• ফুটবল

একাকী লড়াইয়ে পরাজিত এক সৈনিক

পোস্টটি ৫৯০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
রীতিটা অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। সেদিনও ঘটলো না ব্যতিক্রম। "নর্দার্ন ডার্বি" (হাম্বুর্গ-হ্যানোভার) তে সমতা নিয়েই ম্যাচের ইতি টেনেছেন রেফারি। হ্যানোভারের হাইনয ভন হাইডেন অ্যারেনাতে সমর্থকদের অভিবাদন জানাচ্ছিলেন স্বাগতিক "ডি রটেন" এর ফুটবলারেরা। দলের অধিনায়ক রবার্ট এংকাও হাত নেড়ে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের পর্ব সারছিলেন।
 
 
Robert-Enke1920x1280
স্থানীয় ক্লাব কার্ল যাইজ জেনার হয়ে অভিষেক পেশাদার ফুটবলে। শুরুর সাথে শেষটাও মিলেছিল এক বিন্দুতে, সেই হ্যানোভারের হয়েই অভিষেক।
তিনটে ম্যাচ খেলেছিলেন, কোচ এবারহার্ড ভোগেলের প্রথম পছন্দ তার পরেই ফিরেছিলেন গোলপ্রহরী হয়ে।
অবশ্য তাতেই নজর কেড়েছিলেন রাঘব-বোয়ালদের। বরুশিয়া মুনশেনগ্ল্যাডবাখের নজর কাড়লেন, দ্বিতীয় বিভাগ থেকে সোজা বুন্দেসলীগার একজন এংকা। প্রথম দুটো মৌসুম বয়সভিত্তিক দলে খেললেন। তৃতীয় মৌসুমে নাম্বার ওয়ান উয়ে কাম্পসের অ্যাকিলিস চোটের কারণে মূলদলে অভিষেক।
শুরুটা মধুর, শালকার বিপক্ষে ৩-০ গোলের জয়ে রাখলেন ক্লিনশিট। কিন্তু দুনিয়াতে যে বড্ড মন্দ ভাগ্য নিয়ে এসেছিলেন এংকা, পরের দুই ম্যাচে বেয়ার লেভারকুসেন আর ভলফসবুর্গের কাছে পনের গোল হজম করতে হলো মুনশেনগ্ল্যাডবাখকে। টেবিলের তলানিতে থেকে অবনমন, নজরকাড়া একেকটা পারফর্মেন্স দিয়েও তা আটকাতে পারেননি এংকা। লেভারকুসেনে থাকার সময়টাতেই এক অচেনা শত্রু বাসা বেঁধেছিল মাথায়। মানসিক অবসাদ তার নাম। সেই শুরু। "প্যানিক অ্যাটাক" এর সাথে পরিচয় তখনই।
পর্তুগালে পাড়ি জমালেন, একসময়ের দোর্দন্ডপ্রতাপে ইউরোপে ছড়ি ঘোরানো বেনফিকায়।
চুক্তি সই করার পরে হোটেলে ফিরেই মানসিকভাবে ভেংগে পড়েছিলেন, ফলাফল - জার্মানির ফিরতি বিমানে চেপে বসা। কিন্তু পেশাদার ফুটবলের দুনিয়াটা তো দুর্বলচিত্তদের জন্য নয়। চুক্তির প্রতি সম্মান দেখিয়ে আইবেরিয়ায় ফিরলেন। আত্মবিশ্বাস তখন তলানিতে, পেলেন আশ্রয়। বটবৃক্ষের ছায়া হয়ে আগলে নিলেন স্বদেশী কোচ ইয়ুপ হাইংকেস। দলের ম্যানেজমেন্টে আরো ক'জন জার্মান ছিলেন৷ তাই ভিনদেশে এক টুকরো বাড়ির খোঁজ পাওয়া। কিন্তু সুখের দেখা যে মেলে না। বেনফিকার চলছে দুঃসময়ে। দলের ফর্ম ভালো না, অর্থনৈতিক দৈন্যতা ক্রমশ জড়িয়ে ধরছে। হাইংকেস ছাঁটাই দলেন।
 
