• হকি

ব্রোঞ্জ নয়, মন জিতে নিল ওরা

পোস্টটি ৫৮৪ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ব্রোঞ্জ নয়, মন জিতে নিল ওরা      (ফিচার)

অর্ঘ্য দে

 

      “হকি খেলে করবেটা কী? ছোট স্কার্ট পড়ে মাঠে দৌড়ে পারিবারের মুখ ডোবাবে’’ রানি রামপালের বাবা-মা’র মুখ থেকে হামেশা এই কথাটাই বেরিয়ে আসত।

      গ্রামের বয়স্কদের চোখরাঙ্গানি আর তিরস্কারের থেকে বাঁচাতে মেয়েটা লোকচক্ষুর আড়ালে হকি প্র্যাক্টিস করত। এই মেয়েটাই দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে গোলের হ্যাটট্ট্রিক করে ভারতীয় মহিলা হকিতে নতুন ইতিহাস লিখল। মেয়েটার নাম বন্দনা কাটারিয়া। এখন এক ডাকে দেশের অনেকেই তাকে চেনে।

      নেহার সমস্যাটা ছিল আবার একটু অন্য। মদ্যপ বাবা রোজ বাড়ি ফিরে মাকে মারত। দৃশ্যটা নেহার রোজ দেখতে ভালো লাগত না বলে হকির মাঠে পালিয়ে যেত।

      সালটা ২১০৫, নিশা ওয়ারসির বাবা প্যারালিসিসে বিছানা নিয়েছিল। পরিবারের পেট চালাতে তার মাকে ফোম কারখানায় নাগাড়ে কাজ করে যেত হতো। মেয়ের লড়াই আর হকির স্বপ্নকে নষ্ট হতে দেয়নি নিশার মা।

      ঝারখণ্ডের প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে নিক্কি প্রধান। বাবা ধানজমির শ্রমিক। আধিবাসী অধ্যুষিত নুড়ি কাঁকুরে জমিতে বেড়ে উঠেছিল নিক্কি আর তার হকির স্বপ্ন। অভাব যার নিত্যসঙ্গী তার কাছে তার কাছে নতুন হকিস্টিক আকাশ-কুসুম কল্পনা। পুরনো একটা ভাঙা হিকিস্টিক নিয়েই কাঁকুরে জমিতে ছুটে বেড়াত নিক্কি। সেখান থেকে তার দৌড় পৌঁছে গেল মসৃণ অ্যাসট্রোটার্ফে। 

      উপরে আলোচিত চরিত্র বা ঘটনাগুলো কাল্পনিক নয়, কোনও সিনেমা নাটক বা উপন্যাসেরও নয়। দারিদ্র জর্জরিত, হতভাগ্য মেয়েগুলো আমাদের দেশের মহিলা হকি দলের এক একজন খেলোয়াড়। রানি থেকে নিক্কি দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে উঠে আসা মেয়েগুলোর ভাষা আলাদা আলাদা হলেও কয়েকটা বিষয়ে খুব মিল। অবজ্ঞা, উদাসীনতা আর অভাব ওদের ছায়াসঙ্গী। তবু কিছুতেই যেন হার মানতে চায়নি ওরা। তাই ওদের হারানো যায়নি কোনওভাবেই। বিগত পাঁচ-ছ’বছর ধরে সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁতে দাত চেপে লড়াই করে জাতীয় হকির এগারোটা মেয়ে খেলার জগতে এখন বহুল আলোচিত। আগামি ভারতীয় মহিলা হকির অনুপ্রেরণা।   

