যে নাচে মিশে আছে বিষাদ!
পোস্টটি ৪৫১১ বার পঠিত হয়েছেপদক জিতলে আপনি উসাইন বোল্টের মত আকাশমুখী হয়ে বিদ্যুৎ চমক দেখাতে পারেন, মাইকেল ফেল্পসের মত তর্জনিও নাচাতে পারেন, টুইটারে করে বসতে পারেন দম্ভোক্তি, কিন্তু ডেভিড কাতোয়াতাউ গত ১৫ আগস্ট যা করে দেখিয়েছেন, সেটা হয়ত আপনার কল্পনাতেই আসবে না!
যখন দেশের হয়ে খেলতে নামছেন এটা জেনে যে, কয়েক বছর পর আপনার দেশটাই হারিয়ে যেতে পারে বিশ্ব মানচিত্র থেকে, তখন কি করবেন? – আপনি নাচবেন!
শুনতে অবাক লাগছে?
চমকপ্রদ বিষয় হল, কোন পদক জিতে নয়, বরং রিও অলিম্পিকে ভারোত্তোলনের ১০৫ কেজি বিভাগে ১৪তম হয়েও এই অদ্ভুত কান্ড করেছেন প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ কিরিবাতির এই ভারোত্তোলক।
ঘটনার শুরুটা কোয়ালিফাইং রাউন্ডের ক্লিন এন্ড জার্ক অংশে। প্রতিবার ভারোত্তোলনের পরই অদ্ভুত সব ভঙ্গিমায় শরীর নাচাচ্ছিলেন তিনি। দর্শকরা প্রথমে অবাক হলেও পরে উপভোগ করতে শুরু করলেন বিষয়টা। শেষবার যখন ভার তুলতে গিয়ে করতে গিয়ে ব্যর্থ হলেন, সেবারও একটুও হতাশ না হয়ে আবার শুরু করলেন নৃত্য প্রদর্শন। মাথার উপরে হাত নিয়ে কোমর দুলিয়ে সাথে সাথে অনবরত নাচাচ্ছেন পা। ভারোত্তোলনের মঞ্চে ভার তোলার বদলে নাচতেই যেন এসেছেন তিনি। ততক্ষণে এই আমুদে মানুষটাকে পছন্দ করে ফেলা রিওর দর্শকরাও হর্ষধ্বনি আর করতালিতে উৎসাহ দিয়েছেন প্রতিবারই। মঞ্চ থেকে নামার আগে সেই ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে বলেছেন, রাতে তাদের সাথে আবার নাচবেন তিনি।
নাচের এক মুহূর্তে কাতোয়াতাউ
দর্শকদের দারুণ বিস্ময় উপহার দেওয়া কিরিবাতির ভারোত্তোলক এমন করছিলেন কেন? জানা গেলো কিছুক্ষণ পরেই।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে পৃথিবী জুড়েই। বর্তমানে সমুদ্রপৃষ্ঠের মাত্র ৬ ফুট উপরে অবস্থান করা কিরিবাতি আগামী কয়েক বছরেই চলে যেতে পারে পানির নিচে। আর কি করে সচেতনতা বৃদ্ধি করবেন পৃথিবীর লোকজনের? কিভাবে নিজের এই ডুবন্ত, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ক্ষত-বিক্ষত দেশটাকে সাহায্য করবেন? তাই বেছে নিয়েছেন এরকম অদ্ভুত উদযাপন।
শুরুটা ২০১৪-তে, গ্লাসগো কমনওয়েলথ গেমসের সময় এক খোলা চিঠিতে বলেছিলেন, পরিবেশ বিপর্যয় কিভাবে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে প্রশান্ত মহাসাগরের নিচু দ্বীপ দেশগুলোকে। জলোচ্ছ্বাস আর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ভয়াবহ অভিজ্ঞতার গল্পটা জানিয়ে আবেদন করেছিলেন আন্তর্জাতিক সাহায্যের জন্য। কোচ পল কফা গেমস চলাকালীন ক্রীড়াবিদ এবং আয়োজকদের কাছেও পৌঁছে দেন আবেগঘন সেই চিঠি।
