• ক্রিকেট

শাহাদাত হোসেন দিপু দ্যা ডিপেন্ডেবল!

পোস্টটি ২০৩২ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
বিকেএসপি থেকে বাদ পড়ে ছেলেটা বলেছিলো ক্রিকেটটা আর খেলা হচ্ছেনা। ছেলেটা কি আলাদীনের চেরাগ হাতে পেয়েছিলো? নিজেকে ১৮০ ডিগ্রী ঘুরিয়ে দেশের জন্য ১ম বিশ্বকাপটাই জয় করে নিয়ে আসলো। বলছি অনূর্ধ্ব- ১৯ জাতীয় দলের অলরাউন্ডার শাহাদাত হোসেন দিপুর কথা। মাত্র কয়েকবছর আগে তার সাথে একাডেমীর মাঠে খেলেছি, সেই ঘাসগুলো হয়তো মরে গেছে, নতুন ঘাস জন্মেছে। ইচ্ছে ছিলো সেই ঘাসের উপর বসে কোন এক ম্যাচের চা বিরতিতে চা পান করতে করতে একটু আড্ডা দেওয়া হবে। করোনার প্রভাবে ধৈর্য্যের অভাবে সেই আড্ডা জমে গেলো জুম এ্যাপে। দিপুর সাথে দীর্ঘ আড্ডা দিয়েছি আমি নুরুল আমিন ফাহিম আর সেই আড্ডার সঙ্গী ছিলেন বন্ধু ইসমাইল উদ্দিন সাকিবও।
 
শুরুতেই চলে আসে এইসময়ে ঘরবন্দী জীবনের কথা। কেমন কাটছে দিপুর সময়? উত্তরে দিপু বলে, "গত ২ বছর ধরেই ক্রিকেটের মধ্যে ছিলাম। বাসায় সময় দিতে পারিনি। এদিক দিয়ে চিন্তা করলে ভালো দিক বাসায় সময় দিতে পারছি। আম্মুর সাথে মাঝেমধ্যে মজা করি। রান্নাবান্না কিছু শেখার চেষ্টা করছি। বিনোদনের জন্য মুভি, নাটক দেখা হয়। আর স্বাভাবিক একটু খারাপ লাগে ক্রিকেটের বাইরে থাকা, এটা আমাদের জন্য কষ্টের, ক্রিকেটকে খুব মিস করছি। আল্লাহর কাছে দোয়া করি যাতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।"
 
ক্রিকেটের কথা বলতেই নস্টালজিক হয়ে যায় ছেলেটা। ৩ মাস আগেও কি সুন্দর রুটিন ছিলো। তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেই শুরু হতো অনুশীলন,বিকেলেও তাই। সন্ধ্যায় ফিটনেসের জন্য জিম। ফিট না থাকলে ক্রিকেটটা ঠিক খেলা যায় না। ঘরে কি আর নিশ্চিন্তে বসে থাকা যায়! অনূর্ধ্ব -১৯ দলের ট্রেইনার লাইভ আসেন তার শিষ্যদের জন্য। গুরুর কথা শুনে ফিটনেসের ব্যাপারে যত্ন নিচ্ছেন আর গুরুর রুটিনগুলো মেনে চলছেন।  
 
তার সাথে সম্পর্কটা ছোট ভাইয়ের মতো। কেনো বলেছিলো তাকে দিয়ে আর যাই হোক ক্রিকেটটা হবে না। আমি তো জানি, তবু তার মুখ থেকে শুনি, "আমাদের এলাকার এক বড় ভাই ছিলো ইয়াসিন নামে। একদিন আমাকে বললো বিকেএসপির একটা  ট্রায়াল আছে, তুই ত ভালো খেলিস; দেখ সুযোগ পাস কিনা। আমি বললাম,' বিকেএসপিটা কি?' বিকেএসপি যে একটা ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেটা আমি তখন জানতাম না। সেখানে গেলাম, ট্রায়ালও দিলাম। বিকেএসপিতে দুই এক মাস ক্যাম্প করলাম। তারপর আমি বাদ পড়ে যাই। বাদ পড়ার পর পাঁচ ছয় মাস ক্রিকেটের প্রতি মনোযোগ দেইনি। আমি জানি বাদ যেহেতু পড়েছি আমার দ্বারা আর হবে না।"
 
