• ক্রিকেট

পাইরেটস অব দ্যা ক্যারিবিয়ানঃ ভয়ংকর সুন্দর

পোস্টটি ২৪৬৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

১১৭ দিনের দীর্ঘ সময় পরে ৮ জুলাই ক্রিকেট ফিরেছে সবুজ গালিচায়৷ ক্যারিবিয়ানরা মুখোমুখি হলো গ্রেট ব্রিটেনের। বৃষ্টিভেজা আবহাওয়ায় ব্যাটিং নিয়ে এক মহাভূলই করলো ইংরেজ কাপ্তান বেন স্টোক্স। আর এইদিকে আবহাওয়ার সম্পূর্ণ সুবিধা নিয়ে একে একে তাদের ব্যাটিং লাইন-আপকে রীতিমতো ধ্বসিয়ে দিলো ক্যারিবীয় বোলিং লাইন-আপ। হোল্ডার, গ্যাব্রিয়েল, রোচ, জোসেফের গতি রীতিমতো কাঁপিয়ে দিয়েছে এককালে বিশ্বশাসন করা ব্রিটিশ মল্লুকের ক্রিকেটারদের। চতুর্থ ইনিংসে ২০০ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে চেজ আর ব্ল্যাকউডের পার্টনারশিপ ম্যাচ জিতিয়ে আনে ক্যারিবীয়দের। আহ টেস্ট! যেন এক ভয়ানক ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠলাম। ক্যারিবিয়ানদের বোলিং দেখার সময় মনে পড়ে গিয়েছিলাম সত্তর আশির দশকে। আহ! উইন্ডিজ যেনো ফাস্ট বোলার তৈরীর কারখানা। আবার যেমন এমন ফাস্ট বোলার না। একদম জেনুইন ফাস্ট বোলার। যাদের বোলিংয়ের গতিতে বিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানদের হাঁটু কাপতো। যাদের বোলিং ক্যাপাবিলিটি উইন্ডিজকে বানিয়েছিলো মহাপরাক্রমশালী।

শুরুটা হয়েছিলো লিয়েরি কনস্টেনটিনের সময় থেকে। কনস্টেনটিন, জর্জ ফ্রাঙ্কিস, হারমান গ্রিফিথ এরপর ম্যানি মার্টিনডেল, লেসলি হিলটন, হিলস জনসন, ওয়েজ হল, চার্লি গ্রিফিথ হয়ে এন্ডি রবার্টস, মাইকেল হোল্ডিং, জোয়েল গার্নার এবং কলিন ক্রফটের চতুর্মুখি বোলিং আর তারপর ম্যালকম মার্শাল, কোর্টনি ওয়ালশ এবং কার্টলি এমব্রোশ। আর হালের রোচ, গ্যাব্রিয়েলন,জোসেফ এরাতো আছেই। এ যেন এক মনস্টারাস ফাস্ট বোলিংয়ের কারখানা।

কনস্টানটিন ছিলেন তার সময়ের সবচেয়ে দ্রুতগতির বোলার। ১৯৩০-৩১ সালে হারম্যান গ্রিফিথ ডন ব্র‍্যাডম্যানকে ০ রানে আউট করার পর হয়ে উঠেন উইন্ডিজের মুখের নাম। আর ১৯৫৮-৫৯ ভারত সিরিজে রয় গিলক্রিস্ট সেই সময়কার অন্যতম দ্রুতগতির বোলার হিসেবে দাঁড় করান। হল আর গ্রিফিথ জুটির সামনে ৭০ থেকে ৮০ দশকে নামা ব্যাটসম্যানরা নিজেদের দূর্ভাগা মনে করতেন। তারপর চারজন দানব রাজত্ব করে সেই সময়ের ক্রিকেটে। এন্ডি রবার্টস, মাইকেল হোল্ডিং৷ জোয়েল গার্নার আর কলিন ক্রফট; চারজনই ছিলেন ছয় ফুটের অধিক লম্বা। যার মাঝে একজন ছিলে ৬ফুট ৭ ইঞ্চি আরেকজন ৬ফুট ৮ ইঞ্চি। গতির সাথে বিভিন্ন বোলিং স্কিল মিলিয়ে নিজেদের রীতিমতো মনস্টার বানিয়েছেন বিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানের কাছে। চলুন আজকে ঘুরে আসি সেই বিখ্যাত ক্যারিবিয়ান পেস ব্যাটারির রাজ্য থেকে।

