• ফুটবল

রবার্ট কিংবা বোবাকের গল্প

পোস্টটি ২৩৭৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে পৃথিবীতে লাখ লাখ মানুষ বাস্তহারা হয়ে পড়ে, প্রকৃতির খেয়াল কেড়ে নেয় হাজারো মানুষের প্রাণ। কিন্তু ফুটবলের আলাপে হঠাৎই পরিবশবাদী হয়ে পড়া কেনো? কারণটা বলছি, রবার্ট লেভানডফ্স্কি। কী, মাথায় আরো প্যাঁচ লেগে যাচ্ছে? লেভানডফ্‌স্কি নয় প্রতিপক্ষের বক্সে টর্নেডো হয়ে উঠেন, গোলবানে ভাসিয়ে দেন তাদেরকে। কিন্তু যেই প্রাকৃতিক দূর্যোগের কথা বলা হচ্ছে সেটা “রুপক” নয় নিখাদ বাস্তব। ২০১০ সালের এপ্রিলে আইসল্যান্ডের ইয়ালাফিয়ালইয়োকুল আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত ছাইয়ের মেঘে উত্তর ইউরোপের আকাশ ছেয়ে যায়। দুর্ঘটনা এড়াতে একের এক ফ্লাইট বন্ধ করে দেওয়া হলো। লেভানডফ্‌স্কি তখন খেলেন নিজের দেশের ক্লাব লেচ পোজনানে। আসন্ন দলবদলে তাঁকে জড়িয়ে বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের নাম শোনা যাচ্ছে, ওদিকে ল্যাঙ্কাশায়ার থেকে ব্ল্যাকবার্নের কর্মকর্তারাও লেভার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। ব্ল্যাকবার্ন রোভার্স তখন প্রিমিয়ার লিগের মাঝারি সারির ক্লাব, লেভাকে উড়িয়ে এনে নিজেদের ক্লাবের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা দেখাতে চেয়েছিল তারা। কিন্তু বাধ সাধলো ঐ বেরসিক আগ্নেয়গিরিটা, ইংল্যান্ডের “মুভ” পণ্ড হওয়ায় প্রতিবেশী জার্মানির বরুশিয়া ডর্টমুন্ডে যোগ দিলেন। তারপর? ইতিহাস, রেকর্ড আর গোলের পর গোল। ব্ল্যাকবার্নে যোগ দিলে কী ওমন হতো? উত্তরটা জানা নেই। কিন্তু স্যাম অ্যালারডাইসের আদিম রক্ষণাত্মক ফুটবলের তুলনায় ইয়ার্গেন ক্লপের সান্নিধ্যেই নিশ্চয়ই প্রতিভাকে সাফল্যে রূপ দেওয়াটাকে ভালোভাবেন শিখেছেন লেভানডফ্‌স্কি। মনে মনে নিশ্চয়ই ভাগ্য আর বরফের দেশের খটমটে নামের আগ্নেয়গিরিটাকে নিশ্চয়ই ধন্যবাদ দেন লেভা।

