• অলিম্পিক

মানুষ পাখির গানঃ পর্ব ৩

পোস্টটি ২৮৫১ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

সুইজারল্যান্ডের লুজানে অবস্থিত অলিম্পিক মিউজিয়ামে সুসজ্জিত কাঁচের বাক্সে রাখা আছে একখানা মেডেল, যার ছোট্ট বর্ণনায় লেখা আছে, "It is one of the noblest honours that can be bestowed upon an Olympic athlete."

না, অলিম্পিক স্বর্ণ, রৌপ্য, ব্রোঞ্জ কোনটাই না। কি সেই পদক? কি এমন মাহাত্ন্য সেই পদকের, যে অলিম্পিকের সবচেয়ে সেরা সম্মান আপনাকে এনে দিবে?

পদকটার নাম - পিয়েরে দ্য কুবার্তা মেডেল। নামটা চেনা চেনা লাগছে তো? হুম, আধুনিক অলিম্পিকের জনক পিয়েরে দ্য কুবার্তিনের সম্মানেই চালু করা হয়েছে এই পদক। প্রথম দেওয়া হয় ১৯৬৪ অলিম্পিকে।

কারা পান এই সম্মান? - ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি প্রদত্ত এই পদক কেবলমাত্র সেই সকল ক্রীড়াবিদই পান যারা খেলাধুলার আদর্শ ধরে রেখে ক্রীড়াসুলভ মানসিকতার দারুণ প্রদর্শন করেন অলিম্পিকে। এ পর্যন্ত ১২ জন ক্রীড়াবিদসহ মোটে ১৭ জন পেয়েছেন এই বিশেষ পদক। এবারের গল্প সেই অসাধারণ ক্রীড়াবিদদের নিয়েই...

 

ঠোঁটে নিয়ে বেঁচে থাকার গান...

বারবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও বেঁচে ফিরে আসাকে কি বলে? সৌভাগ্য? তাহলে, বারবার মৃত্যুর কাছে যাওয়াটা? দুর্ভাগ্য?

কোনটাকে কি বলা হবে, সেই প্রশ্নের উত্তর নাহয় তোলা থাকলো গল্পটা পড়তে থাকা পাঠকদের প্রতি। গল্পটা বলে যাই!

ভদ্রলোকের নাম শল পল ল্যাডানি। জন্ম ১৯৩৬ সালে, প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়ার বেলগ্রেড শহরের এক ইহুদী পরিবারে। বয়স যখন ৫, ততদিনে শুরু হয়ে গেছে বিশ্বযুদ্ধ। জার্মানরা ১৯৪১ এপ্রিলের এক সন্ধ্যায় আক্রমণ করে বসে বেলগ্রেড, ঠিক ঐ মুহূর্তেই বদলে যাওয়ার শুরু ল্যাডানির স্বপ্নের দুনিয়াটার। জার্মান বিমানের বোমার আঘাতে উড়ে যায় ল্যাডানিদের বাড়িটা। ঐটুকু বয়সে ছোট্ট ল্যাডানিকে পরিবারের সাথে হেঁটে পাড়ি দিতে হয় প্রায় ২০ কিলোমিটার পথ, আশ্রয় নেন হাঙ্গেরিতে।

সেখানে ল্যাডানি সিনিয়র জড়িয়ে পড়েন স্থানীয় ইহুদী আন্দোলনে। সেই সময়ে ইহুদী শিশুদের খোঁজে জার্মান পরিচালিত অভিযানের ভয়ে বুদাপেস্টের এক বৌদ্ধ মঠে পাঠানো হয় ৬ বছরের ল্যাডানিকে, সেখানে পরিচয় লুকিয়ে ৯ মাস পালিয়ে থাকতে হয় তাকে। ১৯৪৩ সালে হাঙ্গেরির ইহুদী নেতা ডাঃ রুডলফ কাৎজস্নার ইহুদীদের জীবন বাঁচানোর বিনিময়ে ট্রাক সরবরাহ করার চুক্তি করেন নাৎসীদের সাথে। বাবার রাজনৈতিক পরিচয়ের সুবাদে ল্যাডানি পরিবার সুযোগ পায় ‘কাৎজস্নার ট্রেইন’ –এর মাধ্যমে নিরপেক্ষ দেশে যাত্রা করার। কিন্তু সেই ট্রেনের যাত্রীরা কখনোই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছোতে পারেননি, কারণ, যাত্রাপথ ঘুরিয়ে নেওয়া হয়েছিল কুখ্যাত বার্গেন-বেলসেন যুদ্ধবন্দী ক্যাম্পের দিকে।

