• আইসিসি বিশ্বকাপ ২০১৫
  • " />

     

    ২২ গজে তুলির আঁচড়

    ২২ গজে তুলির আঁচড়    

    নব্বই দশকের তিনজন খেলোয়াড় এই বিশ্বকাপে খেলছেন। আফ্রিদি, জয়াবর্ধনে আর ভেট্টোরী! এই বিশ্বকাপের পরেই ক্রিকেটে নব্বইয়ের দশকের প্রতিনিধিরা বিলুপ্ত হয়ে যাবেন। আফ্রিদি হয়তো থাকবেন টি-টোয়েন্টিতে। তবে সেটা আপাতত বাদ রাখছি।

     

    ব্যাটিং নামক শিল্পের ধ্রুপদীতম শিল্পীর নাম মাহেলা জয়াবর্ধনে। দীর্ঘদিন পরে প্রেমিকাকে প্রথম দেখার সময় প্রেমিকের চোখে যে আনন্দের পরশ দেখা যায় মাহেলা জয়াবর্ধনের ব্যাটিং ক্রিকেট প্রেমিকের জন্য সেরকমই আনন্দদায়ী! প্রেমিকার জন্য যেমন পৃথিবী ঘুরে একশ আটটা নীলপদ্ম খুঁজে বের করা যায়, মাহেলার ব্যাটিং দেখবার জন্যেও মাইলের পর মাইল হেঁটে যাওয়া যায়। ভদ্রলোক একটা শট খেলার সময় যেন বলটাকে আদর করে বলতেন, আবার এসো কেমন? স্পিনারের বল যখন উইকেটকিপারের গ্লাভসে প্রায় জমা হয়ে গেছে ঠিক তার পূর্বমুহূর্তে মাহেলার ব্যাট নেমে আসতো বুলেট গতিতে। লেট কাট শটটা তার মতো ‘লেট’ করে বোধহয় ক্রিকেটে কেউ খেলেনি। পিচের চারপাশে ব্যাটটাকে তুলি বানিয়ে যে ছবি আঁকতেন আধুনিক ক্রিকেটে এক মার্ক ওয়াহই এমনটা করতে পারতেন।

     

    ভাই ধীশালের সাথে ছোটবেলায় একসাথে খেলতেন। জাতীয় দলে খেলার স্বপ্নটা ধীশালেরই বেশি ছিল। কর্কটরোগের মরণছোবল যখন ধীশালকে কেড়ে নিলো তখন মাহেলা একাই দুই ভাইয়ের স্বপ্ন পূরণে নামলেন। ১৯৯৭ এর রান প্রসবনীর টেস্টে লংকান ক্রিকেটের ভবিষ্যত তকমা নিয়েই অভিষেক। অভিষেকের আলোটা পুরোই কেড়ে নিলেন জয়াসুরিয়া আর মহানামা। ইতিহাস ভেঙে ৫৭৬ রানের সর্বোচ্চ জুটি আর ৯৫২ রানের দলীয় সর্বোচ্চ ইনিংস। সেই ইনিংসে মাহেলারও ৬৬ ছিল। তিনি যখন ক্রিজে, তখনই আগের বিশ্বরেকর্ড ইংল্যান্ডের ৯০৩ পার করেছিলো শ্রীলংকা। কেউ খেয়াল করেনি বোধহয়। প্রথম ১০ ইনিংসের মধ্যেই কিউইদের সাথে ১৬৭ আর ভারতের সাথে ২৪২! এক বিশ্বজয়ীর আগমনী বার্তা শুনতে পেয়েছিলো বিশ্ব।

     

    অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এরপর প্রায় তিন বছরে কোন টেস্ট সেঞ্চুরি পাননি মাহেলা। তবে ’৯৮ এ যে ম্যাচে রস এমারসন মুরালিকে থ্রোয়ের জন্য নো বল ডাকলেন ঠিক সেই ম্যাচেই মাহেলা পেলেন ওয়ানডেতে প্রথম সেঞ্চুরি। চাপের মুখে দলকে জেতালেন। ধারাবাহিকতা নিয়ে সমস্যা আজীবনই ছিল। কিন্তু দরকারের সময়ে প্রতিপক্ষ দলের সবচেয়ে বড় চিন্তার নাম সবসময়ে তিনিই ছিলেন। আর যখনই খেলেছেন, ক্রিকেটামোদীরা মুগ্ধ চোখে দেখেছে মাঠজুড়ে তুলির আঁচড়। ১৯৯৯, ২০০৩ - দুইটা বিশ্বকাপই তাঁর কেটেছিলো দুঃস্বপ্নের মতো। কিন্তু দল তাঁর উপর ভরসা করেছিলো। জয়াসুরিয়া-আতাপাত্তুরা চলে যাবার পরে দলের অধিনায়কত্ব তুলে নিলেন কাঁধে। ৫৭৬ রানের বিশ্বরেকর্ড জুটির ম্যাচে টেস্ট ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। ২০০৬ সালের বন্ধু সাঙ্গাকারাকে নিয়ে ভাঙলেন সেই রেকর্ড! এক জুটিতে ৬২৪! শ্রীলংকার পক্ষে ইনিংস সর্বোচ্চ ৩৭৪ রান; যেটা ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের সর্বোচ্চ ইনিংসের বিশ্বরেকর্ডও। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, কিছুদিন আগ পর্যন্তও উইকেটভিত্তিক জুটির বিশ্বরেকর্ডে ১০টার মধ্যে ৪টার মধ্যেই জয়াবর্ধনের নাম ছিল। এখনও একমাত্র খেলোয়াড়  হিসেবে ২ বার সে তালিকায় নাম আছে একমাত্র জয়াবর্ধনের। ৩য় উইকেটে ৬২৪ আর ৪র্থ উইকেটে ৪৩৭ রান! টেস্টে “কট মাহেলা বল মুরালি” ব্যাপারটা স্কোরকার্ডে আছে ৭৭ বার! এটাও বিশ্বরেকর্ড। ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ ২১৮টা ক্যাচও আছে। রেকর্ডের খাতাটা তার পক্ষে সবসময়েই কথা বলে! অলটাইম গ্রেটেস্ট রান স্কোরারদের লিস্টে চোখ বুলালে দেখা যায় ১১০০০+ রান করা সবার গড় পঞ্চাশের উপর। মাঝখান দিয়ে কলংক হয়ে আছে মাহেলা জয়াবর্ধনের ৫০ এর নিচের গড়! মাহেলা যেদিন টেস্ট থেকে অবসর নিলেন সেদিন মাহেলার টেস্ট গড় যে ৫০ হলো না; সেটা নিয়ে খুব কথা হচ্ছিলো। এমনকি অবসর পরবর্তী সাক্ষাৎকারেও ডিন জোন্স তাকে জিজ্ঞেস করলেন যে, "এই নিয়ে কোন আক্ষেপ আছে কিনা?" মাহেলা জানালেন যে, তার কোন আক্ষেপ নেই। অথচ মাহেলার মোট টেস্ট রান ১১,৮১৪। ১৫ ইনিংসে অপরাজিত বাদ দিয়ে তা ভাগ হয়েছে ২৩৭ ইনিংস দিয়ে। তাতে গড় আসে ৪৯.৮৪। অথচ সে তার জীবনে অপরাজিত ছিল আসলে ১৬ বার!! ভাগ হবার কথা ২৩৬ ইনিংস দিয়ে। এবং তা করলে তার গড় আসে ৫০.০৫!! অর্থাৎ মাহেলার সত্যিকারের গড় ৫০.০৫!

