• ফুটবল

প্রফেসর, স্নাইপার এবং জার্মান যন্ত্র

পোস্টটি ২৪৪৭ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
দৃশ্যপট ১: স্বপ্নের মতো এক বিশ্বকাপ কাটিয়েছেন। ফাইনালে মাঠে নামার আগে তাঁর নামের পাশে দুই গোল ও চার অ্যাসিস্ট। বলটা বুঝি তাঁর কথা শুনতে পায়, একের পর এক নিখুঁত মাপা সব পাসে সতীর্থদেরকে ঠিকঠাক খুঁজে নিয়েছেন। তাঁর পাসিং জাদুতে মুগ্ধ হয়ে স্বাগতিকরা তার দিয়েছিল "গারকম"। পর্তুগিজ থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করলে যার অর্থ দাঁড়াবে "ওয়েদার"। তিনবারের বিশ্বজয়ীদের অন্যতম বড় ভরসা হিসেবেই জীবনের সবচেয়ে বড় ম্যাচে খেলতে নামলেন টনি ক্রুস। কিন্তু প্রকৃতির এক অমোঘ নিয়ম - এক দলকে জিততে হলে তো অন্য দলকে হারতেই হবে। পেশাদার ফুটবলার হলেও মানুষ হয়ে জন্মেছেন, তাই কেউ না কেউ ভুল করেই ফেলেন। জার্মান যন্ত্রে আবেগের অচেনা ছোঁয়া লেগেছিল কিনা কে জানে, ম্যাচের ২০ মিনিটে গড়বড় করে ফেললেন ক্রুস। লাফিয়ে উঠে নিজেদের ডি বক্সের দিকে হেডে ব্যাকপাস দিলেন, কিন্তু ম্যাট হুমেলস দেখেও দুই-তিন গজ সামনে পড়লো সেটা। ক্ষণিকের জন্য মনোযোগ হারানো, তাতেই বিশ্বকাপ স্বপ্ন ভেংগেচুরে পড়ার দশা। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার উপায় ছিলো না চব্বিশ বছর বয়সী তরুণের। আর্জেন্টাইন গন্সালো ইগুয়াইনের সামনে একবার ড্রপ করলো, এরপরই হাফভলিতে জোরসে কিক নিলেন সাবেক রেয়াল মাদ্রিদ স্ট্রাইকার...
জার্মানির উত্তর-পূর্বে বাল্টিক সাগরের তীরে ছিমছাম গোছানো এক শহর গ্রিফসভাল্ড। শহরের বদলে "বিশ্ববিদ্যালয় শহর" নামটাই বেশি মানানসই। শহরের জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশের জীবিকাই যে "গ্রিফসভাল্ড" বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে জড়িত ছিল। তবে ছোট্ট টনির কিন্তু পড়াশোনায় মন বসতো না। বই পড়তে ভালোবাসতো সে, কিন্তু পাঠ্যবইয়ে তেমন রুচি ছিল না। বাকি সময়টায় ফুটবলমাঠেই পাওয়া যেত ওকে। মা বারগিট কামার একসময় তুখোড় ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় ছিলেন, পরে অবশ্য শিক্ষকতায় থিতু হয়েছেন। বাবা রোলান্ড ক্রুস আবার ছিলেন কুস্তিগির, পরে ফুটবল কোচিংয়ে আসা তাঁর। মোটকথা, খেলাপাগল এক পরিবারেই ক্রুসের বেড়ে ওঠা। একবার মওকা পেলেই হয়েছে, ছোটভাই ফেলিক্সকে নিয়ে টনি বেমালুম গায়েব। তবে এমন না যে স্কুল ফাঁকি দিয়ে ফুটবল খেলতো ছেলেটা। পড়াশোনার প্রতি অনীহা থাকলেও নিয়মানুবর্তিতা আর শিষ্টতার জন্য টনির বেশ ভালো নামডাক ছিল। তবে পিঠেপিঠি দুই ভাইয়ের দিনগুলো হঠাৎ করেই বদলে গেলো। স্থানীয় ক্লাব গ্রিফসভাল্ডার এফসির শিশুদলে জায়গা মিললো তাঁদের। স্কুল-ট্রেনিং-ম্যাচ-হোমওয়ার্ক: নিয়মের শেকলে বাঁধা পড়া সেই ৭ বছর বয়স থেকেই। গ্রিফসভাল্ডারে পাঁচ বছর কাটিয়ে এরপর দু'ভাই এলো পূর্ব জার্মানির ইতিহাসে অন্যতম সফল ফুটবল