• ফুটবল

রুশদেশের রূপকথার নয়, বাস্তবের নায়ক যিনি

পোস্টটি ২১৩৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে? ইন্টারনেটের এ যুগে আপাতদর্শন এই প্রশ্নখানাই ধুন্ধুমার যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেবে। প্রশ্নকর্তার একই হাল হবে সর্বকালের সেরা ডিফেন্ডার, মিডফিল্ডার কিংবা ফরোয়ার্ডের প্রশ্নেও। কিন্তু সর্বকালের সেরা গোলকিপার? ৯০ ভাগ লোকের মুখ থেকেই অভিন্ন উত্তর পাবেনঃ লেভ ইয়াশিন। এদের মধ্যে ৯৫ ভাগেরই হয়তো ইয়াশিনের সর্বশেষ ম্যাচের পরে জন্ম। কিন্তু একজন ৫০ ও ৬০ এর দশকে খেলা গোলরক্ষককে সেরা বলে মেনে নেয়া চাট্টিখানি কথা নয়, বিশেষ করে সেটা যদি অন্তর্জালে প্রিয় ফুটবলারদের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কলহপ্রবণ প্রজন্মের কাছে তাহলে তো অবাক হওয়ার মতোই ব্যাপার। ইয়াশিন বিশ্বকাপ জেতেননি, ইউরোপিয়ান কাপ (বর্তমানে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ) ফাইনালেও মাঠে নামে হয়নি তাঁর। তবুও তিনি সেরা, তাঁর হাত ধরে গোলরক্ষার মতো নিষ্ক্রিয় কাজটাও গতি পেয়েছে, গোল রক্ষার মতো “বোরিং” কাজটা করেও ব্যালন ডি’অর জিতেছেন এই রাশিয়ান। ফুটবল ইতিহাসে ইয়াশিন তাই শুধুই একজন গোলরক্ষক হয়ে থাকেননি; ইয়াশিন এক ফুটবলদর্শন, আবেগ কিংবা ভালোবাসার নাম।

বড় দুঃসময়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন ইয়াশিন। ১৯২৯ সালের ২২শে অক্টোবর জন্ম তাঁর, দুনিয়ার বুক থেকে তখনো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত শুকোয়নি, বিপ্লবের গন্ধ লেগে আছে সোভিয়েত ইউনিয়নের গায়ে। বারোতে পা দিতে না দিতেই আরেক ভয়ানক দূর্যোগ হাজির। “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ” নামক সর্বগ্রাসী দানবটাকে পেলে-পুষে বড় করতে বৈদ্যুতিক মিস্ত্রীর কাজ নিতে বাধ্য হলেন বালক ইয়াশিন। পাশাপাশি কারখানায়ও টুকটাক কাজ করতেন। তরুণ বয়স থেকেই বাস্কেটবল, আইস হকি আর ফুটবল – তিন মাঠেই ইয়াশিনের দৃপ্ত পদচারণা। মস্কোর উত্তরে তুশিনো নামক সেই কারখানার শ্রমিকদের সাথে সময় পেলেই বল নিয়ে মাঠে ছুটতো ছেলেটা, গোলরক্ষক হিসেবে শট ঠেকানোর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তেও বেশি সময় লাগলো না। তবে চারদিকের দারিদ্র্য, ধ্বংস আর মৃত্যুর মধ্যে বেড়ে ওঠার সময়টা সুখকর ছিলো না, ইয়াশিনকেও পেয়ে বসেছিল বিষণ্ণতা।

Lev-Yashin-1920x1280-1-1080x675বিশ শতকের মাঝভাগে বিশ্বফুটবলের এক পরিচিত দৃশ্য

কিন্তু সব দুঃস্বপ্নেরই তো শেষ আছে। মহাযুদ্ধ শেষ হলো, দেশের আইন অনুযায়ী সামরিক দায়িত্ব পালন করতে সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন ইয়াশিন। এই সেনাবাহিনীতে থাকার সময়েই ডায়নামো মস্কোর যুবদলের কোচ আরকাদি চেরনিশভের চোখে পড়ে গেলেন ইয়াশিন। ২০ বছর বয়সে মস্কোর ঐতিহ্যবাহী দলটাতে যোগ দিলেন ইয়াশিন, তবে দলের প্রথম পছন্দের গোলরক্ষক হওয়ার আশাকে তখন অলীক স্বপ্ন বলেই মনে হচ্ছিল। মস্কোর গোলবারের নিচে প্রহরী হিসেবে ছিলেন আলেক্সেই খোমিচ, ক্ষিপ্রতার কারণে তাঁকে ডাকা হতো “টাইগার” নামে। খোমিচের দুর্দণ্ড প্রতাপের সামনে এতোটাই মিইয়ে গিয়েছিলেন ইয়াশিন যে ফুটবল ছেড়েছুড়ে আইস হকি খেলাতেই মনোনিবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ডায়নামোর আইস হকি দলে নিয়মিত মুখ ছিলেন তিনি, কাপও জেতা হয়ে গিয়েছিল। শেষপর্যন্ত খোমিচের চোটে ১৯৫৩ সালে ডায়নামোর মস্কোর হয়ে অভিষেক হলো, এক বছরের মধ্যেই সদ্য আন্তর্জাতিক ফুটবলে ফেরা সোভিয়েত ইউনিয়নের জাতীয় দলেও সুযোগ মিলল। সুইডেনের বিপক্ষে সেই ম্যাচে ৭-০ গোলে জিতেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৫৬ সালের মেলবোর্ন অলিম্পিকে সোনাজয়ী দলের গোলরক্ষক হিসেবে আন্তর্জাতিক ফুটবলে নিজের উপস্থিতি জানান দিলেন, তবে ইয়াশিন প্রথম তারকাখ্যাতি পান দু’বছর পরের সুইডেন বিশ্বকাপে।