     

     

    এবার এই অপরাজিত ইনিংসটার কথা বলা যাক! ক্রিকেট ইতিহাসের বাংলাদেশের একটি অপমানজনক ইতিহাস হচ্ছে এই "Retired out" শব্দটি! এখন পর্যন্ত মাত্র দুইবার দুইজন ব্যাটসম্যান ব্যাট করতে আর ইচ্ছে হচ্ছিলো না বলে, 'টেস্ট ক্রিকেটে' (প্র্যাকটিস ম্যাচে নয়) পরবর্তী ব্যাটসম্যানকে ব্যাটিং প্র্যাকটিস করবার সুযোগ দেবার জন্যে ইচ্ছে করে "অবসর জনিত আউট" হয়েছেন! সেটা একই টেস্টে বাংলাদেশের বিরূদ্ধে এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে ২০০১ সালে! মজার ব্যাপার হচ্ছে, সেই টেস্টেই আশরাফুল সবচেয়ে কমবয়সী টেস্ট সেঞ্চুরিয়ানের রেকর্ড গড়েন! মারভান আতাপাত্তু ২০১ আর মাহেলা ১৫০ রান করে "আর ব্যাট করতে ভালো লাগছেনা" বলে টিম ম্যানেজম্যান্টের নির্দেশে ইচ্ছে করে ড্রেসিংরুমে ফিরেন! ক্রিকেট ইতিহাসে এর নজির আর দ্বিতীয়টি নেই! পরে অবশ্য মাহেলা জানান যে, তারা ভেবেছিলেন যে, তাদের রেকর্ডে এটি "অপরাজিত" হিসেবে থাকবে। কিন্তু এটাকে আউট ধরা হয়। অপরাজিত ধরা হলে মাহেলার গড় হতো ৫০.০৫!

     

    হায় মাহেলা জয়াবর্ধনে! কী করেছিলেন আপনি? ইতিহাসের অলটাইম গ্রেট ব্যাটসম্যানদের একজন যার সত্যিকারের গড় পঞ্চাশের উপর, তিনি অফিসিয়ালি ৫০ এর নিচে গড় নিয়ে আছেন; সেটা দেখতে একদম ভালো লাগেনা!

     

    যাই হোক, প্রসঙ্গে আসা যাক। বড় ম্যাচে মাহেলার ব্যাট সবসময়েই হেসেছে। ২০০৭ এ অধিনায়ক হিসেবে গিয়েছিলেন শ্রীলংকাকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন করাতে। সেমি ফাইনালে আবারও ছবি এঁকে ফাইনালে তুলেছিলেন দলকে। পারেননি অ্যাডাম গিলক্রিস্ট সেদিন অতিমানব হয়ে যাওয়ায়। আধো আঁধারে যখন অস্ট্রেলিয়া দল উৎসব করছে, তখন মুখে হাত ঢাকা মাহেলার মুখটিই বেদনা দিয়েছে বেশি। ২০১১ বিশ্বকাপের ফাইনালেও সেঞ্চুরি করেছিলেন। এবারও পারেননি ধোনির কাছে। তবে একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপের সেমি ফাইনাল আর ফাইনালে সেঞ্চুরি করবার গৌরবটাও তারই। ২০০৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে টুর্নামেন্টজুড়ে ওপেনিংয়ে টানা বড় স্কোর করে দলকে নিয়ে গিয়েছিলেন ফাইনালে। পারেননি সেবারও; ঘাতক আফ্রিদি। তবে মার মার কাট কাট টি-টোয়েন্টি খেলাতেও যে শুধুমাত্র ফিল্ডারদের ফাঁক বের করে সেঞ্চুরি করা যায় তা দেখিয়েছিলেন তিনিই!