      ইতিহাস বলছে অলিম্পিক হকিতে ভারতের পুরুষদের শেষ সাফল্য ১৯৮০ সালে মস্কো অলিম্পিকে। আমার জন্মের চার বছর আগে। সেই বছরই মহিলা হকি দল প্রথম অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করে। আয়োজক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ানের কাছে হেরে ৪ র্থ হয়ে শেষ হয় মহিলা দলের অলিম্পিক সফর। তারপর কেটে গেছে চল্লিশটা বছর। আমার জ্ঞান হবার পর বা খেলা বুঝতে পারার ক্ষমতা হবার পর কোনও অলিম্পিকেই ভারতের হকি দলের কোনও পদক প্রাপ্তি ঘটেনি। হকিতে সোনা রুপো বা ব্রোঞ্জের স্বপ্ন দেখছে গোটা দেশ এমন নজিরও গত তিন দশকের অলিম্পিকে অলীক কল্পনার মতো ছিল। এমন হার-না মানা পারফরমেন্সও বিগত চল্লিশ বছরে বিরল। মস্কো অলম্পিকের পর ভারতের মেয়েরা খেলেছে আর মাত্র দুটো অলিম্পিকে। শেষ, তথা রিও অলিম্পিকে রানিরা শেষ করেছিল ১২ তম দল হিসেবে। সেখান থেকে এবারের টোকিও অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ ম্যাচে হেরে ফের ৪র্থ হল ভারতের মেয়েরা। পরিসংখ্যানের বিচারে অভাবনীয় উন্নতি। এই দৃষ্টান্তমূলক উন্নতির পিছনে রয়েছে ডাচ কোচ শোয়ার্ড মারিন ও তার বৈপ্লবিক কোচিং।   

       টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই পুল ম্যাচে পরপর তিনটে ম্যাচে হার। যাকে বলে হারের হ্যাটট্রিক। ভারতীয় মহিলা হকি দলকে ঘিরে তখন দুর্ভেদ্য অন্ধকার। পুল ম্যাচেই এবারের অলিম্পিক থেকে ছিটকে যাবার যে প্রবল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তাকে এক কথায় নস্যাৎ করে শেষ দুই পুল ম্যাচে ভারতীয় মেয়েদের জোরালো প্রত্যাবর্তন। পুল ‘এ’-র শেষ খেলায় বন্দনার হ্যাটট্রিক গোলে প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৪–৩ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালের পথ পরিষ্কার করল রানিরা। সেদিন সেই দুর্ভেদ্য অন্ধকারে ফুটে উঠল রুপোলি রেখা। গুরজিত কাউরের একমাত্র গোলে অস্ট্রেলিয়ার মতো শক্তিশালী দলকে হারিয়ে আমরা পৌছালাম সেমিফাইনালে। আরো কিছুটা উজ্জ্বল হলো সেই রুপোলি আলোকরেখা।ব্যাপারগুলো কেমন যেন অপ্রত্যাশিতভাবেই ঘটে যাচ্ছিল। রানিদের সামনে তখন আরেকটা হার্ডেল - নাম আর্জেন্টিনা। ঐতিহাসিক সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার সঙ্গে ২-১ এ হার। সোনা বা রুপোর আশা শেষ হলেও গেলেও বন্দনা, রানিদের চোখ দিয়ে ব্রোঞ্জের স্বপ্ন দেখতে শুরু করল ভারতবাসী।

      শুনতে অবাক লাগলেও এটা সত্যি যে, ফাইনালে হেরে গলায় রুপো ঝোলানোর থেকেও অনেক শক্ত ছিল রিও অলিম্পিকে চ্যাম্পিয়ান গ্রেট ব্রিটেনকে হারিয়ে ব্রোঞ্জ পদক ছিনিয়া আনা। ব্রোঞ্জ ম্যাচে কাঁধে কাঁধ রেখে লড়েও গ্রেট ব্রিটেনের কাছে আমাদের মেয়েরা হেরে গেল মাত্র এক গোলে। শেষ হয়ে গেল ব্রোঞ্জের হাতছানি। স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। মন ভেঙে গেল একশো তেত্রিশ কোটির। ইতিহাস আর লেখা হলো না! খেলা শেষে টিভির পর্দা জুড়ে তখন ভারতীয় মহিলা দলের বিধ্বস্ত চেহারাগুলো। হতাশায় মারিনের কাঁধে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ল গোলকিপার সবিতা। কান্না থামছে না নেহা, বন্দনা, গুরজিতের। অধিনায়ক রানি রামপাল অনেকক্ষণ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে এল ব্রিটিশ মেয়েরা। ম্যাচের শেষে ব্রিটিশ হকি দলের অফিসিয়াল টুইটার থেকে রানি রামপালের দলের জন্যে এল অভিনন্দন আর প্রশংসা বার্তা—“What an amazing game, what an amazing opponent.”     