বাবা ক্রিস্তফ ছিলেন ইউরোপসেরা জুডোকা আর মা ইভোনা ভলিবল খেলোয়াড় – খেলাধুলাটা তাই ছোট্ট রবার্টের রক্তের সাথে মিশে ছিল। তবে পোলিশ নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে যেখানে ভিনদেশীদের দু’চারটে দাঁত নড়ে সেখানে রবার্ট নামটা উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। পোল্যান্ডের মানুষের নামের বানান দেখে যদি আপনার মাথা ঘুরে থাকে তবে জানিয়ে দেই আপনিই একমাত্র নন। ক্রিস্তফ ভেবে রেখেছিলেন ছেলে যদি খেলোয়াড় হয় তখন তো দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে হবে। ভিনদেশীদের যাতে উচ্চারণ বা মনে রাখতে অসুবিধে না হয় সে জন্য ছেলের নাম বোবেক থেকে বদলে রাখলেন রবার্ট। ধারাভাষ্যকারেরা নিশ্চয়ই ক্রিস্তফকে আশীর্বাদ করেন, খেলার উত্তেজনার মাঝে মাঝে খটমটে নামগুলো বলে যাওয়া যে বড্ড শক্ত কাজ। অনেকগুলো খেলা বাজিয়ে দেখার পর লেভার শিশুমনকে দখল করে নিতে শুরু করল ফুটবল। ন’ বছর বয়সে ভারসোভিয়া ওয়ারশতে লেভানডফ্‌স্কির আনুষ্ঠানিক ফুটবল পাঠ শুরু হলো। লিকলিকে গড়নের রোগা ছেলেটা বয়সে ফুটবল পায়ে তাক লাগিয়ে দিতে শুরু করলো সবাইকে। গায়েগতরে ছোট হলে কী হবে, গোলের রাস্তাটা তখনই চেনা হয়ে গেছে বোবোকের। বয়সভিত্তিক দলে খেলার সময় এক মৌসুমে সবমিলিয়ে ১৫৮ গোল করেছিল ভারসোভিয়া, যার অর্ধেকই এসেছিল লেভার পা থেকে।

ebfc7c762dc3fb0f59747b5e6c24d993

সময় ভালোই যাচ্ছিল, কিন্তু বাবার মৃত্যু হঠাৎই লেভার জগতকে উল্টেপাল্টে দিলো। যার অনুপ্রেরণায় খেলতে আশা, অনুশীলনের সময় সবসময় চোখে চোখে রাখতেন যিনি সেই স্নেহময় পিতার বিদায় লেভাকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তুলল – যে কোনো মূল্য ফুটবলার তাঁকে হতেই হবে। সেই পথেই ছিলেন তিনি – পোল্যান্ডের সবচেয়ে বড় ক্লাব লেজিয়া ওয়ারশর অঙ্গসংঠন ক্লাব ডেল্টা ওয়ারশ দলের হয়ে পোল্যান্ডের পঞ্চম বিভাগে নিয়মিত খেলছিলেন লেভা। ২০০৪-৫ মৌসুমে ১৭ ম্যাচ খেলে ৪ গোল করলেন তিনি, পারফর্মেন্স খুব একটা আহামরি ছিলো না। তবে লেজিয়ার স্কাউটরা যথেষ্ট দেখে ফেলেছিলেন, লেভাকে দলে টানলো লেজিয়া। তবে শর্ত ছিল নিজের যোগ্যতা প্রমাণের জন্য এক বছরের চুক্তি দেওয়া হবে তাঁকে, রিজার্ভ দলের হয়ে খেলার জন্য চতুর্থ বিভাগে পাঠানো হলো ১৭ বছর বয়সী সদ্য কৈশোর পেরনো ফরোয়ার্ডকে। “ট্রায়াল”-এ ফেল করলেন রবার্ট, ১২ ম্যাচে ২ গোল ক্লাব কর্মকর্তাদের মন গলাতে পারলো না। এদিকে বয়সের তুলনায় বাড়ছিলো রবার্টের শরীর, ফুটবলের মতো শরীরনির্ভর খেলায় লেভানডফ্‌স্কির ভবিষ্যৎ অন্ধকার বলে রায় দিলেন লেজিয়ার কোচেরা, চুক্তি না বাড়িয়ে “রিলিজ” করে দেওয়া হলো তাঁকে।

