ফাইনালে ৯ বলে ৩ রান করে আউট হয়ে গেলেন এনামুল হক বিজয়। ১৪৯ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করে মাত্র ১৬.৩ ওভারে ৯০ রানে অল আউট হয়ে পিএসএলের ট্রফি জয় থেকে বঞ্চিত হল কোয়েটা গ্লাডিয়েটরস।
পেশোয়ারের সাকিব সেবার ৪ ম্যাচে ১১২.৫ স্ট্রাইক রেটে করলেন ৫৪ রান, ৬.৪২ ইকোনমিতে নিলেন ৫ উইকেট। ২৪ বলে সাকিবের একমাত্র ৩০ রানের ইনিংসটা এলো লাহোর কালান্দার্সের বিপক্ষে। মাহমুদুল্লাহর বলে সাকিব ব্যাট চালাতে না পারলেও তামিম পেরেছেন। তবে দুই ম্যাচে ১২ বল খেলে তাকে আউট হতেও হয়েছে একবার। মাহমুদুল্লাহর সে বলগুলিতে তামিম রান নিতে পেরেছেন মাত্র পাচঁটি।
তামিম ও মাহমুদুল্লাহ দুজনেই পাচঁ ম্যাচ খেলে চলে আসলেন। আসার আগে তামিম করলেন মোট ৯৪ রান। মাহমুদুল্লাহ ৭.৭৪ ইকোনমিতে নিলেন ৭ উইকেট, ৩ ইনিংসে রান করলেন ৩৪। তামিম ৪৬ বলে ৬২ রান করলেন যেদিন, বৃষ্টি এসে সেদিন গড়লো এক রেকর্ড। ৩২ বছরে শারজায় দ্বিতীয়বারের মতো কোনও ম্যাচের ফল বেরোলা না। কোয়েটা ও পেশোয়ারের মধ্যকার পিএসএলের ৯ম সে ম্যাচটিতে ১৬ ওভারে পেশোয়ার ৩ উইকেটে ১১৬ রান করার পরে বৃষ্টির কারণে ম্যাচ পরিত্যাক্ত হয়ে যায়। ওই ম্যাচটি বাদে পেশোয়ার ও কোয়েটা বাকি ৭ ম্যাচের ৪টি করে জিতে প্লেঅফে যায়। এরপর প্রথম কোয়ালিফায়ারে পেশোয়ারের বিপক্ষে কোয়েটা ১ রানে জিতে ফাইনালে চলে যায়। পেশোয়ার আবার এলিমিনেটরে জিতে ফাইনালে গিয়ে কোয়েটাকে হারায় ৫৮ রানে।
৪.
প্রথম আসরে স্কোয়াডে থেকে এবং পরের আসরে স্কোয়াডে না থেকে মুস্তাফিজের পিএসএল খেলা হয়নি৷ নিজের অভিষেক আসরে এসে খেললেন ৫ ম্যাচ, ২০১৮ সালের ওই আসরই মুস্তাফিজের খেলা একমাত্র পিএসএল আসর।
লাহোর কালান্দার্সের মুস্তাফিজ বল করছেন চিরচেনা স্বদেশী তামিম ইকবালকে। তামিম তারঁ ৫ বল খেলে করতে পারলেন ৪ রান। মুস্তাফিজ সেবার ৫ ম্যাচ খেলে ৬.৪৪ ইকোনমিতে ১৬ ওভার বল করে শিকার করলেন ৪ উইকেট। ৫ দলের দ্বিতীয় মৌসুমে ৮ ম্যাচে ৩টিতে জিতেছিল লাহোর। নতুন দল মুলতান সুলতানসের যোগ হওয়াতে ৬ দলের টুর্নামেন্টে ১০ ম্যাচের ৩টিতে জিতে এবারও পয়েন্ট টেবিলের শেষ দলই থাকল লাহোর কালান্দার্স।
তামিম, সাকিবের সঙ্গে পিএসএলের তৃতীয় সে আসরে পেশোয়ারে নাম লেখালেন সাব্বির রহমান। তামিম ৬ ম্যাচে তিনটি ত্রিশোর্ধ্ব ইনিংসের সহায়তায় ১০৪.৫ স্ট্রাইক রেটে করলেন ১৬১ রান। সাকিব খেললেন না একটিও ম্যাচ। সাব্বির খেললেন একটি ম্যাচ। সাব্বিরের পিএসএল ক্যারিয়ার ব্যাখা করতে এক ও শুন্য ব্যাতীত আর কোন সংখ্যারও প্রয়োজন পড়ে না। সাব্বির ১ ম্যাচে ১০০ স্ট্রাইক রেটে ১ চারের মারে করতে পারলেন ১১ রান। তাদের পেশোয়ার ১০ ম্যাচে ১০ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে গেল। চ্যাম্পিয়ন হতে হলে তাদের জিততে হতো টানা তিন ম্যাচ। গ্রুপ পর্বের শেষ দুই ম্যাচে জেতার পর প্লেঅফের দুই ম্যাচ জিতে, টানা চার ম্যাচ জয়ের পর ফাইনালে গিয়ে ইসলামাবাদের সাথে পেশোয়ারকে হেরে যেতে হল ৩ উইকেটে।
