যাদের জন্য সময় থেমেছিল - পর্ব ১: এরিক দ্যা ঈল
পোস্টটি ৩২১৭ বার পঠিত হয়েছে১৯ সেপ্টেম্বর, ২০০০। সিডনি অলিম্পিকের চতুর্থ দিনে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকুয়াটিক সেন্টারে ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল ইভেন্ট দিয়ে শুরু হবে দিনের প্রতিযোগিতা।
১ নং হিটে অংশ নেবেন ৩ ওয়াইল্ড কার্ড এন্ট্রি - নাইজেরিয়ার কারিন বারে, তাজিকিস্তানের ফারখদ অরিপভ আর ইকুয়াটোরিয়াল গিনির এরিক মুসাম্বানি। ৮ লেনের পুলে বাকি ৫টি ফাঁকা। একি কাণ্ড! বিচারক রেস শুরুর চূড়ান্ত সংকেত দেবার আগেই নাইজেরিয়ান ও তাজিক প্রতিযোগী উত্তেজনার আতিশয্যে ডাইভ দিয়ে হলেন ডিসকোয়ালিফাইড। আর ৫ নম্বর লেনে থাকা অপর প্রতিযোগী এরিক মনে করলেন তিনি বোধহয় ডাইভ দিতে দেরী করে ফেলেছেন। তাই তাকেই ডিসকোয়ালিফাইড করা হচ্ছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আয়োজকরা তার ভুলটা ভাঙাতেই বুঝতে পারলেন, ১৭,০০০ দর্শকে ঠাসা গ্যালারীর সামনে একাই নামতে হবে পুলে!
আর পরবর্তী রাউন্ডে উত্তীর্ণ হবার জন্য তাকে লড়তে হবে ১ মিনিট ১০ সেকেন্ড সময়ের সাথে। নতুবা তিনি প্রতিযোগিতা থেকে বাদ পড়ে যাবেন।
একটু পর দ্বিতীয়বারের মত পিস্তলের গুলি ছুটবে এবং খুবই সাধারণ গগলস আর সুইমপ্যান্ট পরিহিত মুসাম্বানি ২২ বছরের যাপিত জীবনে প্রথমবারের মত পুলে ডাইভ দেবেন।
পরের মিনিট দুয়েক যেন স্লো মোশনে একটা চলচ্চিত্রের দৃশ্য চিত্রায়িত হবে এই সুইমিংপুলে! কিন্তু এই দৃশ্য যে ২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিক তো বটেই, অলিম্পিক ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর একটি হয়ে থাকবে, সেটা মুসাম্বানি, গ্যালারীতে উপবিষ্ট ১৭,০০০ বা টিভি পর্দার সামনের লাখো দর্শকের কেউই বোধহয় ভাবতে পারেননি!
জীবনে প্রথম কোন সাঁতার প্রতিযোগিতায় নামা এই তরুণ নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী প্রথম ৫০ মিটার ভালোই সাঁতরালেন। ৪০.৯৭ সেকেন্ডে শেষ করলেন প্রথমভাগ। সিডনির দর্শকরাও ভালোই উৎসাহ দিচ্ছেন এরিককে। কিন্তু ব্যাকফ্লিপ করে যখন শেষ ৫০ মিটার শুরু করলেন, বদলে গেলো পরিস্থিতি। পরিষ্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছিল, সামর্থ্যের শেষটুকুও দিয়ে ফেলার পর তীব্র ব্যথা আর ভয় গ্রাস করেছে তাকে, এক পর্যায়ে তো সাঁতরানো প্রায় বন্ধ করে শ্বাস নিচ্ছিলেন। পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট দেশের মানুষ এরিক যে ভালো মানের কোন সাঁতারু নন, ততক্ষণে তা বুঝতে পেরে ব্যঙ্গ হাসিতে ফেটে পড়েছে গ্যালারীর একাংশ।
"This guy doesn't look like he's going to make it, I am convinced this guy is going to have to get hold of the lane rope in a moment’’ - টেলিভিশনের পর্দায় তখন শোনা যাচ্ছে, ১৯৮৮ সিউল অলিম্পিকে একই ইভেন্টে স্বর্ণজয়ী ব্রিটিশ সাঁতারু আদ্রিয়ান মুরহাউজের ধারাভাষ্য!
