• ক্রিকেট

ক্লাসিক্যাল সেই ১৯৪

পোস্টটি ১৭০৭ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
হঠাৎ যদি কোনো একদিন শুনতে পান ওয়ানডে ক্রিকেটে কেউ একজন একাই ৩০০ রান বা তার কাছাকাছি করে ফেলেছে তাহলে চোখ কপালে উঠলেও অবিশ্বাস্য কিছু বলে মনে হবে না, তা-নয় কি? কারণ অনিশ্চয়তার এই খেলায় যেকোনো কিছুই সম্ভব। তাছাড়া আধুনিক ক্রিকেটে প্রতিনিয়তই এমনসব অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে আসছে, যা কয়েকবছর আগে কেউ হয়তো মাথায়ও আনতে পারতেন না। এখন ওয়ানডেতে কোনো ব্যাটসম্যান ডাবল সেঞ্চুরি করলে সেটা নিয়ে আর কেউ অবাক হন না। কারণ গ্রেট শচিন টেনডুল্কারের পর বীরেন্দ্রর শেহওয়াগ, ক্রিস গেইল, মার্টিন গাপটিল আর রোহিত শর্মা তো রীতিমতো অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছিলেন ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরি করা। তিন-তিনবার একদিনের ক্রিকেটে এই মাইলফলক স্পর্শ করেন রোহিত শর্মা যার মধ্যে সর্বোচ্চ ২৬৪। যেটা এখনো কেউ ভাঙ্গতে পারেননি। ক্রিকেটে আজকের সময়ে প্রায়ই ডাবল সেঞ্চুরি দেখা গেলেও ২৫ বছর আগে ২০০ তো দূরে থাক নিয়মিত ১৫০ এর ওপরই কেউ করতে পারতেন না। তখন ২০০ হয়তো রূপকথার গল্পের মতনই শুনাতো। তবুও একজন ডাইনামিক ক্রিকেটার সেসময় ২০০র কাছাকাছি গিয়েছিলেন। করেছিলেন ১৯৪, সেটিও মাত্র ১৪৬ বল খেলে। _2c854666-9b2e-11ea-92be-8e275334e660
তিনি সাইদ আনোয়ার। সেদিন ৬ রানের আক্ষেপে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ২০০র এলিট ক্যাটাগরিতে নাম লিখাতে পারেননি। কিন্তু ইতিহাস গড়ে ফেলেছেন ইতিমধ্যে। ১৯৮৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওল্ড ট্রাফোর্ডে স্যার ভিভ রিচার্ডসের তখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ওডিআই স্কোর ১৮৯ রান। ইতিহাসের পাতা সম্পাদন করে সাইদ আনোয়ার নতুন রেকর্ড করলেন ১৯৪। ইনজুরি নিয়েই ভিভের রেকর্ড ভাঙ্গা আর নতুন রেকর্ড গড়ার পাশাপাশি ক্রিকেট দুনিয়ার সকলের মনেও জায়গা গড়ে নেন বড় মঞ্চের পারফর্মার খ্যাত এই ক্রিকেটার। ২০২১এ এসে এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার মনে হলেও সেসময় কিন্তু কাজটি মোটেই সহজ ছিলো না। পুরোপুরি ফিট না হওয়া, চেন্নাইয়ের মাঠে সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় ব্যাটিং করে কিছুক্ষণ পরপর ক্লান্ত হয়ে যাওয়া, তারপর ডিহাইড্রেটেড হয়ে রানারের সাহায্য নিয়ে ১৯৪ করা, সাইদ আনোয়ারের এই ইনিংস খেলার পূর্বে প্রস্তুতিও নাকি ছিলো ভিন্ন। নিজের ইউটিউব চ্যানেলে তার সম্পর্কে এমনটাই বলেছিলেন পাকিস্তানের একসময়কার অন্যতম সেরা স্পিনার সাকলায়েন মুশতাক। তিনি বলেন, '১৯৪ রান করার ৪-৫ দিন আগ থেকেই উনার (সাইদ আনোয়ারের) বডি ল্যাংগুয়েজে অন্যরকম পরিবর্তন আসে। প্রথমে উনি যেভাবে ন্যাট প্র্যাকটিস করতেন তার চেয়ে একটু ভিন্নভাবেই করছিলেন। আগের চেয়ে দিগুণ সিরিয়াস, ফিটনেস নিয়ে কাজ করা আর সময়ও নিচ্ছিলেন অনেক। ন্যাট সেশনে যেখানে সবাই প্রথম দিকে ধীরে শুরু করলেও পরের দিকে উপরে খেলতে পছন্দ করতেন, উনি সেখানে প্রথম দিকে যেমন ছিলেন শেষেও তেমন। খুব ক্যালকুলেটিভ ওয়েতে ব্যাটিং করছিলেন। সাকলায়েন আরও বলেন, dm_200614_SAQLAIN_SALIVA এরকম সাইদ আনোয়ারকে আমি খুব কমই দেখেছি।' সাকলায়েনের মুখে ভিন্ন সাইদ আনোয়ারকে শুনতে পেলেও মাঠে এসে সেটি প্রয়োগ করার কাজটি ছিলো ঠিক ততটাই কঠিন। ওপেনিং শুরু করেন আফ্রিদিকে সঙ্গী করে। মারকুটে আফ্রিদি লম্বা সঙ্গ দেওয়ার মতন কস্মিনকালেও ছিলেন না। দলীয় ৮রানের মাথায় তিনি সাজঘরে ফিরলে ক্রিজে আসেন রমিজ রাজা। তাকে নিয়ে ধীর শুরু করলেও চমৎকার কিছু শর্ট খেলে তুলে নেন ফিফটি। কিন্তু, ১৮.৫ ওভারের মাথায় বোল্ড আউট হয়ে রমিজ রাজা ফেরার পরপরই ঘটে বিপত্তি। ডিহাইড্রেশন আর সম্পূর্ণ ফিট না থাকাতে ক্লান্ত হয়ে পড়া সাইদ আনোয়ারের প্রয়োজন হয় রানারের। আফ্রিদি আসেন রানার হিসেবে। এরকম অবস্থায় বেশিরভাগ ব্যাটসম্যানই ক্রিজে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেন না। তাছাড়া মানসিক চাপ তো কাজ করেই। কিন্তু, মানসিকভাবে ভীষণ ফিট এই মানুষটি এমন কনডিশনেও ব্যাটিং করছিলেন অসাধারনভাবে। তার মধ্যে ছিলো অনিল কুম্বলেকে এক ওভারে তিনটি ৬এর সাথে ২২টি চার ও ট্যোটাল পাঁচটি ছয়ের মারসহ চোখ ধাঁধানো সব শর্টসমূহ। অনেকেই বলেন, সাইদ আনোয়ারের কব্জির পাওয়ার ছিলো ভীষণ কার্যকরী। তাই হয়তো ইনজুরি থাকা সত্ত্বেও সম্ভব হয়েছে৷ কিন্তু, সেদিনের ১৯৪এর পেছনে আফ্রিদির অবদানটা অনেকাংশেই বেশি। অন্তত সাইদ আনোয়ার তাই মনে করেন। ব্যাটিংয়ে ভালো সঙ্গ দিতে না পারলেও রানার হিসেবে সঙ্গ দেওয়ার পার্টটা ভালোই চুকিয়েছিলেন আফ্রিদি। ১৯তম ওভার থেকে শুরু করে ৪৬.৪ ওভার পর্যন্ত রানার হিসেবে যথাযথ ভূমিকা পালন করেছিলেন বুমবুম। pjimage-2020-06-18t095231-1592454160 কিন্তু, কখনোই পুরোদস্তুর বলার না থাকা শচীন টেনডুল্কারের বলে শর্ট ফাইন লেগে গাঙ্গুলির অসাধারণ ক্যাচে ১৯৪এ থামে ক্লাসিক্যাল এই ইনিংস। ১৮৬র পর যখন শচীনকে চার মেরে ৯০এর ঘরে প্রবেশ করেন, তখনি ক্যাপ খুলে ব্যাট ওপরের দিকে তুলে জানান দেন আজ থেকে তিনিই নতুন এই রেকর্ডের মালিক। অনেকের মতে, সাইদ আনোয়ারের উচিত ছিলো ২০০ পাওয়া। কারণ তখনো খেলার প্রায় তিন ওভার বাকি। ছয় রানের জন্য ২০০ ছুঁতে না পারার সেই কষ্ট হয়তো আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি!
