যাদের জন্য সময় থেমেছিল - পর্ব ৫: নেভার ডেরেক আপ!
পোস্টটি ২৭৭৭ বার পঠিত হয়েছে৪০০ মিটার দৌড়ের সেমিফাইনাল শুরু হবে। স্টার্টিং ব্লকে দাঁড়িয়ে আছেন ২৬ বছরের এক টেকো মাথার অ্যাথলেট। একটু পর যখন হাঁটু গেড়ে বসলেন, মনে পড়লো, গত কয়েক বছরে ৮ বার অপারেশন টেবিলে যেতে হলেও এখন তিনি শতভাগ ফিট। প্রথম রাউন্ডে ৬৯ অ্যাথলেটের মধ্যে সবচেয়ে ভালো টাইমিংটা তাঁরই করা, গত ৪ বছরে নিজের সবচেয়ে ভালো দৌড়ও ছিল সেটা। কোয়ার্টার ফাইনাল জিতেছেন ঘাম না ঝরিয়ে, প্রথম স্থানে থেকেই। সেমিফাইনালটা আশানুরূপ হলে ফাইনালে পদকের মঞ্চে তাঁর না থাকাটাই বরং হবে অস্বাভাবিক।
আত্নবিশ্বাসে টগবগ করে ফুটতে থাকা তরুণ পিস্তলের গুলি শোনা মাত্রই দুর্দান্ত স্টার্ট করে ছুটলেন ঘোড়ার গতিতে। প্রথম বাঁকের কাছাকাছি এসে বুঝলেন বেশ এগিয়ে আছেন বাকিদের চেয়ে। ১২৫ মিটারের দিকে আত্নবিশ্বাসের পারদটা আরেকটু বাড়লো, ঠিক তখনই তুড়ি বাজানোর মত একটা শব্দ হল। পাত্তা না দিয়ে আরও ২-৩ কদম যাওয়ার পরই টের পেলেন ব্যথা, পায়ে যেন গুলি খেয়েছেন। কিন্তু তারপরই চিনতে পারলেন পরিচিত যন্ত্রণাটাকে।
হ্যামস্ট্রিং! আগেও মোলাকাত হওয়া এই ইনজুরির ব্যথাটা তীব্র যন্ত্রণাদায়ক। মনে হয় যেন কেউ একটা গরম ছুরি হাঁটুর পেছনে ঢুকিয়ে মোচড়াচ্ছে ইচ্ছেমতন। পায়ের পেছনটা ধরে একটা চাপা আর্তনাদ করে পড়ে গেলেন ট্র্যাকের ওপরেই।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, এত অনুশীলনের পরও এরকম কিছু কল্পনাতেও ছিল না। ততক্ষণে কাছে চলে এসেছে চিকিৎসা সেবা দিতে আসা রেডক্রস দল। এই সময়টায় আর কি করার? যে কোন অ্যাথলেটই বিষণ্ণ মনে ট্র্যাক ছেড়ে যাবেন স্ট্রেচারে করে। কিন্তু কি মনে হতে রেডক্রস সদস্যদের কাছে আসতে মানা করে উঠে দাঁড়ালেন দুঃসহ ব্যথা নিয়ে। একবার তাকিয়ে দেখলেন, বাকি অ্যাথলেটদের কি অবস্থা, তারপর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে শুরু করলেন দৌড়।
ছোটবেলা থেকেই পরাজয়কে ঘৃণা করা এই ব্রিটিশ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, জীবনের শেষ রেস হলেও ফিনিশিং লাইন স্পর্শ করেই যাবেন ট্র্যাক থেকে। এক পা নিয়েই চালিয়ে যাবেন দৌড়, খোঁড়াতে খোঁড়াতে শেষ করবেন রেস, একা একাই, গর্ব আর সাহসে ভরা হৃদয় নিয়ে।
অনেক কিছু বলা হয়ে গেছে, ভদ্রলোকের পরিচয় দিয়ে নেই এবার। নাম ডেরেক রেডমন্ড, ব্রিটেন দলের অন্যতম বড় তারকা। আর যে ঘটনার কথা বলছি, সেটা ৫ আগস্টের ১৯৯২ বার্সেলোনা অলিম্পিক।
রেডমন্ড বার্সেলোনায় এসেছিলেন ৪০০ মিটার দৌড়ে পদক জেতার তীব্র বাসনা নিয়ে। মেডেলের রঙটা তাঁর কাছে অর্থবহ ছিল না, শুধু জিততে চেয়েছিলেন অধরা অলিম্পিক পদক। তাই অলিম্পিক যখন শুরু হল, তিনি জানতেন, এটাই তাঁর সময়, তাঁর মুহূর্ত, তাঁর মঞ্চ - বিশ্বকে দেখিয়ে দেওয়ার তিনি আসলে কে এবং কতটা ভালো অ্যাথলেট!
