• ফুটবল

বিশ্ব ডামাডোলের প্রেক্ষাপট-‘টোটাল ফুটবল’ ॥ নৈব নৈব চ’!

পোস্টটি ৩৭৫৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

98450432_10

টোটাল ফুটবল জীবনের ইতিহাস সমার্থকরূপে কত গভীর হতে পারে, তা সুদূরপ্রসারী ঘটনার মতোই শোনাবে। একটা ঘটনা পরিস্কার লিখে দেয়া যেতে পারে-১৯৭৪ সালে হল্যান্ড যে সংস্করণে টোটাল ফুটবল খেলেছিল বটে! তাদের সমপর্যায়ে আক্রমণাত্মক ফুটবল আজ পর্যন্ত আর কোনো দেশ উপহার দিয়ে যেতে পারেনি। বোধ হয়-ঐ সংস্করণের খেলাও কোনো দেশ বিকল্প কাঠামো সেভাবেও তৈরি করতে পারেনি। ১৯৭৮ সালে হল্যান্ড বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠে খানিকটা চেষ্টা করলেও তাতে পুরোপুরি নিজেদের মধ্যে সফল হতে পারেনি কিংবা ডানা মেলাতে পারেনি।

তার কারণ, ডাচ খেলোয়াড়ের মান রাতদিন পার্থক্য সেই সময়ের ব্যবধান ছিলো স্পষ্ট। বোধ করি, এক সাথে দারুণ দুর্দান্ত খেলোয়াড়ের সমাবেশ পাওয়া খুব কমই বিশ্বের ফুটবল অঙ্গনে ঘটনা ঘটেছে।

বিশ্লেষণ ধরলে বোঝা যাবে-১৯৬০ দশকের শেষপ্রান্তে ডাচ ফুটবলীয় বলয়ে অকুন্ঠ প্রতিভার ঝলক একটা জোয়ারের সময়ে চলে আসে। ১৯৭০ হতে ১৯৭৬ পর্যন্ত এই ৬ বছর যাবত উঁচু পর্বতের চূড়ায় ঐ হল্যান্ড দল চূড়ান্ত ফর্মের তুঙ্গে অবস্থানে ছিল। তারপর ১৯৭৮ সালের পর ক্রমশ হল্যান্ডের শক্তি সামর্থ্য ধীরে ধীরে শিথিল হতে থাকে। ভাটার টান পড়ে। এর ঠিক ৮ বছর বাদে একই ঘটনা দেখা যায়-জিকো, সক্রেটিস, ফ্যালকাও, সেরেজো, জুনিয়রদের ব্রাজিল দল ১৯৭৮’র বিশ্বকাপে এক অনবদ্য স্বচ্ছপ্রবাহী টোটাল ফুটবলের অন্যরূপ সংস্করণে খেলেছে। কিন্তু অবস্থা দফারফা। যাচ্ছে তাই। দ্বিতীয় রাউন্ডে ইতালীর মতো এক মাঝারি পাল্লা দলের নিকট ব্রাজিল হারিকিরি হয়ে পর্যুদস্তে পরিণত হয়। ব্রাজিল একদম বিশ্রী ঘটনার শিকার। কি খেলতে এসে কী যে মহাকান্ড কারখানার কারণ ঘটে গেল! নাহ্! টোটাল ফুটবল খেলেও কাজে লাগেনি। ব্রাজিল সেখানেই মাইনাস পয়েন্টের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে মহাভুল করে বসে। এর ধারে কাছেও যায়নি। সুবিধা নিতে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। 

 

ব্রাজিল যেখানে সাম্বা নাচ বলশিল্পের খেলায় অভ্যস্ত। ওরা হৃদয় ধারণ করে ফুটবলটা খেলে। মস্তিষ্কে নয়। সেখানে ওই টোটাল ফুটবল স্টাইলটি ঝুঁকি নিয়ে খেলতে কেন গেল, তা বোধগম্য নয়। এর ফর্মূলার ধারণা সম্বন্ধে সেই ব্রাজিলরা কোনোকিছু পরিস্কার অবগত ছিল না। এটা যে স্ব-স্ব বিভাগের খেলোয়াড়ের উপর যেকোনো পদ্ধতির সাফল্য পাওয়া যাবে-ব্রাজিলের কাছে তা ছিল অজানা। ঠিক ঐ সমস্ত খেলোয়াড় ছাড়া ‘টোটাল ফুটবল’ নকলের ছাপ নিয়ে এমন সফল হতে পারবে, তা কিন্তু নয়। হওয়াও অসম্ভব বিচিত্র কিছু ব্যাপার ছিল না।

 

বেকেনবাওয়ারের উক্তি-‘জার্মানী নয়, ফুটবলের মনজয় করেছে হল্যান্ড’..

