• ফুটবল

তেনেরিফের সেই ছেলেটা

পোস্টটি ১৪৮২ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

গুডিসন পার্কে ৬৬ মিনিট পেরিয়ে গেছে। মুহুর্মুহু আক্রমণ সত্ত্বেও এভারটনের রক্ষণে চির ধরাতে পারছে না চেলসি। এই ম্যাচটা ড্র হলে ৩৪ ম্যাচ শেষে চেলসির পয়েন্ট দাঁড়াবে ৭৭, তখন হাতের ম্যাচটা জিতলেই গোল ব্যবধানে শীর্ষে উঠে যাবে টটেনহাম হটস্পার। আন্তোনিওর কন্তের চেহারায় কি অসহায়ত্বের আভাস পাওয়া যাচ্ছে? এভারটন বক্সের সামনে দাঁড়ানো পেদ্রোকে বল এগিয়ে দিলেন নেমানিয়া ম্যাটিচ। বাঁ পা দিয়ে টাচ করে ডান দিকে বলটাকে সরালেন পেদ্রো, এরপর আচমকা ঘুরে ডান পায়ের দুই টাচে বাঁ দিকে নিজের জন্য “স্পেস” তৈরি করে নিলেন। হঠাতই ডি বক্সের ঠিক মাঝ বরাবর জায়গা থেকে বাঁ পায়ের বাঁকানো নিখুঁত শট। দেহটাকে শুন্যে ভাসিয়ে দিয়ে বলে হাত ছোঁয়ানোর চেষ্টা করলেন “টফি”স গোলরক্ষক স্টেকেলেনবার্গ। কিন্তু তাঁর বাঁ হাতের পাশ দিয়ে উড়ে বল জালে জড়ালো। সেদিন এরপর আরো দুই গোল করেছিল চেলসি। কিন্তু ম্যাচটাকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন ঐ পেদ্রোই – খর্বকায়, হাসিখুশি এক ফরোয়ার্ড যার দুপায়েই সমান দক্ষতা।

https://i.eurosport.com/

মাদ্রিদ থেকে প্রায় ৩০০০ কিলোমিটার দূরের সান্তা ক্রুজ দি তেনেরিফেতে জন্ম পেদ্রো এলিয়েযার রদ্রিগেজ লেদেসমার। ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের এই শহরটা স্পেনের মূল ভূ-খণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপটি আইবেরীয় উপদ্বীপ থেকে বেশ খানিকটা দূরে। কিন্তু চোখধাঁধানো সব সৈকত আর দারুণ আবহাওয়ার স্বাদ নিতে প্রতি বছর প্রায় দেড় কোটি পর্যটক ভিড় জমায় সেখানে। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান “পেদ্রিতো”র সেই দ্বীপের আলো-বাতাসে বড় হয়ে উঠছিল। ফুটবল খেলাটা তাঁর কাছে নিছকই বিনোদনের উৎস। স্পেনের আর দশটা শিশু যখন ৬-৭ বছর বয়সেই একাডেমিতে ভর্তি হয়ে যায় সেখানে পেদ্রো যখন স্থানীয় ক্লাব সান ইসিদিরোর যুবদলে যোগ দিলেন তখন তাঁর জীবন থেকে ১৬টি বসন্ত নাই হয়ে গেছে। পরের বছরে যোগ দিলেন বার্সেলোনার যুবদলে, দুই লাখ লোকের এক শহর থেকে একজন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে দলে নিচ্ছে - বার্সেলোনার স্কাউটদের কল্পনাতে নিশ্চয়ই সেটা আসেনি। এরপর “বার্সেলোনা বি” এবং আরো দুই বছর “বার্সেলোনা সি” তে কাটানোর পর পেপ গার্দিওলার অধীনে বার্সেলোনার মূলদলে নিয়মিত হওয়া। এরপর ২০০৯-১০ মৌসুমে ছয়টি প্রতিযোগিতার সবগুলোতে গোল করলেন পেদ্রো। মেসি, জাভি, ইনিয়েস্তাদের নৈপুণ্যের অনেকটা আড়ালেই থেকে গেলেন এই উইঙ্গার। তবে গতি, বলের পেছনে ছোটা আর দুই পায়ের সমান দক্ষতার জন্য গার্দিওলার প্রিয় হয়ে উঠলেন খুব অল্প সময়ের মধ্যে। পেদ্রো বার্সেলোনার হয়ে কী কী ট্রফি জিতেছেন সেটার ফিরিস্তি দিতে গেলে রাত পেরিয়ে যাবে তাই বলা ভালো স্পেনের সর্বজয়ী দলের সদস্য হিসেবে ২০১০ এর বিশ্বকাপ আর ২০১২ এর ইউরো জিতেছেন তেনেরিফের এই ফুটবলার। তবে বার্সার মূলদলে ৬ বছর নিয়মিত খেলার একসময় সুয়ারেজ-নেইমারদের দৌরাত্ম্যে দলে জায়গা হারিয়ে ফেললেন, নতুন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সময় বুঝি এসে গেছে। রৌদ্রস্নাত স্পেনে বড় হওয়া পেদ্রো পাড়ি জমালেন শীতল, কুয়াশাচ্ছন্ন লন্ডনে – চেলসি এফসির হয়ে ফুটবল খেলবেন এবার।

