ছেঁড়া গ্লাভস, ১৫ বছর বয়সী আশা এবং এক ডজন গোলের গল্প
সাদা গ্লাভসজোড়ায় সুতো খুলে আসছে। আসলে গ্লাভসজোড়া উপযোগীতা হারিয়েছে বহু আগেই। তাতে অবশ্য কারও কিছু করার নেই, এই যেন স্বাভাবিক। ছেঁড়া গ্লাভসজোড়াই ভরসা শ্রীমতি আশা কর্মকারের। প্রথমবারের মতো ঢাকায় এসেছেন তিনি। সেটাও ওই গ্লাভসের জোরে।
১৫ বছর বয়সী আশার গল্প আদতে মেয়েদের পেশাদার লিগ ফুটবলের প্রতিচ্ছবি। ৭ বছর বিরতির পর, তিন দফায় পিছিয়ে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে শুরু হয়েছে মেয়েদের লিগ। তাতে প্রথম ম্যাচে জায়ান্ট বসুন্ধরা কিংসের কাছে হেরে ১২-০ গোলে হেরেছে আশার দল বেগম আনোয়ারা স্পোর্টিং ক্লাব।
স্কোরলাইন দেখে অবশ্য আশার আশাব্যঞ্জক গল্প আঁচ করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বসুন্ধরার কাছে বড় ব্যবধানের হারেও তৃপ্তি আছে আশার। এই তৃপ্তি খেলতে পারার, ফুটবল পুঁজি করে ঢাকায় আসার। চাঁপাইনবাবগঞ্জের মেয়ে পড়েন স্কুলে, ক্লাস নাইনে।
আনোয়ারার বাকি খেলোয়াড়রা ম্যাচ শেষে ধন্যবাদই দিয়েছেন সতীর্থ আশাকে। বদলি হিসেবে আশা নামার আগেই ৩ গোল খেয়ে বসেছিল তারা। আশা আরও ৯ গোল হজম করলেও তার দ্বিগুণের বেশি গোল ঠেকিয়ে দিয়েছেন একাই। বয়স মাত্র ১৫, তবে আশার উচ্চতা গোলরক্ষক হওয়ার মতোই। ক্লাস সিক্সে যখন স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন তখন শিক্ষকরাও বিশ্বাস করতে চাননি, এই মেয়েদের বয়স এতো অল্প।
সেই স্কুলে ফুটবলে হাতেখড়ি তার, উচ্চতাকে পুঁজি করেই। ২০১৮ সালে বঙ্গমাতা জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে খেলেছিলেন। এর পর গত দেড় বছরে গুণে গুণে ৫টি ম্যাচেও খেলার সুযোগ হয়নি আশার। কয়েকদিন অনুশীলন করে মাঠে নেমে গিয়েছিলেন মারিয়া মান্ডা, সাবিনা, কৃষ্ণাদের বিপক্ষে খেলতে। ১২ গোল খেয়েছেন বটে, কিন্তু সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই তার, “ম্যাচের আগে স্যার আমাদের বলেছিল আমরা জাতীয় দলের ফুটবলারদের বিপক্ষে খেলতে যাচ্ছি। এরকম কিছু হবে সেটা আমরা জানতাম। কিন্তু খেলতে পেরেছি, প্রথমবার ঢাকায় এসেছি- এটাই ভালো লাগছে।”
চর্মগোলক ফুটবল আশার ভাগ্য বদলাতে পারবে কী না সেটা অযাচিত প্রশ্ন। তবে এই পর্যন্ত আসতেও লড়াই-সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকে। অস্বচ্ছল পরিবারে বড় ভাই একমাত্র উপার্জনকারী। মেয়েকে এসএসসি পাস করিয়ে বিয়ে-শাদী দিয়ে দায়মুক্ত হতে চান তারা। স্কুলে আসা-যাওয়া, দুইবেলা বাধ্যতামূলক কোচিং মিলিয়ে প্রতিদিন ৪০ টাকা খরচ হয়। এই অর্থ দিতেই হিমশিম খেতে হয় আশার পরিবারকে। পড়াশুনাই তো মুক্তির একমাত্র উপায়। তবে আশা চান জাতীয় দলে ফুটবল খেলতে।
ঢাকায় আসার আগ পর্যন্ত সাবিনা-কৃষ্ণাদের নামও জানতেন না আশা। নিজে গোলরক্ষক কিন্তু কয়েকদিন আগে হুলিও সিজারের বাংলাদেশ ভ্রমণ সম্পর্কেও কিছু জানা নেই তার। আসলে সিজারকেই চেনেন না আশা। চাঁপাইনবাবগঞ্জের অখ্যাত গ্রামের মেয়ে জানতেন শুধু তার দিকে বল আসবে, আর তাকে ঠেকিয়ে দিতে হবে।
আক্রমণ নাকি রক্ষণের প্রথম লাইন। যদিও আনোয়ারার মেয়েদের রক্ষণই ছিল না বসুন্ধরার বিপক্ষে ম্যাচে। ঝড় ঝাপ্টা সব গেছে ওই একজনের ওপর দিয়ে। বসুন্ধরার মেয়েরা আক্রমণের বুলডোজার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, আর প্রথমবারের মতো খেলতে নামা আশা কখনও সেগুলো বাঁচিয়েছেন, কখনও দলের বাকিদের মতো মুখ থুবড়ে পড়েছেন। তবে আশার খেলা দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি প্রথমবার মাঠে নেমেছেন। বাতাসেও বেশ শক্ত মনে হলো, ছেঁড়া-ফাটা গ্লাভজোড়ায় গ্রিপও খারাপ না।
মেয়েদের প্রিমিয়ার লিগের জৌলুস বলতে সবটুকুই বসুন্ধরার। আর বাকিদের সবার গল্প কম-বেশী আশার মতো। এখন আশা আরও আশা দেখাবেন নাকি একসময় সোনায় বাঁধানো গ্লাভস হাতে তুলবেন সে গল্পের ভবিষ্যের জন্যই তোলা। এর আগ পর্যন্ত আশারা কেবল উপভোগই করতে পারেন। জোড়া তালির হোক, অব্যবস্থাপনার হোক- পেশাদার লিগ তো!