ক্লাব হানসা রোস্টক ক্লাবের একাডেমিতে। মজার ব্যাপার হলো, এই ক্লাবের যুবদলের কোচ ছিলেন স্বয়ং রোলান্ড ক্রুস। তাই বাবার কড়া নজরদারিতেই দুই ভাইয়ের ফুটবল সত্তার বেড়ে ওঠা। তবে ফেলিক্স তো অবশ্যই রোস্টকের পুরো স্কোয়াডের চেয়েই টনি যে আলাদা ধাতুতে গড়া সেটা ঐ বয়সেই বোঝা হয়ে গিয়েছিল। ঠাণ্ডা পরিণত ফুটবল মস্তিষ্কের সাথে ফুটবল দক্ষতার এমন মেলবন্ধন যে সহজে দেখা মেলে না। তাই বায়ার্ন মিউনিখের ২.৩০ মিলিয়ন ইউরোর প্রস্তাবটা ক্লাবের সংশ্লিষ্ট কারো কাছেই বিস্ময় হয়ে আসেনি। ২০০৬ সালের ১ জুলাই পূর্ব জার্মানির সেই শান্তশিষ্ট ছেলেটা আনুষ্ঠানিকভাবে বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে গেলো।

1e6855c854a2f9ddb70a0c9c67d40714

বায়ার্নে আসার পরপরই বয়সভিত্তিক দলের হয়ে আন্তর্জাতিক অংগন কাঁপানো শুরু। লুক্সেমবার্গে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব - ১৭ ইউয়েফা চ্যাম্পিয়নশিপে জার্মানি চতুর্থ হলেও টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হলেন ক্রুস। পরের বছরেও একই চিত্রনাট্যের পুনর্মঞ্চায়ন, আবারো সেমিফাইনাল ওঠার পর টুর্নামেন্ট থেকে জার্মান অনূর্ধ্ব - ১৭ দলের ছিটকে পড়া। তবে দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত সেই টুর্নামেন্ট ক্রুসকে খালি হাতে ফেরায়নি। আরেকবার টুর্নামেন্ট সেরার গোল্ডেন বল জিতলেন, ৫ গোল করে ব্রোঞ্জ বুটও বাগিয়ে নিলেন। বায়ার্নের মূলদলে অভিষেকের জন্য এরপর খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। ২০০৭ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বরে এনার্জি কোটবাসের বিপক্ষে বুন্দেসলীগায় অভিষেক। তবে নিজের জাতটা চেনাতে মোটেও সময় নিলেন না, বদলি হিসেবে নেমে ১৮ মিনিটের মধ্যেই দু'বার মিরোস্লাভ ক্লোসার গোলে সহায়তা করলেন। ২০১০ সালে ডাভিড আলাবার অভিষেকের আগে বায়ার্নের হয়ে সবচেয়ে কম বয়সী "ডেব্যুট্যান্ট" ছিলেন এই ক্রুসই (১৭ বছর ২৬৫ দিন)। ইউরোপীয় প্রতিযোগিতায় অভিষেকটাও মনে রাখার মতো হলো। ৮১ মিনিটে ক্রুস মাঠে নামার সময় স্বাগতিক রেড স্টার বেলগ্রেডের বিপক্ষে পিছিয়ে ছিল বায়ার্ন মিউনিখ। নেমেই ক্লোসাকে গোল বানিয়ে দিলেন, এরপর যোগ করা সময়ে ক্যারিয়ারের প্রথম গোল করে জিতিয়ে দিলেন "ডি রটেন"দেরকে! সিনেমার গল্পকেও হার মানানো এক আবির্ভাব। প্রথম মৌসুমে ২০ ম্যাচ খেলে গোল ঐ একটিই, এরপর অর্ধেক মৌসুম খেলে ধারে যেতে হলো বেয়ার লেভারকুসেনে। ২০০৯-১০ মৌসুমটা ক্রুসের মৌসুমে ইংরেজিতে যাকে বলে "মোস্ট প্রলিফিক" - ঐ মৌসুমে বুন্দেসলিগায় ৩৩ ম্যাচ খেলে ৯ গোল আর ১২ বার গোলে সহায়তা করলেন ক্রুস। নজরকাড়া পারফর্মেন্স জার্মান কোচ ইয়াকিম লোভের নজর এড়ালো না, দক্ষিণ আফ্রিকার বিমানে ঠাঁই মিললো ক্রুসের। মাঠে নামার সুযোগ তেমন মিললো না, ঘানা, আর্জেন্টিনা, স্পেন আর উরুগুয়ের বিপক্ষে বদলি হিসেবেই মাঠে