• ফুটবল

তাঁদের দুঃখগাথা বিশ্বকাপ

পোস্টটি ৫৪১৫ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
শুরু হয়ে গেছে কাউন্টডাউন , কেউ বলে বিশ্বকাপ ফুটবল, আবার অনেকে ই বলে "The Gretest show of Earth" . দিনক্ষন পেরিয়ে আর একমাসের ও কম সময় ফুটবলের এ মহাযজ্ঞ শুরু হতে। একবিংশ শতাব্দীর এ একবিংশ ফুটবল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে জেনে নেই কিছু ফুটবল ট্রাজেডি। হ্যা সবাই ই তো সাফল্যের গল্প শোনায়,আমি না হয় উল্টো দিক থেকে ই শুরু করি.... অনেক সময় অনেকে ই খর্ব শক্তির দল নিয়ে বিশ্বকাপ জিতে এসেছে,আবার সেরাদের সেরা দলটি ও অনেক সময় সাফল্যের দ্বাড়প্রান্তে গিয়ে ফিরে এসেছে। তিন পর্বের এ ধারাবাহিকে এ রকম তিন টি দলের কথা ই আপনাদের জানাবো যারা নিজেরা তো দূরের কথা প্রতিপক্ষ ও হয়তো কখনো ভাবে নি তাঁরা ব্যার্থ হয়ে ফেরত আসবে!! " দ্যা ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্স" ফুটবল বিশ্বের কাছে এখন হয়তো অনেক অজানা একটা নাম "হাঙ্গেরি"। অথচ পঞ্চাশ এর দশকে এ দলটি ছিলো রীতিমতো দূর্ধর্ষ । প্রতিপক্ষকে তখন বলে কয়ে হারাতো তাঁরা।রাশিয়া ও আলবেনিয়াকে ১২-০ কিংবা ফ্রান্সকে ১৩-১ গোলে হারানোর মতো প্রতিপক্ষকে প্রায় ই লজ্জায় ডোবাতো দলটি।এজন্য ই তো তাঁদের নাম "ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্স" বা জাদুকর হাঙ্গেরিয়ানরা। প্রকৃতির অপরুপ লীলাভূমি সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম বিশ্বকাপ (১৯৫৪)।তাদের সাংগঠনিক ক্ষমতা নিয়ে অনেকে ই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলো ,তবে শেষপর্যন্ত ভালো ভাবে ই এ প্রতিযোগিতা সম্পন্ন হয়।তাদের ওপর জার্মানির প্রভাব ছিলো স্পষ্ট,এই সুযোগ নিয়ে ই অপেক্ষাকৃত দূর্বল দল প.জার্মানি ই চ্যাম্পিয়ন হয়ে ছিলো।যাক সেটা পরের কথা। ৫ম বিশ্বকাপে হাঙ্গেরি গিয়েছিলো টানা ৪ বছর ৩১ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড নিয়ে।সাথে ছিলো দুই বছর আগে অলিম্পিকের সোনা জয়ের রেকর্ড টা ও।