• ফুটবল

মরক্কোর জাদুকর

পোস্টটি ২১০৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

আজিজ দৌফিকার ছেলেটাকে নিয়ে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন। দৌফিকার সাহেব নিজেও ফুটবল খেলতেন, মরক্কোর জাতীয় দলের হয়ে ৪৪টি ম্যাচ খেলেছেন। তবে তাঁর বড় পরিচয় একজন পথপ্রদর্শক হিসেবে, ডাচ ফুটবল লিগে তাঁর আগে কোনো মরোক্কান ফুটবল খেলেনি। পেশাদার ক্যারিয়ার শেষ করে আর জন্মভূমিতে ফিরে যাননি, পরিবার নিয়ে নেদারল্যান্ডসেই থিতু হয়েছেন। তাই বালক জিয়েশের বুকে জমে থাকা কষ্টটা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন। তাই দুঃসময়ে ঘূর্ণাবর্তে আটকে পড়া ছেলেটাকে পরম মমতায় কাছে টেনে নিয়েছিলেন। ভাগ্যিস নিয়েছিলেন, নয়তো ফুটবল মাঠে মরক্কোর জাদুকরের ভেল্কি দেখা হতো না ফুটবল সমর্থকদের।

নেদারল্যান্ডসের বেশিরভাগ মরোক্কান পরিবারের মতো জিয়েশ পরিবারের কাজের সন্ধানে নেদারল্যান্ডসে পাড়ি জমানো। নয় সন্তানের মধ্যে হাকিম বয়সে ছিলেন সবার ছোট, তবে শৈশবটা হেসেখেলে কাটানোর সুযোগ হয়নি। খেটে খাওয়া মানুষের পরিবারটায় নুন আনতে পান্তা ফুরোতো, খেয়ে না খেয়ে জিয়েশদের একেকটা দিন পার করতো। তবে রূঢ় বাস্তবতা ভুলে থাকার জন্য ছোট্ট হাকিম বেছে নিয়েছিল ফুটবলে। ফুটবল মাঠে তো আর আমির-ফকিরে ভেদাভেদ নেই, ড্রন্টেনের রাস্তায় খেলার সঙ্গীদের নাকানিচুবানি খাইয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ নাম কামিয়েছিল হাকিম। সাত বছর বয়সে রিয়াল ড্রন্টেনের একাডেমিতে যোগ দিলেও ফুটবলটা হাকিমের কাছে ছিল নিছক বিনোদনের উৎস। কিন্তু ১০ বছর বয়সে বাবার মৃত্যু যেন জীবন থেকে সব আনন্দ শুষে নিলো জিয়েশের। স্কুলে যাওয়া কমাতে কমাতে শেষমেশ একেবারে ছেড়েই দিলো। ফুটবল খেলায়ও মন বসছিল না। আচরণগত সমস্যা দেখা গেলো, চুপচাপ স্বভাবের ছেলেটা যেন চোখের পলকে আক্রমণাত্মক ও মারকুটে হয়ে উঠলো। জিয়েশের মা সংসারের ঘানি একাই টেনে নেওয়ার সংগ্রামের মধ্যেও ছোট ছেলেটা যে বিপথে যাচ্ছে সেটা ঠিক বুঝতে পারছিলেন। হাকিম জিয়েশের প্রতিভার কথা আগে থেকেই শুনেছিলেন আজিজ দৌফিকার। তিনি হাকিমকে নিজের বাসায় নিয়ে এলেন, ফের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। ধ্বংসের ধারপ্রান্ত থেকে যেন নতুন জীবন পেলো হাকিম।

ADO+Den+Haag+v+sc+Heerenveen+Eredivisie+M9BcIjP3CaOxহীরেনভীনে পেশাদার ক্যারিয়ারের সূচনা

১৪ বছর বয়সে হীরেনভীনের একাডেমিতে যোগ দিলেন হাকিম জিয়েশ। জিয়েশের আরো দুই ভাইও ফুটবলার হওয়ার পথে হাঁটছিলেন, তবে ডাকাতির দায়ে ফুটবল মাঠের বদলে জেলে ঠাই হয়েছিল তাদের। তবে দৌফিকারের নিবিড় তত্ত্বাবধায়নে ফুটবলে মন-প্রাণ ঢেলে দিলেন  হাকিম। ২০১২ সালের আগস্টে ১৯ বছর বয়সে র‍্যাপিড বুখারেস্টের বিপক্ষে ইউরোপা লীগের বাছাইপর্বে অভিষেক হলো তাঁর। ঐ মাসেই ডাচ এরেডিভিসিতে অভিষেক হলেও মৌসুমের বাকি সময়টাতে মাত্র ছয়বার মাঠে নামার সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে পরের মৌসুমেই ডাচ লিগের দর্শকেরা তাঁর জাদু দেখতে শুরু করলো সব ধরণের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৩৬ ম্যাচে ১১ গোল, সাথে ৯ অ্যাসিস্ট। সাবেক ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়ন ফেয়নুর্ডে যাবার প্রস্তাব পেলেও জিয়েশ নিজের পরবর্তী ঠিকানা বানালেন এফসি টোয়েন্টেকে।

