• ক্রিকেট

সোনা আগুনে পুড়েই তো খাঁটি হয়!

পোস্টটি ৮৬৫১ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

গতকাল যখন শেষ ৩ বলে জয়ের জন্য ১ রান দরকার তখন কি একবারের জন্য মুশফিকের মনে দুই বছর আগের সেই ব্যাঙ্গালুরু ম্যাচের ছবি ভেসে উঠেছিল ? টাইম মেশিন থাকলে ম্যাচটা থামিয়ে না হয় তখন মুশফিককে জিজ্ঞাস করা যেত। কিন্তু সেই ম্যাচটা কি এতদিনে আদৌ ভুলতে পেরেছিলেন মুশফিক ?

হার মানুষ খুব একটা মনে রাখে না। কিন্তু যে হার মনে পড়লে হৃদয়ে এখনো রক্তক্ষরণ হয় সে হার ভোলা যায় নাকি! ব্যাঙ্গালুরুর হারটা যে এদেশের ক্রিকেটার থেকে শুরু করে ক্রিকেটপ্রেমী কেউই ভুলতে পারেনি একথা তো বাজি ধরেই বলা যায়!চলুন একটু টাইম মেশিনে চড়ে ব্যাঙ্গালুরু ম্যাচটা থেকে ঘুরে আসা যাক।

শেষ ওভারে দরকার ছিল ১১ রান। প্রথম তিন বল থেকেই এসেছে ৯, এর মধ্যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বলে মুশফিকের টানা দুই বাউন্ডারি। ফলে ম্যাচ জয়ে আগাম সেলিব্রেশনটা সেরে নিয়ে ছিলেন মুশফিক! যার ফলে তাকে ম্যাচ শেষে খোঁচাও কম শুনতে হয়নি!কিন্তু এরপরেই ঘটল সেই হৃদয়ে রক্তক্ষরণকারী ঘটনা।

ম্যাচে উইনিং শটের প্রতি সব ব্যাটসম্যানেরই আলাদা একটা মোহ থাকে।আর সেটা যদি হয় চার ছয়ে তাহলে তো কথাই নেই! সেদিন একই মোহে পড়েছিলেন মুশফিক আর মাহমুদুল্লাহ। সেদিন যদি তারা দুজন এই সামান্য মোহটুকু সংবরণ করতে পারতেন তাহলে হয়তো কালকের ওরকম ম্যাচের পরেও স্মৃতি হাতরে দুঃখ খোঁজার কোনো প্রয়োজনই হতো না! শেষ ৩ বলে ১ রানের দূরত্বে থাকতে মুশফিক আর মাহমুদুল্লাহর সেই শটের ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারেনি। তারা নিজেরাই কি পারবেন?

পারেননি বলেই হয়তো মুশফিক সব হৃদয়ের গোপন এক জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিলেন।যেখানে সব বেদনা জমা থাকে। জমিয়ে রেখেছিলেন মোক্ষম সময়ে পাপমোচন করবেন বলে। তো ব্যাঙ্গালুরুর সেই দুঃখ কি মুশফিক প্রেমাদাসায় ভুলিয়ে দিয়ে পেরেছেন? পেরেছেন পাপমোচন করতে? 

উত্তরটা হ্যা হলে অনেকের দ্বিমত থাকতে পারে। তাদেরকে বলব, সেই ম্যাচ থেকে যে মুশফিক শিক্ষা নিয়েছেন এটা তো অন্তত মানবেন ? সেই ম্যাচের পর মুশফিক মাহমুদুল্লাহর উপর দিয়ে ঝড় কম বয়ে যায়নি। সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করতে করতে যেন আগুনের মধ্যেই নিক্ষেপ করেছিল।কিন্তু সোনা যে আগুনে পুড়েই খাঁটি হয়। মুশফিকের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন ছিলনা কখনোই। কিন্তু আগুনে পুড়ে খাঁটি সোনা যে হয়েছেন এটাই দেখানো বাকি ছিল মুশফিকের।

সুযোগ পেয়ে কাল তা দেখিয়েও দিলেন।শুধু দেখালেনই না যা দেখালেন তা অনেকবছর পর দেখলেও চোখে মায়ারঞ্জন বুলিয়ে দেবে। ৩৫ বলে ৭২ রানের ইনিংসটা শুধুই একটা হার না মানা অপরাজিত ইনিংস নয়। যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা কোনো পাপমোচনের ক্যানভাস। যার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে বেদনার নীল রঙ মুছে ফেলার প্রাণান্ত চেষ্টা!

