• ফুটবল

4-3-3 The Ancelotti School

পোস্টটি ১০৩২ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

&NCS_modified=20151008083027&MaxW=640&imageVersion=default&AR-151009155
ফুটবলের সবচেয়ে প্রচলিত ফর্মেশান ৯০ এর দশক জুড়ে আর ০০ এর শুরুতে ছিল ৪-৪-২। এই ফর্মেশানে প্রায় প্রতিটা দল তাদের সামর্থ্য মত কিছু মডারেশান আনত। সেই ব্যাপারে আরেকদিন যাব আশা করি। যাই হোক এই ফর্মেশানে মূল ব্যাপার ছিল দুইজন গোল স্কোরিং ফরোয়ার্ড এর উপস্থিতি। রোমারিও-বেবেতো, রাউল মরিয়েন্তেস, রোনালদো-রোমারিও, ডুইট ইয়র্ক-এন্ডি কোল এমন অনেক ডেডলি ডুয়ো দেখা গেছে এই সময়ে। ফলে মূল নীতি ছিল ভালো ডিফেন্ডার থাকবে, ভালো দুইজন ফরোয়ার্ড থাকবে। দুই উইঙ্গার ভাল ভাল ক্রস ফেলবে। দুই সেন্টার মিডফিল্ডার এর একজন বেশি দোউড়াবে একজন বেশি করে পাসিং এর চর্চা করবে। চ্যাম্পিয়ন দলের মূল মন্তর। এই নীতিতে ফার্গুসন এর ম্যান ইউ ট্রেবল জিতেছিল। রিয়াল মাদ্রিদ নিয়মিত সাফল্য পাচ্ছিল। ইন্টার মিলান আর বায়ার্ন মিউনিখ এই সময় এক ফরোয়ার্ড এর পিছে দুইজন সাপোর্ট উইঙ্গার এর চর্চা শুরু করে। কিন্তু এইখানে ব্যাপারটা ছিল দুই উইঙ্গার এর কাজ বল মূল ফরোয়ার্ডকে পৌছান না পারলে গোল করা।ইন্টার আর বায়ার্ন এর এটাক লাইন লিড করতেন রোনালদো আর এইবার। দুইজনেই ল্যাটিন ঘরানার এলিট ফিনিশার ছিলেন। সব মিলায় খেলা ছিল এলিট পর্যায়ে খুব ডাইরেক্ট। ফলে এই সময়ে থ্রিলার ধরনের ম্যাচ বেশি হচ্ছিল বেশ। লাস্ট মিনিট গোল। বড় স্কোরলাইন এইগুলা ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। ব্যাক্তিগত ভাবে এই সময়টা ছিল ফুটবল দেখা শুরু করার জন্যে খুব আনন্দদায়ী সময়।

ইটালিয়ান দলগুলা অবশ্য একটু অন্য ঘরানার ছিল তাদের জমাট ডিফেন্স এর সুবিধার কারনে। ওই সময়ের সিরি এ এর স্বাভাবিক দল এর ডিফেন্স ও ইউরোপের টপ যে কোন দলকে আটকাতে বেশভালো কাজ দিতে পারত। এই ব্যাপারটা প্রথম ভাল করে খেয়াল করেন তখনকার উঠতি কোচ রাফায়েল বেনিটেজ। ভ্যালেন্সিয়ার কোচ হয়ে এসে তিনি ৪-২-৩-১ বা ডাবল পিভট স্পেন এ প্রথম এপ্লাই করেন। ফলাফল আসে খুব ভালো। স্পেন এর দুই পরাশক্তিকে পিছে ফেলে লা লীগা জেতে ভ্যালেন্সিয়া। কিন্তু তাদের স্কোর গুলা থেকে লেট ৯০ এর সেই থ্রিল চলে যায়। জায়গা দখল করে ১-০,২-১,২-০ ধরনের স্কোরলাইন। ভ্যালেন্সিয়ার ০৩-০৪ মোউসুমে জেতা ইউরোপা লীগে এই তিনটার বাইরে কোন স্কোরলাইন নেই। এটা সকল তরুণ ম্যানেজারকে বার্তা পাঠায়, সাফল্যের নতুন ধারনা এসে গেছে। চারটা ভাল কভার গার্ড জোগাড় কর যারা ব্যাক ফোর এ থাকবে। একটা এভারেজ ফরোয়ার্ড আর দুই বা তিনজন এভারেজ স্কিল্ড কিন্তু কুইক এটাকার নাও যারা ট্র্যাক ব্যাক করবে। আর সবচেয়ে দরকারী সেন্টার পার্ক এ দুইজন মিডফিল্ডার যাদের একজন এর রোল এর নাম “ডেস্ট্রয়ার” অন্যজন “লাঞ্চার”। প্রথমজন বলের জন্যে ট্যাকল করবে, অপনেন্ট এর পাস এর সাইকোলজি নষ্ট করবে ও বল অপনেনেন্ট এর পা থেকে সরিয়ে দেবে। পরেরজন এর কাজ সেই বলটা নিয়ে উপরে অলরেডী দৌড় শুরু করা তিন জনের কাউকে দিয়ে দেয়া। এই স্টাইল পরবর্তীতে মরিনহো পার্ফেক্ট করেন এবং এখনো তিনি এর বড় ভক্ত।

