ক্রিকেট মাঠের আগুন-গদ্য : ০৩
পোস্টটি ১১৮৫ বার পঠিত হয়েছেপ্রথম পর্বে আলোচনার সূচনা হলেও দ্বিতীয় পর্বে আমরা দুটি স্পেল নিয়ে আলোচনা করেছি। এবারে থাকছে বাকি দুটি আলোচনা।
ফেরা যাক বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে প্রিয় ও পছন্দের আঙিনা— ওডিয়াই ক্রিকেটে। আমাদের এবারকার মূখ্য চরিত্রের নাম— রুবেল হোসেন। রুবেল বাংলাদেশকে বেশ কয়েকটি ম্যাচে ‘দুর্ভাগ্য’ যেমন উপহার দিয়েছেন, ঠিক তেমনি কোনো কোনো ম্যাচে এনে দিয়েছেন অবিস্বরণীয় আনন্দের উপলক্ষ্যও। তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে— জেমস এন্ডারসনকে বোল্ড করে বাংলাদেশকে কোয়ার্টার ফাইনালে উত্তরণ এবং নাসের হুসেইনের সেই রক্তে শিহরণ তোলা ধারাভাষ্য, ‘বাংলাদেশ টাইগার হ্যাভ নকড দ্য ইংলিশ লায়ন্স আউট অব দ্য ওয়ার্ল্ড কাপ।’
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও শেষ ওভারে জয়ের নায়ক হয়েছিলেন রুবেল। তা অবশ্য বহু আগের কথা। তখন রুবেল সদ্য তারুণ্যে পা রেখেছেন। মিলসকে বোল্ড করে ৩ রানের জয়ে নিশ্চিত করেছিলেন ‘বাংলাওয়াশ’ রুপকথা।
এবারের গল্পে নিউজিল্যান্ড থাকলেও সময়কাল ভিন্ন।
রঙ্গমঞ্চ— শেরে বাংলা স্টেডিয়াম, মিরপুর, ঢাকা। আঙিনা— ওডিয়াই ক্রিকেট। প্রতিপক্ষ— নিউজিল্যান্ড। সময়কাল— অক্টোবর, ২০১৩।
সেবার বেশ প্রস্তুতি নিয়েই বাংলাদেশে উপস্থিত হয়েছিল নিউজিল্যান্ড। আগেরবারের হোয়াইটওয়াইশের জবাব, এবং সম্মান পুনরুদ্ধারের মিশনে পূর্ণশক্তির দল নিয়ে হাজির। টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশ ‘সমানে সমান’ লড়ে ওডিয়াই সিরিজের বার্তা দিয়েই রেখেছিল। এটাই সেই টেস্ট সিরিজ, মূলত যেখান থেকে মুমিনুল হক-এর ‘ব্র্যাডম্যানের বাংলাদেশী সংস্করণ’ হওয়ার সূচনা।
সাকিব বিহীন বাংলাদেশ-শিবিরে কিঞ্চিৎ শঙ্কা থাকলে আত্মবিশ্বাসের অভাব হয়নি। ব্যাটিংয়ে অধিনায়ক মুশফিকুরের দুর্দান্ত নক এবং নাইমের দারুণ সহযোগ, বাংলাদেশকে চমৎকার একটা স্কোর এনে দিয়েছিল। কিন্তু নিউজিল্যান্ডে ম্যাককালাম-টেলরদের মতো ব্যাটসম্যান আছেন, ২৬৫ কতটা যথেষ্ট আসলে?
শুরুতে উইকেট হারালেও গ্র্যান্ট ইলিয়টের দায়িত্বশীলতা ছিল নিউজিল্যান্ডের ভরসা। লম্বা ব্যাটিং লাইন আপ থাকায় খুব একটা ভাবনার কারণও সৃষ্টি হয়নি তখন। রুবেল আক্রমণে আসেন ১৭তম ওভারে। প্রথম ওভারেই উইকেট মেইডেন। ব্যাকফুটে থাকা নিউজিল্যান্ডকে কোনঠাসা অবস্থায় পাঠিয়ে দেয়া যেন। টেলরকে মুশফিকুরের ক্যাচে পরিণত করে বাংলাদেশের বড় একটা দুশ্চিন্তা-ই দূর করে দেন রুবেল। কোরি এন্ডারসনের আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের সঙ্গে গ্র্যান্ড ইলিয়টের একপ্রান্ত আগলে রাখা— এই দুইয়ের সমন্বয়ে নিউজিল্যান্ড যখন ম্যাচে ফিরছে মনে হচ্ছে, ঠিক তখন বৃষ্টি-বাঁধা।
২০ ওভারে ৮২ রানে ৩ উইকেট। এই অবস্থায় ম্যাচ পন্ড হলে বাংলাদেশেরই জয়। পার স্কোর থেকে ২৫ রান পিছিয়ে সফরকারীরা। কিন্তু ঘন্টা দেড়েকেরও বেশি সময় পর ম্যাচ পুনরায় শুরু হলে তা নেমে আসে ৩৩ ওভারে। তখন নিউজিল্যান্ডের টার্গেট দাঁড়ায় ২০৬। তার মানে বাকি ১৩ ওভারে ১২৪ রান দরকার। ম্যাককালাম ভ্রাতৃদ্বয়, এন্ডারসন, নিশামের মতো ক্লিন হিটার দলে থাকলে তা খুব একটা বড় টার্গেট মনে হবে না নিশ্চয়!
