• ফুটবল

যে কারণে বার্সেলোনার নেইমারকে কেনা উচিত নয়

পোস্টটি ৫১৮০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

চারটা ট্রান্সফার উইন্ডো এই নিয়ে চলতে লাগল। কিন্তু এর একটিও এমন ছিল না যেখানে তার ফিরে আসার গুঞ্জন ছিল না । বরং প্রতিবার তা আরো জোরালো হয়েছে। এই ট্রান্সফার উইন্ডোও এর ব্যতিক্রম থাকল না। এবার বরং যেন সবকিছু ছাপিয়ে নেইমারের বার্সেলোনায় ফিরে আসার গুঞ্জন মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। কয়েকেদিন আগে বার্সেলোনার স্পোর্টিং ডিরেক্টর এরিক আবিদালসহ বার্সেলোনার বোর্ডের দু-একজনের প্যারিসে গিয়ে পিএসজির সাথে আলোচনা করে আসা সবকিছু যেন উসকে দেয়। কিন্তু কোনো সম্মতিতে পৌঁছানো তাদের দ্বারা সম্ভব হয়নি। গুঞ্জন আছে যে নেইমারের জন্য কৌতিনহো+রাকিতিচ+১০০ মিলিয়নের প্রস্তাব ছিল বার্সেলোনার যা পিএসজি নাকচ করে দেয়। একদিক দিয়ে তাতে ভালোই হল বার্সেলোনার । এখন হয়তো তারা এই অসম্ভব এবং অলাভজনক দলবদল থেকে সরে এসে নতুন মৌসুমের দিকে পুরোপুরি মনোযোগ দিতে পারবে।

images                       শেষের দু'লাইন পড়ে পাঠক আপনার ভ্রূ হয়তো কুঁচকে উঠল। অসম্ভব না হয় বুঝা গেল। কিন্তু এমএসএন - এর সেই সর্বজয়ী, সর্বগ্রাসী এবং সর্বকালের অন্যতম সেরা আক্রমণ ত্রয়ীর ফিরে আসার সম্ভাবনা যেখানে তৈরি হচ্ছে সেটা বার্সেলোনার জন্য অলাভজনক কেন হবে? একটু খতিয়ে বিশ্লেষণ করলেই ব্যাপারটা সবার কাছেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। একজন বার্সেলোনা ভক্তের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি বা নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, উভয়েই এই দলবদলের বিরুদ্ধেই আপনার মনকে উসকে দিতে পারে ।

                    প্রথমে সংক্ষেপে একটু অসম্ভবের বিষয়টা তুলে ধরি। নেইমার যাওয়ার পর বার্সেলোনা ৩০০ মিলিয়নের উপরে খরচ করে ডেম্বেলে ও কৌতিনহোকে কিনে আনে। এরপর এই ফেব্রুয়ারিতে ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ংয়ের সাথে চুক্তি করে এই উইন্ডোতে ৭৫ মিলিয়নে দলে ভেড়ায়। আবার এই মৌসুমেই গ্রিজম্যান যোগ দেয় ১২০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে । এর বিপরীতে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে কোনো খেলোয়াড়কে তারা বিক্রি করেনি। এই অবস্থায় নেইমারকে কিনে আনা যাকে তার দল অন্তত ২০০ মিলিয়নে মূল্যায়ন করে অসম্ভবই ( যদি আপনি দার্শনিক হয়ে 'নাথিং ইজ ইম্পসিবল' কথাটায় অতিরিক্ত বিশ্বাসী না হন তাহলে)। আর যদি কিনে আনাও যায় তাহলেও এফএফপি আইন ভঙ্গের কারণে বড় ধরনের শাস্তির সম্মুখীনও হতে পারে তাদের। 