অসউইটজ বন্দী শিবিরে গ্যাস চেম্বারে নিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল নানা-নানীকে। বার্গেন-বেলসেনেও পরিবারের অনেককেই মেরে ফেলা হয় নির্যাতন করে। বাকিরাও প্রচণ্ড ক্ষুধা আর নির্যাতনে ছিলেন বিধ্বস্ত। এমনকি গ্যাস চেম্বারে গিয়েও ভাগ্যক্রমে ফেরত আসেন ল্যাডানি। অবশেষে আমেরিকান ইহুদীদের প্রচুর অর্থের বিমিময়ে সেই বিতর্কিত কাৎজস্নার চুক্তি ফলের মুখ দেখে, প্রায় ২,০০০ বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়। ৬ মাস বন্দী থাকার পর ল্যাডানি এবং তাঁর পরিবার মুক্তি পান ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বরে। যুগোস্লাভিয়ার প্রায় ৭০,০০০ ইহুদীর মধ্যে মাত্র কয়েক হাজার বেঁচে যাওয়াদের অন্যতম ল্যাডানিরা সুইজারল্যান্ডে আশ্রয় গ্রহণ করেন, যুদ্ধ শেষ হবার পর ফিরে যান বেলগ্রেডে, তারপর ১৯৪৮ সালে ইসরাইল নামের নতুন ইহুদী রাষ্ট্রে স্থানান্তরিত হয়ে বসবাস শুরু করেন।

১৮ বছর বয়সে ম্যারাথন দৌড়বিদ হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করা ল্যাডানি কয়েক বছর পর হাঁটা প্রতিযোগিতার দিকে মনোনিবেশ করেন। প্রথমবার অলিম্পিকে অংশ নেন মেক্সিকো ’৬৮ আসরে, ৫০ কিমি হাঁটা ইভেন্টে হন ২৪তম।

১৯৭২ সালে ৫০ মাইল হাঁটা ইভেন্টে প্রায় ৩৭ বছরের পুরনো বিশ্ব রেকর্ড ভাঙ্গেন ৭ ঘণ্টা ৪৪ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড সময় নিয়ে। ৩ মাস পর নিউ জার্সিতে নিজের রেকর্ড উন্নত করেন প্রায় ২৩ মিনিট কমিয়ে এনে! যে রেকর্ড এখনো রয়েছে অক্ষত!

এরপর ’৭২ মিউনিখ অলিম্পিকে ফিরলেন ইসরাইল অ্যাথলেটিক্স দলের একমাত্র পুরুষ সদস্য হিসেবে। ২৮ বছর আগের সেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার পর ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলকে প্রতিনিধিত্ব করার গর্বটাও ছিল বিশেষ কিছু। বলেছিলেন,

“সেই জার্মানরা যারা আমাদের নিভিয়ে দিতে, ধ্বংস করতে, মিশিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে তাদের দেখিয়ে দিতে চাই, আমরাও আছি অলিম্পিকে, আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে এসেছি এবং সব দেশের সাথে দাঁড়িয়ে আছি মাথা উঁচু করেই।”