কিন্তু এই সময় ইউরোপের সবচেয়ে কম আক্রমনাত্মক দেশে এক কোচ ঠিক উলটো পথে হাটছেন। সবাই যখন ডিফেন্স এ একটা শীল্ড বাড়াতে ব্যাস্ত এটাকার স্যাক্রিফাইস করে তখন তিনি ইটালীতে বসে ছক আটছেন অন্য কিছুর। কারণ তার হাতে আছে কাফু মালদিনি নেস্তা আর কালাদজাদে নিয়ে তোইরি এমন এক ব্যাক ফোর যাদের আসলে কোন এক্সট্রা শিল্ড এর দরকার নাই। সাথে দিদা নামের এক গোলকীপার যিনি এর পরের লাইন অব ডিফেন্স। বাড়তি পাওয়া এই সুবিধাটা তিনি কাজে লাগালেন মাঝমাঠে।তবে এটাকিং এর ধারণাটা আবার নিলেন লেট ৯০ এর সেই ইন্টার বা বায়ার্ণ এর ১ ফরোয়ার্ড দুই উইঙ্গার এর ধারনা থেকে। বাকী থাকল মাঝমাঠ। এইখানে তিনি একেবারেই নতুন একটা কাজ করলেন।

সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে ৪-৩-৩ নিয়ে কয়টা বেসিক কথা বলা দরকার। ব্যাক ফোর বা টপ থ্রি এইখানে খুব পরিচিত। ব্যাক ফোর স্বাভাবিক ব্যাক ফোর এর মত। দুইজন ফুলব্যাক আর দুইজন সেন্টার হাফ। এটাকার তিনজন। দুইজন উইঙ্গার (বা লেফট বা রাইট ফরোয়ার্ড) আর একজন সেন্টার ফরোয়ার্ড।
মাঝমাঠ অনেক রকম হইতে পারে। দুইজন CDM একজন CAM (Triquatista)  বা একজন CDM দুইজন CM (Deep lying playmaker) নিয়ে হতে পারে। আনচেলত্তির প্রথম ৪-৩-৩ এর কোনটাই ছিল না। তার মাঝমাঠে ছিল সিডর্ফ, গাত্তুসো আর পিরলো। এটিচিউডে যাই মনে হোক গাত্তুসো আসলে একজন পাসিং এন্ড রানিং ম্যান যে ট্র্যাক ব্যাক করত আর ইন্টারসেপ্ট করতে চেষ্টা করত। উনাকে ডানদিকে সরানো ছিল কিছুটা ট্যাকলিং স্কিল তার খুব সুবিধার ছিল না। ফাউল করে বসতেন করতে গেলেই। সিডর্ফ ও মোটামুটি একই ধাচের কিন্তু অন দ্যা বল সিডর্ফ একটু বেশি স্কিল্ড। আর বাম পায়ের শ্যুটিং ক্ষমতার জন্যে বামে খেলানো হত বেশি আর সেন্টার অব দ্যা পার্কে ছিলেন পিরলো। ইয়াং হওয়া সত্ত্বেও দৌড়ানো বা ট্যাকল করা পিরলোর স্ট্রেন্থ না। ছিলও না। উনি যেটা পারতেন ইঞ্ছি মাপে সঠিক পাস বের করতেন। লং বা শর্ট যেমনই হোক না কেন। খেয়াল রাখতে হবে এই দলে তাহলে কোন তথাকথিত এরিয়াল ডুয়েল উইনার বা ডেস্ট্রয়ার ছিল না। এই দল ০২-০৩ এর চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জেতে। আনচেলত্তি এর পরের কয় বছরে ৪-৪-২ তে চলে যান রুই কস্তা আর কালাদজাদের দল ছাড়া আর ইনজাঘির ইনজুরি প্রবণতা বাড়ায়। আর কাকা আর শেভচঙ্কোর প্রাইমে উঠে আসাটা তাকে এই কাজে অনুপ্রাণিত করে। সেই দলটাও পরে ০৬-০৭ এর চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জেতে।

