• ফুটবল

শুভ জন্মদিন কার্লেস!

পোস্টটি ১২৮৯ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
নিজেদের ফুটবলের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্বমঞ্চে ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে স্পেনের "সোনালী প্রজন্ম"। এর আগে বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতায় চতুর্থ (ব্রাজিল, ১৯৫০) হলেও সে আমলে সেমিফাইনাল-ফাইনালের বালাই ছিল না। বল পায়ে রেখে বারবার আক্রমণ জমানোর চেষ্টা করলেও জার্মান রক্ষণ প্রাচীর যেন অভেদ্য। অন্তত ৭৩তম মিনিট পর্যন্ত। ডান প্রান্ত থেকে বাতাসে ভাসানো ইন্সুংগিং কর্নার নিলেন শাবি এরনান্দেজ। ডারবানের রাতের বাতাসে যেন কিছুক্ষণ ঝুলে থাকলো বলটা, এরপর আস্তে আস্তে নেমে আসতে লাগলো। মার্কার সামি খেদিরাকে পরাস্ত করে হেড করার জন্য লাফিয়ে উঠলেন জেরার্দ পিকে। তবে পিকের ৬ ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা শরীরটা বলের কাছে আসার আগেই তাঁর চেয়ে গতরে ইঞ্চিপাঁচেক ছোট আরেকজন বলের উপর রীতিমতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন। কার্লেস পুইয়োল ফ্রেমেই ছিলেন না, তবে সুযোগ দেখে যেন মুহূর্তের মধ্যেই উন্মত্ত ষাঁড় বনে গেলেন। জার্মান জালের সামনে দাঁড়ানো ম্যানুয়েল নয়্যার বৃথাই ঝাঁপ দিলেন, সেই হেডার ঠেকানো কোনো মনুষ্যসন্তানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। জার্মান প্রতিরোধ ভেংগে "লা ফুরিয়া রোহা"দেরকে ফাইনালের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিলেন এক পুরনো সৈনিক। ভাগ্যিস সেদিন পুইয়োল ছিলেন।
 
ইউরোপীয় ফুটবলে টাকা ওড়াওড়ির এ যুগে "ওয়ান ক্লাব ম্যান" পাওয়া বড়ই দুষ্কর। বেশিরভাগ ফুটবলারই কমসে কম তিনটে ক্লাবের হয়ে গেলেন ক্যারিয়ারের বিভিন্ন পর্যায়ে, সেটা অর্থ, পজিশন, খেলার সুযোগ কিংবা প্রজেক্ট - যে কারণই হোক না কেন। বাকিরা হয়তো ৩৩-৩৪ বছর পর্যন্ত এক ক্লাবে খেলেন, এরপর অন্তিমলগ্নে চলে যান মধ্যপ্রাচ্য, মার্কিন মুলুক কিংবা দূরপ্রাচ্যের কোনো ক্লাবে। কিন্তু পুইয়োল যে এক ব্যক্তিক্রমের নাম। ১৮ বছরের পেশাদার ক্যারিয়ারের পুরোটাই দিয়েছেন বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাবকে। কাতালুনিয়াতেই জন্ম, বেড়ে ওঠা, ফুটবল খেলেছেনও সেখানেই। কাতালুনিয়ার "জাতীয়" দলের অনুমোদন নেই ফিফার, তবুও স্থানীয় খেলোয়াড়দের নিয়ে মাঝে মাঝেই খেলার আয়োজন করা হয়। সেই দলের অংশ হিসেবে ছ'বার মাঠে নেমেছেন পুইয়োল। স্পেনের হয় তাঁর খেলা ম্যাচের সংখ্যা কাঁটায় কাঁটা একশ, শত ম্যাচ খেলা ১৩ জন গর্বিত স্প্যানিয়ার্ডদের একজন ঝাঁকড়াচুলো এই সেন্টারব্যাক। বার্সেলোনার জার্সি গায়ে চাপিয়ে মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন ৫৯৩ বার। হাঁটুর চোট বারবার হানা দিলে হয়তো সংখ্যাটা বাড়তে পারতো। আবার সংখ্যাটা শুন্যতে আটকে যাবারও সম্ভাবনা ছিল। ১৯৯৮ এর দিকে মালাগার কাছে ভবিষ্যৎ বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে বিক্রি করে দিতে চেয়েছিল বার্সা। কিন্তু বন্ধু শাবির মূলদলে ঢোকা দেখে পুইয়োলের মাথায় জেদ চেপে গিয়েছিল। সেন্টারব্যাকের একটা জায়গা তিনি দখল করবেনই। তাঁর বাসার শোকেসভর্তি ট্রফি আর মেডেল জানিয়ে দেবে পুইয়োল পেরেছেন।

Carles-Puyol

 

