• ক্রিকেট

বেহেশতেও কি ক্রিকেট খেলতে পারবো ?

পোস্টটি ১১৫২ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

 

ইমরান খানের জীবনে অধ্যায় তিনটি। প্রথমটি ক্রিকেট হলে দ্বিতীয়টি ব্যক্তিগত আর শেষটি রাজনৈতিক জীবন। মূল পরিচয় যদিও ক্রিকেট। কেননা, ২০১৮ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পূর্বে ২১ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের জন্যেই গোটা ক্রিকেটবিশ্বে তিনি ছিলেন সমাদৃত।

ক্রিকেটের এক জাত অলরাউন্ডার তথা প্রথিতদশা অলরাউন্ডারদের তালিকায় তার নামটা অনেক উপরে অবস্থান করে। তবে সেরা অলরাউন্ডার ছাপিয়ে নিজের গায়ে লাগিয়েছেন বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়কের তকমা। পাকিস্তানের বিশ্বজয়ের পেছনে তার নেতৃত্ব রেখেছে মূল ভূমিকা। এক পকেটে পছন্দের একাদশ আর অন্য পকেটে পদত্যাগপত্র। পছন্দের একাদশ না পেলে পদত্যাগ করার হুমকিতে নিয়মিত অধিনায়কত্ব করে গেছেন। হয়েছেন সমালোচিত, তবে এনে দিয়েছেন শিরোপাও।

ইমরান খানকে বলা চলে মাঠের বাইরে একজন প্রখর মেধাবী ব্যক্তি। বাইশ গজে সার্বক্ষণিক ক্রিকেট নিয়ে থাকলেও এর বাইরে তিনি ছিলেন একজন রাজনীতি সচেতন ও দেশপ্রেমিক মানুষ। রাজনীতিতে পদার্পণ মূলত অন্যায় ও অবিচারের বিপক্ষে লড়াইয়ের উদ্দেশ্যে। ইসলামী অনুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চান বলেও শোনা যায়। যেহেতু পাকিস্তান দেশটিই ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়েছে, তাই পাকিস্তানীদের অন্তরে ইসলামী অনুশাসন প্রতিষ্ঠার বীজ জন্মের পর বপন হয়ে যায়। ইমরান খানও একই তালিকায়।

5b714c634708c

ইমরান খানের আত্মজীবনী 'পাকিস্তান : আমার ইতিহাস' বইটি পড়লে এ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা মিলে। এমনকি এই লেখার এমন শিরোনামের কারণটাও জানা যাবে। পাকিস্তান জন্মলাভের পাঁচ বছর পর ১৯৫২ সালে স্বাধীন পাকিস্তানে ইমরান খান প্রথম নিঃশ্বাস নেন। ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর পর রাজনীতিতে পুরোপুরি ঢুকে পড়েন। ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন তেহরিক-ই ইনসাফ। ১৯৭১ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত জাতীয় দলের জার্সিতে সুনাম কুঁড়িয়েছেন কাড়িকাড়ি৷ তবে জাতীয় দলের সদস্য হয়েও নিয়মিত পাকিস্তান জাতীয়তাবাদের তাড়নায় রাজনীতিতে প্রবেশের প্রবল প্রতীক্ষায় তার দিনগুলো পার হতো।

কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের জাতির পিতা। ইমরান খান মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করলেও কায়েদে আজমের মৃত্যুর পর পাকিস্তানের স্বাধীনতার স্বাদ পরিপূর্ণভাবে লাভ করা সম্ভব হয়নি। যে উদ্দেশ্য এ ভুখন্ড আলাদা করা হয়েভছে তা অর্জিত হয়নি এতবছরেও৷ ইমরান খানের বিবেচনায় অসুস্থ রাজনীতির কবলে পড়ে অন্যায়-অবিচারে ভরপুর এক স্থান পাকিস্তান। সকল অন্যায় ও অবিচারের বিপক্ষে লড়াই করতে গিয়েই তার রাজনীতিতে আগমন।

180726135630-01-imran-khan-file-1987-restricted-super-169

রাজনীতি করতে গেলে সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনার নাম হলো — গ্রেফতার হওয়া বা গ্রেফতারের শঙ্কায় দিন কাটানো। ইমরান খানের রাজনৈতিক জীবনেও তা ঘটেছে একাধিকবার। পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক পারভেজ মোশাররফের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ইমরান রেখেছিলেন বিশাল ভূমিকা। এই ভূমিকার কারণেই লাহোরের জামান পার্কের বাসার কংক্রিকেটের সীমানা দেয়াল টপকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচার ইতিহাসও আছে। এমনকি আত্মগোপনেও থেকেছেন পুলিশের আক্রমণ থেকে বাঁচতে। কোনো কোনো স্থানে আত্মগোপনে অবস্থান শেষে বিদায় নেওয়ার ১০-১৫ মিনিট পর পুলিশ তাকে খুঁজতে গেছে এমন ইতিহাসও আছে। তবে একসময় ধরা খেতেই হয়েছে,  কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে দিন গুনেছেন মুক্তির।

এসকল ঘটনা তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার সমাপ্তির পর ঘটেছে। তবে ক্রিকেট নিয়ে ছিলেন আলোচনায় সবার চোখের মণি হয়ে। দেশে-বিদেশে পাকিস্তানের জার্সিতে ব্যাটে-বলে ও নেতৃত্বে তার দাপুটে পারফরম্যান্সে পাকিস্তানের সূচনা হয়েছিলো এক নবদিগন্তের। ক্রিকেটার হিসেবে ইমরান ছিলেন ব্যাপক আত্মবিশ্বাসী। ক্রিকেট মাঠে বিশাল চাপের জায়গা, আন্তর্জাতিক ম্যাচ হলে তো চাপের কোনো অন্ত নেই। চাপ থেকে উত্তরোনের উপায় খুঁজতে না পারলে জয়ের দেখা পাওয়া কোনোমতেই সম্ভব নয়। ইমরান এই চাপকে পেরিয়ে গেছেন সহজেই। বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে লড়াই করেছেন বীরদর্পে। 