আনচেলত্তি তার সেকেন্ড ৪-৩-৩ গড়ে তোলেন চেলসির চার্জ নেয়ার পরে। কোল-এলেক্স-টেরি-ইভানোভিচ এর ব্যাক ফোর আর দ্রগবাকে সেন্টারে রেখে গড়া দলের মাঝমাঠে ছিলেন মালুদা-বালাক আর ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড। এদের কেউ ডীফেন্সিভ কাজে ওয়ার্ল্ড ক্লাস না। কিন্তু পাস মাস্টারশিপ আর ক্রিয়েটীভিটিটে বিশ্বের সেরাদের কাতারেই ছিলেন।মালুদার এক্রোবেটিক এবিলিটি বা ল্যাম্পার্ড এর লং শট গুলার পরে সবচেয়ে বেশি  তাদের এইখানে যেটা করতে হত- প্রচুর গ্রাউন্ড কাভার করতে হত। পুরোদস্তুর এটাকিং মিডফিল্ডার ল্যাম্পার্ড কে কিছুটা নিচে নামিয়ে এনে হলেও আনচেলত্তি কাজটা করেছিলেন। যদিও এবার তার দুই উইঙ্গার খুব ভালো ছিল না কিন্ত তিনি এর মাঝেও লীগ আর এফ এ কাপ তুলে নেন।

তিন নাম্বার বারে এই একই জিনিস দেখা যায় পি এস জি তে। মাতুইদি বা ভেরাত্তি দুজনই ডিপ লাইং প্লেমেকার এর রোল দিতেন। সাথে কখনো পাস্তোরে কখনো লুকাস কখনো মাহমুদু সিসোকো মাঝমাঠে খেলতেন। মাঝমাঠ এইবারে অতটা ভাল না হলেও আইডিয়া কন্সিস্টেন্ট রেখে ভাল এটাক আর ডিফেন্স তাকে লীগ এনে দেয়।