স্যার ওয়েসলি উইনফিল্ড হলঃ “ ওয়েস, মনে রেখো, তুমি যদি নো-বল ছুঁড়ো, তাহলে তুমি কখনো বার্বাডোস যেতে পারবেনা!"- ফ্রাঙ্ক ওরেল।

১৯৬০ সালের বিখ্যাত 'টাই টেস্ট' এর কথা মনে আছে। ইতিহাসে প্রথম কোনো টেস্ট সেদিন টাই হয়। ম্যাচের শেষ ওভার বোলিং করতে আসেন ওয়েস হল। সেই ওভারে অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন ছিলো মাত্র ৬ রান। অর্থাৎ, ৬ বলে ৬ রান লাগবে জিততে হাতে তিন উইকেট। পাঁচ বলে দুই উইকেট তুলে নেন তিনি এবং শেষ বলে লিন্ডসে ক্লাইনকে আউট করে অজিদের অল-আউট করে দেয় উইন্ডিজ ও ম্যাচ টাই হয়। সেই ম্যাচে ওয়েস হল নেন ৯ উইকেট তিনি। ৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার এক অতিকায় মানব বাইশ গিজে গতির ঝড় তুলতেন৷ তার সময় দুইটা ডেডলি ডুয়ো সৃষ্টি হয়। তিনি এবং রয় গিলক্রিস্ট প্রথমে। এরপর তিনি এবং চার্লি গ্রিফিথ। ওয়েস হল এবং চার্লি গ্রিফিথ নিজেদের বিশ্বের সেরা ফাস্ট বোলিং ডুয়ো হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। একসাথে ৪৮ টেস্টে দুইজন মিলে নিয়েছেন ১৯২ উইকেট, এভারেজ ২৬.৩৮।

চার্লস ক্রিস্টোফার চার্লি গ্রিফিথ ( মাস্টার অব লিথাল ইয়র্কার)ঃ- উইন্ডিজের ওয়ান অব দ্য ডেডলি বোলিং ডুয়ো এর অংশ ছিলেন তিনি। ওয়েস হলের সাথে এক হয়ে বাইশ গজকে ব্যাটসম্যানদের জন্য রীতিমতো নরক বানিয়ে ছেড়েছেন দুইজন মিলে।

১৯৬১-৬২ মৌসুমে বারবাডোজের বিপক্ষে খেলতে যায় ভারত। সেই সময় তার এক ডেডলি বাউন্সারে মাথার খুলিতে মারাত্মক আঘাত পান ভারতীয় ব্যাটসম্যান নরি কন্ট্রাক্টর। মস্তিষ্কে প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হয় তার। পরবর্তীতে সুস্থ হয়ে উঠলেও কখনো আর ক্রিকেটে ফিরে আসেন নি সেই ভারতীয় ব্যাটসম্যান নরি কন্ট্রাক্টর। চার্লি গ্রিফিথ মোট ২৮টি আন্তর্জাতিক টেস্ট খেলেছেন আর এই ২৮ টেস্টে ২৮.৫৪ এভারেজে নিয়েছেন ৯৪ উইকেট৷ বোলিংয়ের পাশাপাশি তিনি ব্যাটিংয়ে পারদর্শীতা দেখানোয় তাকে 'চার্লি' ডাকনাম দেয়া হয়।

মাইকেল এন্থনি হোল্ডিং ( হুইস্পারিং ডেথ)ঃ- ঠান্ডা মাথায় ক্রিজে এসে নিজের ৬ ফুট ৩ ইঞ্চির উচ্চতাকে কাজে লাগিয়ে করতেন ডেডলি বাউন্সার। তার বোলিংয়ের স্টাইলের কারনে আম্পায়াররা তার নাম দেয় “ হুইস্পারিং ডেথ”।

