• ফুটবল

স্পোর্টস মেডিসিনের কল্যাণে যেভাবে নতুন জীবন পেলেন এরিকসেন

পোস্টটি ১২৮৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

 

“জন্মিলে মরিতে হইবে”-এটাই পৃথিবীর শাশ্বত সত্য। কিন্তু মৃত্যুর দুয়ার থেকে মর্ত্যের পৃথিবীতে ফিরে এসে স্বাভাবিক নতুন জীবন লাভ করাটা সত্যি অলৌকিক। যা সৃষ্টিকর্তার কৃপায় আর মানুষের অদম্য চেষ্টার সাফল্যের জোরে ঘোটে গেলো ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনের পারকেন স্টেডিয়ামে গত ২৫শে মে ২০২১ ইং সালে ড্যানিশ সকার অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার ক্রিস্টিয়ান ড্যানিমান জীবনে ২০২০ ইং সালের ইউনিয়ন অফ ইউরোপিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশানের চ্যাম্পিয়নশিপের (উএফা) ম্যাচে ফিনল্যান্ডের বিপক্ষে খেলার সময় হাজার হাজার দর্শকের সামনে। খেলা চলার ৪২ মিনিটের মাথায় ২৯ বৎসর বয়সী ৫ ফুট ১০ ই  লম্বা ১০ নম্বর জার্সিধারী এরিক্সন নাটকীয় ভাবে সাইড লাইনের একটি থ্রো রিসিভ করার সময় অকস্মাৎ সম্পূর্ণ জড় পদার্থের মতন মাঠে অচেতন হয়ে লুটিয়ে পড়েন, মুহূর্তের মধ্যে সবার ভ্রূ-কুি ত হল, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সতীর্থ ৫ নম্বর জার্সিধারী ম্যাডিক্স প্রথমে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হোলেও মুহূর্তে চৈতনে ফিরে এসে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, টিম কাপ্টেন সাইমন এরিক্সনের মাথা ও জিহŸা সোজা কোরে মাটির দিকে নুয়িয়ে দেন, রেফারী খেলা বন্দ করেন, মাঠে কর্তব্যরত ইমারজেন্সি স্পোর্টস-মেডিসিনের বিশেষজ্ঞদল প্রবেশ করেন, মাঠে উপস্থিত সকল খেলোয়াড় আর রেফারীর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে উঠে, চিকিৎসকদলের নির্দেশে খেলোয়াড়রা চারিদিকে এরিক্সনকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে থাকেন, গ্যালারী থেকে তার বান্ধবী (তার দুই সন্তানের জননী) সাব্রিনা কেভিসট জেন্সেন ক্রন্দনরত অবস্থায় মাঠে ছুটে যান  এবং মাঠভর্তি দর্শক অজানা ভীতি ও  উৎকণ্ঠায় নিঃশব্দে হতবিহব্বলভাবে বসে রইলেন। 