ব্রাজিলের বিপক্ষে গ্রুপপর্বের ম্যাচে ২-০ গোলে হারলেও মাঠের সবচেয়ে উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিলো ইয়াশিনের। গারিঞ্চা-পেলেদের একের পর এক আক্রমণের ঢেউ আছড়ে পড়ছিল ইয়াশিন দেয়ালে, সেদিন ম্যাচ হারলেও ঠিকই দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছিলেন। স্বাগতিক সুইডেনের কাছে হেরে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ছিটকে পড়লেও টুর্নামেন্টের সেরা গোলরক্ষকের পুরষ্কারটা গিয়েছিলো ইয়াশিনের ঝুলিতে।

অন্য গোলরক্ষকদের ইয়াশিনের পার্থক্য ছিলো কোথায়? সমসাময়িক গোলরক্ষকদের তুলনায় বেশ লম্বা (৬’২”) ছিলেন। লম্বা হাতের সুবিধা নিয়ে গোলবারের সব কোণার শটই ফিরিয়ে দিতে পারতেন। উচ্চতা সত্ত্বেও দারুণ চটপটে ছিলেন, ইংরেজি ভাষায় যাকে বলে “Agile”. পেশাদার ফুটবলে ১৫০ এর ওপরে পেনাল্টি ঠেকিয়ে দিয়েছেন তিনি। তবে গোলরক্ষণের মতো নিরস কাজটাকে চিরদিনের মতো বদলে দিয়েছিলেন তিনি। ডিফেন্ডারদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে নির্দেশ দিতেন, ক্রসের সময় এগিয়ে এসে শূন্যে ভেসে বল লুফে নিতেন। প্রতিপক্ষের খেলা পড়ে নিতেও জুড়ি ছিল না তাঁর, বিপদ দেখলেই বাইরে বেরিয়ে বল “ক্লিয়ার” করতেন। আবার দ্রুত থ্রো করে সতীর্থদেরকে কাউন্টার অ্যাটাকের সুযোগ করে দিতেন। ফুটবল ইতিহাসের প্রথম “সুইপার-কিপার” তিনিই, গোলরক্ষকের মোড়কে ইয়াশিন ছিলেন পূর্ণাঙ্গ এক প্যাকেজ।

lev-yashin-vs.-englandপেনাল্টি বক্সটাকে এভাবেই শাসন করতে শিখিয়েছেন তিনি

দেশে ফিরে ডায়নামোকে লিগ জিতিয়েই আবার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফেরা। ১৯৬০ এর ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে বীরোচিত পারফর্মেন্সে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বড় কোনো টুর্নামেন্ট জিতে নিলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু আলোর পর আবার আঁধার এলো ইয়াশিনের ক্যারিয়ারে, ১৯৬১ সালে জাতীয় দলে জায়গা হারালেন। ৬২ সালের বিশ্বকাপ আসতে আসতে অবশ্য নিজেকে প্রমাণ করেই প্রথম পছন্দ হিসেবে দলে ফিরলেন। তবে ৩২ বছর বয়সী ইয়াশিনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন নিয়ে করার মানুষের অভাব ছিলো না। কলম্বিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে ইয়াশিন প্রমাণ করলেন তিনিও শেষপর্যন্ত রক্ত-মাংস দিয়েই গড়া। দু’দুটো দৃষ্টিকটু ভুল করলেন যার একটা ছিল সরাসরি কর্নার কিক থেকে গোল হজম। শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত ৪-৪ গোলে অমীমাংসিত রয়ে গিয়েছিল। কোয়ার্টার ফাইনালে চিলির বিপক্ষে আবারো ভুল করা, এবার তো ২-১ এ হেরে টুর্নামেন্ট থেকেই বাদ পড়লো সোভিয়েত ইউনিয়ন। পরে অবশ্য জানা গিয়েছিল ম্যাচের সময় মাথায় আঘাত পেয়ে “কনকাশন” হয়েছিল, তবে প্রত্যাশিতভাবেই দলের ব্যর্থতার দায়ভার চাপানো হলো তাঁর ঘাড়ে।

