মধুময় মৌসুমে মনোমুগ্ধকর মঞ্চ
পোস্টটি ১৪৩৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।
ব্লগের নীতিমালা
ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
এখানকার গ্রীষ্ম উপভোগ্য নয় খুব একটা। স্যাঁতসেঁতে ভ্যাপসা গরম, কখনো বুকের ছাতি ফেটে যায়, কালবৈশাখীর চোখ রাঙানি, সূর্যের হুঙ্কার প্রায় অসহ্য ঠেকে। ব্যতিক্রম কেবল আম-জাম-কাঠাল-লিচু-তাল-বেল-তরমু জ-আনারস। জৈষ্ঠ্যমাস মধুমাস। পাকা ফলের মধুর রসে রঙিন করি মুখ। সুদূর বিলেতি গ্রীষ্মের সূর্য যখন আনন্দের ঢেউ তুলে সেই জনপদে, সেই একই সূর্য--গ্রীষ্মকাল এই জনপদে জনজীবনে তেমন আনন্দ দূরে থাক, কেমন অসহ্য ঠেকে অনেক সময়। যদিও বাহারী ফলাহারে মধুময় সময় কাটানোর উপায় নেই সুদূর ইংল্যান্ডে।
সেখানকার মিঠে রোদ যেমন উপভোগ্য, ক্রিকেট মৌসুমটাও তেমনি। এখানকার বাহারী স্বাদের মধুময় ফলাদি বুঝি সেখানে ক্রিকেট মাঠে ভিন্ন ঢঙে ফিরে আসে। বিলেতি গ্রীষ্মের ক্রিকেট মৌসুমের মতো অমন মধুময় উপভোগ্য ক্রিকেট মৌসুম খুব সম্ভব নেই পৃথিবীর আর কোথাও।
*****
সে বছর পৃথিবীর বুকে নেমেছিল রুপকথার মতো অনিন্দ্য সুন্দর এক ক্রিকেট গ্রীষ্ম। স্টীভেন স্মিথের মহা সমারোহে পুনরায় রাজ্যভিষেক, বেন স্টোকসের স্টোকসশীপ, হেডিংলির সবুজে অলটাইম ক্ল্যাসিক উপাখ্যান। তারও আগে বিশ্বকাপ -- যেখানে পসরা বসেছিল অবিশ্বাস্য ক্রিকেট মুহূর্তের। যেনো টান টান রোমাঞ্চকর কোনো রহস্যপোন্যাস। রোমান্সে ভরপুর, উত্তেজনায় টইটম্বুর। উত্থান-পতন, উঠা-নামা, শিহরণ-স্বস্তি-অবিশ্বাস; অভাবনীয় আনন্দের অকল্পনীয় রোমাঞ্চ অনুরণন। সেই শুরু। তারপর গত দু'বছরে ক্রিকেটীয় মহানন্দের কত রঙ কত রুপ। সর্বশেষ 'বোর্ডার-গাভাস্কার ২০২০-২০২১' ট্রফি স্মরণকালের সবচেয়ে আনন্দদায়ী সিরিজ হিসেবে আদায় করে নিয়েছে সর্বজন স্বীকৃতি। এবং তারপর এই চূড়ান্ত মঞ্চ।
অথচ মঞ্চটা সাজতে পারতো আরো আগেই। এখনকার অনেক ক্রিকেট তারকা ছিলেন না তখন। রস টেইলর ছিলেন, ছিলেন রোহিত শর্মা। দুই দলের অধিনায়ক-দ্বয় আন্তর্জাতিক আঙিনায় সবে প্রবেশ করেছেন বা প্রবেশের প্রহর গুণছেন। এই আয়োজনের তোড়জোড় শুরু প্রায় এক যুগ আগে। প্রয়াত মার্টিন ক্রো'র ক্ষুরধার মস্তিষ্কের উপহার -- টেস্ট ক্রিকেটের চ্যাম্পিয়নশীপ। ২০১৩ সালে প্রথম আসর জমানোর কথা হলেও, ব্যাটে বলে মেলেনি। দুই অধিনায়ক ততদিনে থিতু হয়েছেন। স্বদেশের ক্রিকেটে আগামীর উজ্জ্বল তারকারুপে পেয়েছেন পরিচিতি। আবার ২০১৭ সালে শিডিউল করা হলো, প্রথম সারির চারটি দল খেলবে চ্যাম্পিয়নশীপ। দুটি সেমিফাইনাল, একটি ফাইনাল। বাহ, টেস্ট ক্রিকেটে প্লে অফ! এক্সাইটিং তো। কিন্তু এক্সাইটমেন্ট পড়ে রইলো কল্পনার চৌকাঠে, মাঠে আর হলো না। তখন মার্টিন ক্রো ক্রিকেট ও পৃথিবীর বহু উর্ধ্বে চলে গেছেন, ভারত ও নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটতরীর শক্ত হাতে হাল ধরেছেন বিরাট কোহলি ও কেন উইলিয়ামসন।