এরিক্সন ছিলেন তখন অজ্ঞান, তার হার্টবিট ছিল বন্ধ, পালস পাওয়া যাচ্ছিলো না আর শ্বাস-প্রশ্বাসের তো প্রশ্নই আসে না। এভাবেই প্রায় ১৫০ সেকেন্ড গড়িয়ে যায়। ইমারজেন্সি চিকিৎসক বিশেষজ্ঞদল মরিয়া হয়ে কার্ডিও-পালমোনারী রিসাসিটেসন প্রটোকল অনুযায়ী (যাকে ডাঃ এইচ, আর, সিল্ভাস্টার মেথডও বলে)  শুরু করেন; মাঠে কাজ করার সময় এ অবস্থায় প্রধানত ৩ টি “পি” রুল ফলো করা হয়- ১) প্রিসারভ লাইফ বা জীবনকে ধরে রাখা, ২) প্রিভেনট ডিটোরেসন বা অবনতি ঠেকান এবং ৩) প্রম্পট রিকাভারি বা তাড়াতাড়ি অবস্থার উন্নতি করা। কারণ হার্ট বন্ধের জন্য শরীরে রক্ত স ালন কমে আসছিলো এবং  শ্বাস-প্রশ্বাসের অভাবে শরীরের বিভিন্ন অর্গান ও মস্তিস্কে অক্সজিনের পরিমাণ কমে আসছিলো।  আর প্রটোকল অনুযায়ী পাঁচটি দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়, যথা- ১) এ-এয়ারওয়ে যা শরীরে বাতাস ঢুকার কোন বাঁধা না থাকে-যে জন্য জিহŸা যাতে উল্টে পেছনে না যায় সেদিকে লক্ষ্য, ২) বি-ব্রিদিং যাতে চালু করা যায়, ৩) সি-সার্কুলেশন (রক্ত) যাতে চালু করা যায় , ৪) ডি-ডিসাবিলিটি বা রোগীর অসাড়তাকে লক্ষ্য রেখে কাজ করতে হবে এবং  ৫) ই-এনভাইরমেনট যাতে কাজের সম্পূর্ণ পরিবেশ থাকে । কর্তব্যরত  চিকিৎসকদল মাঠেই তাদের কাজ শুরু করে এরিক্সনের প্রাণ ফেরানোর জন্য নিয়মানুযায়ী, যথা-১) জিহŸাকে আঁটকে দেয় যাতে পেছনে না যায়, ২) চিত করে শুয়িয়ে দেয়, ৩) হাত দুটোকে উপরের দিকে শক্ত করে ধরে রাখে, ৪) পা দুটোকে উপরের দিকে উঠিয়ে শক্ত করে ধরে রাখে, ৫) বুকের বাম দিকে হার্টের উপর দুহাত দিয়ে একটার উপর আরেকটা রেখে সজোরে প্রতিমিনিটে ১০০-১২০ বার করে পালাক্রমে দুজনে চাপ দিতে থাকে, ৬) পোর্টেবল অক্সিজেন সিলিন্ডার ও এ্যাম্বু ব্যাগ দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের চেষ্টা চালায় এবং ৭) সর্বশেষে ব্রমাস্ত্র হিসাবে মাঠেই তার উপর পোর্টেবল ডিফিব্রিলেটর মেশিন ব্যবহার করে তার হার্টের ইম্পাল্সকে কৃতিমভাবে ফিরিয়ে আনা হয়। তারপর তাকে ঐ অবস্থায় ফিল্ড স্ট্রেচার ও কার্টের সাহায্যে মাঠ থেকে বের করে আই, সি, ইউ এ্যাম্বুলাে  করে ইমারজেন্সি চিকিৎসক বিশেষজ্ঞদল কোপেনহেগেনের ক্যাপিটাল রিজিওনে অবস্থিত ১৭৫৭ ইং সালে স্থাপিত স্পেসিয়ালাইসড রিগ হসপিটালের ইমারজেন্সি কার্ডিওলজী সেন্টারে নিয়ে যায়। ১ ঘণ্টার মধ্যেই হসপিটাল থেকে জানানো হয় যে এরিক্সনের অবস্থা আশংক্ষামুক্ত।

 মাঠ এবং উএফা কর্মকর্তারা তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত দেয় যে খেলা চালাতে হবে নতুবা ডেনমার্কে ৩-০ গোলে লিখিতভাবে পরাজয় স্বীকার করতে হবে, অতএব খেলা ১  ঘণ্টা পর তার গতি ফিরে পেল। কারণ ফিফা রুলানুযায়ি- “ খেলার চেয়ে জীবন বড়” সুতরাং তারা তৎক্ষণাৎ নিরবিচ্ছিন ও ত্রুটিহিনভাবে চিকিৎসা সেবার সকল বাবস্থা সুনিশ্চিত করার পর ও হাসপাতালের গ্রিন সিগন্যাল নিয়েই সিদ্ধান্তে অনড় ছিল। ২১-২৬ অগাস্ট ১৯৯৫ ইং সালে ঢাকায় বিএফএফ-এ ফিফা র্কতিক অনু্িস্টত স্পোর্টস-মেডিসিন -এর সেমিনারে অস্ট্রেলিয়ান চিকিৎসক প্রফেসর ডাঃ শ্রী কারনাংগারা  এই একই কথা বলে গিয়েছিলেন,  কিন্তু বিএফএফ কতোটুকু সে নিয়ম পালন করে তা সবাই জানে।