Goalkeeper+Robert+Enke+Dies+Aged+32+0wPRjGmpIYrx
 
তিন বছরে চারবার কোচ বদল হলো "আগুইয়াস" দের। বেনফিকা সমর্থকেরা অবশ্য এই জার্মানকে আপন করে নিয়েছিল, পর্তুগালের রাজধানীতে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন এংকা। নামধাম বেশ শোনাচ্ছিল দলবদলের বাজারেও। আর্সেনাল, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, আতলেতিকোকে পেছনে ফেলে সেই দৌড়ে জিতলো বার্সেলোনা। কাতালুনিয়াতে আসার পর্বটাই ছিল বেশ গোলমেলে। দর হাঁকাহাঁকির পর চুক্তি নিয়ে অচলাবস্থার শংকা, এংকা তাই ফোন করেছিলেন ব্লাউগারানা কোচ লুই ফন হালকে। হালের সোজাসাপ্টা জবাব, "আমি তো চিনিই না তোমাকে। ডিরেক্টর তোমাকে চেয়েছে দেখেই আসছো।" আত্মবিশ্বাস চুরমার হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। বার্সার ফুটবল দর্শনের সাথেও নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলেন।
তৃতীয় বিভাগের নভেলদা সিএফ এর মাঠে মাত্র ৫,০০০ দর্শকের সামনে হেরে বসলো বার্সেলোনা। ম্যাচশেষে জনসম্মুখে দুটো গোলের জন্য এংকাকে সরাসরি দুষলেন ফ্রাংক ডে বোর।
বার্সেলোনা ক্যারিয়ারের অকাল মৃত্যু সেখানেই। দম আটকে আসছিল, মুক্তি নেই।
লা লীগায় ওসাসুনার বিপক্ষে ২০ মিনিট আর চ্যাম্পিয়ন্স লীগে নিয়মরক্ষার দুটো ম্যাচে নামলেন। বার্সা কোচের পালাবদল, তরুণ ফ্রাংক রাইকার্ড দলের হাল ধরলেন।
তুরস্কে ফেনেরবাচের হয়ে ধার খেলতে গেলেন। সুসময়ের দেখা কী মিলবে এবার? অভিষেকে ইস্তাম্বুলস্পরের বিপক্ষে ৩-০ গোলের হার, গ্যালারি থেকে নিজ সমর্থকদের লাইটার আর বোতল ছুটে এলো এংকার দিকে। ক্যারিয়ারে গতি নেই, ঘিরে ধরছে অবসাদ। এবার সেগুন্দা বিভাগের ক্লাব তেনেরিফের হয়ে খেলতে গেলেন৷৷ নয়টা ম্যাচ খেলেছিলেন, সেই ম্যাচগুলোই হয়তো ফুটবল ক্যারিয়ারকে বাঁচিয়ে দিলো। এবার নিজভূমিতে ফেরার পালা, হ্যানোভারের চুক্তিপত্রে সই করে জার্মানিতে প্রত্যাবর্তন।
১৯৯৯ এর কনফেডারেশন্স কাপে দলে জায়গা পেলেও মাঠে নামা হয়নি। অল্পের জন্য ২০০৪ ইউরো আর ২০০৬ এর বিশ্বকাপ মিস হয়ে গেলো। অবশেষে ২০০৭ সালের ২৮ মার্চ ডেনমার্কের বিপক্ষে জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক। "ডি মানশাফট" এর হয়ে অবশেষে টুর্নামেন্টের টিকিট মিললো।
২০০৮ ইউরোতে ইয়েন্স লেম্যানের পর দ্বিতীয় পছন্দ হিসেবে অস্ট্রিয়া-সুইজারল্যান্ডে গেলেন। তবে মাঠে নামা হয়নি সেবারও। হ্যানোভারের অধিনায়ক হিসেবে বেপথু ক্যারিয়ারকে আবার ভালোমতো দাঁড় করাচ্ছিলেন।
ইয়াকিম লুভের প্রথম পছন্দ হিসেবে ক্রমশই আত্মপ্রকাশ করছিলেন। আফ্রিকার প্রথম বিশ্বকাপে "এক নম্বর" জার্সিটা এংকারই পাওয়ার কথা ছিল হয়তো। হয়তো...
মেয়ে লারা জন্মেছিল হৃদযন্ত্রে সমস্যা নিয়ে। অস্ত্রোপচার পরবর্তী জটিলতায় শ্রবণশক্তি হারালো মেয়েটা। শেষ রক্ষা হয়নি, ২০০৬ সালে মা-বাবার বুক খালি করে অসীমের পথে পাড়ি জমালো লারা।
অবসাদ ক্রমেই গ্রাস করছিল, চোখের মণির বিদায়ে মুক্তির দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল চিরতরে। শুন্যতা ঢাকতে সন্তান দত্তক নিয়েছিলেন। হয়তো ভেবেছিলেন শোককে পাথর চাপা দিতে পারবেন। হয়নি সেটা।
তাই হ্যানোভারের হয়ে নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছিলেন। জীবনের সাথে ফুটবল নামক সুতোটার যোগই এংকাকে রেখেছিল নশ্বর পৃথিবীতে। একদিন সেই সুতোটাও ছিঁড়ে গেলো। সবার অগোচরেই, বড্ড অবহেলায়।
 
