• অলিম্পিক

যাদের জন্য সময় থেমেছিল - পর্ব ২: ম্যারাথন কারু

পোস্টটি ২৮৫০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

সময়টা ১৯৬৪ সাল। ইতিহাসে প্রথমবারের মত এশিয়া মহাদেশে বসেছে অলিম্পিক গেমসের আসর।

১৪ অক্টোবরের দুপুর বেলাতেও বেশ ভালো পরিমাণ শীত আয়োজক শহর টোকিওতে, চলছে গ্রীষ্ম অলিম্পিকের ৫ম দিন। কিছুক্ষণ পরেই ১০,০০০ মিটার রেসে অংশ নেবেন ১৭ দেশের ২৯ প্রতিযোগী।

৪০০ মিটারের ২৫ টি ল্যাপে বিভক্ত রেসের শুরুতেই বিশ্বরেকর্ডধারী অস্ট্রেলিয়ান রন ক্লার্ক লিড নিলেন অনুমিতভাবেই। ১০ ল্যাপ (৪০০০ মিটার) শেষে যখন রেস প্রায় মাঝামাঝি পর্যায়ে, তখন তার সাথে সামনের সারিতে আছেন আমেরিকার বিলি মিলস, তিউনিশিয়ার মোহাম্মদ গামুদি, ইথিওপিয়ার মামো ওয়ালদে, জাপানের শুবুরায়া, সোভিয়েত ইউনিয়নের লিওনিদ ইভানভরাও। ইতোমধ্যে তাদের চেয়ে প্রায় ১ ল্যাপ পিছিয়ে পড়েছেন সিলনের (বর্তমান শ্রীলংকা) দৌড়বিদ রানাতুঙ্গে কারুণানন্দ। তরুণ রানাতুঙ্গে যে গতিতে রেস শুরু করেছিলেন, সেই গতি ধরে রেখেই দৌড়চ্ছিলেন, গতি বাড়ানো-কমানো কোনটাই করার চেষ্টা করলেন না। কয়েক মিনিট পর যখন ২০ তম ল্যাপের সীমানা পেরিয়ে ২১তম ল্যাপ শুরু করলেন ক্লার্ক, তখন তার সাথে প্রথমবারের মত অলিম্পিকে অংশ নেওয়া কারুণানন্দর দূরত্ব ৩ ল্যাপেরও বেশি।

একদম শেষ ল্যাপে এসে বাকি সবাইকে পেছনে ফেলে চমক দেখালেন বিলি মিলস, নতুন অলিম্পিক রেকর্ড গড়ে জিতলেন প্রথম আমেরিকান হিসেবে ১০,০০০ মিটার রেসের স্বর্ণ। আশ্চর্য! কি হচ্ছে এটা? ঠিক তার পেছনেই আছেন রানাতুঙ্গে। নাহ! অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই ৬ মিনিটে রানাতুঙ্গে অসুরীয় কিছু করে ফেলেননি। পদকের জন্য হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করা প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং তিনি ঐ মুহূর্তে সেখানে আছেন ৪ ল্যাপ পিছিয়ে পড়া সর্বশেষ অবস্থানের প্রতিযোগী হিসেবে।

এর কয়েক সেকেন্ড ব্যবধানে ফিনিশিং পয়েন্ট পেরোলেন রৌপ্য জয়ী গামুদি এবং ব্রোঞ্জ জয়ী রন ক্লার্ক। এরপরের ত্রিশ সেকেন্ডে আরও ২৫ জন অতিক্রম করে ফেললেন শেষ সীমারেখা। রেস শেষ। পদকজয়ীরা উল্লাসে মত্ত। আয়োজকরা ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছেন পরবর্তী ইভেন্টের জন্য। কিন্তু মিলস চমক শেষে আয়োজক এবং দর্শকদের আরেকবার অবাক হওয়ার পালা।