২০১৪-১৫ সালে লিগে গোল ও অ্যাসিস্টের সম্মিলিত সংখ্যা ছিলো ২৭, পরের মৌসুমেও সংখ্যাটা ২৭ই থাকলো। বাঁ পায়ের দারুণ শটে একের পর এক গোলের সাথে সৃজনশীলতা মিলিয়ে লিগের সবচেয়ে দর্শনীয় ফুটবলারদের একজন হয়ে উঠলেন তিনি। দ্বিতীয় মৌসুমে অধিনায়কত্বও দেয়া হয়েছিল, কিন্তু বিতর্কের সাথে জিয়েশের গাঁটছড়া সেই কবে থেকে। কোচ আলফ্রেড শ্রয়ডারকে ছাটাইয়ের সিদ্ধান্তটা জিয়েশের মনোঃপুত হয়নি। প্রকাশ্যে সমালোচনা করায় তাই কেড়ে নেয়া অধিনায়কের বাহুবন্ধনী। কিন্তু মাঠের দুর্দান্ত পারফর্মেন্সে আয়াক্সের বোর্ডের নজর কেড়েছিলেন। ৯.২ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে এবার ডাচ রাজধানী পা রাখলেন।

শুরুতে বড় ধাক্কা খেলেন, আয়াক্সের হয়ে নিজের দ্বিতীয় ম্যাচে প্যানাথানাইকসের বিপক্ষে ইউরোপা লিগের ম্যাচে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়লেন। ৪৬ ম্যাচে ১২ গোল ও ২০ অ্যাসিস্ট থাকলেও পিএসভির কাছে লিগ শিরোপা হারাতে হলো। সেটা মেনে নিতে পারলো না আয়াক্স সমর্থকেরা, টিম বাসে আক্রমণ চালানো হলো, ভক্তদের সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়ালেন জিয়েশ। এরপর রাগে-দুঃখে সামাজিক মাধ্যম থেকে আয়াক্স জীবনের সব ছবি মুছে ফেললেন, ক্লাব ছেড়ে অন্য কোথাও পাড়ি জমানো তখন স্রেফ সময়ের ব্যাপারই মনে হয়েছিল। তবে আয়াক্সেই থেকে গেলেন সেটা বলাই বাহুল্য। পরের মৌসুমটাও ট্রফিশূন্য থাকলো, কিন্তু ৯ গোল ও ১৮ অ্যাসিস্টে নিজের কাজ করে যাচ্ছিলেন জিয়েশ। ডাচ লিগে খুব পরিচিত নাম হলেও হাকিম জিয়েশকে ফুটবল বিশ্ব আলাদা চোখে দেখা শুরু করলো ২০১৮-১৯ মৌসুমে।

maxresdefaultআয়াক্সের লাল-সাদা জার্সিতে মহাদেশীয় মঞ্চতে আলো ছড়ানো

এরিক টেন হাগের নেতৃত্ব ডি লিখ্‌ট, ডি ইয়ং, নেরেশ, ওনানার মতো তরুণেরা চোখধাঁধানো নির্ভীক ফুটবল খেলে সবার মন জয় করতে লাগলেন। সেই দলটার আক্রমণভাগের ইঞ্জিন ছিলেন জিয়েশ, ৪৯ ম্যাচে ২১ বার বল জালে জড়ালেন, সতীর্থদেরকে দিয়ে গোল করিয়ে নিলেন আরো ২৪ বার। ইয়ুভেন্তাস, চ্যাম্পিয়ন রেয়াল মাদ্রিদের মতো পরাশক্তিদেরকে বিদায় করে দিয়ে মহাদেশীয় প্রতিযোগিতার সেমিফাইনালে উঠে গেলো টেন হাগের দল। তবে শেষরক্ষা হয়নি, লুকাস মওরার দারুণ এক হ্যাট্ট্রিকে আয়াক্স সমর্থকদেরকে চোখের জলে ভাসিয়ে ফাইনালে উঠে গেলো টটেনহাম। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ৩ গোল করেছিলেন জিয়েশ, তাঁর মধ্যে রেয়াল আর টটেনহামের বিপক্ষে দারুণ গোল দুইটির কথা হয়তো আলাদাভাবে মনে থাকবে।

