• বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ
  • " />

     

    দানিয়েল কলিনদ্রেস : অসময়ে রাজ্য ছাড়লেন রাজা

    দানিয়েল কলিনদ্রেস : অসময়ে রাজ্য ছাড়লেন রাজা    

    দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত করে, এরপর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আরও দুই, তিন ধাপ এগুনো গোল উদযাপনটা আর দেখা যাবে না বাংলাদেশে। দানিয়েল কলিনদ্রেসের বাংলাদেশ অভিযান থেমেছে, বসুন্ধরা কিংস ছেড়েছেন কোস্টারিকান ফরোয়ার্ড। তবে কলিনদ্রেসের যাত্রাটা থামল বড় অসময়ে।

    পাট চোকানোর পর কলিনদ্রেস বলেছেন, বসুন্ধরা তাকে ছাড়া ক্লাবের ইতিহাস লিখতে পারবে না। বসুন্ধরা কলিনদ্রেসকে ছাড়া ইতিহাস লিখতেও চাইবে না। প্রথমবার প্রিমিয়ার লিগে এসে বসুন্ধরা একটা বিবৃতি দিতে চেয়েছিল, সেই বিবৃতি ছিল রাশিয়া বিশ্বকাপ খেলা কলিনদ্রেসকে দলে ভেড়ানো। কলিনদ্রেস এর আগে কোস্টারিকার বাইরেই কখনও খেলেননি। এশিয়া তার কাছে অপরিচিত, আরও অপরিচিত বাংলাদেশ। কলিনদ্রেস নতুন একটা চ্যালেঞ্জই নিতে চেয়েছিলেন।

    বিশ্বকাপের খেলোয়াড় খেলবেন বাংলাদেশে, তিনি আবার কেইলর নাভাসের সতীর্থ। রাত জেগে ইউরোপিয়ান ফুটবল দেখা আর দেশের ফুটবলে নাক সেঁটকানো ছোকরাও সে খবর শুনে আঁতকে উঠেছেন। মরা ফুটবল অবশ্য তাতে জেগে ওঠেনি। তবে মাঠে যাওয়ার একটা ছুঁতো অন্তত তৈরি হয়েছিল অনেকের জন্য। যারা মাঠে গেছেন তারাও তৃপ্তি নিয়ে ফিরেছেন। কলিনদ্রেসের টাচ, পাস আর শুটিং তো বাকিদের চেয়ে আলাদা! মিনিট পাঁচেক খেলা দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন এই ভদ্রলোক এই মহাদেশীয় ফুটবল খেলেন না। কলিনদ্রেস একের পর এক গোল করে গেলেন, বসুন্ধরাও জিততে থাকল। ‘রাশিয়া বিশ্বকাপ খেলা কলিনদ্রেসের গোলে জিতল বসুন্ধরা কিংস’ - শিরোনামটাও এক সময় হয়ে গেল নিয়মিত ঘটনা।


    যস্মিন দেশে যদাচার!


    প্রথম মৌসুমে প্রায় শতভাগ সফল কলিনদ্রেস-বসুন্ধরা জুটি। লিগে বসুন্ধরার দাপটের বড় কারণও তিনি। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের এবরো-থেবরো মাঠ বা ঢাকা টু নীলফামারি ট্রেন জার্নি- কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি কলিনদ্রেসের জন্য। ঢাকার ধূলোবালি আর জ্যামের সঙ্গেও কলিনদ্রেস মানিয়ে নিয়েছিলেন দ্রুতই। প্রথম মৌসুমে লিগ, স্বাধীনতা কাপ জিতল বসুন্ধরা কিংস। বাদ ছিল ফেডারেশন কাপ। সেটাও পরের মৌসুমের শুরুতে জেতা হয়ে গেল। কলিনদ্রেস লিগের পর ফেডারেশন কাপেরও সেরা খেলোয়াড় হলেন। কখনও লেফট উইংয়ে, কখনও রাইট উইংয়ে, কখনও খেললেন স্ট্রাইকারের ভূমিকায়। এরপর তাকে সঙ্গ দিতে আর্জেন্টিনা থেকে বসুন্ধরা কিংস উড়িয়ে আনল হের্নান বার্কোসকে।   

    বার্কোসকে দেখে সবচেয়ে বেশি খুশি বোধ হয় কলিনদ্রেসই হয়েছিলেন। অথচ সেই দুইজন একসঙ্গে খেলার সুযোগ পেলেন মাত্র এক ম্যাচ। ওই দিনটা উৎসবের হওয়ার কথা ছিল বসুন্ধরার জন্য। এএফসি কাপে তাদের যাত্রা শুরুর দিন। প্রাণহীন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামও সেদিন সেজেছিল নতুন রূপে। আর বার্কোসকে পেয়ে সেদিন আসল রূপটা দেখিয়েছিলেন কলিনদ্রেস। বসুন্ধরার টাইট্রেশনে অভাব ছিল ইন্ডিকেটরের।  সেই ভূমিকায় কলিনদ্রেস হুঙ্কার ছেড়ে জানান দিয়েছিলেন, দেশের ফুটবলের রঙ বদলেছে।

    টিসি স্পোর্টসকে উড়িয়ে ৫-১ গোলে উড়িয়ে দেওয়ার ম্যাচে বার্কোস করেছিলেন ৪ গোল, অন্যটা কলিনদ্রেসের। বার্কোসের দুই গোলে জোড়া অ্যাসিস্টও ছিল। দুইজনের টেলিপ্যাথিক সম্পর্কটা সেদিনই টের পাওয়া গেল। অমন ম্যাচ শেষে বসুন্ধরা কোচ অস্কার ব্রুজোন দর্শন ফুটবল বাদ দিয়ে দর্শন কপচালেন সংবাদ সম্মেলনে। অস্কার বললেন, কলিনদ্রেস এতোদিন ছিলেন সিঙ্গেল, এবার তার সঙ্গী পাওয়া গেছে। এই দুইজন তার চোখে স্বামী-স্ত্রী। কে জানত, এই জুটির প্রথমটাই হবে শেষ ম্যাচ!

