পেলে - ফুটবলের অবিসংবাদিত রাজা।
পোস্টটি ৩২৬২ বার পঠিত হয়েছে১৯৭৫ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে পেলের শারীরিক এবং মানসিক সক্ষমতার ব্যাপারে নিচের লিখাগুলো প্রকাশ করেঃ
“A few years ago medical experts examined Pelé's slim, athletic figure for weeks in a university laboratory. They prodded him, wired his head for readings, measured his muscles and his mind and when they finished they announced: ‘Whatever this man might have decided to do in any physical or mental endeavor, he would have been a genius.”
১.
ফুটবলে তিন ধরণের GOAT (সর্বকালের সেরা) লেভেলের প্লেয়ার আছে ।
এক, জিনেদিন জিদান বা দিয়েগো ম্যারাডোনার মতো এলিগেন্ট যারা কিনা বড় মঞ্চে নিজেদের যোগ্যতাকে প্রমাণ করেছে এবং শিরোপা জিতেছে ।
দুই, এখনকার লিওনেল মেসি বা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর মতো প্লেয়ার যারা কিনা ক্যারিয়ার জুড়ে প্রচুর গোল করেছে এবং প্রচুর শিরোপা জিতেছে।
তিন, রোনালদো নজারিও বা কিলিয়ান এমবাপ্পের মতো প্লেয়ার যারা কিনা টিনেজ থেকে নিজেদের সেরা প্লেয়ার হিসেবে প্রমাণ করেছে।
আপনি কোন একটা ক্যাটাগরি এখান থেকে নেন এবং পেলেকে নির্দিধায় সব ক্যাটাগরিতে সেরা হিসেবে প্রমাণ করতে পারবেন দিতে ।
আবার, ফুটবলে সাফল্যটা কয়েক রকম হতে পারে।
এক, ব্যাক্তিগত ভাবে প্রচুর গোল বা এসিস্ট করা।
দুই, নিজের পজিশনে নিজেকে সেরা হিসেবে প্রমাণ করা।
তিন, প্রচুর দলীয় সাফল্য অর্জন করা।
পেলেকে এধরণের অর্জনের দিক থেকেও আপনি সেরা হিসেবে প্রমাণ করতে পারবেন।
২.
আমার ধারণা, জিদান যদি ২০০৪ এ অবসর নেয়ার পর অবসর ভেঙ্গে ফিরে ২০০৬ এ বিশ্বকাপ না খেলতো এবং ওভাবে পারফর্ম না করতো তাহলে তার লীগ্যাসিটা এখনকার মতো লেখা হতোনা , ২০০৬ বিশ্বকাপে জিদানের পারফর্মেন্স এতই সুন্দর এবং তার দলের জন্য এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে ওই বিশ্বকাপ না জিতলেও সেবার তার খেলা দেখেই অনেকে তাকে সর্বকালের সেরাদের কাতারে অনেক উপরে জায়গা দেয়া শুরু করে। নিজের শেষ বিশ্বকাপে এসে এমন রাজকীয় পারফর্মেন্স যেকারো মনে জায়গা করে নেয় এবং তার খেলা আবারো দেখতে চাওয়ার একতা অতৃপ্ত ইচ্ছা তৈরি হয় । ইস! যদি আরেকবার দেখতে পারতাম।
১৯৭০ বিশ্বকাপের আগে পেলেও অবসর ভেঙ্গে আসেন। ১৯৬৬ বিশ্বকাপ ব্রাজিলের ভাল যায়নি একেবারেই এবং ১৯৬২ বিশ্বকাপ জিতলেও পেলের পুরো বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ হয়নি । অনেক ফুটবল বিশেষজ্ঞ মনে করেন ১৯৬২ এর পেলে ছিল সত্যিকার অর্থে “বেস্ট ফর্ম অফ পেলে”, কারণ ওই সময় বয়স ছিল মাত্র ২১ এবং ঐ সময়ে সান্তোস্ কে নিয়ে পেলে সাউথ আমেরিকা থেকে শুরু করে ইউরোপ পর্যন্ত রাজত্ব করেছেন । পেলে কিভাবে ইউরোপ রাজত্ব করলো? এগুলা জানার ব্যাপার । যাইহোক, সেই পেলেকে আল্টিমেটলি বিশ্বকাপে দেখে নাই মানুষ । কিন্তু এটা কারো অজানা ছিলনা যে পেলেই বিশ্বের সেরা প্লেয়ার। ১৯৭০ বিশ্বকাপই ছিল পেলেকে বিশ্বমঞ্চে দেখার শেষ সুযোগ ।
