• অলিম্পিক

মানুষ পাখির গানঃ পর্ব ২

পোস্টটি ১৮৩৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

সুইজারল্যান্ডের লুজানে অবস্থিত অলিম্পিক মিউজিয়ামে সুসজ্জিত কাঁচের বাক্সে রাখা আছে একখানা মেডেল, যার ছোট্ট বর্ণনায় লেখা আছে, "It is one of the noblest honours that can be bestowed upon an Olympic athlete."

না, অলিম্পিক স্বর্ণ, রৌপ্য, ব্রোঞ্জ কোনটাই না। কি সেই পদক? কি এমন মাহাত্ন্য সেই পদকের, যে অলিম্পিকের সবচেয়ে সেরা সম্মান আপনাকে এনে দিবে?

পদকটার নাম - পিয়েরে দ্য কুবার্তা মেডেল। নামটা চেনা চেনা লাগছে তো? হুম, আধুনিক অলিম্পিকের জনক পিয়েরে দ্য কুবার্তিনের সম্মানেই চালু করা হয়েছে এই পদক। প্রথম দেওয়া হয় ১৯৬৪ অলিম্পিকে।

কারা পান এই সম্মান? - ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি প্রদত্ত এই পদক কেবলমাত্র সেই সকল ক্রীড়াবিদই পান যারা খেলাধুলার আদর্শ ধরে রেখে ক্রীড়াসুলভ মানসিকতার দারুণ প্রদর্শন করেন অলিম্পিকে। এ পর্যন্ত ১২ জন ক্রীড়াবিদসহ মোটে ১৭ জন পেয়েছেন এই বিশেষ পদক। এবারের গল্প সেই অসাধারণ ক্রীড়াবিদদের নিয়েই...

 

উই আর দ্য চ্যাম্পিয়ন, মাই ফ্রেন্ড......

জুলাই ২০, ১৯৫২, হেলসিংকি অলিম্পিকের ১০,০০০ মিটার ফাইনালে ট্র্যাকে দৌড়াচ্ছেন দুই বিশ্বসেরা ফ্রান্সের অ্যালাইন মিমো আর চেকোস্লোভাকিয়ার এমিল জাতোপেক। ৪ বছর আগের লন্ডন অলিম্পিকেও এরাই ছিলেন প্রথম, দ্বিতীয়। দারুণ ফেবারিট এমিল গত ৪ বছরে ৬৯ রেসে একবারও হারেননি, তবে কয়েকদিন অসুস্থ থাকায় কষ্ট হচ্ছে তাঁর। তার উপর গত রাতে জোর করেই এক অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক রুমে এসে নিয়েছেন সাক্ষাৎকার। পরে সেই ভদ্রলোকের থাকার জায়গা নেই শুনে নিজের রুমেই রাত কাটানোর অনুমতি দিলেন, ফলে নিজের ঘুমটাও হয়নি ঠিকমত। তার উপর মিমো এবার ছেড়ে দেবার পাত্র নন, শুরু থেকেই পেছনে লেগে আছেন আঠার মত। তবে শেষের দিকে হাঁপাতে থাকা ফরাসীকে এবারো ছাপিয়ে গেলেন ৬ ফুটের মানুষটা। নিজের রেকর্ড প্রায় ৪২ সেকেন্ড নামিয়ে এনে গড়লেন নতুন অলিম্পিক রেকর্ড (২৯ মিনিট ১৭ সেকেন্ড)

দৌড়ানোর সময় এমিলকে দেখতেই যে কারো লাগতে পারে ভয়, মাথা দুলছে, হাতগুলো কনুই আর পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে নড়ছে, মুখ নিদারুণ যন্ত্রণায় যেন কাঁদছে! এইজন্য তাঁর নামই হয়ে গেলো এমিল দ্য টেরিবল। এই ভঙ্গিমাকে দেখে নিউ ইয়র্ক টাইমসের বিখ্যাৎ সাংবাদিক রেড স্মিথ বলেছিলেন, যেন তাঁর গলায় ফাঁস লাগানো হয়েছে, কিছুক্ষণ পরেই ফাঁসির দড়িতে ঝুলানো হবে এমিলকে। অবশ্য জাতোপেককে এই অদ্ভুত ভঙ্গিমার রহস্য জিজ্ঞেস করায় দিয়েছিলেন মজার এক উত্তর –

ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড আইস স্কেটিং বা জিমন্যাস্টিকস নয়। এখানে, হাসিমুখে পারফর্ম করে বিচারকদের কাছে প্রভাব রাখাটা জরুরী না।

 

মানুষ পাখির গান পর্ব ২ (9)

ফটোগ্রাফঃ ১০,০০০ মিটার জেতার পর রৌপ্য জয়ী বন্ধু অ্যালাইন মিমোকে জড়িয়ে ধরেছেন এমিল 

যাক, ফিরে আসি গল্পে, টানা দুই অলিম্পিকে একই ইভেন্টে স্বর্ণ জিতলেও তখন জয়ের ক্ষুধা কমেনি বাটা জুতো কোম্পানির সাবেক এই কর্মচারীর। লন্ডনে ৫,০০০ মিটারে প্রচণ্ড বৃষ্টি হওয়া কর্দমাক্ত ট্র্যাকে মাত্র ০.০২ সেকেন্ডের জন্য হাতছাড়া হয়েছে স্বর্ণ। এবার সেটা চাই-ই চাই।

দিন চারেক পর নামলেন ৫০০০ মিটার ফাইনালে, তবে শুরুটা ভালো হয়নি মোটেও। চূড়ান্ত ল্যাপের ৫০ মিটার বাকি থাকতেও পিছিয়ে ছিলেন চেনা প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যালাইন মিমো, জার্মানির হারবার্ট শ্যাড আর দুই ব্রিটিশ গর্ডন পিরি আর ক্রিস চ্যাটঅ্যাওয়ের থেকে। হঠাৎ অমানুষিক শক্তিতে ভর করে দৌড়ালেন ইঞ্জিন ট্রেনের মতই। ৫৭.৫ সেকেন্ড স্থায়ী হওয়া নিজের শেষ ল্যাপের ধ্বংসযজ্ঞে পেছনে ফেললেন সবাইকেই। মাত্র দেড় সেকেন্ডের ব্যবধানে আরও একবার পরাজিত হলেন মিমো, আর এমিল? ১৪ মিনিট ০৬.৬ সেকেন্ড সময় নিয়ে স্বর্ণ জিতলেন অলিম্পিক রেকর্ড ভেঙ্গেই। ইতিহাসের প্রথম অ্যাথলেট হিসেবে জিতলেন দূরপাল্লার দৌড়ের অলিম্পিক ডাবল। এই ঘটনায় তাঁর ডাকনাম হয়ে গেলো চেক লোকোমোটিভ।

মজার ব্যাপার হল, এর মাত্র মিনিট পাঁচেক বাদেই নারীদের জ্যাভেলিন থ্রোতে স্বর্ণ জিতলেন এমিল পত্নী ডানা।

লক্ষ্য পূরণ শেষ। কিন্তু কি মনে হতে, ৩ দিন পর ম্যারাথন শুরু হবার মাত্র ৪ মিনিট আগে নাম এন্ট্রি করলেন। অথচ এর আগে কোনদিন ম্যারাথনে অংশই নেননি। বর্তমান বিশ্বরেকর্ডধারী ব্রিটিশ ম্যারাথন দৌড়বিদ জিম পিটারস তখন অলিম্পিক স্টেডিয়ামের ট্র্যাকে দাঁড়িয়ে ওয়ার্ম-আপ করছেন, তৈরি হচ্ছেন জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রেসের জন্য। ঠিক তখনই সোনালী চুলের এমিল কাছে এসে পরিচয় দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন। পিটারস ঠিকমতোই চিনতেন দূরপাল্লার দৌড়ের এই বিভীষিকাকে। শুধুমাত্র এই মানুষটার কারণে, পিটারস কেবল ম্যারাথনে দৌড়ান এখন। লন্ডনে রীতিমত অপদস্থ হয়ে হেরেছিলেন এমিলের কাছে যে, এরপর ক্ষ্যামা দিয়েছেন ১০,০০০ মিটার দৌড়ে। দুরন্ত ফর্মে থাকা পিটারস সেই স্মৃতিটা মুছে ফেলতে আর কথা বাড়ালেন না, কেবল হাত মিলিয়েই ক্ষান্ত দিলেন কথোপকথনে।

১ ঘণ্টা পরে দৃশ্যপটে আবার দুজন। ম্যারাথনের মাঝ পর্যায়ে দুজনের মাঝে মাত্র কয়েক ধাপের ব্যবধান। তখনই অদ্ভুত এক প্রশ্ন করলেন জাতোপেক; জিম, রেসের গতি কি খুব বেশি? তোমার কি মনে হচ্ছে?