প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের পর সেই উইন্ডিজ দলকে বলা হতো ক্লাইভ লয়েডের অপরাজেয় উইন্ডিজ। বিশ্বকাপ পরবর্তী সময়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট খেলতে নামে উইন্ডিজ। উইন্ডিজ ফাস্ট বোলার বার্নার্ড জুলিয়েন ফর্ম হারানোয় তার স্থলাভিষিক্ত হন মাইকেল হোল্ডিং। খেলতে নামেন এন্ডি রবার্টসের সাথে। এবং সে সময় তিনি বোল করেন প্রায় ৯৭ মাইল বেগে। তার বোলিং গতি নিয়ে উইজডেন বলে, “ হোল্ডিং নিজেকে রবার্টসের সমকক্ষ করে তোলার চেষ্টা করেছেন। তার বোলিং গতি থমসন, লিলি বা রবার্টসের থেকেও বেশি হতো অনেকসয়।”

১৯৭৬ এ উইন্ডিজ গিয়েছে ইংল্যান্ড সফরে। আর সেই সফরে দলে ছিলে হোল্ডিং। এমসিসির বিপক্ষে প্র‍্যাক্টিস ম্যাচে তার বলে ডেনিস এমিস মারাত্মকভাবে আহত হন এবং আঘাত পাওয়া জায়গায় সেলাইয়ের প্রয়োজ হয়। সেই সিরিজে ক্যারিবিয়ান বোলিং লাইন আপ পরিচালিত হয় রবার্টস, হোল্ডিং, ড্যানিয়েল ও হোল্ডার এর দ্বারা। উইজডেনের মতে সেই চারজনের মধ্যে ভয়ঙ্কর ফাস্ট বোলিং করতে মাইকেল হোল্ডিং। তার বোলিংয়ে ইংল্যান্ডের জন এডরিচ ও ব্রায়াম ক্লোজ আঘাতপ্রাপ্ত হয়। দ্য ওভালে ইংল্যান্ডকে তিনি একাই ধ্বসিয়ে দেন। ১৪৯ রানের বিপরীতে নেন ১৪ উইকেট। ক্যারিয়ারে ৬০টি আন্তর্জাতিক টেস্ট খেলেছেন তিনি। নিয়েছেন ২৩.৬৮ এভারেজে ২৪৯ উইকেট।

স্যার এন্ডারসন মন্টগোমারি এভারটন "এন্ডি" রবার্টসঃ উইন্ডিজের আধুনিক ফাস্ট বোলিংয়ের জনক বলা হয় এন্ডি রবার্টসের। সত্তরের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত চার বোলার পুরা ক্রিকেট বিশ্ব শাসন করেছে আর সেটা হলো সেই উইন্ডিজ ফিয়ারসাম ফোর মাইকেল হোল্ডিং, জোয়েল গার্নার, কলিন ক্রফট এবং এন্ডি রবার্টস। পরবর্তীতে তিনি তার বোলিং অভিজ্ঞতার ঝুলি দিয়েছে ওয়েম ড্যানিয়েল, কোর্টনি ওয়ালশ এবং কার্টলি এমব্রোশের হাতে।

টেস্ট ক্যারিয়ার শুরু আড়াই বছর পরে নিজের ১৯তম টেস্টে তিনি নিজের শততম উইকেট শিকার করেন। সত্তরের দশকের বিধ্বংসী বোলার হিসেবে নিজেকে এক অন্য পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন তিনি। তিনি তার ক্যারিয়ারে খেলেছেন ৪৭টি টেস্ট। আর এই ৪৭ টেস্টে তিনি নিয়েছেন ২০২ উইকেট। ব্যাট হাতেও কম যান নি তিনি। টেস্টে তিনটি হাফ সেঞ্চুরি রয়েছে তার পকেটে।

বাউন্সার দিয়েই উনি বিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানদের নাকানিচুবানি খাওয়াতেন। দুই ধরনের বাউন্সার দিতেন তিনি। প্রথমে তিনি একটি সহজ বল দিতেন যেটা ব্যাটসম্যান ইজিলি ফেস করতে পারতো। ব্যাটসম্যান আশায় থাকতো পরের বলও এমন আসবে। কিন্তু বিধিবাম, পরের বলটাই হতো এক বাউন্সার যেটিতে হয় ব্যাটসম্যান আউট হতো নাহলে ব্যাটসম্যান আঘাত পেতো। আর এরপরের বল আরো ভয়ঙ্কর গতির বাউন্সার, যেটিতে ব্যাটসম্যান তার কাছে পরাজিত হতে বাধ্য হতো।