দর্শকভরা স্টেডিয়ামের একেবারেই শূন্য ট্র্যাকে একলা দৌড়ে যাচ্ছেন সিলনের সেই হেরে যাওয়া প্রতিযোগী কারুণানন্দ। বাকি সবারই শেষ জেনেও থামছেন না তিনি। অথচ যত তাড়াতাড়ি শেষ করুন না কেন, ফলাফলের বিন্দুমাত্র এদিক-সেদিকও সম্ভব নয়! বিরক্ত দর্শকরা তাই শুরু করলেন বৈরি আচরণ। শেষ ৩ ল্যাপের প্রথমটা শ্লথ গতিতে পার হবার সময় ব্যঙ্গাত্মক হাসি-উপহাসে মুখর হল অলিম্পিক স্টেডিয়াম। কিন্তু তাতে থোড়াই কেয়ার করেন ২৮ বছরের এই যুবক। সবাইকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মুখভরা প্রাণবন্ত হাসি নিয়ে আরও ৪০০ মিটার ‘অযথা’ যখন ঘুরে আসলেন কারুণানন্দ, ততক্ষণে শব্দ কমতে কমতে ৬০,০০০ মানুষের স্টেডিয়ামে পিনপতন নীরবতা। শেষ ল্যাপে শুরু হল উল্টো আচরণ। সিলনিজ যুবার সমর্থনে বুনো উল্লাসে ফেটে পড়েছে টোকিওর দর্শক। শেষ ১০০ মিটার খুবই দ্রুত দৌড়ে ১০,০০০ মিটারের সীমানা অতিক্রম করা মাত্রই প্রত্যেকটা মানুষ উঠে দাঁড়িয়ে করতালিতে অভিবাদন জানালেন ছোট দেশের শীর্ণকায় মানুষটির হার না মনোভাবের প্রতি, যিনি হেরে গেলেও রেস শেষ করেই থেমেছেন অলিম্পিকে অংশগ্রহণের মূল্যবোধ অক্ষুণ্ণ রেখে।

কারুণানন্দ হয়তো আন্দাজই করতে পারেননি, এই দৌড় তাকে অন্যতম সেরা বিজিত ক্রীড়াবিদ হিসেবে অলিম্পিক ইতিহাসের পাতায় স্থান দেবে, বানাবে কিংবদন্তী।

 

1964 OG 10k0001 (1)

ছবিঃ পেছন দিকে ৬৭ নম্বর জার্সি পরিহিত রানাতুঙ্গে কারুণানন্দ (১৯৬৪ অলিম্পিক) 

 

এমনকি এখন পর্যন্ত পশ্চিম গোলার্ধের একমাত্র অ্যাথলেট হিসেবে ১০,০০০ মিটারে অলিম্পিক স্বর্ণ জেতা বিলি মিলসের অভাবনীয় সাফল্যও ধোপে টিকবে না ৩২ মিনিট ২১ সেকেন্ডে রেস শেষ করা রানাতুঙ্গের কাছে।
 
রেস শেষে আরও একবার সবার মাঝে প্রচণ্ড আলোর ছটা ছড়ালেন রানাতুঙ্গে কারুণানন্দ। তাঁর কাছে দৌড়ে এসে সাক্ষাৎকার নেওয়া প্রথম সাংবাদিক জাপানিজ হারুও সুজুকির প্রশ্নের জবাবে বিশ্বজয়ী হাসিতে বললেন–
 
‘অংশগ্রহণ জেতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। অলিম্পিক স্পিরিট মানে জেতা নয় বরং অংশ নেওয়া। আমি অলিম্পিকে এসেছি, ১০,০০০ মিটারে অংশ নিয়েছি এবং আমার রাউন্ড শেষ করেছি। এটাই আমার দায়িত্ব। সিলন খেলা ভালোবাসা একটা দেশ, আমি সেখান থেকে এসেছি। আমরা শুধু জিততে আসিনি, সাথে সত্যিকারের ক্রীড়াসুলভ মানসিকতার প্রদর্শন করতেও। গর্ব নিয়ে বলতে পারি, আমরা অলিম্পিক স্পিরিট অক্ষুণ্ণ রেখেছি।’

 

ম্যারাথন কারু হয়ে ওঠা

সুজুকির করা সাক্ষাৎকার প্রচারের পূর্বেই জাপানের অগণিত মানুষের কাছে নায়ক হয়ে গেলেন কারুণানন্দ। মিডিয়া আর ভক্তের সাক্ষাৎকার, অটোগ্রাফ, পুরষ্কারে রীতিমত শ্বাস নেবার সময়টা বের করাই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছিল খ্যাতির চূড়ান্ত দেখে ফেলা এই দৌড়বিদের জন্য।