আবার গল্পে ফিরে আসি! তীব্র ব্যথাকে সহ্য করে আরও ৭৫ মিটার মতন দূরত্ব পেরিয়ে যখন ২০০ মিটারের দিকে আসছেন, তখন বাকি সবাই ছুঁয়ে ফেলেছেন চূড়ান্ত সীমানা। আমেরিকার স্টিভ লুইস ৪৪.৫০ সেকেন্ডে জিতে নিয়েছেন সেমিফাইনাল।
স্বপ্নটা শেষ! একেবারেই শেষ! হয়ত আর কোনোদিন জিততে পারবেন না অলিম্পিক পদক।
তারপরও থামছেন না ডেরেক। কি অদ্ভুত বোকামি! ক্যারিয়ারটাই তো ধ্বংস হয়ে যাবে! চিকিৎসক এবং কর্তাব্যক্তিরা এসে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করলেও লাভ হচ্ছিল না, চাপা কান্নার সাথে মনের জোরটা ধরে রেখে এগিয়ে গেলেন ফিনিশিং লাইনের দিকে।
চোখের সামনে অবিশ্বাস্য সব কিছু ঘটতে দেখা দর্শকরা ধীরে ধীরে জাগ্রত হলেন, শুরু হল গর্জন। গর্জন তীব্র থেকে তীব্রতর হল। এক পদক্ষেপের চেয়ে ধীরতর এবং আরও যন্ত্রণাদায়ক পদক্ষেপ নিয়ে তিনি যাচ্ছেন এগিয়ে, তাঁর মুখ বেঁকে যাচ্ছে ব্যথা আর চোখের জলে, দর্শকসারির অনেকেই তখন কাঁদছেন তাঁর সাথে, সাথে হর্ষধ্বনিতে সাহস যোগাচ্ছেন তাকে।
ওদিকে ঘটছে আরেক কান্ড! হঠাৎ করেই গ্যালারীতে থাকা এক মধ্যবয়স্ক লোক অনেককে ধাক্কা দিয়ে, ঠেলে সরিয়ে দাঁড়ালেন রেলিং-এ। তারপর এক মুহূর্তও ইতস্তত না করে লাফ দিয়ে ট্র্যাকে নেমেই সোজা ছুটলেন ডেরেকের দিকে। ততক্ষণে হতভম্ব নিরাপত্তা রক্ষীদল ধাওয়া করেছে তাঁর পিছু। এই পাগলাটে মানুষটা আর কেউ নন! স্বয়ং ডেরেকের বাবা, জিমি রেডমন্ড!
ফটোগ্রাফঃ ছেলের দিকে ছুটছেন জিমি রেডমন্ড
চেঁচিয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের বলে চলেছেন, ‘ওটা আমার ছেলে, এবং আমি তাকে সাহায্য করতে যাচ্ছি!’
