• ফুটবল

শেষটা অন্যরকমও হতে পারত

পোস্টটি ৩৬৫৭ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

 

                 দুহাত বুকের উপর রেখে চিত হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন তিনি। যেন ঘাসের সঙ্গে একেবারে মিশে যেতে চাইছেন। ঠিক এভাবেই তিনি হতাশা নিয়ে পড়ে থাকলেন যতক্ষণ না তার একজন সতীর্থ তাকে টেনে তুলে স্বাভাবিক অবস্থায় আনলেন। লিভারপুলের বিপক্ষে বার্সেলোনার ৩-০ গোলে জয়ের পর ন্যু ক্যাম্পে দৃশ্যটা এরকমই ছিল। উসমান ডেম্বেলে যখন ম্যাচের একদম অন্তিম মূহুর্তে গোলরক্ষককে একা পেয়েও অবিশ্বাস্যভাবে তার হাতে বলটি মারলেন তখন ঠিক এইরকম প্রতিক্রিয়াই লিওনেল মেসি দেখান। কারণ তখনো হয়তো তার মাথায় গত মৌসুমের সেই রোমান রূপকথাই ঘুরে বেড়াচ্ছিল যেখানে তিনি নিজেকে খুঁজে পান ৪-১ গোলে এগিয়ে থাকার পরও অবিশ্বাস্যভাবে একজন পরাজিত নেতার চরিত্রে । তাই চ্যাম্পিয়নস লীগের সেমি-ফাইনালের প্রথম লেগে ৩-০ গোলের জয়ে পুরো ন্যু ক্যাম্প যখন দু’লক্ষ পায়ের পদধ্বনিতে মুখরিত তখন তার আকাশে যে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা যায় সেটা হয়তো শুধু তিনিই দেখতে পান। ছয়দিন পর অ্যানফিল্ডে তাদের পরিণতি কি হবে সে আভাসও হয়তো শুধুমাত্র তিনিই পান। সে সাথে পেয়ে যান পরবর্তী দেড় মাসে তার তিল তিল করে গড়ে তোলা সোনার ফসলে আচমকা খরার পূর্বাভাস।

 

                     শুরুটা হয়েছিল মৌসুমের শুরুতেই। যখন হোয়ান গ্যাম্পার ট্রফির ম্যাচটি খেলতে নামার আগে প্রথা অনুযায়ী নতুন কাপ্তান হিসেবে তিনি সমর্থকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে যান তখন ক্যাম্প ন্যুর আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তুলল " এই সুন্দর ট্রফিটাকে ( চ্যাম্পিয়নস লীগ ) আবার ক্যাম্প ন্যুতে ফিরিয়ে আনতে আমরা আমাদের সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করব।" এই কথাটার মধ্যেই যেন ছিল বছরটাকে নিজের করে নেওয়ার আর্তি। এক অদম্য স্পৃহা নিজের লিগ্যাসিকে আরো এক ধাপ উপরে নিয়ে যাবার। 

 

                  তার প্রতিশ্রুতির সাথে পারফরমেন্সেরও কোনো বিশ্বাসঘাতকতা ছিল না। লা লীগার সর্বোচ্চ গোলদাতা হন ৩৬ গোল করে। আবার ১৩ অ্যাসিস্টের মাধ্যমে সর্বোচ্চ অ্যাসিস্টদাতার তালিকাতেও তার নাম সবার উপরে। বার্সেলোনার শিরোপা নির্ধারণী গোলটাও তার। উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগেও ১২ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে লা লীগা শিরোপাও নিশ্চিত । তখন উপস্থিত যেকোনো কারোর কাছে ট্রেবল জয় সময়ের ব্যাপার মনে হবে। কিন্তু ফুটবল বিধাতা হয়তো তখন 'কহিলেন শেষে ক্রুর হাসি হেসে , আচ্ছা সে দেখা যাবে'। 

 

                অবশেষে তার শঙ্কাই যেন সত্যি হল। ডেম্বেলের শিশুতোষ ভুলের চড়া মাশুলই দিতে হল । অবিশ্বাস্য এক ফিরে আসার উপাখ্যান লিখে লিভারপুল ৪-০ গোলে দ্বিতীয় লেগ জিতে ফাইনালে চলে গেল। আর নিশ্চিত করল লিওনেল মেসির টানা চতুর্থবারের মতো মাথা নিচু করে চ্যাম্পিয়নস লীগ যাত্রা সমাপ্ত করা। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হল কোপা দেল রের ফাইনাল হার। চোট জর্জরিত এক বার্সাকে ২-১ গোলে হারিয়ে শিরোপা ভ্যালেন্সিয়ার। লিওনেল মেসির গোলও এদিন কোনো কাজে দিল না । পরাজিত দিকেই তিনি নিজেকে খুঁজে পেলেন। 

 

                সব ক্ষতে তিনি প্রলেপ দিতে পারতেন কোপা আমেরিকাকে নিজের করে নিয়ে । কিন্তু টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই তিনি আশ্চর্য রকমের নিষ্প্রভ। সেই সাথে নিষ্প্রভ আর্জেন্টিনাও। খুঁড়িয়ে আর্জেন্টিনা গ্রুপ স্টেজ পার হল আশার বাতি নিবু নিবু করে। কিন্ত কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনার উজ্জ্বল এক পারফরমেন্সে সে বাতি জ্বেলে উঠল। টুর্নামেন্টের শুরুতে মেসি নিজেদের আন্ডারডগ বললেও এখন তিনি আশার আলো খুঁজে পান। যদিও ছিলেন নিষ্প্রভ । কিন্তু স্বপ্ন দেখতে তো দোষ নেই। তাই তিনি এক শেষ চেষ্টা করলেন সেই মারাকানায় ফিরে যাবার যে মারাকানা তাকে পাঁচ বছর আগে নিজের স্বপ্ন পূরণ থেকে আঙুল ছোঁয়া দূরত্বে রেখে ফিরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ২-০ গোলের জয়ে ব্রাজিল নিশ্চিত করল এবারও খালি হাতে ফিরছেন তিনি। ম্যাচ শেষে তাই শূণ্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলেন না ।

 

                তিল তিল করে গড়ে তোলা সাম্রাজ্য আচমকাই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল তার । যে আঁচল দিয়ে তার সকল পরিশ্রমের ফসল তিনি আগলে রেখেছিলেন , মৌসুমের শেষ কয়েকটা দিনের দমকা হাওয়াতে উড়ে যায় সেই আঁচল। নিজেকে ক্রমে বিশ্ব শাসকের রূপে প্রতিষ্ঠা করতে করতে হঠাৎই সবকিছুর শেষে তিনি এখন একজন পরাজিত সিপাহী। পহেলা মে'তে তিনি ন্যু ক্যাম্প ছাড়লেন ডেম্বেলের মিসটা নিয়ে অনুতাপ করে , ঠিক ছয়দিন পর তিনি অ্যানফিল্ড ছাড়লেন সবকিছু নিয়ে অনুতাপ করে। তিনি মিনেইরো ছাড়লেন স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে , সেভিয়া ছাড়লেন সব হারানোর শূণ্যতা নিয়ে।