• ফুটবল

"যদি", "হয়তো"তে আটকে যাওয়া এক ডাচ গ্রেটের কথামালা

পোস্টটি ১৩৬১ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
আলেকজান্ডার যাভারভ বলটাকে আয়ত্তে নিতে পারলেন না। কে জানে হয়তো ফাইনালের পাহাড়সম চাপের মধ্যে ম্যাচে পিছিয়ে থাকা সোভিয়েতদেরকে ক্লান্তি পেয়ে বসেছিল। ডাচ লেফটব্যাক আদ্রি ফন টিগেলেন সুযোগ পেয়েই ছুট লাগালেন। ২০ গজ দৌঁড়ে ফাইনাল থার্ডের বাঁ পাশের হাফ স্পেসে দাঁড়িয়ে থাকা আরনল্ড মুরেনকে পাস দিলেন ফন টিগেলেন। বাঁ পা দিয়ে ঝোলানো ক্রস করলেন মুরেন, তবে সেটা দ্বিতীয় পোস্ট পেরিয়ে পেনাল্টি বক্স থেকেই বেরিয়ে যাবার দশা। বল কাছে আসতেই কমলা দলের ১২ নম্বর জার্সির খেলোয়াড়টা যন্ত্রচালিতের মতো পা চালালেন। সম্ভাব্যতার সূত্রকে বোকা বানিয়ে প্রায় শূন্য কোণ থেকে জালে জড়িয়ে গেলো বল। সোভিয়েত গোলরক্ষক রিনাত দাসায়েভ অভ্যাসবশত হাত বাড়িয়েছেন, তবে কোনো মর্ত্যমানবের পক্ষেই যে সেই শট ঠেকানো সম্ভব নয়! নেদারল্যান্ডসের ম্যানেজার রাইনাস মিশেল নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না, রাশিয়ানদেরকে দেখে মনে হচ্ছিল বুঝি যেন তাঁরা ভরদুপুরে ভরা মজলিসে ভূত দেখেছে। ডাচরা অবশ্য ততক্ষণে উৎসব শুরু করে দিয়েছে, অবশেষে আরাধ্য ট্রফিটার এই মিললো বলে। মিউনিখের অলিম্পিয়াস্টাডিয়নে মধ্য গ্রীষ্মের সেই দিনটাতে নেদারল্যান্ডস দেশটার একজন নায়কের দরকার ছিল, মার্কো ফন বাস্তেন নামের ২৪ বছর বয়সী এক তরুণে সেই নায়ক খুঁজে পেয়েছিল ডাচরা। কিন্তু দিনশেষে নেদারল্যান্ডসের সমৃদ্ধ ফুটবল ইতিহাসের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ট্রফি জয়ের নায়কের ক্যারিয়ারটার সুরতহালে "কী হলো" এর চেয়ে "কী হতে পারতো" প্রশ্নটাই বেশি মানানসই। তিন-তিনবার ব্যালন ডি'অর জেতার পরেও মার্কো বাস্তেন যেন সর্বজয়ী নায়ক নন, বরং বিধ্বস্ত ট্রয়ের বিজিত সেনা।
 