১৯৭৪ এর বিশ্বকাপ সমাপ্তির পর জার্মান ক্যাপ্টেন তথা সুইপার সেন্ট্রাল খেলোয়াড় বেকেনবাওয়ার স্বীকার করেন, ‘জার্মানী বিশ্বকাপ জিতেছে; আসলে হল্যান্ড পরাজিত হলেও তাদের টোটাল ফুটবলের মনজয় করেছে। জার্মানরা নয়, হল্যান্ডই প্রধান দাবিদার। ওরা টোটাল খেলার স্থপতি। তাদের টোটাল ফুটবল খেলার ছাপ পুরোদমে প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাওয়া যায়।’ হল্যান্ড ওই ’৭৪ বিশ্বকাপে শিরোপা পেলে তাদের সার্থকতা হয়ে যেতো-এই সম্ভাবনাটাও কিন্তু ছিল। কিন্তু ফলাফল হল্যান্ডের পক্ষে না যাওয়ায় এর বদলে জার্মানী ফিফা বিশ্বকাপ জিতে ট্রফি নিয়ে ঘরে ফেরে। ফলে টোটাল ফুটবলের নায়ক হল্যান্ড আর সাক্ষী সাবুদ হতে পারলো না। সমস্ত বিতর্ক খতম এখানেই!

 

এক সাংবাদিক সম্মেলনে বেকেনবাওয়ার টোটাল ফুটবল প্রসঙ্গে কিছু ব্যাখ্যাও দেন। না, ওই টোটাল ফুটবল কোনো ম্যাজিক ফর্মূলা ছিল না। এটা কোনো ফর্মূলা নয়-যেকোনো দেশ যেকোনো পদ্ধতিতে খেললে অনায়াসে কাপ জিতে যাবে। প্রকৃতপক্ষে প্রচন্ড বিস্ময়কর ও উল্লাসই এর প্রধান মেরুদন্ডের ভেতরে ভেতরে বিস্ফোরিত হচ্ছিল। যে কারণে বড় রহস্যের ঘেরায় হল্যান্ডরা ওই পদ্ধতিতে একের পর এক খেলে এত সাফল্য হাতে নাতে পাচ্ছিল। কারণ, সেই সময়ে টোটাল ফুটবল খেলার মতো হল্যান্ড ছাড়া অন্য কোনো দেশগুলো ওই পদ্ধতির উপর দক্ষতা দেখায়নি। সফলের মুখ দেখেনি। দীর্ঘদিন পর্যন্ত বিশ্বের অধিকাংশ দেশ বা প্রতিপক্ষ দলগুলো বুঝতে পারেনি, তাদের পদ্ধতিটি আসলে কি ছিলো?

এই পদ্ধতির কাঠামোটি নিয়ে অনেক দেরিতে বোঝা গেল-স্বচ্ছ পানির মতো পরিস্কার! টোটাল ফুটবল খেলায় নির্দিষ্ট কোনো ট্যাকটিক্সেই নয়, শুধু আর দশটা স্বাভাবিক প্রতিভাবান খেলোয়াড়কে মাঠে বল পায়ে ছেড়ে দেয়া হয় এবং পরিচ্ছন্ন সৃষ্টির আনন্দে তারা গা-অবগাহনে খেলছিল। এই যে একটা ঘোরের মধ্যে আশা জাগানিয়া খেলা! এই পদ্ধতি নিয়ে তাদের (হল্যান্ড) আগে কেউ বুঝতে পারেইনি-টোটাল ফুটবল খেলায় দুর্বলতার হেতু কী!

যাহোক, টোটাল ফুটবলকে ঘিরে হল্যান্ডের দিকে তাকিয়ে থাকলে অন্তত ১০ বছর লেগে যাবে-শুধু এইটুকু লেখা যায়। এই দলটি খুব ভালো যোগ্যতর দল, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অবশ্য যে বড় টুর্নামেন্ট হতে জয় পাওয়ার প্রচ্ছন্নতা অর্জন করার কথা, সেখানে স্বাভাবিক খেলা খেলে এ দলটির মধ্যে প্রয়োজনীয় রসদপত্রের ভান্ডার ভরে গিয়েছিল। খেলোয়াড়ের পূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে গুণাগুণও তো পিছিয়ে নেই। এমনকি বেশ কয়েকজন বিশ্বমানের ফুটবল খেলোয়াড় নিদেনপক্ষে পার্থক্য গড়ে দিতে পারবেন। এবং ব্যক্তিগত দক্ষতাসম্পন্ন খেলোয়াড় দিয়ে খেলতেও সক্ষমতার পরিচয় দেবেন। এই দু’টির সমাবেশ কিন্তু ঐ হল্যান্ডের পকেটে বারুদ জমিয়ে রেখেছিল।

