• ফুটবল

মারাকানা যেদিন আর্জেন্টিনাকে কাঁদাল

পোস্টটি ২২৫৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

আটাশ বছর আগে অ্যাজটেক স্টেডিয়ামে ছাব্বিশ বছরের এক ফুটবল ঈশ্বরের সোনালি ট্রফিটায় চুমু খেয়ে বিজয়োল্লাসের স্মৃতিটা ততদিন ধূলাচ্ছন্ন। সে স্মৃতিটাকে আবারো রাঙিয়ে তোলার দায়িত্ব আসল সাতাশ বছরের এক ক্ষুদে জাদুকর আর ত্রিশ বছরের এক অভিজ্ঞ সেনাপতির ঘাড়ে। রিও ডি জেনিরোর মারাকানা স্টেডিয়াম সেজন্যেই প্রস্তুত ছিল। কিন্তু মারাকানা স্টেডিয়াম ফুটবলীয় ট্র্যাজেডির জন্য বিখ্যাত । আকাশি নীল সৈন্য সেদিন যুদ্ধে নামল গাঢ় নীল পড়ে। প্রতিপক্ষ ছিল আগের দুই বিশ্বকাপে তাদেরকে কাঁদানো জার্মানি। হিগুয়েইনের সুযোগ ছিল বুরুচাগা হওয়ার । কিন্তু ন্যয়ারকে একদম একা পেয়েও তিনি বুরুচাগা হওয়ার ধারেকাছে দিয়েও যেতে পারলেন না। পরে ক্ষণিকের জন্য তিনি ঠিকই হলেন। পুরো মারাকানা স্টেডিয়ামকে উদ্বেলিত করলেন। পুরো বিশ্বের আর্জেন্টাইন সমর্থকরা উল্লাসে মেতে উঠল। কিন্তু তা ক্ষণিকের জন্যেই । লাইন্সম্যানের উত্তোলিত পতাকা সেদিন আকাশি নীল সৈন্যদের বুকে প্রথম তীর ছিল।

এরপর সেই ক্ষুদে জাদুকর নিজেও সুযোগ পেলেন। বলটা আর ছয় ইঞ্চি অন্যদিকে বাঁক নিলেই তিনি তার ক্যারিয়ারে সৃষ্টিকর্তার একমাত্র বঞ্চিত আশীর্বাদটি লাভ করতেন। কিন্তু সব আশা পূরণ হয়না। যার জন্য তিনিও পারলেন না। পারলেন না বদলি নামা প্যালাসিওও। কিন্তু জার্মানির দুই বদলি সুযোগ হাতছাড়া করেননি। শ্যুরলের ক্রস বুক দিয়ে রিসিভ করলেন গোটজে যার মাথায় হয়তো তখন ঘুরছিল তাকে মাঠে নামানোর সময় তার কোচের একটাই অনুপ্রেরণা " দেখিয়ে দাও সবাইকে যে তুমি মেসির চেয়েও সেরা।" সে জোরেই তিনি শূন্যে ভেসে পুরো বিশ্বকাপ জুড়ে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা আর্জেন্টিনার ডিফেন্সকে ফাঁকি দিয়ে সেমি-ফাইনালের নায়ক রোমেরোর পাশ কাটিয়ে বল জালে জড়ালেন। আর্জেন্টিনার প্লেয়ার কোচ সমর্থকদের হৃদয় ক্ষত বিক্ষত করে দিলেন বাঁ পায়ের লক্ষ্যভেদী গোলায়। মেসির চেয়ে সেরা হয়তো তিনি হননি। কিন্তু ফুটবল ইতিহাসের পাতায় নিজের নামটা আটকে রাখলেন ঠিকই ।