তবে তখন আরও একটা বড় কীর্তি ও সাথে ছিলো; ১৯৫৩ এর ২৫শে নভেম্বর ওয়েম্বলির সেই বিখ্যাত ম্যাচ। নিজেদের দেশে এর আগে যে কখনো হারে নি ইংলিশরা । সেই দর্প চূর্ন করে হাঙ্গেরি জেতে ৬-৩ গোলে। এটিকে অনেকে ফ্লক ফেবেছিলেন। তবে সেই উত্তরটি ও তারা পেয়ে যান মাস দুয়েক পর। ফিরতি ম্যাচে বুদাপোষ্টে হাঙ্গেরি জেতে ৭-১ গোলে!! এখন পর্যন্ত ইংলিশদের যেটি সবচেয়ে বড় পরাজয়। ন্যান্দর হিদেকুটি,স্যান্দর ককসিস,যোসেফ বজসিক, জালতান জিবর আর ফেরেঙ্ক পুসকাস দের নিয়ে গড়া দলটি ফুটবলের সংজ্ঞা টা ই পাল্টে দিয়েছিলো... ফুটবলটি তাঁদের কাছে ছিলো স্রেফ আক্রমন। পুসকাস হাঙ্গেরি তো বটে ই ফুটবল ইতিহাসের ই অন্যতম সেরা ফুটবলার। ফিফা তে একটি এ্যাওয়ার্ড ই আছে "পুসকাস" এ্যাওয়ার্ড।যাই হোক এবার মূল ঘটনায় আসি; এই বিশ্বকাপের ফরম্যাটটি ছিলো খুব ই ত্রুটিপূর্ন,অনেকের কাছে ই হাস্যকর।আসলে জার্মানদের চ্যাম্পিয়ন করানোর লক্ষে ই ছিলো এ অভিনব পথ প্রনয়ন। মোট ষোলটি দলকে চারটি পুলে ভাগ করা হয়। পুল -১- ব্রাজিল,যুগোস্লাভিয়া,ফ্রান্স,মেক্সিকো। পুল-২- হাঙ্গেরি,প.জার্মানি,তুরস্ক,দ.কোরিয়া। পুল-৩- উরুগুয়ে,চেকোস্লোভিয়,অষ্ট্রিয়া,স্কটল্যান্ড। পুল-৪- ইংল্যান্ড,সুইজারল্যান্ড,বেলজিয়াম,ইটালি। শেষ পর্যন্ত ত্রুটিপূর্ন লিগ পদ্ধতি অনুসরন করে ই পুলভিত্তিক লীগ শুরু হয়। ও হ্যা এই বিশ্বকাপে আর্জেন্টাইদের আসা হয় নি, ফলে সর্বকালের সেরা উইঙ্গার "আলফ্রেড ডি ষ্টেফানোর" খেলা দেখা থেকে বঞ্চিত হয় দর্শকরা। পুল ২ এর প্রথম ম্যাচে ই যুদ্ধবিধ্বস্ত কোরিয়ানদের লজ্জার মুখে পরতে হয়। হাঙ্গেরির কাছে তারা হারে ৯-০ গোলে । জার্মানদের ও ৮ গোল দেয়ার পর কেউ ভাবতে পারে নি এই প.জার্মানদের কাছে ই ফাইনাল হারতে হবে ম্যাগিয়ার্সদের। দু খেলায় কোসিস করেন ৭ গোল। জার্মানরা জানতো যেভাবে ই হোক তারা ফাইনালে যাবে আর তাদের প্রতিপক্ষ হবে হাঙ্গেরি ই। তাই অত্যন্ত নগ্নভাবে জার্মান ডিফেন্ডার ওয়ার্নার ল্যাব্রিশ হাঙ্গেরির সেরা খেলোয়ার পুসকাস কে প্রচন্ড জোরে লাথি মেরে প্রতিযোগিতা থেকে প্রায় বিদায় ই করে দেয়। এরপর কোয়ার্টার ফাইনাল, সাধারনত একটি গ্রুপের বিজয়ী দল অন্য গ্রুপের রানার্সআপ দলের সাথে খেলতে দেখা যায়, কিন্তু হলো উল্টো; পুল ১ এর বিজয়ী দল ব্রাজিল খেললো পুল ২ এর বিজয়ী দল হাঙ্গেরির সাথে। আর যুগোস্লাভিয়ার সাথে খেললো প.জার্মানি!!পুল ৩ এর শীর্ষ দল উরুগুয়ে খেলে পুল ৪ এর চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের সাথে আর সুইজারল্যান্ড খেলে অষ্ট্রিয়ার বিপক্ষে। প্রথম কোযার্টার ফাইনালে জার্মানরা যুগোশ্লাভিয়াকে হারায় ২-০ গোলে। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে শেষ হয় ইংল্যান্ড উরুগুয়ের ম্যাচ , উরুগুয়ে জেতে ৪-২ গোলে। এ ম্যাচে দু দলের দুই বয়স্ক "স্ট্যানলি ম্যাথুজ" আর "ভারেলা" ভেলকি দেখান। বিশেষ করে ইংল্যান্ডের স্ট্যানলি ম্যাথুজ ছিলেন অপূর্ব।আর ঐ দিকে স্বাগতিক সুইজারল্যান্ড আর শক্তিধর অষ্ট্রিয়ার ম্যাচের দু গোলবার তো গোলবন্যায় ই ভেসে যায়। ৭-৫ গোলে জেতে অষ্ট্রিয়া, এক খেলায় ১২ গোল তা ও আবার কোয়ার্টার ফাইনালে!! আর যে কোয়ার্টার ফাইনালটি ভালো মন্দে মিশিয়ে থাকবে তা হলো ব্রাজিল হাঙ্গেরি ম্যাচটি। ম্যাচটি হয়েছিলো "বার্নে"। তাই এ ম্যাচটি আজও বার্নের যুদ্ধ নামে পরিচিত। স্বরনকালের অন্যতম সেরা দুটি দল এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটাবে তা কেউ ই বিশ্বাস করেনি।অবশ্য সমালোচকরা এর জন্য ব্রাজিল কে ই বেশি দায়ী করেছেন। হাঙ্গেরি তো বটেই ব্রাজিলে ও ছিলো তখনকার তাবড় তাবড় সব খেলোয়ার।হাঙ্গেরিতে যেমন ছিলো গ্রসিকস,পুসকাস, কোসিস ,জিবর ও বিশ্বশ্রেষ্ঠ গোলকিপার বোজসিক; তেমনি ব্রাজিলে ও ছিলো স্যান্টোস,জুলিনো,ডিডি। যাদের খেলা দেখে সবাই নয়ন জুড়াবেন বলে মাঠে সমবেত হয়েছিলেন তারা সবাই নয়ন ঝরিয়ে মাঠ ছেরেছেন। আহত পুসকাস এদিন খেলতে পারেন নি।তার পর ও বৃষ্টি বিধৌত সেই ম্যাচে প্রথম আট মিনিটেই হাঙ্গেরি ২ গোলে এগিয়ে যায়। গোল ২টি করেন "হিদেকুটি "। এর পর ই শুরু হয় মেজাজ হারানোর পালা।হাঙ্গেরির ব্যাক বুজানস্কি ব্রাজিলের ইন্ডিয়োকে ফেলে দেন , ফলাফল পেনাল্টি। জালমা সেন্টোস প্রাপ্ত সুযোগ কাজে লাগান (২-১)। হাঙ্গেরি আবার ফলাফল বাড়ায় (৩-১)। হাঙ্গেরি অধিনায়ক বোজসিককে ঘুষি মেরে তার একটি মারাত্নক ট্যাকেলের জবাব দেন ব্রাজিলের স্যান্টোসে। ফলাফল দুজন ই লাল কার্ড। এরপর ব্রাজিলের হাম্বান্টো লোরাল্ট লাথি মারার জন্য বহিষ্কৃত হন। হাঙ্গেরি ম্যাচ জেতে (৪-২) গোলে। যথারিতি সেমিতে প.জার্মানি ও অষ্ট্রিয়া। ম্যাচে অষ্ট্রিয়া তাদের ফর্মহীন গোলরক্ষক "ওয়াল্টার জেমান"কে মাঠে নামানোর খেসারত দেয় ম্যাচটি ৬-১ গোলে হেরে। হাঙ্গেরি বনাম উরুগুয়ে ম্যাচটি হয় লুসানে। টূর্নামেন্টের সেরা ম্যাচ ছিলো এটি। পুসকাস বিহীন হাঙ্গেরি ও ভারেলা ছাড়া উরুগুয়ে মাঠে নামে। বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত উরুগুয়ে হার মানেনি আর হাঙ্গেরিকে তো গত ৪ বছর যাবত কেউ হারাতে পারে নি । সেদিন ও মাঠে