ইহুদীবাদের প্রতীক হিসেবে পরিচিত স্টার অফ ডেভিড জার্সিতে লাগিয়ে অনুশীলন করলেন, তবে ৩৬ বছরের ল্যাডানি মূল রেসে খুব একটা ভালো করেননি। ৪ ঘণ্টা ২৪ মিনিট ৩৮ সেকেন্ড সময় নিয়ে হন ১৯তম। তবুও ইসরাইলের হয়ে জার্মান মাটিতে পারফর্ম করতে পেরেও ছিলেন গর্বিত। 

 

মানুষ পাখির গান পর্ব ৩ (10)

ফটোগ্রাফঃ মিউনিখ অলিম্পিকে নিজের ইভেন্টে শল পল ল্যাডানি 

 

পরের দিন সন্ধ্যায় সতীর্থদের সাথে উপভোগ করলেন ‘ফিডলার অন দি রুফ’ মঞ্চ নাটকের প্রদর্শনী। মধ্যরাতে অলিম্পিক ভিলেজে ফিরে ঘুমোতে গিয়েছিলেন বেশ রাতে। কিন্তু ৫ সেপ্টেম্বরের ভোরবেলা ঘুম ভাঙে পাশের বিছানায় থাকা রেসলিং কর্মকর্তা ইয়োসেফ গুটফ্রয়েন্ডের চাপা চিৎকারে।

ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে কুখ্যাত মিউনিখ হত্যাযজ্ঞ। প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের সন্ত্রাসী গ্রুপ ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের ৮ অস্ত্রধারী সদস্য ইসরাইলি অলিম্পিয়ানদের কোয়ার্টারে ঢুকে জিম্মি করে কোচ, ক্রীড়াবিদ এবং কর্মকর্তাদের। জিম্মি রেসলিং কোচ মশে ওয়েইনবার্গ সন্ত্রাসীদের রেসলারদের রুমে নিয়ে গিয়ে প্রতি আক্রমণের চেষ্টা করলে গুলির আঘাতে প্রাণ হারান, তাঁর লাশ জানালা দিয়ে পাশের রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়।

ঘটনা বুঝতে পেরেই ল্যাডানি নিজের রুমের লাগোয়া জানালা থেকে নিচের লনে লাফ দেন, গুলিও করা হয় তাকে উদ্দেশ্য করে, তবে একটুর জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় সেটা। এরপর আমেরিকান ট্র্যাক কোচ বিল বাওয়ারম্যানকে ঘুম থেকে উঠিয়ে তাঁর সহায়তায় জার্মান পুলিশকে সতর্ক করেন। আমেরিকান ম্যারিন বাহিনীও ডাক পেয়ে এগিয়ে আসে সাহায্যে।

সেসময় বেশিরভাগ গণমাধ্যমে ল্যাডানি নিহত হয়েছেন এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে। একটি পত্রিকার শিরোনাম বিশ্বজুড়েই ছড়িয়ে পড়েছিল দাবানলের মত, "ল্যাডানি আরও একবার নিয়তি এড়াতে পারলেন না জার্মানিতে’’

প্রায় দেড় দিনব্যাপী চলা জিম্মিকান্ডে জার্মান পুলিশের অভিযানে ৫ সন্ত্রাসী নিহত এবং ৩ জনকে আটক করা হয়। ল্যাডানি সহ ৫ ইসরাইলি অ্যাথলেট বেঁচে গেলেও ইসরাইল দলের ১১ জন অ্যাথলেট এবং কোচ নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন।

তবে হার মানেননি ল্যাডানি। ইসরাইল ক্রীড়া ফেডারেশনের ব্যাপক আপত্তি সত্ত্বেও ২ মাস পর ফিরে আসেন প্রতিযোগিতায়। যথেষ্ট নিরাপত্তা নিশ্চিত না হবার পরও সুইজারল্যান্ডের লুগানে বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ কিলোমিটার ইভেন্টে অংশ নিয়ে দেখান চমক। ৯ ঘণ্টা ৩১ মিনিট সময় নিয়ে জেতেন স্বর্ণ পদকটাই!