নামলেন। বায়ার্নে ফিরে এসেও আগের কাজটাই করে যেতে লাগলেন। মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণ, নিখুঁত সব পাস, ম্যাচ আর ট্রফির পর ট্রফি জেতা। রেয়ালের হয়ে এখনো এই কাজটাই করে যাচ্ছেন। ২০১৪ বিশ্বকাপ শেষের আগেই রেয়াল মাদ্রিদ ক্রুসকে দলের ভেড়ানোর জন্য আগে থেকেই কথাবার্তা পাকা করে রেখেছিল। তাই মোটামুটি পানির দামেই (২৫ মিলিয়ন ইউরোর আশেপাশের অংক) ক্রুসকে দলে ভেড়ায় ইউরোপের সবচেয়ে সফল দল। ক্রুস যেন আপাতমস্তক চিরন্তন এক জার্মানের প্রতিচ্ছবি। মাঠে সহজে আবেগ দেখান না, দলের প্রয়োজনে উজাড় করে দেন সবটুকু, চাপ সচরাচর স্পর্শ করে না তাকে। দূরপাল্লার শটও সাইডফুটে নিখুঁতভাবে আলস্যভরে ঠেলে দেন যেন, সমর্থকেরা এজন্য তাকে ডাকে স্নাইপার নামে। সম্প্রতি লিভারপুলের বিপক্ষে দাপুটে পারফর্মেন্সে দেখিয়ে দিলেন তিরিশের ডান এসেও তিনি বদলাননি। ভিনিসিয়াস জুনিয়রকে অবিশ্বাস্য এক পাসে খুঁজে নিলেন, সেখান থেকেই এলো প্রথম গোল। জার্মানরা আসলে যন্ত্রই বোধহয়।
2002902
দৃশ্যপট ২: আগের দৃশ্যের পর চারটি বছর পেরিয়ে গেছে। সোচির অলিম্পিক স্টেডিয়াম। গ্রুপ পর্বে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচ খেলতে মুখোমুখি জার্মানি ও সুইডেন। জার্মান চ্যাম্পিয়ন নিজেদের প্রথম ম্যাচে মেক্সিকোর কাছে হেরে যাওয়ায় টিকে থাকার জন্য এই ম্যাচে জয়টা খুব দরকার ছিল। কিন্তু নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলা শেষে খেলায় ১-১ সমতা, জার্মান ভাগ্য ঝুলছে যোগ করা সময়ের সুতোয়। চতুর্থ মিনিটে সুইডেন বক্সের ডান কোণা ঘেঁষা এক জায়গায় ফ্রী-কিক পেলো জার্মানি। তিন পয়েন্টের শেষ সুযোগ। বলের থেকে একটু ডানে সরে কাছেই জায়গা নিলেন মার্কো রয়েস, শট মারার জন্য প্রস্তুত টনি ক্রুস। ক্রুস বলটা ঠেলে দিলেন রয়েসের দিকে, রয়েস থামালেন সেটা, এবার ক্রুস এগিয়ে শট নিলেন...
NINTCHDBPICT0004156325701
মানুষের কর্মফল আর ভাগ্যের সম্পর্ক ভীষণ জটিল ও বিপরীতমুখী। প্রথম দৃশ্যে ইগুয়াইন পারেননি, বিশ্বকাপটা শেষমেশ ক্রুসদের ভাগ্যেই জুটেছিল। পরের দৃশ্যে অবশ্য ক্রুস পেরেছিলেন, দারুণ বাঁকানো শটে অলসেনকে পরাস্ত করলেও ১৯৩৮ সালের পর প্রথমবারের মতো প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল জার্মানদের। তবে সাফল্য পেতে হলে ভাগ্যের পাশাপাশি প্রতিভা আর পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় তার বড় উদাহরণ টনি ক্রুস। ২০১৪ এর আগে জার্মানি তিনবার বিশ্বকাপ জিতেছে পশ্চিম জার্মানির হিসেবে। দুই জার্মানি মিলিত হবার পরে প্রথম বিশ্বকাপজয়ী দলের মাত্র একজনের জন্ম পূর্ব জার্মানিতে। হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, তিনি টনি ক্রুস। "প্রফেসর", "গারকম" কিংবা "স্নাইপার" - এগুলো আসলে একজন মানুষের নানা রূপ। ক্রুস একা এতোকিছু সামলান কীভাবে? নাহ, জামার্নরা বোধহয় আসলেই মেশিন।