B_L_FmhW4AARXalঅন্য অনেক ডাচ গ্রেটের মতোই আয়াক্সে শুরু
 
  • ফন বাস্তেনের জন্ম ১৯৬৪ সালে, হল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডামের ৩২ মাইল দক্ষিণের ছবির মতো সাজানো শহর উট্রেখটে। স্থানীয় দলের হয়ে টুকটাক ফুটবল খেলতেন, তবে পেশাদার ফুটবলার হবেন এমনটা তখনো ভাবনাতে আসেনি। সবুজ মাঠে ছুটে বেড়ানোর পেছনে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিল ভালোবাসা, ফুটবল খেলাটাতেও নেহায়েত মন্দ ছিলেন না। স্থানীয় দল ইউভিভি উট্রেখটের যুবদলে নয় বছর কাটানোর পর ষোলো বছর বয়সে আচমকা আজন্ম লালিত স্বপ্নটা হাতের মুঠোয় এসে ধরা ছিল। স্বপ্নের নায়ক ইয়োহান ক্রুইফের স্বপ্নের ক্লাব আয়াক্স আমস্টারডামে যোগ দিলো উট্রেখটের সেই মার্কো। নিয়তির পাতাগুলোতে যেন আগে থেকেই লেখাজোকা করে রাখা হয়েছিল। ১৯৮২ সালের তেসরা এপ্রিল এনিইসি ক্লাবের সাথে বিখ্যাত লাল জার্সিতে অভিষেক ফন বাস্তেনের, স্বয়ং ক্রুইফের বদলি হিসেবে নামলেন। প্রথম ম্যাচে গোল করে শুরুটা দারুণ হলো। এরপর? দলে জায়গা পাকা করতে আরেকটা মৌসুম সময় নিলেন। তারপর থেকে শুধু গোল, গোল আর গোল। এরপর আয়াক্সে ছিলেন চার মৌসুম, ১১২ লিগ ম্যাচে করলেন ১১৮ গোল। হালের মেসি-রোনালদোর মতো পরিসংখ্যান; তিন লিগ শিরোপার সাথে তিন কাপ, মহাদেশীয় মঞ্চে কাপ উইনার্স কাপও জেতা হয়ে গেলো। কিন্তু নতুন চ্যালেঞ্জের ডাক চলে এসেছে, সিলভিও বেরলুসকোনির হাত ধরে এসি মিলানে চলে এলেন ফন বাস্তেন। ক্রুইফের দেশ থেকে আরো দু'জন এলেন মিলানে, রুড হুলিত এলেন পিএসভি থেকে আর ফ্র্যাংক রাইকার্ড এলেন স্পোর্টিং লিসবন থেকে। তবে প্রথম মৌসুমে মাত্র ১১ বার মাঠে নামা হলো ফন বাস্তেনের, গোড়ালির পুরনো চোটটা ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তবে জরাজীর্ণ ফিটনেস নিয়েই জার্মানির বিমানে চাপলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচটা বেঞ্চে কাটাতে হলো। তবে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচে নেমেই বাজিমাত, তাঁর হ্যাট্ট্রিকে ইংলিশ বাধা পেরোলো ডাচরা। সেমিফাইনালে জার্মান সেন্টারপব্যাক ইয়ুর্গেন কোহলারের সাথে দারুণ এক লড়াইয়ের পর জয়সূচক গোলটা এলো মার্কোর পা থেকেই। আর ফাইনালে তো টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতার পা থেকে মহাকাব্যই রচিত হলো।

CkSBroAWgAATBWAজাদুকরী সেই ভলি

 
  • জাতীয় দলের ফর্মটা ক্লাবেও টেনে আনলেন ফন বাস্তেন। সেবছরের ব্যালন ডি'অর জয়ী মৌসুমে ৩২ গোল করলেন যার দুটি ছিলো ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনালে স্টুয়া বুখারেস্টের বিপক্ষে। পরের মৌসুমেও লিগের সেরা গোলদাতা (১৯ গোল) হলেন, বেনফিকা হারিয়ে ইউরোপিয়ান কাপটা সান সিরোতেই রেখে দিলো সাচ্চি বাহিনী। ফাইনালের একমাত্র গোলটা রাইকার্ডে পা থেকে এলেও মূল কারিগর ছিলেন ফন বাস্তেন। ১৯৯০-৯১ মৌসুমের শুরু থেকেই ধুঁকতে শুরু করলো মিলান। ৩৫ ম্যাচে মাত্র ১১ বার জালের দেখা পেলেন ফন বাস্তেন, দলের ব্যর্থতার দায়ে চাকরি খোয়া গেলো কিংবদন্তি কোচ আরিগো সাচ্চির। ফন বাস্তেনের সাথে মনোমালিন্যও হয়তো এর প্রছন্ন কারণ হতে পারে। সাচ্চির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ বড্ড অসহ্য লাগতো ফন বাস্তেনের কাছে, একই কথা মন্ত্র যপার মতো বলে যাওয়াটার মধ্যে কোনো সৃষ্টিশীলতা যেন খুঁজে পেতেন না ডাচ ফরোয়ার্ড। নতুন কোচ হিসেবে এলেন ফাবিও কাপেলো, ফন বাস্তেন ফিরে পেলেন ফর্ম। গোটেবার্গের সাথে তাঁর চার গোল নতুন মোড়কে সাজানো চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসে প্রথম গোল চতুষ্টয়। লিগে ৩১ ম্যাচে ২৫ গোল; স্কুদেত্তো, ফিফার বর্ষসেরা খেলোয়াড় আর ব্যালন ডি'অর নিয়ে স্বপ্নের মতো মৌসুম। তবে পুরনো দুশমন গোড়ালির চোট বারবার হানা দিতে লাগলো, ১৯৯২-৯৩ মৌসুমে তৃতীয়বারের মতো শল্যবিদের ছুরির নিচে নিজেকে সঁপে দিতে হলো। তবুও ২২ ম্যাচে ২০ গোল করেছিলেন। তবে সব চক্রেরই কিন্তু একটা পূর্ণতা আছে, ভাগ্যচক্রে পেশাদার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচটাও মিউনিখের অলিম্পিয়াস্টাডিয়নেই খেললেন ফন বাস্তেন। তবে এবার রূপকথা রচিত হলো না, ৮৬ মিনিটে চোট নিয়ে উঠে যেতে হতে হলো তাঁকে। ম্যাচশেষে দূর থেকে আবেদি পেলে রুডি ফোলারদের বিজয়োল্লাস দেখতে হলো, ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে মাত্র ২৮ বছর বয়সেই বিদায় বলতে হবে সেটা জানতেন না।
 