অতিকষ্টে শরীরটাকে জোর করে টানতে থাকা মুসাম্বানিকে ঘিরে বাকি সবার ধারণাও একই রকম। শক্তি আগেই খরচ করায় প্রায় হাঁটার গতিতে পুলে এগোচ্ছিলেন। প্রায় খাবি খেতে খেতে সাঁতরে চলা মুসাম্বানির তখনো ৩০ মিটারের মত দূরত্ব বাকি। হঠাৎ করেই গ্যালারীর বিপুল সংখ্যক দর্শক প্রবল চিৎকার-চেঁচামেচি করে উৎসাহের জোয়ারে যেন এই আন্ডারডগ গিনিয়ানকে ভেসে থাকার শক্তি এনে দিলেন।
‘‘গো!গো!গো!’’ গর্জনে মুখর হল অ্যাকুয়াটিক সেন্টার। সেটা টেরও পেলেন ছোট্ট অবয়বের অধিকারী এরিক।
"He's going to make it, this is the Olympics, he's got 17,000 people shouting for him", আবার শোনা গেল মুরহাউজের কণ্ঠ। কিছুক্ষণ আগেও অবিশ্বাস আর রাগ মিশ্রিত কণ্ঠ পরিবর্তিত হল সীমাহীন উল্লাসে।
অবশেষে শরীর নিংড়ে বের করা শেষ শক্তিটুকু দিয়ে সাঁতরে যখন সীমানা দেওয়াল স্পর্শ করলেন বিগস্ক্রিনে সময়টা দেখাচ্ছে ১ মিনিট ৫২.৭২ সেকেন্ড!
ব্যথা, ক্লান্তি আর দীর্ঘশ্বাস গোপন করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে নিজেকে যখন পুল থেকে উপরে টেনে তুললেন, ততক্ষণে এরিকের জন্য তালি-গর্জন-উল্লাসে দাঁড়িয়ে পড়েছে উপস্থিত দর্শকেরা। দেখে মনে হচ্ছিল, স্বর্ণপদক জিতেছেন তিনি!
১ মিনিট ৫২.৭২ সেকেন্ড সময়টাকে পরিসংখ্যানের জটিল খাতায় ফেললে দেখা যেত, ঐ ইভেন্টে স্বর্ণ জেতা ডাচ সাঁতারু হুগেনব্যান্ডের টাইমিংয়ের(৪৮.৩০ সেকেন্ড) দ্বিগুণের চেয়েও বেশি! সেমি ফাইনালে হুগেনব্যান্ড ৪৭.৮৪ সেকেন্ডের বিশ্ব রেকর্ডও গড়েন। এমনকি আগের দিন অস্ট্রেলিয়ান ইয়ান থর্পের করা নতুন ২০০ মিটার ফ্রিস্টাইল বিশ্ব রেকর্ড সময়ের চেয়েও বেশি! তবে সবচেয়ে পরিহাসের বিষয় ছিল –এরিক ঐ সময় নিয়ে হিট জেতেন (ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে টাইমিং করে) এবং ইকুয়াটোরিয়াল গিনির জাতীয় রেকর্ডও গড়েন!
এরিক দ্যা ঈল
দু মিনিটের সাঁতার হঠাৎ করেই এরিক মুসাম্বানিকে সিডনি অলিম্পিকের তারকাখ্যাতি এনে দেয়। তার এই নায়কোচিত ব্যর্থতা তাকে অলিম্পিকের ইতিহাসে চিরস্থায়ী আসনে বসায়! পানির উপরে কোনমতে মাথা রেখে রেস শেষ করা এরিক জয়ের চেয়েও অংশগ্রহণ মুখ্য – এই চিরনবীন অলিম্পিক স্পিরিটের প্রতীক হয়ে দাঁড়ান!