5b693a74c09ab

ওডিআইতে পাঁচ ও ছয় নম্বরে ব্যাট হাতে একজন নিখুঁত ফিনিশার। আর টেস্টে পাঁচ, ছয় ও সাত তিন পজিশনেই ছিলেন নিখাঁদ একজন ব্যাটসম্যান। দলের প্রয়োজনে ব্যাট হাতে চড়াও হওয়া, আবার পরিস্থিতি বুঝে উইকেট সামলে নেওয়া। সবকটি দায়িত্ব-ই ইমরান খান পালন করেছেন। বল হাতে টেস্ট কিংবা ওডিআই  সবদিকেই তিনি সফল। দলের প্রয়োজনে ব্রেকথ্রু অথবা চাপ তৈরি করতে ডট বল, এক্ষেত্রেও তিনি দুটোই করেছেন। অলরাউন্ডাদের এ কারণেই বোধহয় সব্যসাচী ক্রিকেটার বলা হয়। নামীদামী ক্রিকেটারদের জীবনে বিতর্কও কম নয়, ক্ষেত্রবিশেষে তারা নিজেরাই জন্ম দেন এসব বিতর্ক।

ইমরান খানের জীবনেও ঠিক তাই। এমনকি কমতি নেই নারী বিতর্কেরও। ক্রিকেট থেকে স্বেচ্ছায় বা অভিমানে অবসরও নিয়েছিলেন, কিন্তু চাপের মুখে তাকে আবার দলে ফিরতে হয়। ভার বইতে হয় নেতৃত্বের। তবে এসব ছাড়িয়েও ক্রিকেট মাঠে তার জনপ্রিয়তা এতটুকুও কমে আসেনি। বরাবরই ছিলেন প্রতিপক্ষের জন্য আগ্রাসী একজন। যে মাঠে থাকলেই অতিচমকপ্রদ কিছু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে যেকোনোসময়। এবং তাই হয়েছে বারংবার। পাকিস্তান যে বিশ্বকাপ জিতেছে তার নেতৃত্বে, তাতেও তার অবদান ছিলো বেশ। টূর্ণামেন্টে ধুঁকতে থাকা পাকিস্তান শেষ পর্যায়ে এসে শিরোপাই ছিনিয়ে নেয়। যা অবাক করে দেয় গোটা ক্রিকেটবিশ্বকে। সমালোচনা মাথায় নিয়েও ইমরান শক্তভাবে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। যে কারণেই ইমরানের নেতৃত্বগুণকে দেওয়া হয় ১০০ তে ১০০।

রাজনৈতিক ও খেলোয়াড়ি জীবনে ধর্মকে আগলে রেখে বাঁচতে চাইতেন ইমরান। তাই ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বাঁচতে গিয়ে তিনি খেয়াল করলেন, দুনিয়ার পর যে জীবন রয়েছে। তার রয়েছে দুটি বৈশিষ্ট্য। একটি বেহেশত আর আরেকটি জাহান্নাম। পুরস্কৃতরা পাবে বেহেশত আর অপুরস্কৃতদের অবস্থান হবে জাহান্নামে। ইমরান প্রতিনিয়ত এই ভেবে সময় পার করতেন যে, 'দুনিয়ায় সময় কাটালাম ক্রিকেট খেলে, বেহেশতেও কি ক্রিকেট খেলতে পারবো ?' ঘুরে ঘুরে এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে লাগলেন। যদিও সদুত্তর দিতে পারেনি তাকে কেউ।

120947.2

খেলোয়াড়ি জীবন শেষে তার রাজনৈতিক জীবনে অংশ নেওয়ার মূল কারণ পাকিস্তান থেকে অন্যায়-অবিচার দূর করা। দেশে স্থাপন করা ইসলামী অনুশাসন। যে স্বপ্নে ইংরেজদের কাছ থেকে আলাদা করা হয়েছে পাকিস্তানের ভূখন্ড। মৃত্যু পর্যন্ত পাকিস্তানের উন্নতিতে কাজ করার শপথ গ্রহণ করেন সকল বাঁধা-বিপত্তি পেরিয়ে হলেও। এভাবে কেটে যায় অনেকবেলা। বাইশ গজের জনপ্রিয়তা প্রভাব ফেলে রাজনৈতিক জীবনেও। ২০১৮ সালে তার প্রতিষ্ঠিত দল তেহেরিক-ই-ইনসাফ নির্বাচনে জয়লাভ করলে ইমরান খান পাকিস্তানের ২২ তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন। 

শপথ গ্রহণ করেন ন্যায়ের পথে পাকিস্তানকে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যে। ক্রিকেট মাঠের একজন নেতা যোগ্যভাবে দলকে যেভাবে নেতৃত্ব দিয়ছেন সেভাবেই নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে সাফল্যের চূঁড়ায় নেওয়ার অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিলেন। ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই তিনি হয়তো মৃত্যুর পর বেহেশত পাবেন। আর তখনই 'বেহেশতেও কি ক্রিকেট খেলতে পারবো ?' প্রশ্নের সঠিক জবাব পাবেন।