নিজের গতি নিয়ে দারুণ খুশি পিটারস তাঁকে বিড়ম্বনায় ফেলার জন্য জবাব দিলেন, “না, এটা খুব বেশি গতি না, বরং খুবই ধীর গতির রেস হচ্ছে।”

 

মানুষ পাখির গান পর্ব ২ (8)

ফটোগ্রাফঃ ৫০০০ মিটারে জেতার পথে এমিল জাতোপেক

জাতোপেক জিমের সেই জবাবটাকে সত্যি ধরে গতি বাড়িয়ে পেরিয়ে গেলেন ব্রিটিশকে, এরপর দুজনের দূরত্বটা বাড়তে থাকলো, একটা সময় অদৃশ্যই হয়ে গেলেন দৃশ্যপট থেকে।

ঐদিনে শেষবার যখন তাদের দেখা হল, তখন খিঁচুনির কারণে জিম রেস থেকে সরিয়ে নিয়েছেন নিজেকে, চড়ে বসেছেন সাংবাদিকদের গাড়িতে আর এমিল জাতোপেক সবার চেয়ে প্রায় ২ মিনিটের চেয়েও বেশি ব্যবধানে এগিয়ে।

এরপরেরটুকু কেমন যেন গল্পের মত। ম্যারাথনের শেষ ৫ মাইল বিনোদনের জন্য দর্শকদের সাথে হাত মেলানো থেকে শুরু করে, আলোকচিত্রীদের সাথে গল্প করা, পুলিশ সদস্যদের সাথে কৌতুক – সবই করেছিলেন তিনি। তারপরও ভেঙ্গেছিলেন অলিম্পিক রেকর্ড। আর্জেন্টিনার রেনাল্ডো গর্নো যখন ২য় হয়ে ফিনিশিং লাইন ছুঁলেন ততক্ষণে এমিলকে ঘিরে উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছে, অটোগ্রাফ স্বাক্ষর করা শেষ, হাত মেলানো শেষে জ্যামাইকার ৪x৪০০ মিটার রিলে টিম তাঁকে কাঁধে তুলে ল্যাপ অফ অনার দিচ্ছে স্টেডিয়াম চক্কর দিয়ে।

ইতিহাসের প্রথম এবং একমাত্র ক্রীড়াবিদ হিসেবে একই অলিম্পিকে দূরপাল্লার ট্রেবল জেতার রেকর্ড আছে কেবল তারই। তাঁর আগে বা পরে এই রেকর্ডের ধারে-কাছেও আসতে পারেনি কোন অ্যাথলেট। ক্রীড়া রূপকথার জন্ম দেয় এই গল্প।

একই সাথে ৫,০০০ মিটার, ১০,০০০ মিটার (৫বার), ২০,০০০ মিটার (২ বার) ১ ঘণ্টা দৌড়, ২৫,০০০ মিটার, ৩০,০০০ মিটার, ম্যারাথন সবকিছুর বিশ্বরেকর্ড ছিল তাঁর দখলে।

৬ ভাষায় অনর্গল কথা বলার গুণের অধিকারী এমিল ছিলেন দারুণ বন্ধুপ্রিয়, প্রতিযোগিতার সময় গল্প করতে করতেই বন্ধুত্ব পাতিয়েছিলেন অনেক প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে। তাঁর প্রাগের বাড়িতে, সারা বছরই দেখা যেত, বিখ্যাত সব আন্তর্জাতিক ক্রীড়াবিদের চেহারা।

ষাটের দশকে বেশ কয়েকবার বিশ্বরেকর্ড গড়েও কোন অলিম্পিক স্বর্ণ জেতা হয়নি অস্ট্রেলিয়ান রন ক্লার্কের, বারবার অঘটনের শিকার হওয়া ক্লার্ককে ১৯৬৮ সালে নিজের বাসায় ডেকে উপহার দিয়েছিলেন হেলসিংকি অলিম্পিক ম্যারাথনে জেতা স্বর্ণপদকটাই!