pedro-image

কিন্তু ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কিনা সেটা ভেবে বোধহয় বেশ অনুশোচনা হচ্ছিল এই উইঙ্গারের। মাঠের বাইরে গোলমাল আর মাঠের বাইরে ছন্নছাড়া ফুটবল মিলিয়ে চেলসিতে তখন গভীর সংকট, ডিসেম্বরে চাকরি হারানো মরিনহোর জায়গায় অন্তর্বতীকালীন কোচ হিসেবে কাছের বন্ধু গুস হিডিঙ্কের শরণাপন্ন হলেন আব্রামোভিচ। কোনোমতে দশম স্থানে থেকে লিগ শেষ করলো চেলসি, আব্রামোভিচ যুগে এমন দুর্দিন আর আসেনি। সতীর্থদের অনেকে লাখ লাখ পাউন্ডের বিনিময়ে মৌসুমজুড়ে শীতনিদ্রা উপহার দিলেও সেই তুলনায় পেদ্রোকে যথেষ্ট উজ্জ্বলই বলতে হবে। চেলসির ১৭ নম্বর জার্সি গায়ে জড়িয়ে প্রথম ম্যাচেই গোল করলেন, জাতীয় দলের সতীর্থ দিয়েগো কস্তাকে দিয়ে আরেকটি করালেন। নিউক্যাসল, অ্যাস্টন ভিলার সাথে করলেন জোড়া গোল। চেলসি সমর্থকদের জন্য দুঃসহ সব স্মৃতির জন্ম দেওয়া মৌসুমে ৪০ ম্যাচে করলেন ৮ গোল। খুব বেশি না, তবে লিগের দশম ক্লাবের হয়ে এ-ই বা কম কিসের। এরপরের মৌসুমে কোচ বদলালো কিন্তু চেলসির ফর্মের উন্নতি হচ্ছিল না। এমিরেট্‌স স্টেডিয়ামে আর্সেনালের সাথে প্রথমার্ধে আত্মসমর্পণের পর আন্তোনিও কন্তে কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলেন। ইংল্যান্ডে আসার পর প্রথমবারের মতো “থ্রী অ্যাট দ্য ব্যাক” খেলালেন। ভোজবাজির মতো পাল্টে গেলো চেলসি। যেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বদলে চেলসিকে নিজের ঠিকানা বানিয়েছিলেন পেদ্রো সেই ইউনাইটেডের বিপক্ষে ম্যাচের প্রথম মিনিটে গোল করে বসলেন। এরপর বাঁ পা দিয়ে চিপের মতো কিছু একটা করে (ফুটবলীয় সংজ্ঞা নেই বোধহয় তবে “ডিঙ্ক” বলতে শুনেছি) বোর্নমাউথের বিপক্ষে দারুণ এক গোল। এফএ কাপে পিটারবোরো ইউনাইটেডের গোলরক্ষকে পরাস্ত করলেন দু’বার । উলভারহ্যাম্পটন আর লেস্টারের বিপক্ষে হেডে “দুর্লভ” দুটো গোলও থাকলো সংগ্রহের তালিকায়। নভেম্বরের সেরা গোলের পুরস্কার জিতলো টটেনহামের বিপক্ষে তাঁর সমতাসূচক গোল। ডি বক্সের সীমানার বাঁ পাশ ঘেঁষে দাঁড়ানো বল রিসিভ করে একবার বাঁয়ে ঘুরে তারপরে ডানে মোচড় নিলেন। এরপর ডান পায়ের বাঁকানো শট পোস্টের বিঘতখানেক বাইরে থেকে শুরু করে দুর্দান্ত বাঁক নিয়ে উগো লরিসকে পরাজিত করে গোল ঢুকে গেলো। আর আরেক মাসের সেরা গোলের পুরস্কার জয়ী গোলের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। তিনিসহ মাসের সেরা গোলের পুরস্কার একাধিকবার জিতেছেন মাত্র চারজন। লিগ আর কাপ প্রতিযোগতা মিলিয়ে ১৩ গোল করলেন পেদ্রো – আগের মৌসুমে দশম হওয়া চেলসি আবার ইংরেজভূমের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করল।

 