এন্ডারসন ও ইলিয়ট সেটাই জানিয়ে দিলেন। প্রথম তিন ওভার থেকে এলো যথাক্রমে ৬, ১৫ ও ১৭ রান। শেষ ১০ ওভারে প্রয়োজন ৮৬ রান। কার্টেল ওভারে ম্যাচ নেমে আসায় মাশরাফি ও সোহাগ গাজীর ওভার শেষ। পরিকল্পনা যা ছিল, তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। রুবেল ও আব্দুর রাজ্জাকই এভেইলএবল। মুশফিক তা-ই নিয়ে ময়দানে।
আর রুবেলের বাজিমাৎ তারপরই।
রুবেল ২ ওভারে ১৪ রান দিয়ে টেলরকে তুলে নিয়েছিলেন। ২৪তম ওভারে আক্রমণে তিনি। আরো ম্যাক্সিমাম ৫ ওভার বল করতে পারবেন। তার ভালো দিন হলে, বাংলাদেশ ক্রিকেটের হাসার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, আর বাজে দিন গেলে বাংলাদেশ ক্রিকেটের পরিসংখ্যানে লেখা হবে আরো একটি পরাজয়।
প্রথম বল ডট। দ্বিতীয় বল থেকে সিঙ্গেল নিলেন ইলিয়ট। তৃতীয় বলে বোল্ড এন্ডারসন। চতুর্থ বলে ম্যাককালাম ক্যাচ দিতে বাধ্য হলেন। আর পঞ্চম বলে নিশাম মুশফিকুরের হাতে ধরা পড়লেন। হ্যাটট্রিক। শাহাদাত হোসেন ও আব্দুর রাজ্জাকের পর তৃতীয় বাংলাদেশী। গতি, লাইন এবং স্লোয়ারের চতুর সমন্বয়; রুবেল বাংলাদেশকে উপহার দিলেন দারুণ এক জয়।
ন্যাথান ম্যাককালামকে ফিরিয়ে দিয়ে পূর্ণ করেন ফাইফার। আর পথের শেষ কাঁটা গ্র্যান্ড ইলিয়টকে মাশরাফির তালুবন্দী করে ষষ্ঠতম শিকার ঝুলিতে পুরেন রুবেল। ম্যাচশেষে তার ফিগার দেখাচ্ছে ২৬ রানে ৬ উইকেট। আদতে ২৩ বলের ছোট্ট একটা ঝড়ে, ১২ রান দিয়ে ৫ উইকেট নিয়ে নিউজিল্যান্ডের সমস্ত আশা-আকাঙ্খা ও স্বপ্নে জল ঢেলে দেয়ার কাজটা সফলতার সঙ্গে করেছিলেন তিনি। ফলে নিউজিল্যান্ডকে ঘরের মাঠে দ্বিতীয় ‘বাংলাওয়াশ’ করার পথে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ এগিয়ে যাওয়া।
২৬ রানে ৬টি উইকেট বা প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড কিংবা হ্যাটট্রিক আছে বলে নয়, মাঠে রুবেলের যেরকম আগ্রাসন, রথী-মহারথীদের উপড়ে ফেলার যে বাসনা ও আত্মবিশ্বাস তিনি দেখিয়েছিলেন এবং মাঠভর্তি মিরপুরের দর্শক যে আগুন উস্কে দিয়েছিল— এই বোলিং বা স্পেল না রেখে আমাদের উপায় ছিল না আসলে!