     

     

    ২০১১ বিশ্বকাপের পরে শ্রীলংকা দায়িত্ব দিলো দিলশানের হাতে। কিন্তু দায়িত্ব পেয়ে দিলশান যেন খেলা ভুলে গেলেন। মাহেলা আসলেন আবার নেতা হয়ে। তাকে মানা হয় আধুনিক ক্রিকেটের সেরা স্ট্র্যাটেজিস্টদের একজন। ব্যাটসম্যানের মন পড়তে পারতেন। সে অনুযায়ী ফিল্ডিং সাজাতেন। আর ছিলেন দলের নেতা। ২০০৬ সালে হয়েছিলেন আইসিসির ‘ক্যাপ্টেন অফ দ্যা ইয়ার’। তার নেতৃত্বেই ২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আবার ফাইনালে উঠলো শ্রীলংকা। এবারও হার! কলম্বোর সেই রাতটা ক্যারিয়ারের সবচেয়ে দুঃসহ রাত ছিল স্বীকার করেছেন বহুবার। ভাবা যায়, ২০০৭ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ওয়ানডে-টিটোয়েন্টির ৪টা বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেও কাপ ছোঁয়া হয়নি মাহেলার। ২০১৪ তে ঢাকায় অবশেষে বন্ধু সাঙ্গাকারার সাথে সেই স্বপ্ন পূরণ হলো। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ট্রফিটায় হাত বোলালেন এই শিল্পী। ক্রিকইনফোকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “অবসরের পর বিশ্বকাপ জয়ী খেলোয়াড়ের তালিকায় নাম তো থাকবে!” তবু টিটোয়েন্টিতে মন ভরছিলো না। চেয়েছিলেন ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপটা জিতে বিদায় নেবেন। হলো না। টেস্টটাকে আগেই বিদায় জানিয়েছেন প্রিয় মাঠ কলম্বোর এসএসসিতে যেখানে এক মাঠে সর্বোচ্চ ২৯২১ রান করার বিশ্বরেকর্ডটা আছে।

     

    আজকের পর থেকে এই শিল্পীকে আর মাঠে দেখা যাবে না। সম্ভবত ব্যাটিংয়ের শিল্পীত সৌন্দর্যের যুগেরও শেষ এখানে। মাহেলা অথবা মার্ক ওয়াহদের তৈরি করা যায় না, তারা জন্মায়। আজকের মারমার কাটকাট যুগে তাদের কদর কতটা হবে সেটা যথেষ্টই সন্দেহের ব্যাপার।

     

    ক্রিকেটীয় জীবনে ছিলেন ভদ্রতার প্রতিমূর্তি। ২০১৩ তে জিতেছেন আইসিসির “স্পিরিট অফ দ্যা ক্রিকেট আওয়ার্ড”! বন্ধু সাঙ্গাকারার সাথে ব্যবসা আছে। তবে সবচেয়ে বড় স্বপ্নটা আসলে ভাই ধীশালকে নিয়ে। যতদিন যখন খেলতে নেমেছেন সবসময়ে মনে করেছেন তিনি একা নন, তিনি আসলে দুইজন। ভাইয়ের স্মৃতিতে শ্রীলংকায় গড়ে তুলেছেন ‘হোপ’ নামের বিনামূল্যের ক্যান্সার হাসপাতাল। যেন কর্কট রোগটা আর কারও প্রাণ কেড়ে না নেয়। বলেছিলেন ক্যারিয়ার শেষে মন-প্রাণ ঢেলে দিবেন এ জায়গাতেই।

     

    ১৮ বছরের জীবনে মাঠে যার কাজ ছিল দর্শকদের আনন্দ দেয়া তিনি এখন শান্তি খুঁজবেন হাসপাতালে রোগীর সারল্যমার্কা হাসিতে। সেখানে ধীশালকে খুঁজে বেড়াবেন। শিল্পীদের মন বড় না হলে তো তারা আর অন্যদের চেয়ে আলাদা হন না। দেনাগামাগে প্রবোথ মাহেলা ডি সিলভা জয়াবর্ধনে মানুষ হিসেবে মাঠের চেয়েও বড় শিল্পী। জীবনের হাসি-কান্না মাখা শিল্পের এক বড় আঁকিয়ে!

     

    হে শিল্পী, এই ক্ষুদ্র ক্রিকেট ফ্যানের ক্ষুদ্র সম্মান গ্রহণ করুন।