 

‘টোটাল ফুটবল একটা অবাস্তব খেলা’ : রাইনাস মিশেল

আজকাল ফুটবল খেলা নিয়ে বহু দেশে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। নিঃসন্দেহে এটা এতো উন্নত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে-যার চিন্তা এখন রীতিমত গবেষণার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ওই ফুটবল খেলা এখন আর পুরোনো ’৫০ ও’৬০ দশকের অবস্থায় নেই। এখনকার কৌশলের অসামান্য অগ্রগতির খেলায় যথেষ্ট রূপান্তর ঘটেছে। তবে লোকের মুখে মুখে কয়েক বছর আগে ‘টোটাল’ বা ‘প্রেসিং স্টাইল’ ফুটবলের কথা ফেরে। টোটাল ফুটবলের বায়বীয় ধারণা ছিল অনেকটা বাস্কেটবল ফুলকোর্ট প্রেস মডেলের মত। এ ধরনের খেলা ডাচ ফুটবলের জনক রাইনাস মিচেল যাকে ‘প্রেসিং স্টাইল’ বলেছিলেন। তবে আজ এখনকার ওসবের প্রথা নেই বললেই চলে। কেউ কেউ টোটাল ফুটবলকে অবাস্তব বলে মনে করেন। বাস্কেটবলে পুরো ৪০ মিনিট কোনো দলই ফুলকোর্ট প্রেস চেপে নিয়ে খেলতে পারে না।

১৯৭৪-এর বিশ্বকাুপ ফুটবল শুরুর প্রাক্কালে কয়েক বছর পূর্বে হল্যান্ডের এ্যাজাক্স ক্লাবের রুমানীয় কোচ স্তেফান এ পদ্ধতিতে খেলানো শুরু করেন। হল্যান্ডেও ইংরেজ বয়নশিল্পীরা ফুটবল নিয়ে যায়। সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর ঘটনা। ১৮৯৮ খৃস্টাব্দে ওই দেশে লীগ খেলা আরম্ভ হয়। ইংরেজরা সোভিয়েত ইউনিয়নে ফুটবল নিয়ে যায়। হল্যান্ডের মতই সে ইতিহাস। ইংরেজ সূতা ব্যবসায়ীরা রুশীয়দের এই খেলায় দারুণভাবে উৎসাহিত করে তোলেন। ১৮৯৮ খৃস্টাব্দে রুশ দেশের ফুটবল খেলা প্রচলন শুরু হয়। এই সব খবর কেউ কি রেখেছেন? জেনেছেন খুঁটিনাটির কোনো খবর?

 

এখনকার টোটাল ফুটবলের সেই ছায়া আর নেই

টোটাল ফুটবলের বিনির্মাণ বিষয়ে প্রসঙ্গে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, গত (১৯৫০-১৯৭৪) ২৪ বছর যাবত হাঙ্গেরী, পোল্যান্ড, সোভিয়েত ইউনিয়ন, জার্মানী, ডেনমার্ক প্রভৃতি তথাকথিত সমস্ত উত্তর ইউরোপিয়ান দল এই তত্ত্ব কাঠামোর উপর নির্ভরশীল হয়ে টোটাল ফুটবল খেলেছে। কিন্তু সাফল্য অর্জনে তেমন কোনো লাভ হয়নি। তবে এই খেলার প্রাসঙ্গিক বিচারে কখনো কোনো দেশ এতটা ভালো খেলেছে, আবার কোনো দেশ খুব বাজে খেলেছে এবং ঐ দু’টো’র সংমিশ্রণে ফুটবল তত্ত্বের উপর তাদের টোটাল ফুটবল খেলার প্রতিপার্শ্বে নিরানন্দ উৎসব মনে করে খেলেছে। আবারো বলতে হয়-ঐ আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ইতালি, ফ্রান্স, পর্তুগালের অচিন্ত্যনীয় ফুটবলকে কেন টোটাল ফুটবল খেলার প্রতি এতোটা ঝুঁকে পড়েনি কেনো? বোঝা যায়, তাদের স্ব-স্ব ফুটবল ঘরাণার উৎস প্রাণ থাকার কারণে টোটাল ফুটবলের দিকে এত আগ্রহ দেখায়নি। প্রকাশ করেনি। অন্তত তাই হয়েছে। এখন কোনো দেশই টোটাল ফুটবল স্টাইল খেলে না। এখানে ফুটবলের প্রথম ও শেষ জবাব!

 

এলিস হক

ক্রীড়া সাংবাদিক ও ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার

আদর্শপাড়া, ঝিনাইদহ

১৬.৪.২০১৮