পরের গল্পের নায়ক একজন অভিষিক্ত। একজন তরুণ। লিকলিকে পাটকাঠির মতো শরীর তার। এই ক’বছরেও শারীরীক গঠন ও আকৃতিতে তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। সেই যে শুরু, তারপর তিনি ভারত-ইংল্যান্ড হয়ে বিশ্বজয়ের লক্ষ্যে পা রেখেছেন বিশ্বের নানা প্রান্তে। অনেকেই তার নাম অনুমাণ করতে পারছেন, নিশ্চয়?
মুস্তাফিজুর রহমান। বিস্ময় বালক থেকে আজকের পরিণত তরুণ। বাংলাদেশ ক্রিকেটের পেস ইউনিটের অন্যতম সুনিপুণ ও গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী। তার সঙ্গে ‘শিল্পী’-ই মানানসই। তার বাঁহাত জাদু জানে, ‘কাটার’ নামের কী এক মারণাস্ত্র নিয়ে হাজির হয়েছিলেন, কুপোকাত সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠদল।
রঙ্গমঞ্চ— শেরে বাংলা স্টেডিয়াম, মিরপুর, ঢাকা। আঙিনা— ওডিয়াই ক্রিকেট। প্রতিপক্ষ— ভারত। সময়কাল— জুন, ২০১৫।
মাস কয়েক আগে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ দাবানলের সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করে রেখেছিল। আম্পায়ারদ্বয়, ভারতীয় ক্রিকেট দল, আইসিসি, বিসিসিআই; সবাই বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রতিপক্ষ। আর এর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ বা শত্রুপক্ষ হচ্ছে— ভারত। অতএব সেই ভারতীয় দল বাংলাদেশের আতিথ্য গ্রহণ করতেই বাংলাদেশ ক্রিকেটে কেবলই প্রতিশোধের মন্ত্র।
ক্রিকেট নিছক খেলা মাত্র। হারজিৎ— খেলারই অংশ। ভুলত্রুটি— মানবীয় সীমাবদ্ধতারই একটা রুপ। ক্রিকেট বা যেকোনো খেলা কোনো প্রতিশোধের মঞ্চ নয়, বরং তা মোটাদাগে সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বেরই বার্তাই বয়ে নেয় দেশ থেকে দেশে।
এই সমস্ত শোনার সময় তখন কারো নেই। ভারতকে জবাব দেয়া চাই-ই চাই।
বাংলাদেশের শুরুটাও হলো আগ্রাসী। তামিম-সৌম্য কেউ কারো চেয়ে কম যান না। ১৩ ওভারে একশো পেরোয় বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত ভারতের সামনে ৩০৭ রানের হৃষ্টপুষ্ট সংগ্রহ দাঁড় করায়। কিন্তু তারও আগে চার-চারজন পেসার নিয়ে খেলতে নেমে ফিয়ারলেস ক্রিকেটের একটা বার্তা দিয়ে রেখেছিলেন অধিনায়ক মাশরাফি।
ভারতের শুরুটাও আক্রমণাত্মক। ফিল্ডারদের ক্যাচ মিস মড়ার উপর খাড়ার ঘা। লম্বা ব্যাটিং লাইন আপ ভারতের। রোহিত, ধাওয়ান, কোহলি, রাহানে, রায়না, ধোনী... বড় বড় নাম সব। সেখানে একটা ক্যাচ মিস করা মানে নিজের পায়ে নিজেই কুড়োল মারা। সেই কুড়োল মারার কাজটিই করে বসল বাংলাদেশ। কিন্তু এইদিন সব সম্ভবের দিন। তাই ধাওয়ান আবার ভুল করতে বাধ্য হন। তাসকিন পরপর দুই ওভারে ধাওয়ান-কোহলি দু’জনকেই ফেরান। গর্জে ওঠে গ্যালারী। পুরো বাংলাদেশ যেন কেঁপে কেঁপে উঠে।
মুস্তাফিজুর রহমান নতুন বল হাতে ৪ ওভার করেছিলেন। ২৭ রান দিয়ে কোনো উইকেট পাননি। ২১তম ওভারে অধিনায়ক মাশরাফি তাকে আবারো আক্রমণে নিয়ে আসেন। আর এবার কাটারে রোহিত-কাঁটা উপড়ে ফেলেন মুস্তাফিজ। পরের ওভারে রাহানে। রক্তের নেশায় বাঘ যেমন হয়ে উঠে হিংস্র ও ভয়ঙ্কর, বাংলাদেশ ক্রিকেটও তেমন উন্মত্ত হয়ে উঠে। যেন মানুষখেকো নেকড়ে পেয়ে গেছে মানব-মাংসের ঘ্রাণ।
মুস্তাফিজুর সপ্তম ওভারের দুটো বল করে ড্রেসিংরুমে ফিরে যেতে বাধ্য হন। ধোনীর ধাক্কায় পড়ে যান লিকলিকে মুস্তাফিজ। ধোনীর দৌড়-পথে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। অবশ্য ধোনীর ধাক্কাটাও অনিচ্ছাকৃত ছিল কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কিন্তু দর্শকের অত প্রশ্ন-উত্তরের সময় নেই। গর্জন শুরু হয়। হুড়োহুড়ি, হুল্লোড়। মেজাজ চড়ে যায় সকলের। একটুখানি ছোকরাটাকে ঐ মুশকো জোয়ান কোন আক্কেলে ধাক্কা মারে?