না। তারা পারলেন না। লিওনেল মেসি গত বারো বছরে ২০১৪ সালেই বার্সেলোনার হয়ে একমাত্র ট্রফিবিহীন মৌসুম পার করেন। সে দুঃখ ঘুচানোর চেষ্টায় এত কাছে গিয়েও শূণ্য হাতে ফিরতে হল। তাঁর ক্যারিয়ারে ২০১৪ কখনোই মনে রাখতে চাইবেন না তিনি, কিন্তু এটাকে তিনি ভুলতেও পারবেন না। তাঁর চার গোল, এক অ্যাসিস্ট মূল্যহীন হয়ে রইল। শুধু তাই না। আর্জেন্টিনার বিখ্যাত নড়বড়ে ডিফেন্সকে দুর্ভেদ্য বানানোতে নেতৃত্ব দেওয়া মাশ্চেরানোর দুর্দান্ত পারফরমেন্সও ফলহীন। সেমি-ফাইনালে তার মাথায় ব্যান্ডেজ দিয়ে লড়ে যাওয়া, রোবেনকে করা সেই ম্যাচ বাঁচানো ট্যাকল, হাতে আঘাত পাওয়ার পরও জাবালেতার হাত বেঁধে খেলা, বা রোমেরোর টাই-ব্রেকার বীরত্ব। সবই শেষ পর্যন্ত মূল্যহীন।

২০১৪ বছরটা ডি মারিয়াকে দু'হাত ভরে দেয়। কিন্তু আরেক হাত দিয়ে আবার সব কেড়ে নেয়। মারাকানা থেকে তিনি আগেই ছিটকে যান। বিশ্বকাপও তার হাত থেকে সরে যায়। ১৯৯০ এর পর প্রথমবার আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ সেমি-ফাইনালে উঠানো গোলটা করার পরেও মারাকানা হিগুয়েইনকে আর্জেন্টিনার ফুটবলে চিরদিনের জন্য খলনায়ক বানিয়ে দেয়।

ডিমারিয়া তাও চ্যাম্পিয়নস লীগ পান। জাবালেতা তাও প্রিমিয়ার লীগ জিতেন মেসির তাও প্রাপ্তি ছিল। গোল্ডেন বলটা তিনি পান। কিন্তু মাশ্চেরানো? ২০১৪ তাকে কিছুই দিল না। তাকে একরাশ হতাশা বাদে মারাকানা সেদিন কিছুই দিতে পারেনি। আর্জেন্টিনার অন্যতম সেরা কিংবদন্তী হবার দ্বারপ্রান্তে এসে তারা দুজন আন্ডাররেটেড কিংবদন্তী হয়েই রইলেন। অ্যাজটেক স্টেডিয়ামে ম্যারাডোনার সেই উল্লাসকে ফিরিয়ে আনতে গিয়েও তাই একটি আহত দৃষ্টিতে ট্রফিটার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার থাকল না। এরপরের দুই বছরেও বছরের ঠিক এই সময়টাতেই তারা অন্তত দেশের হয়ে কিছু জেতার সুযোগ পায়। ভিন্ন বছর, ভিন্ন মূহুর্ত, ভিন্ন প্রতিপক্ষ, ভিন্ন দেশ, এমনকি ভিন্ন মেসিও। সবই ভিন্ন । কিন্তু বদলানো না শুধু একটি জিনিস। ২০১৪ এর মতো ২০১৫ এবং ২০১৬ তেও তাদের একমাত্র আক্ষেপ ছিল আর্জেন্টিনার হয়ে একটি ট্রফি জয়।

যেটা বলেছিলাম । মারাকানা ফুটবল ইতিহাসে ট্র্যাজেডির জন্য বিখ্যাত । তাই হয়তো মেসির ইতিহাসের নিরঙ্কুশ শ্রেষ্ঠত্ব সেদিন বাধা পড়ে যায়। ফুটবলের অন্যতম মহানায়কের আক্ষেপকে সঙ্গে করেই সেটা রয়ে গেল। ১৯৫০ সালে এই স্টেডিয়ামেই আলসিদেস ঘিগিয়ার গোল পুরো ব্রাজিলকে কাঁদায়। আর ২০১৪ তে আবার যখন বিশ্বকাপ মারাকানায় ফিরে এলে সেখানে মারিও গোটজের গোল তখন তা পুরো বিশ্বকে কাঁদায়। পুরো না হলেও অন্তত অর্ধেক বিশ্বকে তা কাঁদিয়ে যায়। যে অর্ধেক সেদিন মেসির হাতে ট্রফিটা দেখতে চাইত।