এরপরের ক্যারিয়ারটা কেটেছে সাফল্যের মাঝেই, ইহুদী ধর্মানুলম্বীদের গেমস হিসেবে পরিচিত ম্যাকাবিয়া গেমসে স্বর্ণ জিতেছেন সব মিলিয়ে ৫ বার। হাঁটা প্রতিযোগিতায় প্রথম অ্যাথলেট হিসেবে জিতেছেন আমেরিকান ওপেন এবং মাস্টার্স - দুই শিরোপাই। ১৯৭৭ আর ৮১ সালে আরও দুইবার স্পর্শ করেছেন নিজের রেকর্ড।

ইসরাইলের জাতীয় শিরোপা প্রথম জিতেছেন ১৯৬৩-তে, এরপর আরও ২৭ বার! আমেরিকান ওপেনসহ বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মেজর সব প্রতিযোগিতার শিরোপাও আছে শোকেসে। অবসর নেবার পর মাস্টার্স বিভাগেও দেখিয়েছেন দারুণ সাফল্য। ২০০৬ সালে প্রথম সত্তরোর্ধ্ব অ্যাথলেট হিসেবে ১০০ মাইল হেঁটেছেন ২৪ ঘণ্টার কম সময়ে, ২১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট ৩৪ সেকেন্ড নিয়ে করেছেন বিশ্বরেকর্ড।

১৯৯৭ সালে হিব্রু ভাষায় প্রকাশিত হয় তাঁর আত্নজীবনী The Walk to the Olympics, পরে ২০০৮ সালে ইংরেজিতে অনূদিত হয় সেটা, King of the Road: The Autobiography of an Israeli Scientist and a World Record-Holding Race Walker শিরোনামে।  

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা ল্যাডানি নেগেভের বেন গুরিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০ বছর ধরে শিল্প প্রকৌশল এবং ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক এবং চেয়ারম্যান ছিলেন। এখন এমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

অলিম্পিক আন্দোলনে অসামান্য অবদান রাখায় ২০০৭ পিয়েরে দ্য কুবার্তা পদকে ভূষিত হন ল্যাডানি। অনুষ্ঠানে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়, এমন একজন বিশেষ ব্যক্তিত্ব হিসেবে যিনি চার দশক ধরে অস্বাভাবিক এবং অসামান্য ক্রীড়া নৈপুণ্য দেখিয়ে গেছেন।

বারবার নিয়তি তাঁকে ঠেলে দিয়েছে মরিয়া পরিস্থিতিতে, বারবার তিনি বেঁচে ফিরে এসেছেন! এমনকি ক্যান্সারও তাঁকে হারাতে পারেননি। কয়েক মাস আগে বাইপাস সার্জারি করাতে হলেও মৃত্যুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পা দিয়েছেন জীবনের ৮০তম বসন্তে! প্রতি জন্মদিনকে স্মরণ করেন নিজের বয়সের সমান মাপের দূরত্ব হেঁটে, এবার তাই হেঁটেছেন ৮০ কিলোমিটার!

নাৎসীরা তাঁকে থামাতে পারেনি, সন্ত্রাসীরাও নয়, এমনকি ইসরাইলের ক্রীড়া ফেডারেশনও থামাতে পারেনি এই মানুষটাকে, তাঁর ইচ্ছেশক্তিতেই এগিয়ে গেছেন সামনের দিকে। এখনো গেয়ে যাচ্ছেন জীবনের গান, বেঁচে থাকার গান!

‘আল্টিমেট সারভাইভার’ খ্যাত ল্যাডানি জীবনের মন্ত্র বলে দিয়েছেন নিজের এক বিখ্যাত উক্তির মাধ্যমেই –

Quitters don't win, and winners don't quit

 

 

উইন্ড ইন দেয়ার সেইলস...

কিংদাও আন্তর্জাতিক সেইলিং সেন্টারে হচ্ছে বেইজিং অলিম্পিকের সব সেইলিং ইভেন্ট। বর্ণিল অলিম্পিকে ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে ডিঙ্গি বাইবেন সেইলরেরা!