১২০ মিটার বাকি থাকতে ছুঁয়ে ফেললেন পুত্রকে, কোমর জড়িয়ে ধরে এগিয়ে দিলেন কাঁধ। তারপর অনুরোধ করলেন সরে দাঁড়াতে, হয়ত ৪x৪০০ মিটার রিলের আগেই সেরে যেতে পারে ইনজুরি। কিন্তু না, ডেরেক তখন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যে করেই হোক, শেষটা দেখেই ছাড়বেন। ছেলের মনোবলের কাছে হার মানলেন বাবা। তাঁর কাঁধে ভর দিয়ে শুধু হাঁটতে বললেন ছেলেকে। এরপর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না ডেরেক। বাবার কাঁধে মাথা দিয়েই ফোঁপাতে শুরু করলেন, সাথে চালিয়ে গেলেন নিজের না শেষ করা যুদ্ধটাও। কিন্তু প্রতি মুহূর্তেই তরুণের তীব্র যন্ত্রণা যে বেড়েই চলেছে, মুখভঙ্গিতেই ফুটে উঠছে তা। কিন্তু বাবাও দিয়ে যাচ্ছেন প্রেরণা। বারবার বলে চলেছেন, “You’re a champion, you’ve got nothing to prove.”
ফটোগ্রাফঃ বাবাকে জড়িয়ে ধরে ক্রন্দনরত ডেরেক এগিয়ে যাচ্ছেন ফিনিশিং লাইনের দিকে!
জিমি রেডমন্ডের টিশার্টে লেখা "Have you hugged your foot today?" কথাটা যেন বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে ডেরেকের জীবনে। হ্যামস্ট্রিং পেশীতে টান খাওয়া ঐ দৌড় চালাতে গিয়ে একেবারেই ছিঁড়ে যায় ডেরেকের হ্যামস্ট্রিং পেশী!
ঘটনাবহুল দিনটায় মায়ের সাথে নর্দাম্পটনশায়ারের বাসায় টেলিভিশনের সামনে বসা ডেরেকের ২৮ বছরের বোন কারেন তখন ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা, ভাইয়ের দুর্ঘটনা দেখার মুহূর্তেই শুরু হয়েছে তাঁর প্রসব বেদনা!
আর ওদিকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পিতা-পুত্র স্টেডিয়ামের ৬৫,০০০ দর্শকের হর্ষধ্বনি, তালি, কান্না মিশ্রিত উন্মত্ত গর্জনে ফিনিশিং লাইনের দিকে যাচ্ছেন অদম্য প্রতিজ্ঞায়। লাইন থেকে কয়েক ধাপ দূরে থাকতে জিমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেন, যাতে ডেরেক নিজেই স্পর্শ করতে পারেন চূড়ান্ত সীমানা। পুত্র তা করলেন।
এরপরের দৃশ্যটা অলিম্পিক ইতিহাসের অ্যালবামে করে নিবে চিরস্থায়ী আসন। পিতা-পুত্রর একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকা দৃশ্যটা কাঁদিয়েছে স্টেডিয়াম আর টিভি পর্দার সামনে থাকা অজস্র দর্শককে।
কিন্তু ডেরেক পিতার সাহায্য নিয়ে দৌড় শেষ করায়, তাকে ডিসকোয়ালিফাইড ঘোষণা করা হয়। এমন গর্বিত ঘটনার নায়ক হবার পরও তাঁর নামের পাশে লেখা হয়, DNF (ডিড নট ফিনিশ)!
রেস চলাকালীন পুরোই অন্য জগতের বাসিন্দা বনে যাওয়া ডেরেক জানতেনও না কি হয়েছে সেই কয়েক মিনিটে তাকে কেন্দ্র করে, “After I crossed the line I was taken to the doctors and I was crying like a baby the whole time, I had no idea how the crowd had reacted until I saw the video – they were the last thing on my mind. It could have gone one of two ways: they’d either think ‘what a complete prat’ or ‘good on him’. Luckily they chose the second one.”
পুত্রের কথা তো শুনেছেন, পিতা কি বলেছিলেন?
“I’m the proudest father alive, I’m prouder of him than I would have been if he had won the gold medal. It took a lot of guts for him to do what he did.”