গেমসের মাত্র বছর তিনেক আগে এক ভয়ংকর সাইক্লোনে হারিয়েছিলেন কয়েক পুরুষের ঐতিহ্য ধরে রাখা ঘরবাড়ি, সম্পত্তি। কিন্তু সবাইকে অবাক করে অবিশ্বাস্য নৈপুণ্যে ১০৫ কেজি ইভেন্টে জিতলেন স্বর্ণ, কিরিবাতির ইতিহাসে প্রথম কমনওয়েলথ গেমস পদক। সেখানেই প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে এই অদ্ভুত নাচকেই বেছে নেন তিনি। গ্লাসগোতেই শুরু হয় ট্রেডমার্ক এই সেলিব্রেশনের।
তারপর থেকে বছর দুয়েক ধরে প্রতিযোগিতায় নিয়মিত নর্তন-কুর্দন করে যাওয়া কাতোয়াতাউ রিও অলিম্পিকে স্টেডিয়াম মাতানোর পর আবারো জানিয়েছেন মর্মস্পর্শী আবেদন,
"Most people don't know where Kiribati is, I want people to know more about us so I use weightlifting, and my dancing, to show the world. We don’t have the resources to save ourselves."
মনের ভেতরের কথাগুলো দিয়ে নাড়িয়ে দিয়েছেন উপস্থিত সবাইকেই, ''আমি জীবনে এতটা অসহায় আর কখনো অনুভব করিনি, একজন ক্রীড়াবিদ হিসাবে আমার দেশকে যা দেওয়া সম্ভব, সবটুকু দিতে চেষ্টা করেছি। কয়েক বছরের মধ্যেই কিরিবাতি এবং আমাদের সংস্কৃতি মানুষের কাছে বিস্মৃত হয়ে যাবে, তবুও আমি কিছু করতে পারবো না! তাই আমি আন্তর্জাতিক সাহায্যের জন্য আকুতি জানাচ্ছি! কিরিবাতির বিভিন্ন স্কুলে আমি কয়েক হাজার শিশু-কিশোরের সাথে কথা বলেছি, যারা বড় হয়ে কিছু করার স্বপ্ন লালন করে। কিন্তু আমি কিভাবে তাদের মিথ্যা আশ্বাস দিবো? কিভাবে বলবো, তাদের স্বপ্ন সফল হওয়া সম্ভব, যখন আমাদের দেশটাই বিলীন হয়ে যাচ্ছে?''
নির্দেশ করেছেন অবকাঠামোগত দুর্বলতাকেও। যখন তিনি ভারোত্তোলন শুরু করেন, কোনো জিম ছিল না কিরিবাতিতে, নেই এখনো। তাই সাগরতীরে খোলা আকাশের নিচেই করেন অনুশীলন। রোদ উঠলে আগুন-গরম বার ছোঁয়া অসম্ভব হয়ে যায় বলে, খুব ভোরবেলায় করতে হয় ভারোত্তোলনের অনুশীলন।
কিরিবাতি দ্বীপপুঞ্জকে চেনানোর মহাদায়িত্ব নেওয়া এই অলিম্পিয়ান জন্ম নিয়েছেন ১৯৮৪ সালের ১৭ জুলাই। কমনওয়েলথ স্বর্ণ জেতার পর সরকার থেকে প্রাপ্ত বোনাস অর্থ দিয়ে বানিয়েছিলেন শখের ঘর। গেল বছর আরেক জলোচ্ছ্বাসে সেই ঘর উড়ে গেছে, তবুও হারাননি আশা। জিতেছেন প্যাসিফিক গেমসের স্বর্ণ। এসেছেন অলিম্পিকে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঐতিহ্যবাহী পোশাকে কিরিবাতির ভারোত্তোলক
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও মাতিয়েছেন তিনি। কিরিবাতির নাম ঘোষণা করার পর এমন প্রাণপণে পতাকা ওড়াচ্ছিলেন আর অঙ্গভঙ্গি করছিলেন, দেখে মনে হচ্ছিল, এটাই বোধহয় তাঁর ইভেন্ট। এই কাজ না করলে পদক মেলা তো দূরে থাক, জীবনটাই হয়ে যাবে বিপদাপন্ন। আসলেই তো তাই!