                        তাহলে হয়তো কিছুটা বুঝে গেছেনও আর্থিকভাবে কতটা অলাভজনক এই দলবদল বার্সেলোনার জন্য । কিন্তু খেলাটা তো মাঠে । সেই মাঠের খেলায় তো বার্সেলোনার সুবিধাটা হবেই - এই প্রশ্নও জাগতেই পারে। বার্সেলোনায় চার মৌসুমে নেইমারের পরিসংখ্যান এবং এমএসএন এর বিধ্বংসী রূপ দেখার পর এরকম চিন্তা কারো মাথায় আসলে তাকে দোষ দেওয়াও যায় না। কিন্তু নেইমার বার্সেলোনাতে আসলে বার্সেলোনার ফরোয়ার্ড সংখ্যা দাঁড়াবে সাতজন (মেসি, সুয়ারেজ, ডেম্বেলে, গ্রিজম্যান, রাফিনহা, পেরেজ, নেইমার)। কোচ এর্নেস্তো ভালভের্দেকে যদি ভুল না চেনা হয় , তার মেন্টালিটি পড়তে যদি ভুল না হয় তাহলে এতজন সুপারস্টারকে বেঞ্চে রাখার মত কোচ তিনি না। ফলে তিনি অবশ্যই দলকে খেলাবেন ৪-২-৩-১ ছকে যেখানে মিডফিল্ডার মাত্র দুইজন । ২০০৮-২০১৩ বার্সেলোনার এই স্বর্ণযুগে তাদের খেলাটা হত মিডফিল্ড থেকেই। মিডফিল্ডকে শক্তিশালী রেখে সেখান থেকেই খেলাটা নিয়ন্ত্রণ করে খেলাটাকে নিজেদের হাতের মুঠোয় করে ফেলত এবং প্রতিপক্ষের নাভিশ্বাস ছুটিয়ে দিত। এই দর্শন থেকে বার্সেলোনা সরে আসে টিটো ভিলানোভার আকস্মিক মৃত্যুর পরেই। এরপর সব কোচেরই প্রতিনিয়ত মুন্ডুপাত হয় বার্সেলোনাকে ঐ দর্শনে না খেলানোর জন্য । অবশেষে ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং এবং আর্থারকে একসাথে দলে পেয়ে বার্সেলোনার ভক্তরা হয়তো আবার নতুন করে সেই পুরনো দিনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করছে। কিন্তু নেইমারকে কেনা এই স্বপ্ন ভেঙে দেওয়ার ফ্রি লাইসেন্স ছাড়া আর কিছুই হবে না।

                     তবুও হয়তো তর্ক থাকতে পারে ট্যাকটিক্যাল দিক দিয়ে এই সমস্যাকে উতরে যাওয়ার । কিন্তু সেখানেও থাকে বাধা। সুয়ারেজ এবং মেসি বয়সের ভারে এবং স্বভাবের বশে খুব একটা বেশি নিচে নামেন না। নিচে না নামার প্রবণতা নেইমারেরও অনেক বেশি । গ্রিজম্যানেরও ঠিক তেমনই । এ অবস্থায় যদি চারজনের কেউই ফলব্যাক না করে ( যেটা হবার সম্ভাবনাই বেশি ) তাহলে তা দুইজন মিডফিল্ডারের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে যা মিডফিল্ডকে প্রতিপক্ষের কাছে এক্সপোজ করে দিবে। ফলশ্রুতিতে এমনিতেই নাজুক এক ডিফেন্সকে ভেঙে দেওয়া প্রতিপক্ষ স্ট্রাইকারদের জন্য 'ডালভাত' হয়ে দাঁড়াবে যা মোটেই কারোর জন্যই সুখকর হবে না। লুইস এনরিকের সময়ে যখন এই এমএসএন ত্রয়ী ছিল বার্সায় তখনো তাদের মধ্যমাঠের এই দুর্লতা চোখে পড়ত স্পষ্ট । মাঝমাঠের সাথে আক্রমণভাগের সমন্বয়টা ছিল মরীচিকা । রক্ষণভাগের সাথে সমন্বয়টা খুঁজে পাওয়া ছিল দুষ্কর। এমএসএন এর দুর্দান্ত নৈপুণ্যে এক মৌসুম হয়তো সেটা ঢাকা পড়ে । কিন্তু পরবর্তী মৌসুমগুলোতে বার্সাকে ভুগতে হয় অনেক।