হারিও সুজুকির দেওয়া নাম ম্যারাথন কারু হঠাৎ করেই অলিম্পিক ভিলেজে ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মত। মিডিয়া ম্যারাথন কারুর সাথে কথা বলার জন্য হন্য হয়ে ওঠে। সবাই ছিলেন কারুণানন্দের অলিম্পিক স্পিরিটের প্রশংসায় মুখর। শুধুমাত্র সাহসের জোরে রুগ্ন শরীরের অধিকারী কারু ৬০,০০০ দর্শকের ব্যঙ্গের শিকার হয়েও হার মানেননি। এমনই বিশেষ কিছু করে দেখিয়েছিলেন যা ভাষায় পুরোপুরি বর্ণনা করা সম্ভব নয়।

ঐদিন স্বর্ণ জিতেও কারুর আবির্ভাবে ঢাকা পড়ে যাওয়া বিলি মিলস অকুণ্ঠ প্রশংসা করেন ২৮ বছরের এই দ্বীপদেশের ক্রীড়াবিদের, উপহার দিতে চেয়েছিলেন নিজের পদকটাই। কিন্তু তার অনুরোধ বিনীতভাবেই প্রত্যাখ্যান করেন রানাতুঙ্গে। 

"The Gold medal should have gone to Karunananda of Ceylon." – বিলি মিলস

 রানাতুঙ্গের সম্মানে পুরো জাপান জুড়ে নানা সংবর্ধনা, পুরষ্কার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় অলিম্পিক চলাকালীন। জাপানে দারুণ প্রশংসিত হওয়া কারু ঐ অলিম্পিকের যেকোন স্বর্ণজয়ী অলিম্পিয়ানের চেয়েও অধিকতর জনপ্রিয় ছিলেন সেই সময়ে। তার সাথে সবগুলো অনুষ্ঠানে সহযাত্রী হওয়া বন্ধু ফার্নান্দো সেই সময়টাকে দেখেছেন একদম কাছ থেকে।

 "In my life, I had not seen such a reception being given to a sportsman who could not win an event at an Olympics. I was blessed to witness that." – লংকান অলিম্পিক কুস্তিগির ফার্নান্দো

 হঠাৎ করেই কারুণার বন্ধু হয়ে ওঠা সাংবাদিক সুজুকি ঐ সময়ে জাপানের উঁচু পর্যায়ের সামাজিক এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন তার সাথে। জাপান এতটাই ভালবেসেছিল এই সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষটাকে যে পরবর্তীতে এই ঐতিহাসিক দৌড়ের গল্পকে জাপানের স্কুল পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

অথচ কারুণানন্দের অংশ নেওয়ারই কথা ছিল না ১০,০০০ মিটারে। জাপানি মিডিয়ার মাধ্যমে ‘ম্যারাথন কারু’ নামে খ্যাতিমান এই ক্রীড়াবিদ অলিম্পিক ম্যারাথনে অংশ নেননি, নিয়েছিলেন ৫০০০ মিটারে, হয়েছিলেন ৫২ জনের মধ্যে ৪৭ তম। এরপরেই টোকিওর মারাত্নক ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের মানুষ কারুণানন্দ ঠাণ্ডা-জ্বর-কাশিতে পুরোপুরি কাবু হয়ে পড়েন, সাথে শরীরটাও বেশ দুর্বল। তার উপর নিজের দেশের চ্যাম্পিয়ন হলেও অলিম্পিক মানের ক্রীড়াবিদদের তালিকায় বেশ নিচেই ছিলেন তিনি। কিন্তু সময়টা ১৯৬৪, যখন অ্যাথলেটরা শতভাগ ফিট না থাকলেও নাম প্রত্যাহার করতেন না, স্পন্সর বা চাকরির ভুঁড়ি ভুঁড়ি প্রস্তাবের বালাই ছিল না, গাড়ি-বাড়ি-উপহারে ভেসে যেতেন না ট্র্যাক এবং ফিল্ড কাঁপানো ক্রীড়াবিদরা। তাই এত কিছুর পরেও ১০,০০০ মিটারে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তাঁর ছোট্ট মেয়ের জন্য যে বাবাকে দেখার জন্য আগ্রহ নিয়ে বসে ছিল টেলিভিশনের সাদাকালো দুনিয়ার সামনে।

