• ফুটবল

মাঝমাঠের মায়েস্ত্রো, মাঝমাঠের কান্ডারি : জাভি

পোস্টটি ৬০৪৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

প্রথমেই দানি আলভেস এর একটি উক্তি দিয়ে শুরু করি , " আমরা যদি বর্তমানে বাস করি, তবে জাভি ভবিষ্যতে থাকে।সে সবার থেকে একটু বেশিই ভাবে এবং সে সবকিছুকে অন্যদের থেকে বেশি সহজ করে তুলে"। সত্যি জাভি এক অন্য ধাতুতে গড়া,  তার ডিফেন্স চেরা পাস, লব পাস, ডিফেন্স এ এসে সব আক্রমন নস্যাৎ করে দেওয়া, অসাধারন ট্যাকল, ফ্রি কিক সবকিছুতেই মাস্টার বার্সার ও স্পেন এর মধ্যমাঠের মধ্যমনি।

তাকে বর্ননা বা তাকে লিখার মত সাধ্য আমার নেই, তবুও সামান্য কিছু লিখার চেষ্টায়

 

১৯৮০ সালের ২৫ শে জানুয়ারি স্পেন এর তেরাস্সা শহরের এক বাড়িতে ঘর আলো করে জন্ম নেয় এক বিস্ময় বালক, তখন হয়তোবা তার বাবা-মা,আত্নীয় স্বজন,প্রতিবেশীরা বুঝতেই পারেনি একদিন এই ছেলেটিই হবে ফুটবলের মধ্যমাঠের কান্ডারি, এক জীবন্ত কিংবদন্তী।তার বাবা জোয়াকিম ছিলেন স্পেন এর এক অখ্যাত ক্লাব সাদাবেল এর প্রথম ডিভিশন এর একজন সাবেক খেলোয়ার। তার বাবার রক্ত থেকেই তার মধ্যেও প্রবাহিত হচ্ছিল ফুটবলের আবেগ। তাইতো মাত্র ১১ বছর বয়সে তাকে ভর্তি করা হয় বিশ্বের অন্যতম ফুটবল খেলোয়ার তৈরির একাডেমি বার্সেলোনার লা মাসিয়ায়। তার পর চলতে থাকে তার পথচলা। সে কিছুদিন সেখানে খেলার পর তার সিনিয়র ক্যারিয়ার শুরু করে বার্সেলোনা বি দলে এবং তখনকার কোচ গঞ্জালভোকে সাথে নিয়ে বার্সেলোনা বি দলকে সেকেন্ড ডিভিশন এ উন্নতি করে।

আস্তে আস্তে তার উন্নতির পথও চলতে শুরু করে আলোর বেগে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালের ৫ই মে লেইডা এর বিপক্ষে সে বার্সার হয়ে তার প্রথম ম্যাচ খেলে ফেলে। ১৯৯৮ সালের ১৮ই আগস্ট সে তার ক্যারিয়ারের প্রথম গোল করে মার্য়োকার বিরুদ্ধে স্প্যানিশ সুপার কাপ এর ফাইনালে।লা লিগায় তার অভিষেক ঘটে সেই বছরের ৩ অক্টোবর ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে, যে ম্যাচে বার্সা ৩-১ গোলে জয়লাভ করে।সে বছর বার্সেলোনা লা লিগা জয় করে এবং জাভি ২৬ টি ম্যাচ খেলে।সে সিজনে অসাধারণ খেলে তখনকার বার্সা কোচ লুই ভন গালের নজরে পরে জাভি এবং পেপ গার্দিওলার ইঞ্জুরিতে সে প্রধান প্লে-মেকার হয়ে উঠে।১৯৯৯ সালে জাভি লা লিগা ব্রেক থ্রো প্লেয়ার অফ দি ইয়ার এর পুরস্কার পান।  তারপর অতি শীঘ্রই দলের মুল খেলোয়ার হিসেবে নিজেকে প্রতিস্ঠিত করেন। ২০০১-২০০৩ বার্সা খুব খারাপ সময় কাটায় কিন্তু তখন ও মাঝ মাঠের ভরসা ছিলেন জাভি।এটির প্রমান স্বরুপ বলা যায়,  সে সময়ও সে ২০ টি অ্যাসিস্ট এবং ৭ টি গোল করে।সে ২০০২ সালের ১৬ মার্চ এল-ক্লাসিকোতে তার প্রথম গোল করে।

তারপর ২০০৪-০৫ মৌসুমে তার অসাধারণ প্রতিভায় তাকে ভাইস-ক্যাপ্টেন করা হয়।সে বছর বার্সা লা লিগা ও সুপার কাপ জয় করে।২০০৫ সালে জাভি লা লিগার সেরা খেলোয়ার নির্বাচিত হয়।২০০৫-০৬ সিজনে জাভি মারাত্মক লিগামেন্ট এর ইঞ্জুরিতে পড়ে কিন্তু সে তাতে থেমে থাকে নি,তার অদম্য পরিশ্রম এর মাধ্যমে কিছু দিনের মধ্যেই আবার মাঠে ফিরে আসে।