রাগে-দুঃখে-হতাশায় প্রায় ফুটবলই ছেড়ে দিয়েছিলেন লেভা, এবার এগিয়ে এলেন মা ইভোনা। রবার্টকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তৃতীয় বিভাগের দল যেনিয প্রুস্কোতে খেলতে পাঠিয়ে দিলেন একসময়ের তুখোড় এই ভলিবল খেলোয়াড়। নিমিষেই খাদে পড়ে থাকা ক্যারিয়ারটা বিদ্যুৎবেগে ছুট দিলো। ২০০৬-৭ মৌসুমে তৃতীয় বিভাগের সবোর্চ্চ ১৫ গোল করলেন, ক্লাবও উঠে গেলো দ্বিতীয় বিভাগে। পরের মৌসুমে গোলের সামনে আরো ভয়ঙ্কর লেভা, ২১ বার জালে বল জড়ালেন দ্বিতীয় বিভাগের সর্বোচ্চ গোলদাতা। লেজিয়া ওয়ারশ আবার ছুটে এলো কিন্তু রবার্ট যোগ দিলেন লেচ পোজনানে। পোলিশ প্রথম বিভাগ এক্সত্রাক্লাসায় প্রথম মৌসুমে ১৮ গোল, গোলদাতাদের তালিকায় তাঁর উপরে থাকলো মাত্র একটি নাম। পরের মৌসুমেও (২০০৯-১০) ১৮ বার জাল খুঁজে নিলেন, তবে এবার আর তাঁকে কেউ ছুঁতে পারলো না। অন্যদের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলো লেভানডফ্‌স্কির ক্লাব পোজনানও, ১৭ বছর পর লিগ ট্রফি ফিরলো পশ্চিম পোল্যান্ডের শহরটাতে। তবে লেভানডফ্‌স্কির উত্থানের সেটা যে কেবল শুরু সেটা ক’জনই বা ভাবতে পেরেছিল?

5039474-3x2-940x627

শুরুটা অবশ্য ধীরগতিরই বলতে হবে, ৩৩ ম্যাচে ৮ গোল করলেও ৯ বছর পর ইয়ার্গেন ক্লপের অধীনে বুন্দেসলিগা ফিরলো ভেস্টফালেনস্টাডিওনে। পরের মৌসুমে মূল স্ট্রাইকার লুকাস ব্যারিওসের চোটের পুরো ফায়দা তুললেন লেভানডফ্‌স্কি, লিগে ২২ গোলের পাশাপাশি ৬টি অ্যাসিস্ট। তবে সেরাটা শেষের জন্যই তুলে রেখেছিলেন বোধহয়। জার্মান কাপের ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখের বিরুদ্ধে হ্যাট্ট্রিক করে ক্লাবের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ডাবল জেতানোর মূল কারিগর এই পোলিশই। তবে লেভানডফ্‌স্কি নামটা সবাই নতুন করে চিনলো ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিলে। রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে সেমিফাইনালে ঘরের মাঠে একটি কিংবা দুটি নয়, চার-চার খানা গোল করলেন রবার্ট লেভানডফ্‌স্কি। ফুটবল ভক্তরা সেদিন অবাক হয়ে দেখলো অনেকটা চোখের আড়ালেই পরিপূর্ণ এক স্ট্রাইকার হয়ে উঠেছেন লেভা। বক্সের ভেতরে চতুর মুভমেন্ট, সঠিক সময়ে সঠিক সময়ে হাজির হবার সহজাত ক্ষমতায় মুগ্ধতা ছড়ালেন, ডান অথবা বাঁ কিংবা মাথা কোনোটা দিয়েই গন্তব্যস্থলে বল পাঠানোতে অরুচি নেই তাঁর। ফাইনালে অবশ্য চেনা শত্রু বায়ার্ন শিরোপাবঞ্ছিত করলো ডর্টমুন্ডকে, তবে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৩৬ গোলে বিশ্ব জেনে গেলো লেভা এসে গেছেন।