৬০ এবং ৭০ দশকে দূরপাল্লার দৌড়ে শ্রীলংকাকে প্রতিনিধিত্ব করা ম্যারাথন কারু শ্রীলংকার সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলেন। ছিলেন এমন এক প্রখর ক্রীড়াবিদ যিনি সবসময় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন ক্রীড়াসুলভ মানসিকতা এবং দক্ষতা প্রদর্শনের জন্য।

১৯৬৪ অলিম্পিকের কীর্তিগাঁথার কারণে সংকল্প শক্তি আর মানব আত্নার নিরংকুশ বিজয়ের প্রতীক হয়ে থাকা ম্যারাথন কারু ১০,০০০ মিটারে সবার শেষে দৌড় শেষ করলেও জিতে নিয়েছিলেন লাখ লাখ জাপানি দর্শকের হৃদয়।

রন ইচিকাওয়ার বিখ্যাত অলিম্পিক ফিল্ম টোকিও অলিম্পিয়াড-এ টোকিও অলিম্পিকের দ্রুততম মানব ববি হায়েস, টানা দুবার ম্যারাথন জেতা প্রথম দৌড়বিদ আবেবে বিকিলার মত তারকাদের ভিড়ে সবার শেষে দৌড় শেষ করেও বিজয়ীদের কাতারে দাঁড়ানোর বিরল এক সম্মান লাভ করেন ম্যারাথন কারু। সমান গুরুত্ব পায় ম্যারাথন কারুর সেই ১০,০০০ মিটারের পারফর্মেন্স। অলিম্পিক ইতিহাসের সেরা এবং দারুণ সব মুহূর্তের মধ্যে থেকে তিনিও হয়ে যান চিরস্থায়ী কিংবদন্তী।

 

sumithatananda

ছবিঃ কিশোর বয়সে কারুণানন্দ 

 

শেষটা কেমন?

অলিম্পিক স্পিরিটের দারুণ উদাহরণ হয়ে থাকা কারুণানন্দ নিজ দেশে কোন সম্মানই পাননি। সুজুকি ১৯৭০ সালে শ্রীলংকার জাতীয় অলিম্পিক কমিটির সাথে যোগাযোগ করে পত্রিকার কাটিং, ছবি, ভিডিও দিলেও অলিম্পিক জয় করা এই মানুষটিকে নিয়ে কিছুই করেননি তারা।

নিভৃতচারী এই ক্রীড়াবিদকে জাপান সরকার ১৯৭৫ সালে স্কলারশিপ এবং চাকরি প্রদান করে। কিন্তু জাপান যাওয়ার মাত্র তিনদিন আগে খুবই রহস্যজনকভাবে পুকুরে ডুবে মারা যান ম্যারাথন কারু। কারো মতে দুর্ঘটনা, কারো মতে খুন আর কারো মতে নিরুদ্দেশ হওয়া কারুর এই করুণ অন্তর্ধান বিতর্ক অমীমাংসিতই থেকে গিয়েছে!

স্বামীশোকে কারুর পত্নী মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন এবং অর্থের অভাবে পথে নামতে বাধ্য হয় পুরো পরিবার। কিছুদিন পর এক আত্মীয় ভরণপোষণের দায়িত্ব নিলে অবস্থা কিছুটা উন্নত হয়। অথচ এই পুরো পরিস্থিতিতে শ্রীলংকা সরকার নীরব ভূমিকা পালন করেন।