তড়িঘড়ি করে স্টেডিয়ামে এসে রেডমন্ডের সাথে দেখা করেন গ্রেট ব্রিটেন দলনেতা লিনফোর্ড ক্রিস্টি। ক্রিস্টির সাথে রীতিমত দা-কুমড়া সম্পর্ক ছিল ডেরেকের। ১৯৯১ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের ৪x৪০০ মিটার রিলেতে স্বর্ণ জেতার পরের উল্লাস দেখে তাদের ব্যক্তিগত ইভেন্টে নৈপুণ্যকে হতাশাজনক মন্তব্য করে কঠোর সমালোচনা করেছিলেন ক্রিস্টি। সে দলে থাকা রেডমন্ড পাল্টা জবাবে, দু' কাঁধেই মাংসপেশি থাকা ক্রিস্টিকে ব্রিটেনের সবচেয়ে পারফেক্ট অ্যাথলেট বলে ব্যঙ্গ করেন। কিন্তু সেদিন বার্সেলোনার এস্তাদিও অলিম্পিকে বদলে যায় পরিস্থিতি। ক্রিস্টি এসেই জড়িয়ে ধরেন তাকে, দু'জনেই ভেঙ্গে পড়েন কান্নায়। ঐ ঘটনায় ক্রিস্টির প্রতি সব রাগ উবে গিয়েছিল। আবেগাক্রান্ত গলায় বলেছিলেন, খেলাধুলা মানে কেবল খেলতে আসা আর অর্থ উপার্জন না, বরং এর চেয়েও অনেক বেশি কিছু।
অলিম্পিক ভিলেজের শেষ কয়েকদিন অ্যাথলেটদের অসংখ্য প্রশংসা বার্তা পেয়েছেন ডেরেক। তবে কখনো না দেখা এক কানাডিয়ান অ্যাথলেটের বার্তাটা যত্ন করে রেখেছেন স্মৃতির ডায়েরীতে - “Long after the names of the medallists have faded from our minds, you will be remembered for having finished, for having tried so hard, for having a father to demonstrate the strength of his love for his son. I thank you, and I will always remember your race and I will always remember you – the purest, most courageous example of grit and determination I have seen.”
সমবেদনা জানাতে এসেছিলেন ১৯৮০ সালের অলিম্পিকে রূপা জয়ী ব্রিটিশ সাঁতারু শ্যারন ডেভিস, কিন্তু এসেই প্রেমে পড়লেন ডেরেকের। বছর দুয়েক পর বিবাহ বন্ধনেও জড়ালেন নিজেদের। দুই বাচ্চার জন্ম দেওয়া এই সম্পর্ক পরে অবশ্য টেকেনি বেশিদিন, ২০০০ সালে ডিভোর্স হয় তাদের।
সেবারের ১৯৯২ অলিম্পিকটা উল্লেখযোগ্য ছিল বেশ কিছু কারণে - বর্ণপ্রথার ঘৃণ্য চর্চায় ৩২ বছরের নিষেধাজ্ঞার পর প্রত্যাবর্তন করে দক্ষিণ আফ্রিকা, অলিম্পিকে ১০০০০ মিটার প্রমীলা দৌড়ে সোনাজয়ী কৃষ্ণাঙ্গ ডেরার্তু তুলু আর রূপাজয়ী ‘সাদা’ দক্ষিণ আফ্রিকান এলেনা মেয়ারের হাতে হাত মিলিয়ে ‘ভিক্টরি ল্যাপ’ দেয়ার দৃশ্য অলিম্পিকের ফ্রেমে নিশ্চিতভাবেই চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে। ৫৬ বছর পর অলিম্পিক দেখেছিল ‘এক’ জার্মানির অংশগ্রহণ - জার্মানির প্রতিটা সোনাজয়ের পর জার্মানদের উল্লাস আর জাতীয় সংগীত বাজার সময় আবেগের তোড় ছিল স্বাভাবিকভাবেই চোখে পড়ার মতো! ২২ বছরের মধ্যে সেটাই ছিল কোনো দেশ কর্তৃক বয়কটহীন প্রথম অলিম্পিক! কিন্তু নিশ্চিতভাবেই ব্রিটিশ দৌড়বিদ ডেরেক রেডমন্ড এবং তাঁর পিতার ফিনিশিং লাইন স্পর্শ করার ছবিটা ১৯৯২ অলিম্পিকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মুহূর্তের একটি হয়ে থাকবে।
আইওসির 'Celebrate Humanity' ভিডিওতে ব্যবহার করা হয় এই ঘটনাকে। তাতে বলা হয়, ‘শক্তি বিচার করা হয় কেজিতে, গতি মাপা হয় সেকেন্ডে, কিন্তু সাহস? সাহসকে তো কখনো মাপতে পারবেন না!’