যে আগুন এতক্ষণ দাউ দাউ করে জ্বলছিল, এবারে তা দাবানলে পরিণত হয়। এতক্ষণ যা কেবল একটা অঞ্চল বা এলাকা পোড়াবে মনে হচ্ছিল, এবারে তা মাইলের পর মাইল ছারখার করে দেবে মনে হয়।
মুস্তাফিজ ফেরেন মাঠে। সাকিবের বলে তার আগেই ফেরেন ধোনী। উত্তাল হয়ে উঠে এই জনপদ। রায়না-জাদেজা টিকে থাকেন ভারতের আশা হয়ে। ৩৭তম ওভারে বল হাতে নেন মুস্তাফিজ। সহস্র চিৎকার তাকে সাদরে গ্রহন করে। প্রথম বলেই রায়নার ছয়, কিন্তু চতুর্থ বলেই বোল্ড রায়না। পরের বলে অশ্বিন। পরের ওভারে জাদেজাও আউট। অভিষেকেই মুস্তাফিজের ফাইফার পূর্ণ। যেন মহাবীর দ্য গ্রেট আলেক্সান্ডার। এলাম, দেখলাম, জয় করলাম।
প্রেক্ষাপট, প্রতিপক্ষ ও পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় এটা কী পরিমাণ বারুদে ঠাসা ম্যাচ ছিল তা সেই সময়ে ম্যাচ-উপভোগ করা দর্শক মাত্রই উপলব্ধি করতে পারবেন। এতটা উত্তেজনার ম্যাচ বা সিরিজ তার আগে-পরে বাংলাদেশ আর খেলেছে কিনা সন্দেহ! মুস্তাফিজের সারল্য, অমায়িক ব্যবহার, আকন্ঠ বিস্তৃত হাসি— সবকিছুতেই অদ্ভুত ভালোলাগা আর স্নিগ্ধ-আবহ। কিছুতেই ফাস্ট বোলার সুলভ আগুন নেই। তবে যে সময়ের মহানায়ক তিনি, তা বিবেচনায় এই আগুন গদ্যের উপাখ্যানে, একটা চরিত্র না হয়ে উপায় নেই তার!
মুস্তাফিজ অমন আগুনে-স্পেল আরো ভুরিভুরি উপহার দেবেন, এই আশাবাদ।
****
আলোচনার একদম শেষ প্রান্তে আমরা। এবার উপসংহার। হঠাৎ ম্যাচজয়ী স্পেল বা আনপ্লেয়বল ডেলিভারিতে ব্যাটসম্যান ব্যতিব্যস্ত করা মুহূর্ত, এইমুহূর্তে হয়তো হাতে গোণা। তবে তাসকিন রিদমে ফিরছেন। রুবেলেরও দেয়ার বাকি অনেক। এবাদাত লম্বা রেসের ঘোড়া হতে পারেন। আবু জায়েদের মধ্যেও আছে সম্ভাবনা। মেহেদী হাসান রানা, শরীফুল ইসলাম, হাসান মাহমুদ... বেশ কয়েকজন প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ উঠে আসছেন। আশা করা যায়, এমন দিনও আসবে বাংলাদেশ ক্রিকেটে যখন ক্রিকেট মাঠে আগুনে গদ্যের উপাখ্যান লিখতে গিয়ে যে কেউ হিমশিম খাবেন। এত এত অবিশ্বাস্য স্পেলের সাক্ষী হবেন যে, আঙুলে গুণে শেষ করতে পারবেন না।
আমাদের পক্ষ হতে তেমনই অনাগত আগামীর প্রত্যাশা।
- 0 মন্তব্য