                     তবুও একটা যুক্তি থেকেই যায় সকলের কাছে। তাহল এমএসএন এর বিগত সফলতা। কিন্তু তাতে বার্সেলোনার সাফল্য কতটুকু ছিল তাও একটু মেপে দেখা প্রয়োজন । এমএসএন এর তিন মৌসুমের প্রথম মৌসুমে বার্সেলোনা ট্রেবলসহ পাঁচ ট্রফি জিতে। সত্যি । কিন্তু এরপর? পরবর্তী দুই মৌসুমেই তাদের চ্যাম্পিয়নস লীগের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বাদ পড়তে হয়। বিশেষত তাদের শেষ মৌসুমটা ছিল যাচ্ছেতাই যেখানে তারা লীগ, চ্যাম্পিয়নস লীগ কিছুই জিততে না পারার ব্যর্থতার সঙ্গী করে নিয়ে আসে সিটির মাঠ থেকে ৩-১ , পিএসজির মাঠ থেকে ৪-০ এবং জুভেন্টাসের মাঠ থেকে ৩-০ গোলে হারের লজ্জা। যে মৌসুমে তারা ট্রেবল জিতে সেবার স্প্যানিশ সুপার কাপেও তারা বিলবাওয়ের মাঠে ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত হয়। আবার উয়েফা সুপার কাপ জিতলেও ৪-১ এ এগিয়ে থাকার পরেও সেভিয়াকে তারা ৪-৪ এর সমতায় ফিরে আসতে দেয়। এসবই ছিল সেই ছন্নছাড়া মাঝমাঠের ফল যার মূল কারণ ছিল এই এমএসএন এর কারোরই রক্ষণে সাহায্য না করা বা মাঝমাঠের সাথে সমন্বয় না গড়া। আর এখন আমরা আরো দুর্বল এক মাঝমাঠের কথা বলছি যেখানে এমনকি ইনিয়েস্তাও নেই। তাই এমএসএন সফল হলেও এমএসএন এর সময় বার্সেলোনা কতটা সফল তা ভাববার বিষয়। 

                    নেইমারকে বার্সেলোনা ফিরিয়ে আনতে চায় চ্যাম্পিয়নস লীগে সাফল্য পেতে। কিন্তু নেইমার যে চার মৌসুম বার্সায় ছিল সেখানেও তো তারা তিনবার কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বাদ পড়ে। আবার নেইমার থাকা অবস্থায় বার্সেলোনা দু'বার লীগ জিততেও ব্যর্থ হয় যেখানে তারা গত ১১ বারের মধ্যে আটবার লীগ জয়ী। তাহলে? তখন নেইমার ছিল বিশ্বের তৃতীয় সেরা ফুটবলার । কিন্তু এখন তার ফর্ম অনেকটাই পড়তির দিকে। গত বিশ্বকাপে তার পারফরমেন্স সেই সাক্ষ্যই দেয়। তার উপর সুয়ারেজেরও গত দুই মৌসুম অফ ফর্ম এবং বয়সটাও তার জন্য থেমে নেই। তাই এমএসএন ত্রয়ী আবার ফিরে আসলেও সফল হবার সম্ভাবনা কমই। আবার যোগ হয়েছে তার ইন্জুরী প্রবণতা। আর অফ দ্যা ফিল্ড নানা কারণে বারবার সমালোচনার মুখে তো আসছেনই। আবার দুই বছর পর যখন মেসি-সুয়ারেজরা থাকবেন না তখন তিনি আর গ্রিজম্যানই হয়তো বার্সাকে নেতৃত্ব দিবেন। দুজনেই সবসময় স্পটলাইটটা নিজেদের উপরেই রাখতে চান। তাই তখন এত বড় দুটো ইগো বার্সার ড্রেসিংরুম সামলাতে পারবে কিনা সেটাও সমর্থকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দেয়। আর তার উপর কয়েকদিন পর পর নেইমারের বাবার নানা নাটক পরিস্থিতিকে অস্থির করে তোলার জন্য তো আছেই। এতসব ঝুঁকি নিয়ে নেইমারকে বার্সেলোনায় নিয়ে আসা তো অলাভজনকই। তাই নেইমারের বার্সেলোনায় ফিরে এসে বার্সেলোনার স্বর্ণালী দিনগুলো ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখাটা এক মরীচিকা ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না আমার কাছে।