রিগ হসপিটালে এরিক্সনকে র্আটিফিসিয়ালি স্টেবল করার কয়েক দিন পর কার্ডিওলজী সেন্টারে তার হার্টের মধ্যে একটি কার্ডিওর্ভাটেড ডিফিব্রিলেটর মেশিন অপারেশনের করে স্থাপন করা হয়, যার বদৌলতে পরবর্তীতে তার খেলোয়াড়ি জীবনে কোন অসুবিধা হওয়ার কথা না। এরিক্সনের মতন একই অবস্থা হয়েছিল ইংলিশ ফুটবলার ফাব্রি মুম্বা (২০১২ ইং সাল)  ও ডাচ ফুটবলার আব্দেহাক নুরাই-এর  (জুলাই ৮, ২০১৭ ইং সাল)  জীবনেও , কিন্তু দুর্ভাগ্যবসত তাঁদের ব্রেন ড্যামেজ (পারসিয়াল) হেয়ে গিয়েছিলো রক্ত ও অক্সিজেনের অভাবে। তারা আর পরবর্তী জীবনে খেলায় ফিরে আসতে পারেনি। 

ফিল্ড স্পোর্টস-মেডিসিন বিশেষজ্ঞের বিশেষত্ব হোল ইনজুরির মুহূর্তে ইনজুরিকে রিড বা উপলব্ধি করা ( জার্মান ফিজিসিয়ান র্আথার মালউইতসের মতে ১৮৮০-১৯৬৮ ইং সাল)  আর ইমারজেন্সি মেডিসিন বিশেষজ্ঞের বিশেষত্ব হোল  ইনজুরিকে তৎক্ষণাৎ ম্যানেজ করা ( আইরিশ ফিজিসিয়ান ফ্রাঙ্ক পানড্রিচের মতে ১৯১৬-২০০৪ ইং সাল )। 

সৃষ্টিকর্তার সহায়তায় এরিক্সনের নতুন জীবন লাভের কৃতিত্বের সন্মান স্বরূপ  “ট্্রু হিরোস অফ উইফা ২০২০ ইং সাল” নামে “২০২১ ইং সাল উইফা প্রেসিডেন্ট এওয়ার্ড”   পাবেন মেডিক্যাল টিমের ৮ জন ও ডেনমার্ক ফুটবল টিমের কাপ্টেন,  যথাঃ- ১)  র্মজেন ক্রুজফিল্ড-চীফ মেডিক্যাল অফিসার, ২) ফ্রেডরিক ফ্লেন্সটেড-স্টেডিয়াম মেডিক্যাল মানাজার , ৩) এন্ড্রেস বসেন-ফিল্ড ইমারজেন্সি ফিজিসিয়ান, ৪) প্যাডর এরসগার্ড-প্যারামেডিক, ৫) জেন্স ক্লেনফিল্ড-ভেনু মেডিক্যাল অফিসার,৬) ভ্যালেন্টিন ভেলাকভ- ভেনু মেডিক্যাল অফিসার,৭) মরটেন জলডাগার-টিম ফিজিও, ৮) মরটেন বিসন–টিম ফিজিসিয়ান, ৯)সাইমন জার- ডাচ টিম কাপ্টেন ।

স্পোর্টস-মেডিসিন ও ইমারজেন্সি মেডিসিনের এই সাফল্য ক্রীড়াঙ্গনের জন্য এক বিরাট ভরশা ও সস্থির অধ্যায়। যদিও সাবজেক্ট দুটি একে অন্যের সম্পূরক ।    

 (ডাঃ গোলাম শওকত হোসেন- চিকিৎসক, শিক্ষক, গবেষক ও লেখক)