অমল মজুমদার- এত কাছে তবু এত দূরে
পোস্টটি ১৪৭৫ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।
ব্লগের নীতিমালা
ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
এক রঞ্জি হিরো। কিন্তু তার নামের পাশেও যুক্ত হওয়ার কথা ছিল কিংবদন্তী কিংবা রথী-মহারথী এসব শব্দমালা। ভাগ্যের পরিহাস আর ভুল যুগের সারথি ছিলেন কিনা - তাই তার নামের পাশে শুধুই দীর্ঘশ্বাস আর আক্ষেপ ঝরে। কিংবদন্তী শচীন টেন্ডুলকার আর প্রতিভার নিদারুণ অপচয় করা বিনোদ কাম্বলির সাথে একই স্কুলের ক্লাসমেট ছিলেন তিনি। ক্রিকেট গুরু হিসেবেও পেয়েছিলেন শচীন, কাম্বলি'র গুরু রমাকান্ত আর্চেরেকারকে।
১৯৮৮ সালে বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) হ্যারিস শিল্ড ইন্টার স্কুল টুর্নামেন্ট চলতেছিল। ১৩ বছরের দুটো ছেলে শচীন টেন্ডুলকার এবং বিনোদ কাম্বলি শারদাশ্রম বিদ্যামন্দির উচ্চ বিদ্যালয়ের হয়ে তৃতীয় উইকেট জুটিতে ৬৬৪ রানের পার্টনারশিপ গড়ে চারদিকে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন। তখনকার সময়ের দুই অখ্যাত ছেলের স্কুল ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের জুটি হঠাৎ করে দুজনের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।
ঠিক ওই জুটির সময়ে স্ট্যান্ড থেকে খানিক দূরে ১৩ বছরের আরেকটা ছেলে ওয়ার্মিং করছেন, নেট প্র্যাকটিস করছেন ব্যাট প্যাড পড়ে রেড়ি হয়ে দুইদিন 'অপেক্ষা' করছিলেন পরবর্তী ব্যাটসম্যান হিসেবে ব্যাট করতে নামার জন্য। কিন্তু তার সেই 'অপেক্ষার' পালা শেষ হয়নি আর ব্যাটিংয়েও নামা হয়নি সেই ম্যাচে। দল যখন ইনিংস ঘোষণা করে তখনো যে শচীন-কাম্বলি অপরাজিত। ক্যারিয়ার জুড়ে 'অপেক্ষার' সাথে বন্ধুত্ব করা সেই ছেলেটি আর কেউ নন আজকের গল্পের নায়ক অমল অনিল মজুমদার। যে 'অপেক্ষা' শব্দটি অমল মজুমদারের সারাজীবনের আক্ষেপ হয়ে থেকেছে।
যখন শচীন, কাম্বলী ভারতের হয়ে খেলছেন অমুল মজুমদারের ক্যারিয়ার তখনো ওই হ্যারিস শিল্ড ইনিংসের মতোই ব্যাট, প্যাড পড়ে রেড়ি হয়ে সাইডলাইনে বসে আছেন শুধু একটি সুযোগের অপেক্ষায়। কিন্তু সেই সুযোগ একবারও ধরা দেয়নি। কারো কারো ভাগ্যে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো অপশনই হয়তো থাকে না! সারা জীবন তাই অপেক্ষা করেই কাটাতে হয়েছে অমল মজুমদারকে।
পাঁচ বছর পরে ১৯৯৩-৯৪ মৌসুমে রঞ্জি ট্রফিতে ফরিদাবাদে হারিয়ানার বিপক্ষে বোম্বের হয়ে (বর্তমান মুম্বাই) অভিষেকে ২৬০ রানের এক জ্বলজ্বলে ইনিংস খেলেন অমল। যে ইনিংসে ফুটে উঠেছিল অমলের বড় ইনিংস খেলার ক্ষমতা, ব্যাটিংয়ের সময় শতভাগ মনোযোগী অমলের বৈশিষ্ট্য। যেটি প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে যেকোনো ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ রানের স্কোর হয়ে টিকেছিল পঁচিশ বছর। অবশ্য ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অজয় রোহেরা সেই রেকর্ডটি ভেঙ্গে দেন।
১৯৯৪ সালে ভারত অনূর্ধ্ব ১৯ দলের হয়ে ইংল্যান্ড সফরে সহকারী অধিনায়কের দায়িত্ব পান অমল। তখন থেকে তাকে মনে করা হচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেটের 'ভবিষ্যত তারকা' হিসেবে এবং গায়ের সাথে সেঁটে গিয়েছিল 'নতুন টেন্ডুলকার' তকমাও। সে সফরে সেঞ্চুরী করা অমলকে নিয়ে বলতে গিয়ে তখনকার ভারত অনূর্ধ্ব ১৯ দলের কোচ সাবেক ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটার সন্দীপ প্যাটেল বলেন -
"এখন চারদিকে মানুষজন তাকে নিয়ে প্রচুর কথা বলবে, এটা অমলের মধ্যে একটা ভুল আত্মবিশ্বাসের বীজ বপন করতে পারে"।
ক্যারিয়ারজুড়ে অমল সেটা ভুল প্রমাণ করেছেন।