wp4608237গোলবারের কোণার শটগুলোও অবিশ্বাস্য দক্ষতায় ফিরিয়ে দিতেন

তবে আজন্ম চ্যাম্পিয়ন ইয়াশিন আরেকবার প্রত্যাবর্তনের গল্প লিখলেন। ১৯৬৩ সালে এফএ কর্তৃক আয়োজিত ইংল্যান্ড বনাম বিশ্ব একাদশের ম্যাচে একের পর এক সেভ করে ওয়েম্বলির দর্শকদেরকে অবাক করে দিচ্ছিলেন ইয়াশিন। জিমি গ্রীভসের শট ফেরাতেই  সেদিন সম্মিলিত করতালিতে ফেটে পড়েছিল ওয়েম্বলির গ্যালারি। এরপর ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বের ম্যাচে ইতালিয়ান কিংবদন্তী সান্দ্রো মাযযোলার পেনাল্টি ঠেকিয়ে দলকে মহাগুরুত্বপূর্ণ এক পয়েন্ট এনে দিয়েছিলেন ইয়াশিন। বছরজুড়ে দারুণ পারফর্মেন্স দেখিয়ে প্রথম এবং একমাত্র গোলরক্ষক হিসেবে ব্যালন ডি’অর জিতেছিলেন ইয়াশিন। আনুষ্ঠানিকভাবে পুরষ্কারটা তাঁর হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল মে মাসের ২৭ তারিখে, সুইডেনের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের পূর্বে। ঘরের মাঠে এক লাখের বেশি সমর্থকের সামনে সেই পুরষ্কার গ্রহণ করাটা সম্ভবত তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। স্পেনের কাছে হেরে ঘরের মাঠে ইউরোপ সেরার মুকুট রক্ষা করা না গেলেও ইয়াশিনের গল্প তখনো ফুরোয়নি।

চোটের কারণে গ্রুপপর্বের দুই ম্যাচে বিশ্রাম নিলেও মাঠে নেমেই সেরা রূপে আবির্ভূত “ব্ল্যাক স্পাইডার”। লালচে রঙের টুপি মাথায় দিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে হাঙ্গেরিকে ছিটকে দিলেন।  সেমিফাইনালে উইয়ি সীলার-বেকেনবাওয়ারদের কাছে পরাজয়টা হয়তো অবধারিতই ছিলো, সাথে শেষ হয়ে গেলো ইয়াশিনের বিশ্বকাপ অধ্যায়ও। ইউসেবিওর পর্তুগালের কাছে হেরে সেবার চতুর্থ হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। ’৬৬ এর পর আর কোনোদিনই বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলা হয়নি ইসবোরনায়াদের। পরের বিশ্বকাপ দলেও ইয়াশিন ছিলেন - তবে তৃতীয় গোলরক্ষক ও সহকারী কোচ হিসেবে। ১৯৭১ সালে ডাইনামো মস্কোর হয়ে শেষবারের মতো মাঠে নেমেছিলেন। সেই বছরই ফিফা তাঁর সম্মানে বিদায়ী ম্যাচের আয়োজিন করেছিলো, লেনিন (বর্তমানে লুঝনিকি) স্টেডিয়ামে লাখখানেক দর্শকের সামনে সেদিন মাঠে নেমেছিলেন পেলে, ইউসেবিও ও বেকেনবাওয়ারদের মতো মহাতারকারা।

শট সেভ করার সময় মনে হতো ইয়াশিনের হাত বুঝি দুটো নয়, আটটা তো হবেই। সবসময় কালো রঙের জার্সি পড়ে নামতেন দেখে ভক্তরা ভালোবেসে তাঁর নাম দিয়েছিলো “ব্ল্যাক স্পাইডার”। মজার ব্যাপার হলো ইয়াশিনের জার্সির রঙ ছিলো গাঢ় নীল, সাদা-কালো টিভির পর্দায় সেটাকে কালো দেখাতো। ১৯৯০ সালে ২১শে মার্চ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন এই কালজয়ী গোলরক্ষক। এরপরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়েছে; এরপর গর্বাচেভ, ইয়েলতসিনদের আমল পেরিয়ে রাশিয়ার ক্ষমতার মসনদে এখন ভ্লাদিমির পুতিন। গোলরক্ষকের পজিশনেও ঘটে গেছে বিপ্লব। ম্যানুয়েল নয়্যারদের হাত ধরে অ্যালিসন-এডারসনরা এখন সুইপার-কিপিংকেই পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু লেভ ইয়াশিনের কাছে গোলরক্ষকরা চিরঋণী – তাই হয়তো মস্কোর গলির ফুটবলে খেলা ছেলেটা, ইউরোপীয় প্রতিযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত মহাতারকা কিংবা আফ্রিকার দুর্গম কোণে খেলা গোলরক্ষক নিয়ত শ্রদ্ধাভরে ইয়াশিনের নাম স্মরণ করে অস্ফুটে বলে চলে “স্যার, আই স্যালুট ইউ।“