তারপরই শুরু হয় তার আসল জাদু। বার্সায় তখন চলে এসেছে বিশ্বের সেরা খেলোয়ার লিওনেল মেসি আর তখনকার কোচ পেপ গার্দিওলা, আর তার মাঝমাঠের সহযোগী আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা।  সবাইকে নিয়ে শুরু হল এক স্বর্ন যুগ।  সে তার খেলার ধার বাড়াতে শুরু করল আর সাহায্য করতে থাকল মেসিকে, তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালে বার্সা জয় করতে শুরু করল একের পর এক শিরোপা। লা লিগার সে সিজনে রিয়াল মাদ্রিদ এর বিপক্ষে বার্সা খেলে এক  চমৎকার ম্যাচ। সে ম্যাচে বার্সা, রিয়াল কে ৬-২ গোলে বিধ্বস্ত করে যার ৪ টি অ্যাসিস্টই করে জাভি, এবং সিজন শেষে জয়লাভ করে লা লিগা।কোপা দেল রের ফাইনালে বিলবাওকে ৪-১ গোলে হারায় যার একটি গোল ফ্রি কিক থেকে করে ফ্রি কিক বস জাভি। তারপর, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের পালা, সে বছর ফাইনালে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড কে ২-০ গোলে হারায় বার্সা, যার ২য় গোলে মেসিকে অসাধারন পাস দেয় জাভি।সে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেরা মিডফিল্ডার নির্বাচিত হয়।সে সিজনে জাভি ২৯ টি অ্যাসিস্ট করে।বছর শেষে ক্লাব বিশ্বকাপ জয়ের মাধ্যমে হেক্সা জয় করে বার্সা, যার মুল কান্ডারি ছিল জাভি।সে বছর ইউরোপের ৩য় সেরা খেলোয়ার হয় জাভি, যেখানে ১ম হয় তারই সতীর্থ মেসি।তারপর ব্যালন ডি অরে সেরা তিনে জায়গা হয় জাভি সহ বার্সার ইনিয়েস্তা ও মেসির, যেখানেও সে ৩য় হয়। পরের বছর ও খুব ভাল খেলে জাভি এবং এবারো ব্যালন ডি অরে ৩য় হয়। 

২০১১ সালের ৫ই জানুয়ারি জাভি তার বার্সার ক্যারিয়ারের ৫৫০ তম ম্যাচটি খেলে বিলবাও এর বিপক্ষে এবং হয়ে উঠে বার্সার হয়ে সবথেকে বেশি ম্যাচ খেলা খেলোয়ার। সে সিজনে ১৪ টি গোল করে এবং বার্সাকে জয় করান ৫ টি শিরোপা। ২০১২ সালের তার চুক্তি বৃদ্ধি হয় এবং সেটি ২০১৬ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়।

গেটাফের বিপক্ষে ২০১৪ সালে জাভি তার ৭০০ তম ম্যাচটি খেলে এবং পদার্পন করে অনন্য রেকর্ডে। তারপর ২০১৪ সালে বার্সার হয়ে শিরোপাহীন থাকা তাকে একটু অম্লান করে এবং বার্সায় আবির্ভাব হয় এক নতুন যুগের। রাকিটিচ,  নেইমার, সুয়ারেজ দের মধ্যে সে তার জায়গা একাদশে হারাতে থাকে, কিন্তু তবুও সে গুরুত্ব পুর্ন ম্যাচ গুলোতে অসাধারন খেলতে থাকে। সিজন শেষ এ মেসি,সুয়ারেজ,নেইমাররা তাকে ট্রেবল উপহার দেন এবং বার্সা ক্যারিয়ার শেষ করে। লা লিগার শেষ ম্যাচের আগেই বার্সা লা লিগা জয় করে কিন্তু তবুও লা করুনার বিপক্ষে ম্যাচটি ছিল উত্তেজনাময়, কারন সেটি ছিল জাভির নূ্্য ক্যাম্পে শেষ ম্যাচ। সেদিন সবকিছুই ছিল জাভিময়।

নিজে কেঁদে, ন্যূ ক্যাম্প কে কাঁদিয়ে, হাজারো বার্সা সমর্থককে কাঁদিয়ে বিদায় নিলের ফুটবলের এক বিস্ময়কর খেলোয়ার জাভি হার্নান্দেজ।তারপর জাভি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে বার্সা ক্যারিয়ার শেষ করল।

 