ঝক্কি ঝামেলা পেরিয়ে নতুনভাবে, নতুন ফরম্যাটে সাজানো হলো টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপ। এবার আরেক ফাঁড়া। বিশ্বব্যাপী মহামারী। ক্রিকেট ও জীবন -- সমস্ত স্তব্ধ, সব বিপর্যস্ত। সিরিজ পেছালো কিছু, বাতিল হলো কিছু, আর কিছু হলো আধাআধি।
অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড টুর্নামেন্টের দুই উদ্বোধক, শতাব্দী প্রাচীন দুই ক্রিকেট শক্তিকে পেছনে ফেলে সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী, ভারসাম্যপূর্ণ ও প্রতিভাবান দুটি দল উন্নীত হলো চূড়ান্ত নক আউটে। মধ্যিখানের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, পথ পরিক্রমা পেরিয়ে সমাপনী মঞ্চকে স্বাগত সম্ভাষণে রাঙিয়ে দিতে উপস্থিত -- একদম ঝাঁ ঝকঝকে নতুন একটি ইংলিশ গ্রীষ্ম।
*****
আগ্নেয়গিরির মতো টগবগে একজন, অন্যজন আইসবার্গের মতো স্বচ্ছ বরফখন্ড। দুইজনের অবস্থান দুই মেরুতে। দুই দলর অধিনায়ক-দ্বয় বিশ্বক্রিকেটের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ। ভারতে আদর্শ ক্রিকেট সংস্কৃতির সার্থক রুপায়নের অভিপ্রায় কোহলির, নিউজিল্যান্ডের ছোট্ট ছেলেপিলে কেন উইলিয়ামসনকে দেখে ঝুঁকছে ক্রিকেটে। ভারতের পেস ইউনিটের অন্যতম কুশীলব কোহলি, দলের অধিনায়কই নন শুধু, তিনি দলের অভিভাবকও। উইলিয়ামসনের প্রতি আস্থাশীল পুরো দলই। কোহলি ভারতের 'নেতা' বনে গেছেন, উইলিয়ামসন হয়েছেন প্রিয় স্কিপার। কিউই ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার হয়তো হয়ে উঠবেন উইলিয়ামসন, ভারতবর্ষে 'সর্বশ্রেষ্ঠ' হওয়া কঠিন হলেও, বিরাটের পক্ষে অসম্ভব নয় তা।
মাঠে ও মাঠের বাইরে মানবিকতা, মনুষত্ব ও দর্শনতত্ত্বের নন্দনতত্ত্ব দেখিয়েছেন দু'জনই। বিশ্বকাপ ফাইনালের নাটকীয়তা, কিঞ্চিৎ দুর্ভাগ্য বা বাউন্ডারির হিসেব কষে বিজয়ী নির্ধারণের হাস্যকর প্রক্রিয়া সত্ত্বেও, আশ্চর্য শান্ত কেন উইলিয়ামসন। কার্পণ্য নেই প্রতিপক্ষকে অভিনন্দন জানানোয়। বিন্দুমাত্র হতাশা নেই। ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যরে নাও সহজে। কোহলি অমন সহজে নিতে পারেন না সব। স্টীভ স্মিথের প্রত্যাবর্তনে দর্শকদের দুয়ো বা স্যান্ডপেপার প্রদর্শন -- কোনোটাই মেনে নেন না তিনি। কী হলো তোমাদের? চ্যাম্পিয়ন ফিরে এসেছে, ওকে হাততালি ও উষ্ণ অভ্যর্থনা দিয়ে গ্রহণ করো; গ্যালারির পানে তাকিয়ে বলতে চান তিনি।
ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপের ফাইনালটা শুধু ভারত ও নিউজিল্যান্ডই খেলবে না, দুই দেশের দু'জন অসাধারণ অধিনায়ক ও ব্যক্তিত্বও থাকবেন মাঠে।