এরপর কি আলাদীনের দৈত্য এসে বলে গিয়েছিলো দিপু তুমি ক্রিকেট খেলো, আমি তোমার হাতে বিশ্বকাপ দেখতে পাচ্ছি। না, অজানা ছেলেটাকে পথ দেখিয়েছে তার এলাকার বড় ভাইয়েরা। তারা হয়তো বুঝেছিলো সে একটুকরা ঝিনুকে ঢাকা মুক্তা। "আরেকটা বড় ভাই ছিলো সুদীপ্ত দেব। উনি আমাকে অনেকবার বলেছিলো বিকেএসপি থেকে বাদ পড়েছিস সমস্যা নাই। বিকেএসপি থেকে অনেকেই বাদ পড়ে। অনেক প্রসেস আছে ডিসট্রিক্ট, ডিভিশন এগুলো খেলেও অনেক দূরে যাওয়া যায়। সত্যি বলতে তখন আমি বিশ্বাস করতাম না। ভাবতাম বিকেএসপিই সব। বাদ পড়েছি মানে শেষ। আমিও চাচ্ছি না আর। দুই তিন মাস পর একদিন আমাকে জোর করে নিয়ে গেলো এবং বললেন তুই শুরু কর, পারবি। আম্মুকে বললাম আর আম্মুও যেতে বললো। আম্মু, ভাইয়া সবাই সাপোর্ট করেছে। ২০১৩ এর অক্টোবর থেকেই সম্ভবত আমার ক্রিকেটে আসা।"
 
101966657_694103761371402_2731094142422642822_nতার ব্যাটিং দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে বলতো একাডেমীর রাহুল দ্রাবিড়। দ্রাবিড় কি তার আইডল? "আমার অনেককেই ভালো লাগে। তাদের ব্যাটিং, এটিটিউড সবই ভালো লাগে। ওদের থেকে শেখার চেষ্টা করি। কিন্তু আইডল যদি বলি তাহলে আমি সুদীপ্ত দেব ভাইকেই মানি। উনাকে ছোটবেলা থেকেই আইডল হিসেবে মানতাম। এবং উনাকেই সবসময় ফলো করতাম। আমাদের দেশে অনেকেই আছে যেমন তামিম ভাই, সাকিব ভাই, মুশফিক ভাই, রিয়াদ ভাই আছে; বাইরের দেশে যদি বলি ভিরাট কোহলি, স্মীথ, উইলিয়ামসন, জো রুট এরকরম অনেক ব্যাটসম্যানকেই ভালো লাগে।" রাহুল দ্রাবিড় উপাধি ভালো লাগেনি তার। হতাশ হয়ে পড়েছিলো ছেলেটা, আবারও সিদ্ধান্ত ক্রিকেট ছাড়তে হবে। ছেলেটা কি বোকা! নিজেকে বুঝতে পারে না। আবারও কেউ একজন আলাদীনের দৈত্য হয়ে এসেছেন।" একাডেমীতে যখন যাই তখন অনূর্ধ্ব -১৬ এ একটা বিজয় দিবস টুর্নামেন্ট হয়। ওটাতে আমি ভালো খেলেছিলাম। ভালো খেলার পর আমাদের একাডেমীতে কোচ যারা ছিলেন রাজিব ভাই, জুয়েল ভাই উনারা আমাকে অনূর্ধ্ব -১৪ ডিসট্রিক্ট টিমে রাখলো। ওখানে প্র্যাকটিস চলছে, ম্যাচ খেলছি, সব ঠিকঠাক চলছে। কিন্তু তখন আমি মেডিক্যাল টেস্ট করিনি। মেডিক্যাল না করলে ডিসট্রিক্ট খেলা যায় না। তাই প্রথমবার ডিসট্রিক্ট থেকেও বাদ পড়ে যাই। বাদ পড়ার পর আবারও মাথায় আসলো আমার দ্বারা হবেনা। সেদিন শুভ ভাইকে ডেকে বললাম আমি মনে হয় পারবো না। তিনি বললেন তোর তো দোষ নাই, মেডিক্যাল করতে পারিস নাই তাই খেলতে পারিস নাই। আমি হাল ছেড়ে দিয়ে ছিলাম কিন্তু শুভ ভাই বললো তুই দেখবি নেক্সট ইয়ার ক্যাপ্টেন হিসেবে থাকবি। ঠিকই পরবর্তী বছর ক্যাপ্টেন হিসেবে ছিলাম। সেকেন্ড ডিভিশন ক্রিকেট খেলার আগে আমরা বাড়ি চলে যাওয়ার প্ল্যান ছিলো। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই ভাইয়ার উপর চাপ সৃষ্টি হয়। তাই আমি নোবেল স্যার, উজ্জ্বল ভাইদের বলেছিলাম কিন্তু তারা বললো তুই থাক সেকেন্ড ডিভিশনটা খেল। ওখানে ভালো করলে ডিসট্রিক্ট টিমে ডুকতে পারবি। ওখান থেকে সেকেন্ড ডিভিশনটা খেলা। তারপর আসতে আসতে ডিসট্রিক্টে আসা।" না, সে বোকা হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় নি। তার মাথার উপর বাবা নামক ছায়াটা আর ছিলো না। সকলের পরামর্শে জেদ চেপেছে তার। "আমি সবসময় চিন্তা করতাম আমাকে ভালো করতেই হবে। আমি অনেক কিছু ত্যাগ করেই ক্রিকেটে এসেছি। ওটা সবসময় মাথায় ছিলো। চিন্তা করতাম এটাই আমার প্যাশন। এটা একটা জেদ ছিলো এবং আমাকে ভালো করতেই হবে। আমি মনে করি আমার ত্যাগ গুলোই আমার পারফর্মেন্স উন্নতি করার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে।" এবার একটু টাইম মেশিনে উঠে বসা যাক। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে একেবারে অনূর্ধ্ব -১৯ বিশ্বকাপে পৌছে গেছে ছেলেটা। পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই ব্যাটিং-এ অসাধারণ পারফর্মেন্স। কি হলো শেষ বেলায়, ফাইনাল ম্যাচে কি স্নায়ু চাপ নিতে পারে নি। খেলাটা শেষ করে আসতে পারলো না, ১৬ কোটি মানুষের হৃদয় তখন ধুক ধুক করছিলো। "আমি প্রতিটা ম্যাচে চিন্তা করি ম্যাচ জিতিয়ে নামবো। সবসময় চিন্তা করতাম নট আউট থেকেই ম্যাচটা যেন শেষ করতে পারি। এটা শুধু ফাইনালে না, যেকোনো ম্যাচেই আমি আউট হলে আফসোস লাগে ইশ আমি ম্যাচটা শেষ করতে পারিনি।"
 