১৯ দেশের ১৯ দল অংশ নিচ্ছে '৪৯ ইআর' ইভেন্টের মোট ১৬টি রেসে। ১৫ রাউন্ড শেষে পয়েন্ট তালিকার সেরা ১০ দল অংশ নেবে ফাইনালে। কিন্তু ঐ সৈকতে ঢেউ এতোটাই কম ছিল যে, দুটি রাউন্ড পরিত্যক্ত হয়েছে। তাই ১৩ রাউন্ড শেষেই নির্ধারিত হয়েছে ফাইনালের ১০ দল।

ক্রোয়েশিয়ান সেইলর দলে থাকা ২৮ বছরের পিটার কুপাক এবং সবে মাত্র ২১-এ পা দেওয়া পাভলে কোস্তভের মন বেশ খারাপ। প্রত্যাশার চাপ সামলাতে না পেরে ১৭তম হয়েই শেষ করেছেন অলিম্পিক। তাই ফাইনালে কোয়ালিফাই করা হয়নি তাদের। ঘণ্টা দেড়েক বাদে হতে যাওয়া ফাইনাল দেখার জন্য অপেক্ষা করলেন না তাঁরা। নিজেদের ডিঙি ফেলে রেখেই অলিম্পিয়ানদের জন্য রাখা নির্দিষ্ট বাসে চেপে ফিরলেন অলিম্পিক ভিলেজে।

ভিলেজে পৌঁছে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, আর মিনিট বিশেক বাদেই শুরু হবে ফাইনাল। হঠাৎ শোনা গেলো, দুঃখজনক এক সংবাদ! ফাইনালের আগ পর্যন্ত স্বর্ণপদকের লড়াইয়ে বেশ এগিয়ে থাকা ডেনমার্ক দলের সাথে ঘটে গেছে ভয়ংকর এক দুর্ঘটনা। হঠাৎ করে ডেনিশদের ডিঙ্গির মাস্তলটাই গেছে ভেঙ্গে। মাস্তল ছাড়া ডিঙি চলবে না, তাছাড়া কোন দলই একটির বেশি ডিঙি নিয়ে আসে না। তাই ফাইনালে অংশ নেওয়াটাও হবে না ডেনিশ জুটির। হতাশ হয়ে বসেছিলেন জোনাস ওয়ারার এবং মার্টিন ইবসেন।

দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন কোস্তভ-কুপাক জুটি, কোচ ইভান বুলাজার সাথে কয়েক মুহূর্তের কথোপকথনেই একমত হলেন ডেনিশদের সাহায্য করতে। সাথে সাথেই যোগাযোগ করলেন ডেনিশ দলের সাথে। এরপর ছুটে গেলেন ম্যারিনা বে-তে। ততক্ষণে অন্য সব দল প্রস্তুত হয়ে স্টার্টিং লাইনে বাঁশির অপেক্ষায়! ডেনিশরা অংশ নিতে না পারলে স্পেন, জার্মানি, ইতালি – ৩ দলেরই দারুণ সুযোগ স্বর্ণ জেতার।

কোস্তভ, কুপাক, বুলাজা – ৩ ক্রোয়েশিয়ান তখন দারুণ ব্যস্ত ডিঙি বের করে প্রস্তুত করতে। ওদিকে কিন্তু রেস শুরু হয়ে গেছে। নিয়ম অনুযায়ী, রেস শুরুর বাঁশি বাজানোর ৫ মিনিট পরেও কেউ শুরু করতে না পারলে ডিসকোয়ালিফাইড ঘোষিত হবে।

সময় পেরিয়ে যাচ্ছে! ১ মিনিট, ২ মিনিট, ৩ মিনিট.........৪ মিনিট......আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড পরেই শেষ হয়ে যাবে ডেনমার্ক দলের অলিম্পিক স্বপ্ন!