    করোনাভাইরাস হুট করে রাক্ষস না হয়ে উঠলে হয়ত কলিনদ্রেস-বসুন্ধরা কিংস সম্পর্কটা অটুট থাকত। প্রিমিয়ার লিগ  স্থগিত হওয়ার পর ঝামেলার শুরু। পরে দুই পক্ষের চুক্তি ভেস্তে যাওয়াতে তাই অবাক হওয়ার সুযোগ কম। বসুন্ধরা কিংসের গল্পে সাবেক হয়ে যাওয়া ক্লাব অধিনায়ক কলিনদ্রেস থাকবেন গৌরব হয়ে। কিন্তু কলিনদ্রেসের গল্পে বাংলাদেশ থাকবে কোথায়?


    শুধুমাত্র ঘরোয়া লিগ জিততেই বাংলাদেশে এসেছিলেন কলিনদ্রেস? ফিফা বিশ্বকাপ থেকে ফিফা র‍্যাংকিংয়ের ২০০ ছুঁই ছুঁই দেশে খেলতে এলে প্রচ্ছন্ন কিছু দায়িত্ব চাপে কাঁধে। এক কলিনদ্রেসের পক্ষে দেশের ফুটবল বদলানোর কোনো কারণ ছিল না। তবে একটা নতুন ধারা সৃষ্টি হতে পারত। একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠতে পারত। শ্লথ হলেও পরিবর্তনের ধারা কিছুটা হলেও লেগেছিল। সেগুলোই আবার থমকে গেল এখন।  

    বসুন্ধরা প্রেসিডেন্ট ইমরুল হাসান বলেছিলেন, এএফসি কাপে আবাহনীর সাফল্য অনুপ্রাণিত করেছে তাদের। কলিনদ্রেস থাকার পরও বার্কোসকে দলে ভেড়ানো আসলে এএফসি কাপের জন্যই। বার্কোসের সঙ্গে  চুক্তিটাও ছিল সেরকম। কলিনদ্রেসই যদি না থাকেন, বার্কোস একা কতোখানি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারবেন? কলিনদ্রেস যাওয়ার সময় বসুন্ধরাকেই অনেকগুলো প্রশ্নের সামনে ফেলে দিয়ে গেলেন।

    ব্রুজোনের কাছে কলিনদ্রেসের বিদায়ের দিনটা “খুব কঠিন”। ফুটবলের বাইরে কলিনদ্রেসের সঙ্গে তার সখ্যতাটা ছিল বন্ধুর পর্যায়ে। ব্রুজোনের বিশ্বাস তার ক্লাব কলিনদ্রেসের বিদায়ে থমকে যাবে না। বসুন্ধরাও হয়ত আটকে থাকবে না। কিন্তু কলিনদ্রেসের বিদায়টা নিশ্চিতভাবেই এমন হওয়ার কথা ছিল না। এমন সময়ে তো আরও না।  

    ৩,০৯০ মিনিট খেলে ২৬ গোল, ১৩ অ্যাসিস্ট ৩ শিরোপা- সবকিছু কলিনদ্রেস নামের সঙ্গে বড্ড মানানসই। কলিনদ্রেস এসেছিলেন ফুটবল খেলতে, সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন নতুন জীবনের গল্প। একটা সময় বাংলা কিডস নামে একটি দাতব্য সংস্থাও গড়ে তুলেছিলেন বাংলাদেশে। লক্ষ্য ছিল দুস্থ শিশুদের সহায়তা করা। ক্যারিয়ারের ইতি টানতেই তিনি বাংলাদেশে আসেননি- এমন ইঙ্গিত বারবার পাওয়া গেছে তার কথা বার্তায়। ফুটবলের মতো বসুন্ধরার বুকের জীবনটাও থেমে গেল কলিনদ্রেসের। তার ফুটবলের নতুন ঠিকানাও সম্ভবত হতে যাচ্ছে কোস্টারিকার পুরনো ক্লাবেই। তবে একটা আক্ষেপ বোধ হয় সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন তিনিও। অনেক কিছু পাওয়ার আগেই বিদায় বলতে হলো তাকে।  

    বৈশ্বিক মহামারী বদলে দিয়েছে অনেক কিছু। আরও অনেক কিছুই বদলাবে। সেই বদলের গ্যাড়াকলে পড়ে গেলেন কলিনদ্রেসও। সময়টা এর চেয়ে মন্দ হতে পারত না। দুই হাত মেলে ধরে কলিনদ্রেস উড়তেই চেয়েছিলেন, ডানাও মেলছিলেন। তাতে ভর করার কথা ছিল দেশের ফুটবলের। কলিনদ্রেস উড়লেন একাই, বাংলাদেশকে নিয়ে ওড়া হলো কই?