    ভারতীয় হকির জন্যে একই সঙ্গে এত আনন্দ, রোমাঞ্ছ আর এত বিষাদের স্বাদ আগে কখনও পাইনি। ভারতের ক্রিকেটের দল ফাইনালে বা সেমিফাইনালে হেরে গেলেও এতটা মন খারাপ হয়েছে বলে মনে পড়ছে না, যতটা মন খারাপ হল মেয়েদের হকি দলের জন্য। আসলে এভাবেও যে ফিরে আসা যায়, ফিরে পাওয়া যায় হারিয়ে যাওয়া সেই সম্মান, ঐতিহ্য সত্যিই ভাবিনি। টোকিও অলিম্পিকে হকি থেকে কোনও পদকের স্বপ্ন বা আশা কোনওটাই ছিল না কিন্তু আশা জাগিয়েছে পুরুষ ও মহিলা হকি দল। তাই মনের এই দুই বিপরীতধর্মী অবস্থা। আমাদের চোখের আড়ালে ধর্মান্ধ সমাজ,পরিবেশ আর নিত্য অভাবের সঙ্গে প্রাণপণে লড়তে থাকা নেহা, নিশারা ভারতকে মেয়েদের হকিতে এফ.আই.এইচ র‍্যাংকিংয়ে নিয়ে গেল অষ্টম স্থানে। এ কোনও ফিল্মি ড্রামা বা ম্যাজিক নয়। ভারতের মহিলা হকির এই ক্রমোন্নতি টোকিও অলিম্পিকে চমকপ্রদ পারফরমেন্সের দৌলতে। নাই বা জিততে পারলো ওরা ব্রোঞ্জ, আমার মতো অগণিত ভারতবাসীর মন তো জিতে নিয়েছে রানি আর তার দলের দশজন বাঘিনী। আমরা ফিরে পেলাম বিশ্বাস, হারিয়ে যাওয়া সেই ঐতিহ্য। এই বা কম কী!

      এখনও চোখ বন্ধ করলে ভেসে উঠছে নীল অ্যাস্ট্রোটার্ফ, প্রাণবন্ত হকিস্টিক আর নীল জার্সি-পরা ছাপোষা মেয়েগুলোর ক্ষিপ্র প্রত্যয়ী চেহারাগুলো। এখনও যেন খেলা চলছে, যেকোনও সময় বেজে উঠবে রেফারির বাঁশি। পেনাল্টি কর্নারে নিমেষে গোল গোল করে এক মিনিটে ফলাফল পাল্টে দেবে রানি, নভজ্যোত, বন্দনা বা গুরজিত কাউর। জানি এসবই মনের ভুল, পাগলামি। হুটার বেজে গেছে অনেক আগেই। ষাট মিনিটের যুদ্ধ শেষে এখন শুধুই শূন্যতা আর বিষণ্ণতা। মেয়েদের হকি নিয়ে যতবার ভাবছি, কিছু লিখছি বুকের ভিতর একটা কষ্ট শ্রাবণের কালো ঘন মেঘের মতো ঘনিয়ে উঠছে। নিঃশব্দে ঝরছে স্বপ্নভঙ্গের ধারাপাত। সেই ধারাপাত হারিয়ে যাচ্ছে মনের গভীরে। হারিয়ে যেতে যেতে রেখে যাচ্ছে রুপোলি আলোর রেখা। সেই রেখা এগিয়ে যাচ্ছে প্যারিসের দিকে।

 

 

 

 

অর্ঘ্য দে

ঠিকানা – ১ নম্বর ফার্ম সাইড রোড

ডাক – চুঁচুড়া আর.এস.

জেলা – হুগলি

সূচক – ৭১২১০২

কথা – ৭০০৩৪৪৪২৪৮ 

 

 

 


Virus-free. www.avast.com