মনে করিয়ে দেয়, আধুনিক অলিম্পিকের জনক ব্যারন পিয়েরে দ্যা কুবার্তিনের বিখ্যাত অলিম্পিক বানীকে - "The most important thing in the Olympic Games is not winning but taking part; the essential thing in life is not conquering but fighting well"
ঐদিন সন্ধ্যায় লন্ডনের বিখ্যাত টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক ক্রেইগ লর্ড তাকে ‘এরিক দ্যা ঈল’ নামে সম্বোধন করেন যা হঠাৎ করেই জনপ্রিয় হয়ে যায়।
হঠাৎ করেই অলিম্পিকের সবচেয়ে বড় আকর্ষণে পরিণত হওয়া এই আফ্রিকানকে নিয়ে গণমাধ্যম এতটাই উৎসাহী ছিল যে, অলিম্পিক কর্মকর্তারা তাঁর জন্য আলাদা করে একজন দোভাষী এবং সহকারী নিযুক্ত করে। জার্মান এক টিভি চ্যানেল তাকে পুরো সিডনি হারবার প্রদক্ষিণ করায় এবং এক ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড তাকে স্পেশাল মেডেল প্রদান করে। শত শত ফ্যান তাঁর অটোগ্রাফের জন্য হন্য হয়ে পড়ে। তাকে অলিম্পিক চলাকালীন কয়েকশ টিভি, পত্রিকা, রেডিও, ম্যাগাজিনের জন্য সাক্ষাৎকার দিতে হয়।
অলিম্পিক ভিলেজ তখন মুসাম্বিনির অলিম্পিক স্পিরিটের প্রশংসায় মুখর। স্বর্ণজয়ী অস্ট্রেলিয়ান সাঁতারু মাইকেল কিম নিজে খুঁজে বের করে তাঁর সাথে হাত মেলান। তার সমর্থনে "This is what the Olympics is all about," মন্তব্য করেন সিডনি অলিম্পিকে সবচেয়ে বেশি পদক (৩ স্বর্ণ, ২ রৌপ্য) জয়ী অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তী ইয়ান থর্প।
তবে তার এই পারফর্মেন্স বিতর্কের স্ফুলিঙ্গও ছড়াতে থাকে। অনেকেই অভিযোগ করেন, উন্নয়নশীল দেশকে ওয়াইল্ড কার্ড দিতে গিয়ে অধিক প্রতিভাবান ক্রীড়াবিদরা অলিম্পিকে সুযোগ বঞ্চিত হচ্ছেন। অলিম্পিকে এরকম সাহসী নৈপুণ্য আরও দেখতে পাওয়া উচিৎ নাকি এরকম অ্যাথলেটকে সুযোগ না দেওয়া উচিৎ এই বিতর্ক চলতে থাকে ক্রীড়াজগতে। এরপর থেকে ওয়াইল্ড কার্ড এন্ট্রির নিয়ম কঠোর করা হয়।
গিনির অপর অলিম্পিয়ান পওলা বারিলা বোলোপা ৫০ মিটার ফ্রিস্টাইল ইভেন্টে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি সময় নিয়ে (১ মিনিট ৩.৯৭ সেকেন্ডে) সাঁতার শেষ করেন এবং এরিকের জন্যই খানিকটা তারকাখ্যাতি পেয়ে যান।
পেছনের গল্প
১৯৭৮ সালের মে মাসে জন্ম নেওয়া এরিক মুসাম্বানি মালোঙ্গার এই অবিশ্বাস্য উত্থানের পেছনের গল্পটা খুবই চমকপ্রদ। গিনির রাজধানী মালাবোতে বেড়ে ওঠা এই তরুণ সিডনি অলিম্পিকের মাত্র ৮ মাস আগে রেডিওতে জাতীয় অলিম্পিক কমিটি সাঁতারু খুঁজছেন শুনে নিছক কৌতূহলের বশে আবেদন করেন।
এরপর ট্রায়ালের দিন মালাবোর হোটেল ইউরেকায় হাজির হয়ে দেখলেন আয়োজক বাদে শুধু তিনি এবং পওলা বারিলা বোলোপা নামের এক মুদি দোকানের ক্যাশিয়ার মেয়ে এসেছেন ট্রায়ালে অংশ নিতে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও আর কেউ না আসায় এবং সাঁতার জানেন তা নিশ্চিত হবার পর কমিটি দুজনকেই অলিম্পিকে যাবার জন্য মনোনীত করেন।