পরবর্তীতে বিখ্যাত ব্র্যান্ড নাইকির "Courage" কমার্শিয়াল এবং ভিসার অলিম্পিক আদর্শকে ভিত্তি করা "Go World" সিরিজেও ব্যবহার করা হয় ডেরেকের গল্পটা যাতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন স্বয়ং মর্গান ফ্রিম্যান।
যদি সেদিন হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিতে না পড়তেন, ফাইনালে গিয়ে হয়তো হয়েও যেতেন অলিম্পিক পদকধারী; কিন্তু এই ভালোবাসার গল্প, বিজয়ের গল্প, কিছু না পেয়েও সব পাওয়ার গল্পটা লেখা হত কি করে?
ভিডিওতে ডেরেক রেডমন্ডের ইতিহাস বিখ্যাত সেই দৌড়!
পদক-রেকর্ড-চমক আর ইনজুরির ক্যারিয়ার
১৯৬৫ সালের বসন্তে বাকিংহামশায়ারের এক ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান অধিবাসী পরিবারে জন্ম নেওয়া ডেরেক অ্যান্থনি রেডমন্ড পড়াশোনা করেছিলেন নর্দাম্পটনশায়ার কাউন্টির রোডি স্কুলে। সেখানে তাঁর নামে আছে একটি ক্রীড়া মিলনায়তন।
পাঁড় নিউক্যাসল ভক্ত এই ব্রিটিশ নজরে এসেছিলেন খুব কম বয়সেই ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে। ১৯৮৫ সালে ১৯ বছর বয়সে দেখালেন চমক! ৪০০ মিটারে গড়লেন নতুন ব্রিটিশ রেকর্ড। জানান দিলেন আলো হতেই এসেছেন তিনি।
কিন্তু সে রেকর্ড টিকেছিল মাত্র দু'বছর। রিলে দলের সতীর্থ রজার ব্ল্যাক ভেঙ্গে দিলেন রেকর্ড। কিন্তু ব্ল্যাককে সরিয়ে রেকর্ডবুকে আবার নাম লেখাতে সময় নিয়েছিলেন মাত্র ২ মাস। ৪৪.৫০ সেকেন্ডে করা সেই ব্রিটিশ রেকর্ড রেমন্ডের অবসরের আগে ছুঁতে পারেননি কেউই।
গ্রেট ব্রিটেনের হয়ে ৪x৪০০ মিটার রিলেতে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ এবং কমনওয়েলথ গেমসে জিতেছেন স্বর্ণ, দুটোই ১৯৮৬ সালে। পরের বছর রোমের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ রিলেতে আবার পদক, তবে এবার রূপা।
তবে ইতিহাসের অন্যতম সেরা রিলে দলটা বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিলো ১৯৯১-এ। মহা ফেবারিটের তকমা লাগানো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দলকে ৪x৪০০ মিটার রিলেতে পেছনে ফেলে জিতলেন টোকিও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের স্বর্ণ! রজার ব্ল্যাক, জন রেজিস, ক্রিস আকাবুসিকে সঙ্গে নিয়ে ঐ রিলেতে করা টাইমিং তখন ৪x৪০০ মিটার রিলের ইতিহাসেই দ্বিতীয় সেরা।
ক্যারিয়ার জুড়ে ইনজুরির সাথে লড়াই করা রেডমন্ডের কাছে অলিম্পিকটা কখনোই আসেনি সাফল্য নিয়ে। দু'বার অংশ নিয়ে দু'বারই পুড়েছেন মর্মবেদনার আগুনে। ১৯৮৮ সিউল অলিম্পিকে ৪০০ মিটার হিটে দুটো পেইনকিলার ইনজেকশন নিয়ে নেমেছিলেন ট্র্যাকে, কিন্তু করতে পারেননি শেষরক্ষা। রেস শুরুর মাত্র ৯০ সেকেন্ড আগে অ্যাকিলিস টেন্ডনের ইনজুরির কারণে নাম প্রত্যাহার করেন। আর '৯২ অলিম্পিকের গল্পটা এতক্ষণে জেনেই গিয়েছেন।
’৯২ অলিম্পিকের আগে সর্বমোট ৮ বার চিকিৎসকের ছুরির নিচে যাওয়া ডেরেক কেবল ১৯৮৯ সালেই অপারেশন করান ৫ বার। তাই ১১তম বার অপারেশনের পর অ্যাথলেটিক ক্যারিয়ারটাও থেমে গেছে দ্রুতই।
ফটোগ্রাফঃ ১৯৯১ সালের ৪x৪০০ মিটার রিলেতে স্বর্ণ জয়ী গ্রেট ব্রিটেন দল
শেষটা কেমন?