আরেকটা মৌসুম ডর্টমুন্ডে থাকার পর বিনে পয়সায় বায়ার্নে যোগ দিলেন লেভা। এবার শুরু হলো রেকর্ড ভাঙ্গাগড়ার খেলা। ব্যাভারিয়াতে প্রথম মৌসুমে ২৫ গোল করার পর আর কখনোই চল্লিশের নিচে নামেনি লেভানডফ্‌স্কির গোলসংখ্যা। মুড়ি-মুড়কির গোল যেমন করেছেন, তেমনি আদর্শ সেন্টার ফরোয়ার্ডের মতো সতীর্থদের জন্য ফাঁকা জায়গা বানিয়ে দিয়েছেন। ডিফেন্সচেরা নিখুঁত পাস দিতে জুড়ি নেই তাঁর, আবার মাপা ক্রসে বক্সে অপেক্ষারত লাল জার্সিধারীদের পা বা মাথা খুঁজে নিতে বেগ পেতে হয় না তাঁকে। বায়ার্নের আসার পর থেকেই তাঁর পায়ের কাছে লূটিয়ে পড়েছে একের পর এক রেকর্ডঃ ২০১৫-১৬ মৌসুমের এক লিগ ম্যাচে ভলফসবুর্গের বিপক্ষে এক ম্যাচে ৯ মিনিটে ৫ গোল করে চারটি গিনেস বিশ্বরেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন, বুন্দেসলিগার সবোর্চ্চ অজার্মান গোলদাতা (২১৫ গোল) , অজার্মান হিসেবে বুন্দেসলিগায় এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলসহ (২০১৯-২০ মৌসুমে ৩৪ গোল) – তালিকাটা বেশ দীর্ঘ। ৩১ বছর বয়সেই পোল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে সবোর্চ্চ ম্যাচ (১১২) ও গোলের মালিক (৬১) মালিক হয়ে গেছে সেদিনের সেই বোবাক। ২০১৬ ইউরো বাছাইপর্ব ২০১৮ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে করা যথাক্রমে ১৩ ও ১৬ গোল দুটিই ইউরোপ অঞ্চলের রেকর্ড। তবে ২০১৬ এর কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠা বাদ দিলে (কোনো গোল পাননি) বাদে বড় টুর্নামেন্ট শুধু হতাশাই উপহার দিয়েছে লেভাকে। তিন টুর্নামেন্টে গোল পেয়েছেন মোটে একটি, ঘরের মাঠে গ্রীসের বিপক্ষে করা ২০১২ ম্যাচের উদ্বোধনী ম্যাচের গোলটা কেবল সান্ত্বনাই দিতে পারবে তাঁকে। পোল্যান্ডের অন্য সেরা লাতো কিংবা বনিয়েকদের চেয়ে এখানে যোজন যোজন পিছিয়ে বায়ার্ন স্ট্রাইকার। কিন্তু পোলিশ ফুটবলের সেই স্বর্ণযুগ যে আর নেই, বিশ্বকাপে দু’বার তৃতীয় হওয়া পোল্যান্ডকে তাই এখন “অংশগ্রহণই বড় কথা” মন্ত্র যপতে হয়।

robert-lewandowski-cropped_1ja9d21zp5o571mnjlywgayhee

আরেকটা অতৃপ্তির জায়গা আছে, সেই ২০১৩ সালের পর চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল খেলা হয়নি প্রতিযোগিতাটির চতুর্থ সর্বোচ্চ গোলদাতার (৬৭)। তবে বায়ার্নের ফর্ম আর লেভার অতিমানবীয় ফর্ম মিলিয়ে মিউনিখের ক্লাবটির পক্ষে বাজি ধরা লোকের সংখ্যাই বেশি। হয়তো ২৩ জুলাই রাতে এস্তাদিও দা লুশের জনশূন্য গ্যালারির সামনে বিজয়োল্লাসে মেতে উঠবে বায়ার্নের খেলোয়াড়েরা। দলের ৯ নম্বরের চোখ অবশ্য তখন লিসবনের আকাশের দিকে থাকবে। ছলছল চোখে হাজারো তারার মাঝে স্বপ্ন বুনে দেয়া লোকটাকে খুঁজবেন হয়তো। ছেলে হয়তো শুনতে পাবে না, পাবার যে কোনো উপায় নেই; তবুও জীবননদীর ওপার থেকে ক্রিস্তফ তখন হাসিমুখে বলবেন, “তোকে নিয়ে গর্ব হয় রে বোবাক!”