ক্লাবের জার্সি গায়ে জাভি যেমন উজ্জ্বল ছিলেন, তেমনি দেশের জার্সি গায়ে ছিলেন আরো উজ্জ্বল। ২০০০ সালে জাভি তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু করে। তারপর দলের হয়ে সাফল্য পেতে থাকে একের পর এক।২০০৮ সালের ইউরোতে সে তার চমক দেখায়। সে মাঝমাঠ কে নিজের করে নেয় এবং স্পেন কে জিতাতে থাকে একের পর এক ম্যাচ।সেমি ফাইনালে জাভিরা রাশিয়াকে ৩-০ গোলে হারায় যার প্রথম গোলটিই করে জাভি। ফাইনালে মুখোমুখি হয় ইউরোপের সেরা জার্মানি, কিন্তু জাভি নামক এক প্রতিভার কাছে হারতে হয় তাদের। জাভির অসাধারন এক অ্যাসিস্টে তোরেস গোল করে শিরোপা উৎসবে মাতে।জাভি প্লেয়ার অফ দি টুর্নামেন্ট নির্বাচিত হয়।

তার ২ বছর পর শুরু হয় ফুটবলের সবথেকে বড় আসর বিশ্বকাপ ফুটবল। যেখানে একের পর একের কারিশমা দেখাতে লাগে স্পেন যার মুলে ছিল জাভি।সে বিশ্বকাপে জাভি শেষ ১৬ এর ম্যাচে পর্তুগালের বিপক্ষে অসাধারন এক ব্যাক হিল পাস দেন, যেটিকে গোলে পরিনত করেন ডেভিড ভিয়া, যার ফলে পরের রাউন্ডে যেতে সমর্থ হয়। সেমি ফাইনালে আবারো মুখোমুখি হয় জার্মানির, সেখানে জাভির ক্রসে পুয়োল হেডে গোল করে ফাইনালে নিয়ে যায় স্পেনকে।তারপর ফাইনালে নেদারল্যান্ডকে হারিয়ে শিরোপা জয় করে স্পেন। সে বিশ্বকাপে জাভি ৫৯৯ টি পাস দেয় যার সঠিক পাসের শতাংশ ছিল ৯১। সে বিশ্বকাপে জাভি প্রায় ৮০ কিলোমিটার দৌড়ায় যার গড় প্রতি ম্যাচে ১১.৫ করে। আর, ফাইনালে সে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দৌড়ায়, যা ছিল অবিশ্ববাস্য।

২০১২ ইউরোতেও জাভি অনেক ভাল খেলে এবং দলকে শিরোপা এনে দেয়।সে ইউরোতে তার পাসিং অ্যাকুরেসি ছিল ৯৪ শতাংশ। আয়ারল্যান্ড এর বিপক্ষে এক ম্যাচে সে ১৩৪ টি পাস দেয় যা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন্সশিপ এর যে কোন ম্যাচের রেকর্ড।সে ম্যাচে জাভি-ইনিয়েস্তা ২২৯ টি একে অপরকে পাস দেয় যা ছিল আয়ারল্যান্ড এর সকল খেলোয়ার এর মোট পাসের থেকে বেশি। ফাইনালে ইটালিকে ৪-০ গোলে হারার পথে দুটি অ্যাসিস্ট করে জাভি, তারপর শিরোপা উৎসবে মাতে।

২০১৪ সালে স্পেন প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নেয়, জাভি সেই বছরের ৫ আগস্ট আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার থেকে অবসর নেয়।

 

জাভি তার ক্যারিয়ারে বার্সা ও স্পেন এর হয়ে সম্ভাব্য সকল ট্রফি অর্জন করে। তার মধ্যে বার্সার হয়ে ৮ টি লা লিগা, ৩ টি কোপা দেল রে,৬ টি স্প্যানিশ সুপার কাপ,  ৪ টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ২টি উয়েফা সুপার কাপ এবং ২ টি ক্লাব বিশ্বকাপ জয় করে।

স্পেন এর  হয়ে জাভি ১ টি বিশ্বকাপ, ২ টি ইউরো জয় করে।

এছাড়া, জাভি অনেক ব্যাক্তিগত সাফল্য অর্জন করে।

জাভি হল এখন জীবন্ত কিংবদন্তী। সে সবকিছু জয় করে ফেলেছে।সে হচ্ছে বর্তমান সময়ের পরিপূর্ন মিডফিল্ডার। সে হয়ত আবার বার্সায় ফিরে আসবে তবে খেলোয়ার হয়ে নয় কোচ হয়ে বা আসবে না।কিন্তু, জাভি এখন পর্যন্ত বার্সার জন্য যা করে গেছে, তা বার্সা সমর্থকরা হাজারো বছর মনে রাখবে।আশা করি, ভবিষ্যতে সে বার্সায় ফিরে আসবে এবং বার্সাকে আরো অনেক  কিছু উপহার দিবে, এই আশায় শেষ করলাম।

শুভ কামনা জাভির জন্য