সর্বপ্রথম রঙ্গিন টিভিতে বিশ্বকাপ দেখতে এসে ’৭০ বিশ্বকাপে ৩০ বছর বয়সেও দর্শক দেখলো পেলে সত্যিকার অর্থেই বিশ্বের সেরা প্লেয়ার এবং সেই বিশ্বকাপে শুধু গোল্ডেন বল না সাথে নিজের এবং ব্রাজিলের ৩য় বিশ্বকাপ নিয়েই ঘরে ফেরেন পেলে । ওই বিশ্বকাপের ব্রাজিলে দলকে বলা হয় ইতিহাসের সেরা দল এবং পেলে ঐ ছিলেন ওই দলের সেরা প্লেয়ার।
একজন কিংবদন্তির জন্য মানুষ এমন রাজসিক বিদায়ইতো প্রত্যাশা করে এবং বিদায়ের সময় পেলে এমন রেকর্ড রেখে যান যেটা ৫০ বছর মধ্যেও কোন প্লেয়ারের ছোঁয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হয়নাই । ব্রাজিলের রোনালদো আর কাফু সবচেয়ে বেশি কাছে জেতে পেরেছেন দুইবার বিশ্বকাপে জিতে এবং একবার রানার হয়ে । তাও '৯৮ তে জিতলে তাদের আর ২০০২ এ জেতার সেই আকাঙ্খা থাকতো কিনা বলা কঠিণ। কিন্তু পেলে নিজের ৪র্থ বিশ্বকাপ খেলতে এসেও সেইভাবেই বিশ্বকাপ শেষ করেন যেভাবে ১২ বছর আগেও করেছিলেন ।
১৯৫৮ বিশ্বকাপে ফ্রান্সের জাস্টেন ফনটেইন একাই করেছিলেন ১৩ গোল । সেবার সেমিফাইনালে ব্রাজিল মুখোমুখি হয় ফ্রান্সের । ব্রাজিল এর আগে কখনো বিশ্বকাপ জিতেনি, ফ্রান্সও না । ব্রাজিল সাউথ আমেরিকান দল, ফ্রান্স ইউরোপের । কোয়ার্টার ফাইনালে তারা নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডকে হারায় ৪-০ গোলে, ৩য় নির্ধারণি ম্যাচে তারা জার্মানিকে হারায় ৬-৩ গোলে । আর ব্রাজিলের সাথে ওই সেমিফাইনালে তারা হারে ৫-২ গোলে এবং সে ম্যাচে ১৭ বছর বয়সি পেলে হ্যাট্রিক করেন ইউরোপের মাটিতে ।
আপনি পুরা ফুটবল ইতিহাস ঘেটে এমন একটা প্লেয়ারও পাবেন না যে কিনা ওই বয়সেও দলকে বিশ্বকাপ জেতাতে এমন ভূমিকা রাখে, আবার ৩০ বছর বয়সে এসেও বিশ্বকাপ নিয়ে যায় সাথে নিজের ঝুলিতে নেন সেরা প্লেয়ারের তকমা।
৩.
আজকে আমরা মেসি-রোনালদো কে দেখে বুঝতে পারি ক্যারিয়ারে ৭০০+ গোল করতে কি পরিমাণ ধারাবাহিকতা লাগে, কি পরিমান ফিটনেস থাকা লাগে, কি পরিমণ মেধা থাকা লাগে, কি পরিমাণ আগ্রহ থাকা লাগে । মানুষ না বুঝে না জেনে পেলের গোল সংখ্যা নিয়ে ঠাট্টা করে থাকে। পেলে যে ১০০০+ গোল করেছে এটা একটা “লীগ্যাসী”। আর একজন ফুটবলাপ্রেমির এটাকে সম্মান করা উচিত । হ্যা, আপনি যখন তুলনা করবেন তখন আপনাকে অফিশিয়াল ম্যাচ নিয়েই কথা বলতে হবে, এবং সেই অপশন্ আছেই। পেলের অফিশিয়াল গল কয়টা ফিফা নিজেই জানিয়ে দিয়েছে । আপনি পেলের আন-অফিশিয়াল গোলে সংখ্যা নিয়ে যতই মজা করুন না কেন ক্যারিয়ারে অফিশিয়াল ৭৫৭টা গোল কে কি কখনো ইগনোর করা যাবে ? যাবেনা, কোনভাবেই না । আর বর্তমানে ফুটবলাররা যে পরিমাণ অফিশিয়াল ম্যাচ খেলার সুযোগ পান তখনকার সময়ে কি সে সুযোগ ছিল??? অবশ্যই না ।
এবার একটা সম্পুরক প্রসঙ্গে আসি।