ম্যানেজার ভিক্রাম দাসগুপ্ত বলেন -
"হি ইজ অ্যা টেস্ট প্রসপেক্ট"।
সকল প্রকার ব্যাটিং মেধা এবং ট্যাকনিক থাকা স্বত্বেও অমল মজুমদার আটকা পড়ে গিয়েছিলেন সময়ের মারপ্যাঁচে। এমন সময়ে এসে ক্যারিয়ার পড়েছিল যখন ভারতীয় ক্রিকেট তথা ভারতের মিডলঅর্ডার রাজ করতে অপেক্ষা করছিলেন রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষ্মণ, সৌরভ গাঙ্গুলিরা। একই স্কুল দলে শচীন, কাম্বলির পর এবার অমলের কপাল পুড়ল রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষ্মণ আর সৌরভ গাঙ্গুলিতে। বলা হচ্ছিল, ১৯৯৫ সালে এই তিন বর্তমান মহারথীর সাথে মিডলঅর্ডারের চিন্তায় ভারত এ দলের হয়ে ইংল্যান্ড সফরে সুযোগ পান অমল মজুমদার।
ভারতীয় মিডল-অর্ডারের দুই আস্থা রবী শাস্ত্রী এবং নভোজিত সিং সিধু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণ করার পর মিডল-অর্ডারে জায়গা ফাঁকা হয়। সেজন্য ১৯৯৫-৯৬ দুলীপ ট্রফিকে ভাবা হচ্ছিল জায়গাগুলো পূরণ করার অডিশন হিসেবে। যেখানে সবাইকে অবাক করে ভিভিএস লক্ষ্মণ ৩৯৫ রান করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন। দ্বিতীয় রাহুল দ্রাবিড় করেন ৩৫৩ রান, একটি দ্বিশতকসহ তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক অমল মজুমদার করেন ৩৩৩ রান। পঞ্চম স্থানে থাকা সৌরভ গাঙ্গুলি করেন ৩০৮ রান। কিন্তু একে একে সবাই সুযোগ ফেলেও অমল থেকে গেলেন 'অপেক্ষায়'।
ট্যাকনিক, লম্বা সময় ব্যাটিং করার প্রজ্ঞা, ধৈয্য সবমিলিয়ে ব্যাটিংয়ের একটা দারুণ প্যাকেজ ছিলেন অমল মজুমদার। কখনো কখনো তারছেঁড়া ডিফেন্স আবার কখনো কখনো জ্বলজ্বলে স্ট্রোকপ্লে তবে একটা জায়গায় তিনি অনন্য। ব্যাটিংয়ে ডিফেন্সের সাথে ধৈর্য্যের অনন্য নিদর্শন ছিলেন অমল মজুমদার। জনৈক ইংলিশ রিপোর্টার মজুমদারের ডিফেন্স সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন -
"এমসিসি অ্যাপ্রুভড ডিফেন্স"।
মুম্বাই ক্রিকেট অমল মজুমদারের রক্তের সাথে জড়িয়ে ছিল। এক সাক্ষাৎকারে মুম্বাই ক্রিকেট নিয়ে বলতে গিয়ে বলেন -
"মুম্বাই ক্রিকেট ইজ এন এডিকশন ফর লাইফ"।
মুম্বাই -য়ের হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে ১৫ সিজন খেলেন তিনি। ২২ সেঞ্চুরীর সাথে ৫০ হাফসেঞ্চুরি সহ করেছেন ৮৭৬৯ রান। এ সময়ে মুম্বাইয়ের হয়ে সাতটি রঞ্জি ট্রফি জিতেন অমল মজুমদার। সবমিলিয়ে ১৭১ ফাস্ট ক্লাস ম্যাচে ৪৮.১৩ গড়ে ১১১৬৭ রান করেছেন তিনি। ৩০ সেঞ্চুরীর পিঠে ৬০ টি হাফসেঞ্চুরি সর্বোচ্চ স্কোর ২৬০ রান। লিস্ট 'এ' তে ১১৩ ম্যাচে ৩৮.২০ গড়ে করেছেন ৩২৮৬ রান। ২৬ হাফসেঞ্চুরির পিঠে ৩ টি সেঞ্চুরি সর্বোচ্চ স্কোর ১০৯ রান। ১৪ টি টোয়েন্টিতে ১৯.৩৩ গড়ে করেছেন ১৭৪ রান হাফসেঞ্চুরি রয়েছে ১ টি।
এক সাক্ষাৎকারে নিজের পুরনো দিনের আলোচনায় অমল মজুমদার বলেন -
"আমার একমাত্র লক্ষ্য রান করা। নব্বইয়ের দশকে যা ঘটেছিল, যে আমাকে বাছাই করে নি, যে আমাকে অগ্রাহ্য করেছে.... এসব কোন কিছুই আমার মাথায় থাকে না যখন আমি মাঠে পারফর্ম করতে নামি"।
প্রতিভা স্বত্বেও প্রতিভায় পরিশ্রমের দাগ লাগাতে না পারার অবহেলায় কত প্রতিভাবান অকালে হারিয়ে যায়। তারা নিজেরা ব্যর্থ হয় প্রতিভাকেও অঙ্কুরে -ই বিনষ্ট করে। অমলকে আপনি সেই দলে ফেলতে পারবেন না। অমল প্রতিভা আর নিজের চেষ্টায় অপেক্ষা করে গেছেন। স্রেফ সময়ের মারপ্যাঁচে বাঁধা পড়ে গিয়েছিলেন বলে ব্লু জার্সিটা গায়ে জড়াতে পারেন -নাই অমল মজুমদার। সফল তো তারাই যারা চেষ্টার দ্বার খোলা রেখে প্রতিনিয়ত স্বপ্নকে তাড়া করে। অমল মজুমদার তাদের -ই একজন ছিলেন।
ReplyForward
|
- 0 মন্তব্য