তামিম সেবারই প্রথম প্লেঅফে খেললেন, প্রতিপক্ষ ছিল মাহমুদুল্লাহর কোয়েটা। কোয়েটাও ১০ ম্যাচে ১০ পয়েন্ট নিয়ে প্লেঅফে গিয়ে প্রথম এলিমিনেটরে ১ রানে হেরে গেল তামিমদের পেশোয়ার জালমির কাছে। তামিম সে ম্যাচে ২৯ বলে ২৭ রান করলেন, রিয়াদ ২ ওভারে ২০ রান দিয়ে ১ উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি ২০ বলে ১৯ রান করলেন। এই ম্যাচ বাদে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ আর খেললেন মাত্র একটি ম্যাচ। মোট ২ ম্যাচ খেলে ৩৩ বলে ৩৪ রান করলেন রিয়াদ, সর্বোচ্চ ইনিংস ছিল ২০। ২ ম্যাচে বল করে ৩ ওভারে ২৬ রান দিয়ে নিতে পারলেন ১ উইকেট।
৫.
ধীরে ধীরে পাকিস্তানের লীগ পাকিস্তানের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ২০১৮ সালে প্লেঅফের তিনটি ম্যাচ অনুষ্টিত হবার পরে ২০১৯ এ লীগের শেষ আটটি ম্যাচই অনুষ্টিত হয় পাকিস্তানের করাচিতে। তবে সেবার কোন বাংলাদেশীই খেলেননি। এবং বরাবরের মতোই লাহোর কালান্দার্স ছিল পয়েন্ট টেবিলের তলানীতে। ২০২০ সালে এসে গ্রুপ পর্ব শেষে লাহোর ৬ষ্ট থেকে আসে ৩য় স্থানে। পুরো পিএসএলও চলে আসে পাকিস্তানে।
পঞ্চম সে আসর হয় পাকিস্তানের চার স্টেডিয়ামে। বাংলাদেশী কেউ থাকেন না সেবারও। লাহোর কালান্দার্স প্লেঅফ নিশ্চিত করে, তখন আগমন ঘটে করোনাভাইরাসের। ৮ মাস পরে আবার মাঠে ফেরার কথা থাকলে তামিম ও মাহমুদুল্লাহরও কথা হয় পিএসএলে খেলার। তখন মাহমুদুল্লাহর সামনে বাধা হয়ে আসে সেই করোনাভাইরাস। মাহমুদুল্লাহ যেতে পারেননা, তামিম পারেন। তামিমের দল লাহোর কালান্দার্স টানা দুই এলিমিনেটর জিতে চলে যায় ফাইনালে। ফাইনালে গিয়ে ছুতে পারে না সেই অধরা ট্রফিটা। তামিম তিন ম্যাচে করেন- ১৮, ৩০ ও ৩৫। কোন মৌসুমেই তামিমের স্ট্রাইক রেট ১২৩ এর উপরে যায় না, এবার প্রথম দুই ম্যাচের দুর্দান্ত শুরুতে তা হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও ফাইনালের ৩৮ বলে ৩৫ তা আর হতে দেয়নি।
গেল চার আসরের সর্ববাজে দল পঞ্চম আসরে হল রানার্সআপ। প্লেয়ার ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম থেকে পাওয়া হারিস রউফ, দিলবর হুসেইন এতে অবশ্যই রাখেন বড় অবদান। ৬ দলের চারটিরই জেতা হয়ে গেছে শিরোপা। লাহোর কালান্দার্স পাচবারেও যা পারেনি তা মুলতান সুলতানসও পারেনি তিনবারে।
- 0 মন্তব্য