অলিম্পিকের দুঃস্বপ্নটা শেষ হয়নি ঐদিনটার পরেও। দু'বছর ইনজুরির সাথে লাগাতার যুদ্ধ করতে থাকা ডেরেকের ক্যারিয়ারের বিদায় ঘণ্টা বাজিয়ে দেন ব্রিটেন অ্যাথলেটিকস দলের চিকিৎসক। জানান যে, তিনি আর কোনদিন প্রতিযোগিতায় দৌড়াতে পারবেন না, তাই আর কখনো হবে না দেশকে প্রতিনিধিত্ব করাও।
কিন্তু স্নেহশীল বাবার অনুপ্রেরণায় আবার নতুন করে শুরু করেন সবকিছু। মনোযোগ দেন পছন্দের অন্যান্য খেলায়। বার্মিংহাম বুলেটসের হয়ে খেলেছেন প্রফেশনাল বাস্কেটবল। এরপর সেই চিকিৎসককে পাঠিয়েছিলেন খেলার ফটোগ্রাফ!
পরবর্তীতে বেশ কিছুদিন ব্রিটেনের স্প্রিন্ট এন্ড হার্ডলস দলের উন্নয়ন পরিচালকের দায়িত্ব পালন করা এই সাবেক অ্যাথলেট ১৯৯৪ সালে জেতেন টেলিভিশন শো - সেলিব্রিটি গ্ল্যাডিয়েটরস। ইউরোস্পোর্টস চ্যানেলের পক্ষে ধারাভাষ্য করেছেন, খেলেছেন কার রেসিং-এ। কস্তেলো-রেডমন্ড রেসিং দলের হয়ে ২০০৯ সালে সিনিয়র ট্যাগ এন্ডুরেন্স চ্যাম্পিয়নশিপে হয়েছেন রানার আপ। এক সুপার বাইক টিমের মালিক ডেরেক কভেন্ট্রিকে জিতিয়েছেন প্রথম বিভাগ রাগবি, একটুর জন্য জায়গা করে নিতে পারেননি ইংল্যান্ডের জাতীয় সেভেনস রাগবি দলে।
২০১২ লন্ডন অলিম্পিকের মশাল বহনের সম্মান দেওয়া হয় ডেরেকের পিতা জিমি রেডমন্ডকে।
বর্তমানে অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তা বনে যাওয়া সব্যসাচী এই ক্রীড়াবিদ এপর্যন্ত কয়েকশ' সম্মেলনে-অনুষ্ঠানে দিয়েছেন বক্তৃতা। মানুষকে জানান ১৯৯১ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের স্বর্ণ জয়ের গল্প, বলেন ১৯৯২ অলিম্পিকের বেদনাদায়ক সেই ঘটনাটাও। নিজের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে আছে তাকে নিয়ে করা মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উক্তি –
“Derek Redmond bravely making it through with little help, moments of euphoria after years of hard work. Moments when the human spirit triumphs over injury that should have been impossible to overcome’’
- 0 মন্তব্য