কঠোর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে নিজেকে তৈরি করা এমিল ছিলেন হাইপারভেন্টিলেশন ট্রেনিং  ইন্টারভাল ট্রেনিং এর জনক। বিখ্যাত ছিলেন রেসে ভালো করা, জেতার মূলমন্ত্র নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের উপদেশ দেওয়াতে। প্রতিদিন গড়ে ৪০,০০০ মিটার দৈর্ঘ্য দৌড়াতেন অনুশীলনে; প্রচণ্ড শীত, তুষারপাত, বৃষ্টি, গরম কিছুতেই থেমে থাকত না তাঁর অনুশীলন।

এমিল জাতোপেক শুধু অ্যাথলেটিক্সে বিপ্লব ঘটাননি, নতুন করে উদ্ভাবন করেছিলেন খেলাটাকেই, রেকর্ডবুক নতুন করে লিখিয়েছেন, মানুষের দ্বারা কি কি সম্ভব তাঁর সঙ্গায়ন করেছেন। হেলসিংকিতে করা রেকর্ডটি এখনো ছোঁয়া প্রায় অসম্ভব। আর এগুলা সবই করেছিলেন, এমন কৌতুকপূর্ণ পাগলামি আর আত্নার ঔদার্যে যেটা তাঁকে অলিম্পিক ইতিহাসের অন্যতম ভালোবাসার অ্যাথলেটে পরিণত করেছে। বিংশ শতাব্দীতে কেবল মোহাম্মদ আলীর সাথেই তুলনা করা যায়।

অবসরের পরের জীবনটা ভালো কাটেনি এই কিংবদন্তীর, প্রাগ বসন্ত আন্দোলনে কমিউনিস্ট দলের উচ্চপদস্থ সদস্য হয়েও কিছুটা গণতান্ত্রিক মতবাদের প্রচার করায় রোষের শিকার হন তিনি। কেড়ে নেওয়া হয় তাঁর সামরিক পদবী, বহিষ্কার করা হয় বাহিনী এবং দল থেকে। সাথে বাধ্য করা হয় ইউরেনিয়াম খনি, কুয়াখনন, পাবলিক টয়লেট পরিষ্কারের মত কাজে, প্রায় ৩০ বছর থাকেন দুর্গম অঞ্চলে নির্বাসিত। পরে তাঁকে পুনর্বাসন করা হলেও ৭৮ বছর বয়সে ২০০০ সালে মৃত্যুবরণ করেন মহানায়ক। ঐ বছরই ক্রীড়ার আদর্শ, মানবতার প্রচারে দারুণ ভূমিকা রাখার কারণে মরণোত্তর পিয়েরে দ্যা কুবার্তা পদকে ভূষিত করা হয় তাঁকে। রন ক্লার্ক হয়তো ঠিকই বলেছিলেন,

“এমিল জাতোপেকের মত মহৎ মানুষ কখনো ছিল না, কখনো আসবেও না’’

 

বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও......

 

২৯ আগস্ট, ২০০৪, এথেন্স অলিম্পিকের শেষ ইভেন্ট পুরুষ ম্যারাথন। ম্যারাথন নামকরণ করা হয়েছে যে জায়গা থেকে সেই ইতিহাস বিখ্যাত ম্যারাথন শহর থেকে শুরু করে শেষ হবে ১৮৯৬ সালের প্রথম আধুনিক অলিম্পিকের ভেন্যু প্যানাথিনাইকো স্টেডিয়ামে।