দ্রুত ডিঙি ধার দিলেন ডেনমার্ক দলকে। তাঁদের স্বপ্নটা এখনো জিইয়ে আছে। ডেডলাইন শেষ হবার মাত্র ১১ সেকেন্ড আগে স্টার্টিং পয়েন্ট থেকে চলতে শুরু করলো ধার নেওয়া ডিঙিটা।

 

মানুষ পাখির গান পর্ব ৩ (3)

ফটোগ্রাফঃ ক্রোয়েশিয়ান ডিঙিতে ডেনিশ দল (বামে) স্বর্ণ জেতার পর ডেনিশ দল (ডানে উপরে) একটি ফেয়ার প্লে অ্যাওয়ার্ড জেতার পর কুপাক-কোস্তভ জুটি (ডানে নিচে)  

 

ফাইনালিস্ট সব দলের থেকে এত সময় পরে শুরু করেও কি শেষরক্ষা হবে তাদের? ওয়েরার প্রাণপণে শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে বাইতে শুরু করলেন ডিঙি, আর ইবসেন হাল ধরে বসে আছেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চিত্তে। যে করেই হোক, জিততে হবেই!

সবার পেছনে থেকে শুরু করলেও অসম্ভব নৈপুণ্য প্রদর্শন করে ৭ম অবস্থানে থেকে রেস শেষ করে ডেনমার্ক দল। আগের সব রাউন্ডের পয়েন্ট কি যথেষ্ট ছিল পদকের জন্য?

হ্যাঁ! পুরো আসরে দারুণ পারফর্ম করা ডেনিশরা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শেষে রৌপ্য কিংবা ব্রোঞ্জ নয়, তাদের নামে পাশে লেখা হল স্বর্ণপদকটাই। মাত্র ৩ পয়েন্টের ব্যবধানে স্পেনকে পেছনে ফেলে ডেনিশরা, ৫ পয়েন্টে পিছিয়ে থেকে ব্রোঞ্জ জেতে জার্মানরা।

যদিও হার মানতে পারেনি স্পেন, জার্মানি এবং খুবই সামান্য ব্যবধানের জন্য পদক তালিকায় স্থান না পাওয়া ইতালি – কোন দলই। প্রথমে স্পেন অলিম্পিক কমিটি ডিঙ্গি পরিবর্তনের কারণে ডেনিশ জুটিকে ডিসকোয়ালিফাইড আনুষ্ঠানিক আবেদন করে আয়োজকদের কাছে, কিন্তু সে আবেদন গ্রহণ না করে নিজেদের সিদ্ধান্তে বহাল থাকেন বেইজিং অলিম্পিক কমিটি। এরপর আইওসির কাছে ধর্না দেয় স্পেন, তাদের সে আবেদনও নাকচ হয়। এরপর শেষ উপায় হিসেবে, ইতালি ও স্পেন আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আদালতে আবেদন করে পদক পরিবর্তনের। আদালত সেই প্রস্তাবে নেতিবাচক রায় দিলে শেষ হয় এই টম এন্ড জেরি রেসের।

নিয়তির কি পরিহাস! ১৭তম হওয়া ডিঙিটাই শেষপর্যন্ত জেতালো স্বর্ণটা।

সেবার না পারলেও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ৫ বার সেরা দশে স্থান পান কোস্তভ-কুপাক জুটি। অলিম্পিকেও অংশ নিয়েছেন লন্ডন, রিও – ২ আসরেই। তবে তাদের মর্যাদা যে কোন স্বর্ণজয়ী সেইলরদের থেকে আলাদা। ২০০৮ সালে এই স্বার্থহীন ক্রীড়া নৈপুণ্য প্রদর্শন করায় পিয়েরে দ্য কুবার্তা পদকে ভূষিত হন তাঁরা, সাথে কোচ ইভান বুলাজাও।

সার্কিটে পারফর্ম করতে থাকা কোস্তভ-কুপাকরা এখনো রোমাঞ্চকর গল্পের নায়ক হয়েই ভাসতে থাকেন সমুদ্রের নীলে!