আইওসি প্রতি অলিম্পিকেই উন্নয়নশীল দেশের ক্রীড়াবিদদের বেশ কিছু ইভেন্টে ওয়াইল্ড কার্ড এন্ট্রি দেয় যাতে তারা সুযোগ পায় বিশ্বমঞ্চে পারফর্ম করার, এটা ছিল তেমনি একটা সুযোগ! তাই নূন্যতম কোয়ালিফিকেশন না পেরোনোর পরও মুসাম্বানি আর বোলোপা যুক্ত হয়ে যান অলিম্পিকের যাত্রায়।
বলে রাখা ভালো, দরিদ্র যুবক এরিক এর আগে কখনো সুইমিংপুল দেখেননি, আর হোটেল ইউরেকার এই পুলের দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র ১২ মিটার।
অলিম্পিকের টিকেট নিশ্চিত হবার পর অনুশীলন করতে শুরু করেন, কিন্তু পুরো গিনির একমাত্র সুইমিংপুল - ইউরেকা হোটেলের পুলে সপ্তাহে মাত্র ৩ ঘণ্টা সময় পেতেন অনুশীলন করার। কোচবিহীন এরিকের ধারণা ছিল না প্রতিযোগিতামূলক সাঁতার সম্পর্কে! কোন লেন না থাকা সেই পুলে মুসাম্বানির টাইমিং মাপার জন্য কেউ ছিল না। সাঁতারের বেসিক সব স্টাইল – ক্রল, বাটারফ্লাই, ব্রেস্টস্ট্রোক; আয়ত্ত করতে থাকেন নিজের মত করে।
অলিম্পিকের প্লেনে উঠবার আগে কোনদিন দেশের বাইরে পা না দেওয়া এই তরুণ কখনো অস্ট্রেলিয়া বা সিডনির নামও শুনেননি। আরও এক ভয়ংকর প্রথমের মুখোমুখি হন, সিডনি অলিম্পিকে এসে। প্রথমবারের মত অলিম্পিক সাইজের ৫০ মিটার (১৬০ ফুট) পুল দেখেন। এত বড় হবে, কল্পনাতেও ভাবতে পারেননি।
দুর্দশাকে আরও বাড়াতে গিনির অলিম্পিক কমিটির এক সদস্য ভুল করে জানিয়েছিলেন, এরিককে ৫০ মিটার ফ্রিস্টাইলে অংশগ্রহণ করতে হবে। কিন্তু সিডনিতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইলের জন্য পুলে নামবেন।
নিরুপায় মুসাম্বানি আমেরিকা সাঁতার দলের সাথে একই সময়ে অনুশীলন করতে নামতেন; ডাইভ দিয়ে সাঁতার শুরু, হাত-পা নাড়ানোর কৌশল - সবই ঐ কয়েকদিনে তাদের দেখে শেখা। সেসময় এক সাউথ আফ্রিকান কোচ তার পরিচয় পেয়ে প্রতিযোগিতার সুইমপ্যান্ট, গগলস উপহার দেন, পাশাপাশি কিছু কৌশলও শেখান।
তারপরের গল্পটুকু তো আগেই বলে দিয়েছি!
শেষটা কেমন?
বর্তমানে আইটি ইঞ্জিনিয়ার মুসাম্বানি অলিম্পিকের পরই নিয়মিত অনুশীলন এবং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের ফলে ৫৭ সেকেন্ডে নামিয়ে আনেন নিজের সেরা টাইমিং। কিন্তু ২০০২ বিশ্ব সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপের পর আর কোন বড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারেননি এরিক। ২০০৪ অলিম্পিকের ওয়াইল্ড কার্ড এন্ট্রি পেয়েও পাসপোর্ট অফিসের বড় ধরণের গাফিলতির কারণে ভিসা পাননি মুসাম্বিনি। ২০০৮ অলিম্পিকে অসুস্থতার জন্য হয়নি অংশগ্রহণ করা।
ইকুয়াটোরিয়াল গিনি জাতীয় সাঁতার দলে এখন ৩৬ জন সাঁতারু আছেন। গিনিতে অলিম্পিক সাইজের পুলও আছে একটা। অলিম্পিকের সেই ওয়াইল্ড কার্ড সিস্টেম বৃথা যায়নি বটে! আর কোচ হিসেবে কে আছেন, অনুমান করাটা অস্বাভাবিক নয়? –ভদ্রলোকের নাম এরিক দ্যা ঈল।
- 0 মন্তব্য