গত মৌসুমে করোনার কারণে ২১ ম্যাচ শেষে বাতিল করা হলো ডাচ লিগ। তবে তাঁর আগে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে অবিশ্বাস্য পারফর্মেন্স দেখে ভাগ্যবিধাতা বুঝি তাঁর পরবর্তী ঠিকানা নির্ধারণ করে দিলেন। স্ট্যামফোর্ড ব্রিজের ভরা গ্যালারির সামনে ২২জন ফুটবলারের ভিড়ে নিজেকে আলাদাভাবে চেনালেন। দারুণ এক কোণাকুণি পাসে কুইন্সি প্রমেসকে দিয়ে গোল করালেন, ডান প্রান্ত থেকে নেয়া ধনুকের মতো বাঁকানো শট বারে লেগে স্বাগতিক গোলরক্ষকের নাক মলে দিয়ে জালে জড়ালো। নিজে গোল না করেও আয়াক্সের নায়ক জিয়েশ, শেষমেশ অবশ্য এক পয়েন্ট নিয়েই ফিরতে হয়েছিল। চেলসি বোর্ড বোধহয় নড়েচড়ে বসেছিল সেদিন, তাই জানুয়ারিতেই আয়াক্সের সাথে পাকা কথা বলে রাখলেন ল্যাম্পার্ডরা। মৌসুম শেষে প্রাথমিকভাবে ৪০ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে চেলসিতে যোগ দেবেন।

মিডফিল্ডে খেলার অভ্যেস থাকলেও আয়াক্সের তাঁর সেরাটা দেখা গেছে ডানপাশের উইংয়ে। ডান প্রান্ত থেকে কাট ইন করে জাদুকরী বাঁ পা দিয়ে অবিশ্বাস্য সব গোল করতে পারেন। কিন্তু জিয়েশের প্রধান অস্ত্র তাঁর সৃজনশীলতা। আপাত নিরীহ সব পাসেও প্রতিপক্ষের রক্ষণকে চিরে ফেলতে পারেন। আয়াক্সে তাঁর শেষ মৌসুমে কুইন্সি প্রমেসকে নিয়ে দারুণ কার্যকর এক জুটি বেঁধেছিলেন এই মরোক্কান। ডান প্রান্ত থেকে তাঁর বাঁয়ের ইনসুইংয়িং ক্রসগুলো ডিফেন্সিভ লাইনের পেছনে পড়তো, ওঁত পেতে থাকা প্রমেস বলটাকে জালে জড়াতে ভুল করতেন না। গত মৌসুমে জমাট রক্ষণের দলগুলোর বিপক্ষে বলের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ রেখেও একটু উদ্ভাবনী ক্ষমতার অভাবে মাথা কুটে মরেছেন ল্যাম্পার্ডের শিষ্যরা। মাস্টার টেকনিশিয়ান জিয়েশের সৃজনশীলতা সেই সমস্যার সমাধান করবেন – চেলসি সমর্থকদের এমনটাই বিশ্বাস। ডাচ বয়সভিত্তিক দলে খেললেও জাতীয় দল হিসেবে বাবা-মায়ের জন্মস্থান মরক্কোকেই বেছে নিয়েছেন, অসামান্য এক প্রতিভা হাতছাড়া হয়ে গেছে বলে নিশ্চয়ই আফসোস হয়ে ডাচ সমর্থকদের।

1536150882-3মামা নৌজ বেটার!

হাকিম জিয়েশের মায়ের বয়স ৭০ পেরিয়েছে। এখন ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারেন না, ছোট ছেলে হাকিমের খেলা তাই মাঠে গিয়ে দেখা হয় না তাঁর। সেই ১৮ বছর বয়সে জন্মভূমি ছেড়ে নেদারল্যান্ডসে আসা, তখন ডাচ ভাষাটাও জানতেন না। চিরসংগ্রামী এই নারী উদায়াস্ত খেটে একে একে ন’টি সন্তানকে মানুষ করেছেন, জিয়েশ তাই সুযোগ পেলেই মাকে ধন্যবাদ জানাতে ভোলেন না। হাকিম মাঠে নামলে অবশ্য টিভির পর্দায় চোখ থাকে মায়ের, প্রতিপক্ষের প্রতিটি ট্যাকেলে মায়ের বুক কেঁপে ওঠে। মমতাময়ী এই মা কিংবা আজিজ দৌফিকার না থাকলে আজ হয়তো হাকিম জিয়েশকে কেউ চিনতোই না। তবে সব বাধা পেরিয়ে হল্যান্ড জয় করে হাকিম জিয়েশ এখন ইংল্যান্ডে। “মরক্কোর জাদুকর” – এর ভেলকিবাজি দেখার জন্য আপনি তৈরি তো?