জোয়েল 'দ্য বিগ বার্ড' গার্নারঃ ফিয়ারসাম ফোরের অন্যতম সদস্য ছিলেন জোয়েল গার্নার। এই ফিয়ারসাম ফোরের সময় টানা ১৫ বছর তারা কোনো টেস্ট হারেনি।

৬ফুট ৮ ইঞ্চি এর একজন ফাস্ট বোলার যখন তার সর্বোচ্চ গতিনিয়ে আপনার সামনে বোলিং করবে তখন কেমন হবে? নিজেকে অসহায় ভাবা ছাড়া কিছুই করার নাই। ইংলিশ কিংবদন্তি জিওফ্রে বয়কট, জোয়েল গার্নারের বোলিং নিয়ে বলেছিলেন, " তার বল খেলার সময় মনে হতো আকাশ থেকে বল পড়ছে। তার বলের লেংথ বোঝা ছিল প্রায়ই অসম্ভব।

১৯৭৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাইশ গজে রোলার কোস্টার চালান তিনি। এই ম্যাচে তিনি এক স্পেলেই নেন ৪ রানে পাঁচ উইকেট। তার এই ভয়ঙ্কর বোলিং উইন্ডিজকে এনে দেয় নিজেদের দ্বিতীয় শিরোপা। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত খেলা জোয়েল গার্নার ৫৮টি টেস্ট খেলেছেন, নিয়েছেন ২০.৯৮ গড়ে ২৫৯ উইকেট। ইয়র্কার, এক্সট্রা বাউন্স আর সুইংয়ের কম্বিনেশনে ওয়ানডেতেও রীতিমতো ভয়ানক ছিলেন তিনি। ৯৮ম্যাচে নিয়েছেন ১৪৬ উইকেট। ওয়ানডেতে ১০০ এর বেশি উইকেট পাওয়া বোলারদের মাঝে তার এভারেজ সবচেয়ে কম (১৮.৮৪)।

কলিন এভারটন হান্ট ক্রফটঃ এই ব্যাক্তি কোন হাতে বল গ্রিপ করে কোন হাতে বল করবে এইটা কেউই জানতো না। রান আপের সময় দেখবেন বল বাম হাতে নিয়ে রান আপ শুরু করেছে। কিন্তু বল ডেলিভারি করার সময় দেখবেন তিনি বল ছুড়ছেন ডান হাত থেকে। সেই সময় রাউন্ড দ্য উইকেটের সেরা বোলার বলা হতো এই কলিন ক্রফটকে৷

৭০ দশকের শেষার্ধে তিনি যুক্ত হয়েছেন ফিয়ারসাম ফোরে। ১৯৭৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের বিপক্ষে অভিষিক্ত হন তিনি। আর পাকিস্তানের বিপক্ষেই তিনি তার সেরা বোলিং ফিগার করেন, ৮/২৯। '৭৯ বিশ্বকাপে জয়ী উইন্ডিজ দলের প্লেয়ার ছিলেন তিনি। তিনি তার ছোট ক্যারিয়ারে মোট ২৭টি টেস্ট খেলেছেন। আর এই ২৭টেস্টে তিনি নিয়েছেন ১২৫ উইকেট! এভারেজ ২৩.৩০!! বুঝায় যাচ্ছে যে তার বিপক্ষে নামা ব্যাটসম্যানরা রীতিমতো দূর্ভাগ্যর শিকার হতো। ১৯৮২ সালে বর্ণবৈষম্যবাদজনিত কারণে আজীবন নিষিদ্ধ হন তিনি। আর কলিন ক্রফট ছিলেন সেই সময়কার সবচেয়ে আন্ডাররেটেড বোলার।