*****
বহু পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা দু'জনার। মালয়েশিয়ায় পড়ন্ত এক বিকেলে, অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে কিউই ক্রিকেটের স্বপ্ন ভেঙ্গে ফাইনালে পৌঁছে ছিল বিরাট কোহলির দল। সাউদি ছিলেন সে দলে, চার উইকেট নিয়েও জেতাতে পারেননি দলকে। কেন উইলিয়ামসন পাওনাটা তুলে রেখেছিলেন ছোট্ট বুকে। উনিশের তরুণ খন ত্রিশে পৌঁছেছেন, বিশ্বকাপে গেছেন দলের নেতৃত্ব কাঁধে। আরো একটি সেমি ফাইনালের প্রতিপক্ষ বিরাট কোহলির ভারত। মার্টিন গাপটিলের ইঞ্চি-মাপা থ্রোতে ছত্রখান ধোনীর স্ট্যাম্প। শতকোটির স্বপ্ন মুহূর্তেই ধূলিস্যাৎ। ফাইনালে কেন উইলিয়ামসন, টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় কোহলির। গাপটিল এক ব্যাচ সিনিয়র, রোহিত শর্মার মতো ২০০৬ অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ছিলেন। কিন্তু জাদেজা ছিলেন বিরাট কোহলির ২০০৮-এর বিশ্বকাপ জয়ী অনুর্ধ্ব-১৯ দলে। বড়দের সেমিতে জাদেজার ব্যাটে অবাক তান্ডব। ফিকে হয়ে আসা স্বপ্নের নব জাগরণ। শেষ রক্ষা হয় না। ৫৯ বলে ৭৭ রানের 'সুপার এক্সাইটিং' ইনিংসটা স্বান্তনা ছাড়া আর কীই-বা হবে ভারতের?
সাউদির বোলিং-পার্টনার ট্রেন্ট বোল্টও ছিলেন সেখানে, আছেন এবারও।
কনওয়ে সমস্ত দিয়ে বাজি ধরেছিলেন ক্রিকেটে, পুজারার পুজা-পাঠ ক্রিকেটই। ওয়াগনার দলের জন্য সর্বস্ব নিংড়ে দেবেন, রবি অশ্বিন উজার হবেন পুরোটা। পান্টের অভিধানে 'ভয়' শব্দটি নেই, বিজে ওয়াটলিং শেষের ঘোষণা দিয়েছেন আগেই।
দুর্দান্ত দুটি দলের লড়াইয়ের জন্য আদর্শ পরিবেশ যেনো ইংলিশ গ্রীষ্মই।
*****
মেঘে মেঘে বেলা তো আর কম হয়নি। সাদা-কালো-রঙিন মিলিয়ে হরেক রঙা ক্রিকেট দর্শনের সুযোগও ঘটেছে। কত ক্রিকেট মৌসুম অতীত হয়েছে। কত গ্রীষ্ম-বসন্তে ক্রিকেট হেসেছে শতরঙের প্রজাপতি হয়ে, কতবার মনমরা ক্ষণ সঙ্গী হয়েছে জীবনপথে। সবুজ ঘাসে কবিতার জন্ম, দু'পেয়ে মানুষের মানবিক-সীমার উর্ধ্বে উঠা। সহজ সাধারণ মানুষ ২২ গজে কেমন জাদুকর হয়, পিকাসোর রঙতুলি হাতে বা বিটোফেন সুর-সঙ্গে ভিন্ন রুপে আসর মাতিয়েছেন কতবার! এই চোখ কত কী দেখেছে কাঠ বল-ব্যাটের মহিমা, সবুজ উদ্যানের ক্রিকেট-বিভা। বহু ক্রিকেট স্মৃতিপট থেকে মুছে গেছে চিরতরে। বহু ম্যাচ হারিয়ে গেছে স্মৃতির ধাঁধাময় জগতে। কিন্তু কিছু ক্রিকেট-ক্ষণ চির অম্লান। কিছু ক্রিকেট স্মৃতির রাজ্যে চিরভাস্বর। সমুজ্জ্বল আভায় চির উজ্জ্বল সবুজ মঞ্চের কোনো কোনো ক্রিকেট আসর।
বেশি কিছু নয়, মধুময় মৌসুমের এই মঞ্চে এমন কতক ক্রিকেট হোক -- যা স্মৃতির সাম্রাজ্যে রাজার আসন নিয়ে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে আমৃত্যু।
- 0 মন্তব্য