যুবদলের শুরুতে ছিলেন ফরোয়ার্ড, এরপর আস্তে আস্তে রক্ষণে নেমে যাওয়া। সোনালী প্রজন্মের আরেক কাণ্ডারি সের্হিও রামোসের সাথে এই ব্যাপারে দারুণ সাদৃশ্য আছে পুইয়োলের। রামোসের মতোই পুইয়োল শুরুর দিকে ছিলেন রাইটব্যাক, এমনকি ২০০২ সালে ইউয়েফা বর্ষসেরা ডিফেন্ডারও হয়েছিলেন। কিন্তু চোটের থাবায় গতি হারিয়ে পরে রক্ষণের মাঝেই থিতু হন। ফুটবলে সুবিধে করতে পারবেন না ভেবে বাবা-মা যে কার্লেসকে পড়াশোনায় মন দিতে বলেছিল, ২০০৩-০৪ মৌসুমে লুই এনরিকের অবসরের পর সেই পুইয়োলই কিনা বার্সেলোনার অধিনায়ক হলেন। অধিনায়ক অনেকেই হতে পারে, কিন্তু নেতা হতে পারেন ক'জন। কার্লেস পুয়োল হয়ে উঠেছিলেন বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাবের প্রতীক, কাতালুনিয়ান ফুটবলের অবিসংবাদী নেতা। ডিফেন্ডার হলেও ট্যাকলে ছিলেন পরিচ্ছন্ন, জয়ের নেশার সামনে কোনোকিছুকেই প্রশয় দেননি কখনো। ভনিতা করে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা নেই, সতীর্থদেরকে আগলে রেখেছেন, আবার মনোযোগ হারাতে দেখলে করেছেন শাসন। মাঠে বাকি ২২ জনের মধ্যে থেকে আজীবন ঝাঁকড়াচুলো পুইয়োলকে আলাদাভাবে চেনা যেত। তারকাসুলভ অহমিকা তাঁর ছিল না কোনোকালেই, যে কোনো মূল্যে কেবল জিততে চাইতেন। "ব্লাউগারানা" জার্সিটাকে প্রতিনিধিত্ব করাটাকেই জীবনের মূলমন্ত্র বানিয়েছিলেন, সাতবার শল্যবিদের ছুরির নিচে গিয়েও সেই স্পৃহা কমেনি। "লা মাসিয়া"তে বেড়ে ওঠা সমসাময়িকদের মতো বলে দক্ষতা হয়তো অতোটা ছিল না, কিন্তু আত্মনিবেদনে পুইয়োল শতভাগ নম্বর পাবেন। স্লাইডিং ট্যাকলের টাইমিংয়ে ছিলেন নিখুঁত, পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চির "বেঁটে" ডিফেন্ডার হলেও বাতাসে রীতিমতো শাসন করতেন ফরোয়ার্ডদেরকে, পজিশনাল সেন্স ছিল ঈর্ষণীয়, নব্বইতম মিনিটেও মনোযোগে একটুও চির ধরতো না। পিকেদের মতো পাসিংয়ে অতোটা দক্ষ না হলেও বল ডিস্ট্রিবিউশনে পিছিয়ে থাকবেন না অতোটা। তবে চমৎকার ফুটবলার তো অনেকই আছে, পুইয়োলের মতো নেতা? কোটিতে একজন মেলে কিনা সন্দেহ।
 

20170707-The18-Photo-Carles-Puyol-Goal-Germany-2010-World-Cup

২০১৪ সালের ১৫ই মে'তে প্রিয় নেতাকে বিদায় জানিয়েছিল বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাব। সেদিন লোকে লোকারণ্য অডিটোরিয়ামে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে কার্লেস পুইয়োল সাফোরকাদা জানিয়েছিলেন স্বপ্নপূরণের কথা, "হাজারো শিশুর মনে যে স্বপ্নটা লুকিয়ে থাকে আমি সেটা বাস্তবে করতে পেরেছি। ফুটবল খেলা আর অনুশীলনের মধ্যে জীবনের সবচেয়ে উপভোগ্য সময় কেটেছে আমার"। ক্যারিয়ারে যা যা সম্ভব তার সবকিছু জিতেই ফুটবলের মঞ্চ ছেড়েছেন পুইয়োল। পুইয়োলের সাথে সাথে যেন বার্সেলোনার সুসময়টাও নাই হয়ে গেছে। সাথে স্পেন জাতীয় দলেরও। ভগ্নদশা রক্ষণ যেন চিৎকার করে বারবার জানিয়ে দেয় একজন নেতার অভাব। বার্সেলোনা আরেকজন পুইয়োলকে পাবে কখনো? যিনি জয়ের জন্য খেলার মাঠে নিজেকে উজাড় করে দেবেন। নিজে লড়াই করে যাবেন, সতীর্থদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন পথ দেখিয়ে। তবে পুইয়োলরা যে বারবার আসেন না। এখন তাই এখন সুসময়ের স্মৃতি হাতড়ানো চলে। ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো উল্লাসের স্মৃতি।
জন্মদিনের শুভেচ্ছা কার্লেস!