ম্যালকম ডেঞ্জিল 'ম্যাকো' মার্শালঃ প্রথম দেখায় যে কেউ ভাববে তিনি হয়তো একজন স্লো বোলার বা একজন ব্যাটসম্যান। উচ্চতার দিক দিকে অন্যান্য উইন্ডিজ বোলারদের থেকে খাটো হলেও বোলিংয়ে ছিলেন ভয়ংকর রকমের ফাস্ট।

ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট সিরিজের সময় উইন্ডিজের একটি দল যখন অস্ট্রেলিয়া খেলতে গিয়েছিলো। তখন আরেকটি দল প্রস্তুতি নিচ্ছিলো ভারত। আর সেই ভারত সফরে ডাক পান তিনি। ব্যাংকস ব্রিউয়েরির স্টোর রুমে কাজ করার সময় দলে অন্তর্ভুক্তির খবর শুনেন তিনি রেডিওতে। মজার বিষয় তখন তিনি জানতেন না ভারত কোথায়। ১৯৮৮ সালে ইংল্যান্ড সফরে যায় উইন্ডিজ৷ সেই সফরে ৪-০তে সিরিজ জিতে উইন্ডিজ। সেই সিরিজের জয়টা মূলত নির্ধারণ করে দেয় উইন্ডিজের বোলাররা। পুরো সিরিজে নেন ৩৫ উইকেট। সিরিজের তৃতীয় টেস্টে তিনি ভাঙা বাম হাত নিয়ে খেলতে নামেন, আর সেই ভাঙা হাত নিয়েই তিনি ৭ উইকেট নেন ২২ রান খরচায়৷

হাইটে ছোট হলেও দুর্দান্ত গতিতে বোলিং করতেন তিনি। ইনসুইং আউটসুইং দুইটাই বেশ ভালোভাবে করতে পারতেন। তবে তার বোলিংয়ের আসল অস্ত্র ছিলো বাউন্সার। তিনি ৮১টি টেস্ট ম্যাচ খেলেন আর সব মিলিয়ে নেন ৩৭৬ উইকেট, এভারেজ ২০.৯৪।

কোর্টনি ওয়ালশ 'দ্য জেন্টল জায়ান্ট'ঃ দীর্ঘদেহী ওয়ালশ ক্যারিয়ার শুরু করেন স্টক বোলার হিসেবে। ম্যালকম মার্শাল, জোয়েল গার্নার এবং পরবর্তীতে এমব্রোশের সাথে বোলিং জুটি গড়েন তিনি। লং রান আপ নিয়ে যখন ছয় ফুট ছয় ইঞ্চি উচ্চতার একজন বোলার যখন বোলিং করতে আসতেন তখন ব্যাটসম্যানের কি অবস্থা হতো চোখ বন্ধ করে কল্পনা করুন শুধু।

তিনি তার টেস্ট ক্যারিয়ারে ১৩২টি টেস্ট খেলেছেন। এবং নিয়েছে ৫৯২ উইকেট। এবং এরই সাথে তিনি কপিল দেবের রেকর্ড ভাঙেন। পরবর্তীতে ২০০৪ সালে এই রেকর্ড ভাঙেন অজি গ্রেট শেন ওয়ার্ন। টেস্ট ক্রিকেটের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলারের তালিকায় পঞ্চমে রয়েছেন তিনি। টেস্টের বাহিরে তিনি খেলেছেন ২০৫টি টেস্ট এবং নিয়েছেন ২২৭ উইকেট।

স্যার কার্টলি এলকন লিনওয়াল এমব্রোসঃ এগ্রেসন, স্পিড, সুইং আর হার্ড হিটিং ব্যাটিং মিলিয়ে এক পারফেক্ট প্যাকেজ ছিলেন স্যার কার্টলি এমব্রোস। একই জায়গায় কন্টিনিউয়াসলি বল করে ব্যাটসম্যানকে আনপ্লেয়েবল করে দিতো। তারউপর সেইম লেংথে বল করে সাডেন বাউন্সে নাকাল হতো ব্যাটসম্যানরা।