বৃষ্টি ছিলো ; এর মাঝে ই চলে সুন্দর ফুটবল । আধঘন্টার মধ্যে ই হাঙ্গেরিকে এগিয়ে দেন জিবর, কিছুক্ষন পর ই ব্যাবধান দ্বিগুন করেন হিদেকুটি। এতে দমে যায়নি উরুগুয়ে, বরং জ্বলে উঠে ৭৫ মিনিটে একটি ও ৮৭ মিনিটে শোধকরে দ্বিতীয় গোলটি। অতিরিক্ত সময়ে আন্দ্রাদে আহত হয়ে মাঠের বাইরে চলে যাওয়ার সুযোগটি নিয়ে হাঙ্গেরি ম্যাচটি (৪-১) এ জিতে যায়।খেলা শেষে হাঙ্গেরি ম্যানেজার বলে, আজ সেরা দলকে হারালাম। ফাইনালে জার্মানদের বিপক্ষে হাঙ্গেরিয়ানরা সবচেয়ে বড় ভুল করে আহত পুসকাস কে মাঠে নামিয়ে ও উরুগুয়ের বিপক্ষে অত্যন্ত ভালো খেলা বুডাই কে না নামিয়ে। তার পর ও খেলার মাত্র ৮ মিনিটে ই ম্যাগিয়ার্সরা এগিয়ে গেলো ২ -০ গোলে !প্রথমে পুসকাস পরে জিবর। তিন মিনিটের মধ্যে ই জার্মানরা ব্যবধান কমালেন (২-১) । এর ষোল মিনিট পর জার্মানরা ম্যাচে সমতায় ফেরে হেলমুট রানের গোলে। বিরতির পর জার্মানরা আক্রমন বৃদ্ধি করে আর হাঙ্গেরি হয়ে পরে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত । পুসকাস দৌড় তো দুরের কথা মাঠে হাটে ই খুড়িয়ে খুড়িয়। তারপর খেলার যখন ষোল মিনিট বাকি তখন জার্মানির "রান" ব্যবধান তৈরি করেন (২-৩) এ। পরে পুসকাস গোলদিলে লাইন্সম্যান গোলটিকে অফসাইড ঘোষনা করেন। ওয়েলসের লাইন্সম্যান "গ্রিথিফ" এর এই সিদ্ধান্তটি ছিলো খুবই বিতর্কিত। বহুদিন এ সিদ্ধান্তটা নিয়ে তর্ক চলে , কিন্তু তাতে কি ? ততক্ষনে তো জার্মানরা চ্যাম্পিয়ন হয়ে ই গেছে... এই টুর্নামেন্টের সবকিছুই ছিলো জার্মানদের পক্ষে। গ্রুপলীগে তৃতীয় হয়ে ও অদ্ভুত আইনে প্লে-অফ খেলে তারা।তারপর গ্রুপের শীর্ষদেশের পরিবর্তে রানারআপ (যুগোস্লাভিয়া) দলের সাথে খেলে ।বিশ্বসেরা পুসকাস কে প্রচন্ড জোরে লাথি মারলে ও ল্যাব্রিস বহিষ্কৃত হয় না। ফাইনালে পুসকাসের গোল বাতিল! তবুও ইতিহাস তো জার্মানদের পক্ষে ই। কারন পঞ্চম বিশ্বকাপ জয়ী দল টি তো প.জার্মান ই । আর ৫০ এর বিশ্বকাপের মতো এ বিশ্বকাপে ও একটি বিশ্বসেরা দলকে খুশি থাকতে হয় রানার্সআপ হয়ে। খ্যাতিমান সব ফরোয়ার্ড থাকার কারনে এ বিশ্বকাপে ২৭ ম্যাচে মোট গোল হয় ৪০ টি,গড় ৫.৩৮। এর মাঝে হাঙ্গেরি তাদের ৬ ম্যাচে ই গোল করে ২৭ টি!! তাদের "কোসিস" পান সর্বোচ্চ (১১) গোলদাতার পুরস্কার। যা ছিলো বিগত সব বিশ্বকাপ থেকে বেশি। আর এ বিশ্বকাপ থেকে ই খেলা টেলিভিশনে সম্প্রচার শুরু করা হয়।