দৌড়ের শুরুটা হয়েছিল আশাব্যঞ্জক। পদকের জন্য ফেবারিটরা গতি বাড়িয়ে বাকিদের থেকে এগিয়ে গেছেন বেশ। সেই দলে আছেন বিশ্বরেকর্ডধারী কেনিয়ান পল তেরগাত ও দুবারের অলিম্পিক পদকজয়ী এরিক ওয়াইনানা, ইতালির স্তেফানো বালদিনি, যুক্তরাষ্ট্রের মেব্রাহতম কিফলেযিঘি, ব্রাজিলের ভান্দারলেই করদেইরো দি লিমা এবং জাপানের শিগেরু আবুরায়া। প্রত্যেকেই লিড নেওয়ার চেষ্টা করলেও সফল হলেন কেবল লিমা, ২০ কিমির দিকে সবার থেকে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলেন তিনি, কিন্তু ২৫ কিমির দিকে এসে বালদিনি গতি বাড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলেন লিমাকে

আটলান্টা অলিম্পিকে জুতার সমস্যায় ৪৭তম হয়ে দৌড় শেষ করেছিলেন, ৪ বছর পর সিডনিতে ইনজুরির কারণে ফলাফলটা হয়েছিল ভয়াবহ – ৭৫তম। এবারই শেষ অলিম্পিক মাত্র ১৮ দিন আগে ৩৫তম জন্মদিন পালন করা লিমার। শেষ সুযোগ অলিম্পিক পদক অর্জনের।

৩৫ কিমি (২২ মাইল) পর্যন্ত যখন আছেন এক নম্বরেই, সবার চেয়ে এগিয়ে আছেন ৪৮ সেকেন্ড, প্রথম ব্রাজিলিয়ান হিসেবে স্বপ্ন দেখছেন ম্যারাথনে স্বর্ণ জেতার, তখনই ঘটলো বিপত্তি। কোণাকুণি দৌড়ে এসে এক দর্শক ধাক্কা দিলেন লিমাকে। আর্তনাদ করে উঠলেও দৌড় থামাননি লিমা। এরপর সবাইকে হতভম্ব করে লিমার জার্সি খামচে ধরলেন সেই পাগলাটে দর্শক। আর কি! টাল সামলাতে না পেরে ঐ দর্শককে সহই উপুড় হয়ে পড়ে গেলেন রাস্তার পাশের দর্শকদের উপরে। কিন্তু আইরিশ বেশভূষায় সজ্জিত বুড়ো দর্শক তখনো ছাড়ছেন না লিমার জার্সি।

অবস্থা বুঝে পাশ থেকে সাহায্যে এগিয়ে এলেন গ্রীক দর্শক পলিভাস কসিভাস, লিমাকে ঐ পাগলাটে দর্শকের করাল গ্রাস থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন দৌড়াতে।

(সেই আইরিশ দর্শকের নাম কর্নেলিয়াস নেইল হোরান, পেশায় যাজক। তবে তাঁর এরকম আচরণ নতুন নয়। ২০০৩ সালে ফর্মুলা ওয়ানের ব্রিটিশ গ্রাঁপ্রির রেস ট্র্যাকের ভেতর এলোমেলো দৌড়ে ভন্ডুল করেছিলেন রেস। এছাড়া ইপসম ডার্বিতেও বাঁধিয়েছিলেন ঝামেলা। ২০০৫ সালে তাঁকে পদচ্যুত করে ব্রিটিশ চার্চ)

 

মানুষ পাখির গান পর্ব ২ (10)

ফটোগ্রাফঃ লিমাকে আক্রমণরত সাবেক যাজক নেইল হোরান

 

লিমা এই ঘটনায় প্রায় ২০ সেকেন্ড লিড হারালেও সমস্যাটা ছিল আরও বড়। পায়ে ক্র্যাম্প ধরায় আর পেশীর ব্যথায় দৌড়াতে পারছিলেন না লিমা। ইতালির স্তেফানো বালদিনি এবং যুক্তরাষ্ট্রের মেব্রাহতম কেফলেযিঘি ২৪ মাইলের দিকে এসে তাঁকে পেছনে ফেলেন। ৩য় অবস্থানে থেকে ২ ঘণ্টা ১২ মিনিট ১১ সেকেন্ডে রেস করেন তিনি।