ছয় ফুট ৫ ইঞ্চি এর অধিক লম্বা উচ্চতার দুই বোলারের রান-আপ দেখলেই তো ব্যাটসম্যানদের কলিজার পানি শুকিয়ে যেতো। কোর্টলি ওয়ালশ আর কার্টলি এমব্রোস মিলে ফিয়ারসাম ফোর পরবর্তী সময়ে বাইশগজে ঝড় তুলেছেন।

স্বপ্ন দেখেছিলেন বাস্কেটবল বা ফুটবল প্লেয়ার হওয়ার। কখনও চিন্তাও করেননি যে তিনি একজন ক্রিকেটার হবেন। তবে তার মা ছিলো একজন ক্রিকেট ফ্যানাটিক আর এমব্রোসের ক্যারিয়ারের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিলো তার মা'র। ১৯৮৪ সালে ক্লাব ক্যারিয়ার শুরু করে মাত্র ৪ বছর পরেই জাতীয় দলে জায়গা পান তিনি। তিনি ক্যারিয়ারে খেলেছেন ৯৮টি টেস্ট এবং সেই ৯৮টেস্টে নিয়েছেন ৪০৫ উইকেট; এভারেজ ২০.৯৯। সাথে ১৭৬টি ওয়ানডেতে নিয়েছেন ২২৫ উইকেট।

ইয়ান রাফায়েল বিশপঃ উইন্ডিজে যদি কোনো ক্রিকেটার পূর্বনির্ধারিত ভাবে বিখ্যাত হিসেবে আসে আর সেটা হলো ইয়ান বিপশ। বিউটিফুল রান আপের সাথে প্রচন্ড গতির আউট সুইং ডেলিভারি মূহুর্তেই ভেঙে দিতো স্ট্যাম্প। ১৯৯১ সালে ইঞ্জুরির ফলে দল থেকে বাহিরে চলে যান। এরপর আবার পূর্ণ শক্তিতে দলে ফিরে আসেন কিন্তু ১৯৯৩ সালে আবার ইঞ্জুরিতে পড়েন তিনি এবং ১৯৯৫ পর্যন্ত দলের বাহিরে ছিলেন।

ইঞ্জুরির কারণে তিনি ধীরে ধীরে তার বোলিং স্টাইল চেঞ্জ করতে বাধ্য হন। যদিও তার বোলিংয়ের ধার পূর্বের মতোই ছিলো। তিনি ক্যারিয়ারে ৪৩টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন এবং ২৪.২৭ এভারেজে নিয়েছেন ১৬১ উইকেট। বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা ধারাভাষ্যকার তিনি। একসময় কাঁপিয়েছেন বাইশ গজ আর এখন কমেন্ট্রি বক্স।

ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারোর নাম শুনেছেন। এক হাতে বোতলভরা মদ আরেক হাতে ধুলোপড়া কম্পাস। গায়ে নোংরা পোশাক পরা স্প্যারো ছিলো ক্যারিবীয় সাগরের ব্রেদার্ন কোর্টের একজন পাইরেট লর্ড। সদা হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিতে আড়ালে থাকা এক পাইরেটের বিপরীতে ছিলেন কিছু কুখ্যাত পাইরেটসরা। হেনরি মরগান, ক্যাপ্টেন কিড, ফ্রান্সিস ড্রেকের মতো দস্যুদের ভয়ে চুপসে যেতো সাগর পাড়ের বণিকরা।

ক্রিকেটের বাইশ গজে ওইসব কুখ্যাত পাইরেটসরা না থাকলেও ছিলো ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারোর মতো কোল্ড ব্লাডেড ফাস্ট বোলার। যাদের ভয়েই হাত পা কাঁপতো বিশ্বের বাঘা বাঘা সব ব্যাটসম্যানদের। উইন্ডিজদের ক্রিকেট ইতিহাসে যেসব ভয়ঙ্কর ফাস্ট বোলার এসেছে তার অর্ধেকও বোধহয় অন্য কোনো দেশে আসেনি। কিন্তু সেই সত্তর আশির দশকের ফাস্ট বোলিং আক্রমণ আর এখন নেই। ধার কমে গিয়েছে সেই আক্রমণাত্মক উইন্ডিজ পেস ব্যাটারির। তবে সেই সময়কার বোলাররা ইতিহাসে যা সৃষ্টি করেছে তা অনন্য।