মুশফিক উইকেটে এসেছিলেন দশম ওভারে। প্রথম বলেই সিঙ্গেল। স্ট্রাইক ফিরে পেলেন পরের ওভারে। প্রথম বাউন্ডারিটা ‘রিভার্স সুইপ’। পরের ওভারে শেষ দুই বলে ছক্কা ও বাউন্ডারি। এর মধ্যে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট দিয়ে মারা ছক্কাটা হয়তো আজ থেকে ১০-১৫ বছর পর দেখলেও মনে একই রোমাঞ্চ বয়ে যাবে। নিজের গার্ড থেকে একটু সরে গিয়েছিলেন। পেসার দাসুন শানাকা তা বুঝতে পেরে খাটো লেংথে বল করেছেন ‘ফোর্থ স্টাম্পের’ও বাইরে। মুশফিক করলেন কী, শূন্যে লাফিয়ে বলটাকে তাড়া করে মারলেন! তাঁর ব্যাট থেকে এমন শট এর আগে কেউ দেখেছেন?

কিন্তু কাল দেখলেন। কারণ কাল যে মুশফিক পাপমোচনের পণ নিয়েই নেমেছিলেন! বস্তুত, ওই রকম আত্মবিশ্বাসী শটের পর ব্যাটিংয়ে অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায়। আর পাহাড় সমান রান তাড়া করতে নেমে জয় থেকে ৮ বলে ১৬ রানের দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছোটখাটো অসম্ভবও সম্ভব করা যায়! 

১৯ তম ওভারের ৫ম বলটা নুয়ান প্রদীপ ইয়র্কার মারতে গিয়ে লাইন-লেংথে গড়বড় করে ফেলেন। বেশ গতিসম্পন্ন ডেলিভারিটা ছিল অফ স্ট্যাম্পের ওপর ফুলটস। সেটা টেনে মিড উইকেটে মারা চাট্টিখানি কথা নয়! আর বলটা শুধু মারলেনই না যেন ব্যাট থেকে কামান ছুড়লেন! যেটা আকাশছোঁয়া উচ্চতা নিয়ে আছড়ে পড়েছে শ্রীলঙ্কার ড্রেসিংরুমে।

 মুশফিক খোঁড়াচ্ছিলে আরো আগে থেকেই।কিন্তু হাল ছাড়েননি। এরপর এলো সেই পাপমোচনের মুহূর্ত। এবার আর কোনো আগাম উদ্‌যাপন নয়। শেষ ৩ বলে আবারও সেই ১ রানের মঞ্চে উঠে নয় চার-ছক্কার খোঁজ। এবার আগুনে পুড়ে যে কতটা খাঁটি হয়েছেন তা দেখিয়ে দিলেন।তাই পরের বলে ‘সিঙ্গেল’ নিয়েই মুশফিকের মুখ চিরে বেরিয়ে এসেছে হুংকার। 'পাপমোচন'র হুংকার।পরক্ষণেই যেটা রাঙিয়েছেন নাগিন সেলিব্রেশনে।

পাপমোচন তো মুশফিক করেই ফেললেন। তাহলে কি এখন দলের দুঃসময়গুলোতে মুশফিকরা আমাদের তাদের পাশে চাইতে পারেন না ? চাওয়াটা অযৌক্তিক কিছু নয়। কিন্তু এরপরও যদি আমরা দুঃসময়ে তাদের পাশে না থেকে আবারো সমালোচনার আগুনে নিক্ষেপ করি তাহলে আমাদের থেকেও বেশি অকৃতজ্ঞ কি আর কেউ থাকবে! সোনা পুড়ে খাঁটি হয় এটা সত্যি কিন্তু বেশি পুড়লে যে কালো হয়ে যায় এটাও আমাদের মনে রাখা উচিত!