আন-অফিশিয়াল গোল বলে পেলের যেসব গোল বাতিল করা হয় সেগুলার মধ্যে সান্তোসের ইউরোপ ট্যুরের সময় করা গোল গুলাও ছিল । আর একটা “আনটোল্ড স্টোরি” হচ্ছে – এই ট্যুরগুলোর জন্য সান্তোস ১৯৬৫ এর পর “কোপা লিবার্তিদোরেস” এর মতো অফিশিয়াল টুর্নামেন্ট থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। কারণটা খুবই যৌক্তিক, কোপা লিবার্তোদোরেস এ চ্যাম্পিয়ন হয়েও ক্লাব এর যে উপার্জন হতো তার চেয়ে বেশি আয় আসতো ইউরোপ ট্যুর থেকে । আর পেলে সহ ওই সান্তোস দলের প্লেয়ারদের বেতনের ব্যাপারটাত ম্যানেজম্যান্টের চিন্তার কারণতো ছিলই। ওই সময়ে আয় এর প্রধাণ উৎস ছিল ম্যাচ এর টিকিট বিক্রির টাকা, এখনকার মতো এতো স্পন্সর সুবিধা ছিলনা । আর এদিকে ক্লাব ওই দশকে লিবার্তদোরেস জেতে দুইবার এবং দুইবারই ইন্টার-কন্টিনেনটাল জেতে, তাই তাদের কিছু প্অরমাণ করারো ছিলনা। এদিকে পেলের সান্তোসের ইতিমধ্যে বিখ্যাত পুর বিশ্বে। তাই সান্তোসের এমন সীদ্ধান্ত নিতে খুব একটা ভাবতে হয়নি। আর সান্তোস যদি কোপা লিবার্তদোরেস এর পরবর্তি আসরগুলো খেলতো তাহলে পেলের অফিশিয়াল গোল সংখ্যা বাড়তো । এদিকে আবার ওর আন-অফিশিয়াল গোল বলে যেসব গোল বাদ দেয়া হচ্ছে সেখানে ইউরোপের দলের বিপক্ষে করা প্রায় ১৪৫ গোলও বাদ পড়ে যাচ্ছে যেটা আসলে কোনভাবেই পেলের সঠিক পরিসংখ্যান তুলে ধরেনা। তারপরও ৭৫৭ অফিশিয়াল গোলও তাকে সর্বকালের সেরা গোলস্কোরার বলার জন্য যথেষ্ঠ বলা যায় ।
৪.
আমার ব্যাক্তিগত মত হচ্ছে, পেলেকে আসলে কোন প্লেয়ারের সাথেই তুলনা করা উচিত না। ফুটবলে পেলের অবস্থান অন্য যেকোন ফুটবলারের চেয়ে উপরে থাকা উচিত। একই প্লেয়ার ট্যাকনিক্যালি, ফিজিক্যালি, ইন্ডিভিজুয়্যালি, কালেকটিভলি এতটা সফল এবং একইসাথে বিশাল তারকার খ্যাতি নিয়ে ফুটবলের সব ক্ষেত্রে প্রথম সারিতে থাকা – এর সবকিছু শুধুমাত্র পেলেই অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে । যেকোন প্লেয়ারের সাথেই অন্য প্লেয়ারের তুলনা হতে পারে, কিন্তু দিনশেষে সেই “অদেখা” পেলের সমকক্ষ অন্য কাউকে বলে মনে হয়নি। ২০০৬ বিশ্বকাপে যখন রোনালদো-জিদান বিদায় নেয় তখন ভাবতাম পেলে বোধয় এদের চেয়ে ভাল ছিলনা । কারন এর চেয়ে ভালতো হতে পারেনা। এরপর যখন মেসি-রোনালদোর যুগ আসলো এখন ভাবি বছরের পর বছর এতো গোল করা কিভাবে সম্ভব- তাও তাদের একজনেরও একটা বিশ্বকাপ নেই। এই যে একটু অপূর্ণতা – এটা পেলের বেলায় খাটেনা বলেই পেলের সাথে আসলে কারো তুলনা চলেনা । তিনটা বিশ্বকাপে, ১৭ বছর বয়সে বিশ্বকাপ।
ফুটবলে প্লেয়ারদের ফিটনেস এখন আগের চেয়ে অনেক অনেক ভাল । গত দশ বছরে গোলের সংখ্যাও বেড়েছে অনেক । সব লীগেই তাদের অতীতের গোল স্কোরিং রেকর্ডগুল ভেঙ্গে যাচ্ছে । এটা দ্বারা বুঝা যায় উন্নত প্রযুক্তি ফুটবলে কতটা প্রভাব ফেলতে সক্ষম । আর বলাই বাহুল্য, পেলে যখন ফুটবল খেলে তখনকার প্রযুক্তি, ট্রেইনিং এর সুযোগ-সুবিধা এবং চিকিতসা ব্যাবস্থা ছিল বর্তমানের তুলনাই ছিল অনেক অনেক পিছিয়ে । আর সেই সময়েই পেলে ছিল ফিজিক্যালি এবং মেন্টালি অস্বাভাবিকরকম ফিট যেটার রেফারেন্স এই লেখার শুরুতেই দেয়া হয়েছে।
****************
৯৮ এর আগে ক্লাস ফোর বা ফাইভের বাংলা বই এ পেলেকে নিয়ে একটা চ্যাপ্টার ছিল – “ফুটবলের রাজা”। ফুটবলে এটাই পেলের ডাকনাম এবং কোন সন্দেহ নেই যে ফুটবলের সত্যিকার রাজা যদি কাউকে বলা যায় তিনি পেলে । আপনি যদি রোনালদো মেসি জিদানদের ফুটবলিয় দক্ষতাগুলোকে এক করেন তাহলে হয়তো আপনি পেলে কে পাবেন। পেলে একজনই, অবিসংবাদিত। ।
৮০ তম জন্মদিনে শুভকামনা।
- 0 মন্তব্য