এর প্রায় ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে জাপানি টিভি চ্যানেল 'এন এইচ কে' শ্রীলংকায় আসে এই কিংবদন্তী দৌড়বিদকে নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে। কিন্তু দূরদেশে বিখ্যাত কারুণানন্দ সম্পর্কে কেউ কিছু জানত না।  ভুল করে ম্যারাথন কারু খ্যাত কুরুপ্পা করুণারত্নে নামক আরেক ম্যারাথন দৌড়বিদের কাছে দেখা করতে যান তথ্যচিত্র নির্মাতারা। পরে  কুরুপ্পার সাহায্যেই খুঁজে বের করা হয় কারুণানন্দের পরিবারকে। পরবর্তীতে ডকুমেন্টারি প্রচারিত হওয়ায় অনেক বছর পর শিরোনামে আসেন প্রথম ম্যারাথন কারু রানাতুঙ্গে করুণানন্দ। 

[নতুন ম্যারাথন কারু কুরুপ্পা করুণারত্নের শেষ পরিণতিটাও করুণ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে বেশ কয়েকবার বড় ধরণের ম্যারাথন জেতা এই দৌড়বিদ ছিলেন শ্রীলংকাতে দারুণ জনপ্রিয়। ২০০৮ সালের ৬ এপ্রিল শান্তি চুক্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক ম্যারাথনে অংশ নেবার কিছুক্ষণ আগে তৎকালীন বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী জয়রাজ ফার্নান্দোপুল্লে এবং আরও ৯০ জন মানুষের সাথে এক আত্নঘাতি বোমা হামলায় নিহত হন তিনি]

১৯৯৭ সালে ক্রীড়া মন্ত্রণালয় থেকে কারুণানন্দের পরিবারের খোঁজ করা হলে তার একমাত্র ছেলে চান্না দর্শনপ্রিয় দেখা করেন মন্ত্রীর সাথে। পেশায় শিক্ষক দর্শনপ্রিয়কে মন্ত্রীর উচ্চস্বরে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, তিনি নয় বরং তার বাবা দৌড়েছিলেন অলিম্পিকে। তাই তার বাবা যেন দেখা করেন মন্ত্রীর সাথে। অথচ কারু ধরাধাম ত্যাগ করেছেন ২২ বছর আগেই। এভাবেই হাস্যকর, হতাশাজনক আর অর্থহীনভাবে শেষ হয়, শ্রীলংকা কর্তৃপক্ষ থেকে করা একমাত্র যোগাযোগের চেষ্টা।

কি নির্মম পরিহাস! একমাত্র কন্যা নিলাম প্রিয়দর্শনীর কাছে থাকা কারুর স্ত্রী এখনো বিশ্বাস করেন, তিনি স্বামী-সন্তানসহ জাপান যাবেন কিছুদিন পরেই।

আনসাং হিরো কারুণানন্দ নিজ দেশের মানুষের জন্য হতে পারতেন এক স্বপ্নদ্রষ্টা অ্যাথলেট, হতে পারতেন বিখ্যাত কেউ, কিন্তু মিডিয়া আর সরকারের অবহেলায় ওসব তো দূরে থাক, একজন নাগরিকের সম্মানটুকুও পাননি।

নিজের দেশের মানুষের কাছে অতি সহজে বিস্মৃত হলেও কারুণানন্দকে জাপানিরা মনে রেখেছি নায়ক হিসেবে; যে নায়ক হাজার হাজার তরুণের জীবন পরিবর্তন করেছেন সংকল্প, সাহস, অঙ্গীকার এবং প্রেরণার উদাহরণ হয়ে থেকে। ’৬৪ অলিম্পিকের সেই ঐতিহাসিক ঘটনার ৫ দশক পার হয়ে যাবার পরেও দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি বরণ করা এই সিংহ হৃদয় শ্রীলংকান বন্ধুকে জাপানিরা এখনো কিংবদন্তী হিসেবেই দেখে।

১৯৮৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ম্যাড ম্যাক্স চলচ্চিত্রে টিনা টার্নারের We don't need another hero! গানের লিরিকটা কেন জানি মনে করিয়ে দেয় ম্যারাথন কারুর গল্পটাকেঃ

"So what do we do with our lives? We leave only a mark. Will our story shine like a light or end in the dark?" 

অনেকেই আলো ছড়ায়, আবারকেউ হারিয়ে যায় অন্ধকারে। কেউ আবার তারার মত টিমটিম করে জ্বলতে থাকে দূর আকাশে। ম্যারাথন কারু হয়ে থাকুক সেই তারাদেরই একজন!