GYI0058879302
 
রবার্ট এংকা আত্মহত্যা করেছিলেন। হাম্বুর্গের বিপক্ষে সেই ম্যাচের দু'দিন পরে স্ত্রীকে অনুশীলনের কথা বলে গাড়ি নিয়ে বেরোলেন। বেশ কিছুক্ষণ এদিক সেদিকে ঘুরে বেড়ালেন। সন্ধ্যের দিকে এলিভেসের এক লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে এসে গাড়ি থামিয়ে দিলেন। বেরিয়ে হাঁটা দিলেন রেললাইনের দিকে...
পুরো ফুটবল বিশ্ব থমকে গিয়েছিল। সুইসাইড নোটটা পুলিশ পড়তে দেয়নি কাউকে। হাজারো জল্পনা-কল্পনা তাঁর মৃত্যুকে ঘিরে। যে মানুষটা নামকরা সব স্ট্রাইকারের শট ঠেকিয়ে দিতেন, সেই মানুষটাই অবসাদের কাছে হার মানলেন। কিংবা এক নির্মম সত্য মুখের সামনে এনে ছুঁড়ে মারলেন হ্যানোভারের অসাধারণ সব জয়ের নায়কও একজন মানুষ। দুঃখ, কষ্ট, বেদনা তাঁকেও স্পর্শ করে। জার্মানির সেরা গোলরক্ষক হওয়ার সুবাদে মেলা অর্থ-যশ-খ্যাতিও সেই শত্রুকে ফেরাতে পারেনি। নিজের মস্তিষ্কে আটকে থাকা দানবের কাছেই পরাস্ত হলেন এই চ্যাম্পিয়ন।
লোকে তাঁকে ভালোবেসেছিল, ক্যারিয়ারজুড়ে গালমন্দও কম শুনতে হয়নি। হ্যানোভারের প্রতিটা মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছিলেন। পেশাদার ফুটবলারদের জীবনটাই এমন৷
নিয়মিত পারফর্ম করার চাপ তো থাকেই, এর সাথে কোচের চাহিদা, দর্শকদের প্রত্যাশার চাপ মিলিয়ে আস্ত এক প্রেশার কুকার। যে কোনো সময়ে ফেটে যাবে।
সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে সেই চাপটাই শতগুণে বেড়েছে। পান থেকে চুন খসলেই ব্যংগ, বিদ্রূপ থেকে শুরু করে মৃত্যুহুমকি পর্যন্ত সইতে হয়। এংকার আর অনেক কিছুই দেয়ার ছিল হয়তো। গল্পটাতে অসময়ে ইতি টানলো সময়।
শেষকৃত্যানুষ্ঠানে 'ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন" বাজছিল। কিন্তু রবার্ট এংকা ১০ই নভেম্বরের বিকেলে রেললাইন ধরে যখন হাঁটছিলেন তখন তিনি ছিলেন নিঃসংগ, ভীষণ একা। মাথায় বিশাল বোঝা, ভেতরে বীভৎস গতিতে পার হচ্ছে একের পর এক চিন্তা। তারচেয়েও দ্রুতবেগে ছুটে আসছে এক্সপ্রেস ট্রেন। বল আটকাতে জালের কোণায় নিয়মিতই ঝাঁপিয়ে পড়া লোকটা সরলেন না। রেললাইনের মাঝ দিয়ে হেঁটে চলছেন। ট্রেন আসছে।
 
গতকাল চুয়াল্লিশে পা দেবার কথা ছিল এংকার। কিন্তু মানুষটা তো বত্রিশেই আটকে রইবেন চিরকাল!