পরের মৌসুমে আবার উদ্ভ্রান্ত দেখালো চেলসিকে। একদিকে মাঠে নিয়মিত হতাশা উপহার দিচ্ছে চেলসি, অন্যদিকে কোচ আন্তোনিও কন্তে খোলামেলাভাবে দলের সমালোচনা করলেন। পেদ্রোর পারফরমেন্স যেন পুরো দলের বিবর্ণ দশারই প্রতিচ্ছবি – ৩১ লিগ ম্যাচে মাত্র ৪টি গোল করলেন এই ফরোয়ার্ড। তবে শেষমেশ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে হারিয়ে এফএ কাপ ঘরে তুললো চেলসি, নতুন এক ট্রফির স্বাদ পেলেন পেদ্রো। লেস্টারের সাথে ষষ্ঠ রাউন্ডের ম্যাচে অতিরিক্ত সময়ে গোল সম্ভবত মৌসুমে তাঁর চুম্বক অংশ। ২০১৮-১৯ “সারিবল” দর্শন নিয়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমালেন মরিসিও সারি। ইংল্যান্ডে সারিবল অতোটা না জমলেও চেলসি লীগ শেষ করলো তৃতীয় স্থানে থেকে। স্ট্যামফোর্ডে ব্রিজে চেলসির হয়ে সহস্রতম লীগ গোল করলেন পেদ্রো - প্রতিবেশী ফুলহামের বিপক্ষে, লিগে ৮ গোলের পাশাপাশি ইউরোপা লিগে করলেন ৫ গোল। বাকুতে অনুষ্ঠিত ইউরোপা লিগের ফাইনালে নগর প্রতিদ্বন্দ্বী আর্সেনালের বিপক্ষে ৪-১ এক গোলের দ্বিতীয়টি এলো এই স্প্যানিশের বাঁ পা থেকে। হ্যাজার্দের কাটব্যাক পিকাসোর দেশের ফুটবলার শিল্পীর মতো সুনিপুণ ছোঁয়ায় ডান পোস্টের পাশ দিয়ে জালে পাঠালেন। বিদায়ী কিংবদন্তী চেককে দুঃস্বপ্ন উপহার দিয়ে ইউরোপা লিগ জিতে নিলো চেলসি। ইউয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ইউরোপা লিগ আর সুপারকাপের ফাইনালে গোল করা একমাত্র ফুটবলার এই পেদ্রো। আরেকটি রেকর্ডে তিনি অনন্য। আর কেউই একাধারে ইউরোপের ক্লাব ফুটবলের বড় দুই শিরোপা, বিশ্বকাপ ও ইউরো জিততে পারেনি। তেনেরিফের ছেলেটা সবকিছুই জিতে ফেললো তো!

pedro-rodriguez-spain-training-session-30052016_10v5got6dept31j3ei5xbhvw8z

পেদ্রোর হাবভাবে অবশ্য তারকাসুলভ অহমিকা একেবারেই অনুপস্থিত। দ্বীপদেশের রোদে পোড়া তামাটে চামড়ার লোকটার প্রাণখোলা হাসি দেখলে মনে হয় যেন পাশির বাড়ির কেউ। তবে ফুটবল মাঠে তিনি প্রতিপক্ষকে একচুলও ছাড় দেন না। নাছোড়বান্দার মতো বলের পেছনে লেগে থাকেন, আর গোলের সামনে ডান বা বাঁ পায়ের “ইনসাইড” দিয়ে আলতো ছোঁয়ায় ফিনিশ তো স্পেন কিংবা ইংল্যান্ডের ফুটবল সমর্থকেরা অনেকদিন মনে রাখবে। পেদ্রোর চেলসি অধ্যায় শেষ হলো বলে, আর্সেনালের বিপক্ষে এফএ কাপের ম্যাচে মাঠে নামুন আর না-ই নামুন এরপরেই পাড়ি জমাবেন ঐতিহ্যবাহী শহর রোমে। পহেলা আগস্ট হয়তো তাঁর মেডেলের সুদীর্ঘ তালিকায় আরেকটু বড় হবে, না বাড়লেও ক্ষতি কই? বয়স ৩৩ ছুঁয়েছে আজ, পাততাড়ি গুটিয়ে তেনেরিফেতে রোদ পোহানোর সময় এই এলো বলে। কে জানে মেডেল আর ট্রফি সাজিয়ে রাখার জন্য তাঁর আলাদা শো-কেস বা আলমারি আছে কিনা, এতোগুলো মনে রাখাই তো মানবমস্তিষ্কের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। তবে পেদ্রো ভালো থাকুন, দ্বীপদেশের আমুদে পরিবেশে বেড়ে ওঠা এই পরিশ্রমী ফুটবলার তাঁর ভক্তদের হৃদয়ের খুব কাছাকাছিই থেকে যাবেন। চমৎকার সব গোল আর দু’পায়ের কারিকুরি দিয়ে তো আমাদেরকে এতোগুলো বছরজুড়ে মুগ্ধই করে রেখেছেন।  

গ্রাসিয়াস, পেদ্রিতো!