কোচ কফাও কথা বলেছেন কাতোয়াতাউর সুরেই। তাঁর কাছে অংশ নেওয়াটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আর কিছুই না। অলিম্পিকের মাধ্যমে বিশ্বকে জানানো, আমরাও আছি কিন্তু!
২০১২ সালে দ্যা টেলিগ্রাফের রিপোর্টে দেখা যায়, কিরিবাতি বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম দেশ হিসেবে জলবায়ু জনিত মাইগ্রেশনের শিকার হতে পারে, ৩৩টি দ্বীপ নিয়ে গড়া কিরিবাতির ১ লাখের সামান্য বেশি জনসংখ্যার প্রায় পুরোটাকেই করতে হতে পারে স্থানান্তর। ২০১৪ সালে চার্চ অফ ইংল্যান্ডের কাছ থেকে কিরিবাতি সরকার প্রায় ৭ মিলিয়ন ডলারে কিনে নিয়েছে ফিজির কিছু অংশ ভূমি। অনেকটাই খাদ্য, কৃষিজমি আর বাসস্থানের বিকল্প উপায় হিসেবে।
জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড় অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের আগেই ডুবে যেতে পারে আলাস্কার প্রায় দ্বিগুণ বড় এই প্রবাল দ্বীপপুঞ্জ।সাথে বছর বছর বাড়ছে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, ভূমিক্ষয়, পরিষ্কার পানির অভাব। চরম উপকূলীয় ভাঙ্গন কেবল কিরিবাতি দ্বীপপুঞ্জের সৈকত নয়, বরং ভূমিও ধ্বংস করে দিচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের এই ভয়াবহতার গল্পটা নতুন সুরে বলতে থাকা কাতোয়াতাউ অংশ নিয়েছেন বেইজিং, লন্ডন আর রিও – টানা ৩ অলিম্পিকে। প্রত্যেকবারই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কিরিবাতির পতাকাটা শোভা পেয়েছিল মাত্র ৫ ফুট সাড়ে ৫ ইঞ্চির এই ভারোত্তোলকের হাতেই।
কমনওয়েলথ গেমসে স্বর্ণজয়ী এই অ্যাথলেট ২০১২ অলিম্পিকে কিরিবাতির প্রথম ক্রীড়াবিদ হিসেবে ওয়াইল্ড কার্ড ছাড়াই অলিম্পিকের টিকেট পেয়েছিলেন নৈপুণ্যের ভিত্তিতে। ওশেনিয়া অলিম্পিক কোয়ালিফিকেশনে প্রথম হয়েই পেয়েছিলেন এন্ট্রি। প্যাসিফিক গেমসের ১০৫ কেজি বিভাগের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন তিনি, সাথে আছে ২০০৭ আর ২০১১ আসরের রৌপ্য পদক। অর্জনের ঝুলিতে আরও আছে ওশেনিয়া অঞ্চলের ভারোত্তোলন প্রতিযোগিতায় ২০০৭ আসরের শিরোপা আর ২০০৬ আসরের ব্রোঞ্জ।
২০১৫ প্যাসিফিক গেমসে কাতোয়াতাউ এর নাচ
২০৪৮ অলিম্পিকে হয়ত দেখা যাবে না কিরিবাতিকে, সাথে আরও কিছু দ্বীপ দেশকেও। হারিয়ে যেতে পারেন কাতোয়াতাউ আর তাঁর এই প্রতিবাদী সেলিব্রেশন। কিন্তু না হারানোর গল্পটা লিখতে থাকা কাতোয়াতাউ বিবেকের প্রশ্ন তুলে অলিম্পিকটা রাঙিয়ে দিয়ে গেলেন জীবনের ছন্দেই!
- 0 মন্তব্য