  • গোড়ালির চোটের জন্য অবর্ণনীয় ব্যথা সহ্য করতে হয়েছে ফন বাস্তেনকে। মাঝরাতে ঘুম ভেংগে গেলে বাথরুমে যেতেন হামাগুড়ি দিয়ে, পা টা সোজা করার সামর্থ্যও ছিল না। তবে দুই মৌসুম তাঁকে দলে রেখেছিল মিলান, ফন বাস্তেনও মাঠে ফেরার প্রাণপন চেষ্টা করেছেন। তবে লাভের খাতায় শুন্যটা আঁকাই ছিল, ১৯৯৫ সালে সান সিরোতে এক লিগ ম্যাচের আগে রোসোনেরি সমর্থকদেরকে বিদায় বলে দিলেন মার্কো ফন বাস্তেন। স্তাদিও জিউসেপ্পে মিয়াজ্জাতে সেদিন কান্নার রোল উঠেছিল, খাঁটি পেশাদার ফাবিও কাপেলোকেও সেদিন চোখ মুছতে দেখা গিয়েছিল। ফুটবল এক অনন্য সাধারণকে হারালো বড্ড অসময়ে।

EfspfrDX0AAOXggতবুও যে বিদায় বলতে হয়!

 
এতশত ট্রফি, মেডেল আর ব্যক্তিগত অর্জনের মাঝেও ফন বাস্তেন তাই দীর্ঘশ্বাস ছাড়বেন। ছেলেবেলার নায়ক ক্রুইফের সাথে মনোমালিন্য হয়েছিল আয়াক্সের ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে, সেই সম্পর্কের বরফ গলার আগেই অবশ্য পৃথিবী ছেড়ে অনন্তলোকে পাড়ি জমান ক্রুইফ। কোচিংয়ে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু প্রধান কোচের জোয়ালটা বইতে গিয়ে হাসফাঁস করে ছেড়েছেন সেটাও। আমরা বরং খেলোয়াড় ফন বাস্তেনকেই মনে রাখি। ফুটবল পায়ে অভিজাত ভংগিমার কারণে তাঁকে ডাকা হতো "উট্রেখটের রাজহাঁস নামে"। ফুটবলের ইতিহাসে সেরা পরিপূর্ণ ফুটবলারের তালিকায় তাঁর নামটা ওপরের দিকেই থাকবে। মুভমেন্ট, ফিনিশিং, বাতাসে দক্ষতা, শারীরিক সক্ষমতা, দারুণ সব শট, ড্রিবলিং, হোল্ড আপ প্লে থেকে শুরু করে ফাইনাল পাস - ফন বাস্তেনের তূণে তীরের অভাব ছিল না। ডে বশ, গোটেবার্গের বিপক্ষে বাইসাইকেল কিক দুটো নিয়ে বেশি হইচই হলেও এই ধরণের এক্রোবেটিক শট তাঁর কাছে ডালভাত ছিল। আর ১৯৮৮ ইউরোর ফাইনালে সেই ভলিটা? কী হতে পারতেন, কী হয়েছেন প্রশ্নগুলো তাই মাঝে মাঝে বড্ড পানসে লাগে, মার্কো ফন বাস্তেনকে কি আর একটা প্রশ্নবোধক চিহ্নের মধ্যে আটকে ফেলা যায়!