রিয়াল মাদ্রিদ এর দল মরিনহো গড়েছিলেন ৪-২-৩-১ মাথায় রেখে। আনচেলত্তি যখন ৪-৩-৩ এপ্লাই করলেন এখানে তখন আসলে পিওর টাইকোয়াতিস্তা ওজিল এর দরকার কমে গেল। তাই তাকে বিক্রি করে দিলে তিনি তেমন আপত্তি করেন নি। গ্যারেথ বেল আসায় দুই উইঙ্গার হিসাবে রোনালদো আর বেল এর মাঝে জায়গা নেন বেনজেমা।মাঝমাঠে তাকে যেটা করতে হয় মদ্রিচ আর আলোন্সোর পাশে জায়গা দিতে হয় ডী মারিয়াকে (এটা লুকাসকে নিয়ে তিনি আগেও করে এসেছেন) আলোন্সো খেলতেন ঠিক পিরলোর রোল এ। এবং তিনি ডিফেন্সিভ ওয়ার্ক এ ভালো ছিলেন মরিনহোর আমলের অভিজ্ঞতার জন্যে। সেটা খুব দরকারী হয়ে দেখা দেয় কারণ রিয়াল মাদ্রিদ এর ব্যাক ফোর খুব বেশি কনসিস্টেন্ট কখনো ছিল না। কিন্তু লক্ষনীয় পিওর CDM খেদিরা দলে জায়গা হারান। ক্রিয়েটিভ রোল মদ্রিচ, ডি মারিয়া আর আলোন্সো তিনজনকেই প্লে করতে হত। ডি মারিয়া এমনিতেই প্রচুর দৌড়াতেন। যেটা আলোন্সোর কম দোউড়ানোকে কাভার করত। আর মদ্রিচ এর কাজ দোউড়ানো আর পাস দেয়া। এই দল কোপা ডেল রে আর লা ডেসিমা জিতে। পরের সিজনে আলোন্সো গেলেন ক্রুস এল। এবার দায় ভাগ করা হল এইভাবে মদ্রিচ আর ক্রুস একই কাজ করবেন। দুইজনেই প্রচুর গ্রাউন্ড কাভার করে। তাই আগের মত রানিং ব্যালেন্স করার দরকার হল না। কিন্তু সমস্যা যেটা হল সেটা হল তিন নাম্বার মিডফিল্ডার ডি মারিয়াকেও বেচে দেয়া হল। আনচেলত্তির মনে মদিরচ আর ক্রুস এর ব্যাক আপ ছিল ইলারামেন্ডি। জানুয়ারীতে যে কোচ কখনো কিছু কেনেন না তিনি লুকাস সিলভাকে কিনে আনলেন এই জায়াগাটা পুরণ করতে আসলে তিনি তার প্রথম ৪-৩-৩ এর মত ফ্ল্যাট মিডফিল্ড চাচ্ছিলেন। কিন্তু সব ভেঙ্গে গেল যখন মদ্রিচ ইনজুরীতে পড়লেন আর নতুন আসা ইয়ারা আর সিলভা তার জায়গা নিয়ে খুব সাধারণ খেলে গেল। সিজন শেষে স্যাকড।

জিদান এর নীতিটা অনেকটা এরকমই দেখায়। যদিও পার্থক্য আছে। এই আলোচনার আগে বলে নেই, ক্রুস এর পাসিং রেট দেখালেই একদল লোক ক্ষেপে যায়। ট্যাকল কম করে। ইন্টারসেপ্ট কম করে এইসব কথা উঠে আসে। ক্রুসকে সার্জিও বুস্কেটস বা প্যাট্রিক ভিয়েরা বা ক্লদ ম্যাকেলেলের রোল দেয়া হয় নি। তাকে দেয়া হয়েছে চেলসিতে বালাক, বার্সায় জাভি বা এসি মিলানে সিডর্ফ/পিরলো এর মত রোল।আর মদ্রিচ এর সাথে তার রোল এর পার্থক্য- যেহেতু সে জার্মান তার পজিশান ডিসিপ্লিন বেশি। তাই যে জায়গায় খেলতে দেয়া হয় সে একেবারে তাই করে। মদ্রিচ বেশি ক্রিয়েটিভ। কিন্তু তার রানিং এর সময় ফাকা যে জায়গা হয় ক্রুসকে সেটা কভার দিতে হয়। তাই উপরে উঠে কম। (এর মানে সে ডি এম তাও না) তবে যেইটা মানতে হবে তার ন্যাচারাল রোল এইটা না। তারপরেও সে এক্সট্রিমলি ভাইটাল। কারন বল ডিস্ট্রিবিউশানে সে মদ্রিচ এর চেয়ে ভালো। ফিজিক ভালো বিধায় গ্রাউন্ড ও বেশি কাভার করে। তবে জিদান যে হুবহু আনচেলত্তি স্কুল অনুসরণ করবে না তার প্রমাণ হচ্ছে পজিশানাল ডিসিপ্লিন এর দিকে নজর দিয়ে ক্যাসেমিরোকে দলে নেওয়া। এবং ভাল রেজাল্ট ও আসছে এর ফলেই। হয়ত সামনে মদ্রিচ-ক্রুস-ক্যাসেমিরো এরকম একটা ৪-৩-৩ এর নতুন ফর্ম লিজেন্ড হয়ে উঠবে। এর সাথে আনচেলত্তি স্কুল এর সম্পর্ক?মাঝমাঠ বিষয়ে জিদানের খেলোয়াড়ি জীবনের ট্যাকটিকাল ও টেকনিকাল জিনিয়াস বাদ দিলে, জিদানের এই বোধ গুলো কিন্তু অনেকাংশে কার্লো দ্যা ডন এর হাতেই গড়া।