86290585_112683330299660_8472091207772667904_oছেলেটার হাতে বিশ্বকাপ। যে বলেছিলো ক্রিকেট তার দ্বারা হবে না, বিকেএসপি কি সে জানে না; তার হাতে আজ বিশ্বকাপ। শুধু কি তাই, বিকেএসপিতে চান্স না পাওয়া ছেলেটা আজ অনূর্ধ্ব -১৯ বিশ্বকাপে আইসিসি থেকে ঘোষিত সেরা একাদশে সুযোগ পেয়েছে। "যখন ওয়ার্ল্ড কাপ খেলতে যাই তখন জানতামই না যে সেরা একাদশ হয়। ওয়ার্ল্ড কাপ শেষে যখন সেরা একাদশ দিয়েছিলো তখন আমার এক ফ্রেন্ড আমাকে দেখিয়েছিলো। আমি বললাম এটা কি আবার, এখানে আমিও আছি! সে বললো আইসিসি থেকে সেরা একাদশ দিয়েছে। এটা দেখে একটু সারপ্রাইজড হলাম এবং খুব ভালো লাগছিলো।" এখনো কি আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেনা ছেলেটা। স্বপ্ন দেখেন না বড় অলরাউন্ডার হওয়ার! বোলিং-টাও যে বেশ ভালোই করেন। 87257004_111339393788951_8784397942225108992_o এখন ত বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখা যায়। "আমি কম চিন্তা করি। সুদূর চিন্তা করিনা। আমি সবসময় চিন্তা করি ব্যাটিং করার পর যতটুকু পারি বোলিং দিয়ে টিমকে কন্ট্রিবিউট করতে। যেটা বললেন একজন ভালো অলরাউন্ডার হিসেবে অবশ্যই নিজেকে ভালোভাবে গড়ার চেষ্টা থাকবে।" পথ দেখাতে একজন পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন হয়। অনূর্ধ্ব -১৯ দিয়েই কি আশা পূর্ণ হয়। দেশ এখন জাতীয় দলের হয়ে বিশ্বকাপ চায়। কি ভাবছে সে? "আমি সবসময় চিন্তা করি যতটুকু করছি সেটা এখনো পর্যাপ্ত না। চেষ্টা থাকে যতো ভালো করা যায়। আমাদের হান্নান স্যার বললেন তোমরা ওয়ার্ল্ড কাপ জিতে গেছো এটা খুশির খবর। কিন্তু এটা এখন অতীত হয়ে গেছে। এখন থেকে নতুন জার্নি শুরু তোমাদের। এখন নতুন করে হার্ড-ওয়ার্ক করতে হবে। আসল ক্রিকেট কিন্তু এখন। এখন যদি আমি প্রিমিয়ার লীগ খেলি আমার সামনে ফেস করতে হবে ন্যাশনাল টিমের বড় ভাইদের। আমার ওভাবে প্রস্তুত হতে হবে। ম্যান্টালি যাতে আরও স্ট্রং হতে পারি ওটার জন্য স্যারদের সাথে কথা বলি। কিভাবে আরও ভালো করা যায় সেটা নিয়ে উনাদের সাথে আলাপ করি।" ঘড়ির কাটা টিক টিক করতে করতে অনেক দূর এগিয়েছে। স্পর্শহীন, শরীরের অনুভুতিহীন এই আড্ডা কতক্ষণ চালানো যায়! আজ থাক; মাঠের ঘাসগুলো অপেক্ষায় আছে, তাদেরকে নিয়েও গল্প করা বাকি। এর ঘাসের সাথেই যে তার বেড়ে ওঠা! বড় হোক ছেলেটা আরো, বিশ্ব দরবারে দেশের পতাকা জড়িয়ে ধাপিয়ে বেড়াতে হবে তার। তাকে যে অলরাউন্ডার, সাকিব আল হাসানের মতো বিশ্বসেরা হতে হবে!