 
তাই, যখন ম্যাচ শেষে ম্যান অব দ্যা ম্যাচের পুরস্কার নিতে যান তখন রাবি শাস্ত্রী প্রশ্ন করেন, '১২তম সেঞ্চুরি আজকেরটাসহ। এটাকে কোথায় রেটিং করবেন?' ছয় রানের আক্ষেপের কথা না তুললেও সাইদ আনোয়ার বলেন, 'এটা সম্ভবত আমার খেলা সেরা ইনিংস কারণ, আজকে প্রচণ্ড গরম ছিলো আর হিউমিডিটিও ছিলো সর্বোচ্চ। ১৩০ থেকে ১৪০ এর মধ্যে আমি ভেবেছিলাম আউট হয়ে যাবো। কিন্তু, শাহীদ আফ্রিদিকে ধন্যবাদ দিতেই হয় আমাকে সাহায্য করার জন্য।' তারপরের প্রশ্নে জিজ্ঞেস করেন, 'ইনিংসের মাঝখানে আপনাকে ডিহাইড্রেটেড/ইনজুরিড মনে হচ্ছিলো। আপনি রানারের জন্য কল করেছিলেন। সেখানে কী হয়েছিলো?' তখনি সাইদ আনোয়ার বলেন, 'আসলে আমি ১০০% ফিট নই। আমি ৭৫% ফিট ছিলাম। আশা করি দ্রুত ফিটনেস ফিরে পাবো।' অতঃপর রাবি শাস্ত্রীর ভ্রূ কুঁচকানো ২০০ দেখছি কিনা এমন প্রশ্ন জুড়ে দেওয়ার আগেই হেঁসে ফেলেন সাইদ আনোয়ার। হয়তো মনে মনে বলছিলেন ফিটনেস সঙ্গ দিলে আর ইনজুরি পিছু ছাড়লে, কেন নয়! কারণ ক্যারিয়ারজুড়ে ইনজুরি বেশ ভালোই ভুগিয়ছেন তাঁকে।Saeed-Anwar
একদিনের ক্রিকেটে ১৯৯৭এ করা এই রেকর্ড প্রায় একযুগেরও বেশি সময় ধরে সাইদ আনোয়ারের ঝুলিতেই ছিলো। পরে অগাস্ট ১৬, ২০০৯এ চার্লস কভেন্ট্রি অপরাজিত ১৯৪ রান করে সেই রেকর্ডে ভাগ বসালেও ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১০এ অফিসিয়ালি সেটা ভাঙ্গেন লিটল মাষ্টার খ্যাত শচীন টেনডুল্কার
তারপর ক্রিকেট বিশ্ব শেহওয়াগের ২১৯, গেইলের ২১৫, মার্টিন গাপটিলের ২৩৭ আর রোহিতের ২০৮, ২০৯ আর ২৬৪ তো দেখেছেনই কিন্তু, আজও যখন ওডিআইতে ডাবল সেঞ্চুরির আলাপ ওঠে আর মে ২১ আসে, তখন এই ক্যাটাগরিতে না থাকা সত্ত্বেও সাইদ আনোয়ারকে সবাই স্বরণ করেন। অন্তত ক্রিকেটপ্রেমীরা তো বটেই।
 
কেননা খুব কম ইনিংসই আছে, যা সাইদ আনোয়ারের সেই আইকনিক ইনিংসকে ম্যাচ করার ক্ষমতা রাখে!