রেস শেষ করার পরও কোন আপীল করেননি লিমা, মেনে নিয়েছিলেন ফলাফল, বরং দর্শকদের অভিনন্দন পেয়েই বর্তে গিয়েছিলেন মধ্যবয়স্ক ব্রাজিলিয়ান। ব্রোঞ্জ জয়ের পর সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সেই ঘটনার কথাঃ

যা কিছুই ঘটুক, আমি জানতাম, থেমে থাকা যাবে না। আমার জন্য বহু মানুষ কষ্ট করেছেন, তাদেরকে হতাশ করতে পারবো না। হয়ত ওরকম কিছু না হলে আমি জিততাম, কিন্তু দুর্ঘটনার পর ব্যথার কারণে রেস শেষ করাই কঠিন ছিল আমার জন্য। কিন্তু অলিম্পিক আদর্শ ধারণ করে আমার প্রতিজ্ঞা বজায় রেখেছি এবং পদক জিতেছি। এতেই আমি খুশি।’’

তবে ব্রাজিলের অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশন সাথে সাথেই লিমার পক্ষে আপীল করে স্বর্ণ পদক লিমাকে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আপীলটি প্রত্যাখ্যান করে আইওসি। অলিম্পিকের সমাপনী অনুষ্ঠানে আইওসি অসাধারণ প্রতিজ্ঞা আর ক্রীড়ার আদর্শ ধরে রাখায় পিয়েরে দ্য কুবার্তা পদকের জন্য মনোনীত করে লিমাকে, পরে ঐ বছরের ৭ ডিসেম্বর রিও ডি জেনেইরোতে প্রদান করা হয় পদক। একই অনুষ্ঠানে ব্রাজিলের বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ নির্বাচিত হন লিমা। 

২০০৫ সালে এক টেলিভিশন অনুষ্ঠান চলাকালীন ২০০৪ অলিম্পিকে স্বর্ণজয়ী ব্রাজিলিয়ান বিচ ভলিবল খেলোয়াড় ইমানুয়েল রেগো তাঁর পদক উপহার দেন লিমাকে। লিমা বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দেন সেই পদক। সঞ্চালকের প্রশ্নে আবেগঘন উত্তর দিয়ে বলেছিলেন,

"ইমানুয়েলের পদক গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, আমার পদক নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। যদিও এটা ব্রোঞ্জ কিন্তু আমার কাছে এটা স্বর্ণের সমান"

ক্রুজেইরো দি ওয়েস্তে পারানায় ৬ ভাইবোনের কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়া লিমার স্বপ্নটা ছিল পেশাদার ফুটবলে খেলা, পরে স্কুলের কোচের পরামর্শে ক্রস কান্ট্রি রেসে ক্যারিয়ার শুরু করে মহাদেশীয় পর্যায়ে পেয়েছিলেন সাফল্য। পরে হঠাৎ করেই ম্যারাথনে এসে ১৯৯৬ সালে টোকিও ম্যারাথন জিতে চমকে দিয়েছিলেন সবাইকে, সাথে দক্ষিণ আমেরিকার ক্রস কান্ট্রি শিরোপাটাও ছিল দখলে। এরপর নিউইয়র্ক ম্যারাথনে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে হন পঞ্চম। আর টানা দুবার প্যান আমেরিকান গেমস ম্যারাথনের স্বর্ণ (১৯৯৯, ২০০৩) ছিল লিমার অর্জনের খাতায়। পরে ১৯৯৮ সালে টোকিওতে করা ২ ঘণ্টা ৮ মিনিট ৩১ সেকেন্ডের টাইমিং হয়ে থাকে তাঁর ক্যারিয়ার সেরা।

২০০৭ সালে নিজের আত্নজীবনী A Marathon of Life প্রকাশ করা লিমা এথেন্সের পর নিজের সেরা নৈপুণ্যের কাছে পৌঁছুতে না পারলেও বেশ কবার দেখিয়েছিলেন ঝলক। শেষ পর্যন্ত ২০০৯ প্যারিস ম্যারাথনে প্রায় ২০ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারের ইতি টানেন তিনি।

২০১৬ রিও অলিম্পিকের মশাল দৌড়ে সর্বশেষ ক্রীড়াবিদ হিসেবে অলিম্পিক মঞ্চে মশাল জ্বালানোর সম্মান পান তিনি।