• ফুটবল

ফ্লোরেন্সের বাতিগোল, আর্জেন্টিনারও

পোস্টটি ১১৩১ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
ফ্লোরেন্স শহরের নামটা নিশ্চয়ই শোনা হয়েছে? মধ্য ইতালির শহরটা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কিংবা দারুণ আবহাওয়ার জন্য পরিচিত হতে পারতো, কিন্তু ফ্লোরেন্স ইতিহাসের পাতায় অক্ষত থাকবে চতুর্দশ শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া শিল্প-সাহিত্য-স্থাপত্যকলার নবজাগরণের জন্য। তবে বিংশ শতাব্দীটা যখন ফুরিয়ে আসছিল সেই সময়টায় মাকিয়াভেলি, মেদিচি, দা ভিঞ্চি, বতিচেল্লি কিংবা কারাভাজ্জোদের দিনগুলো কেবল শুধুই সোনালী অতীত। স্থানীয় ফুটবল দল এসিএফ ফিওরেন্তিনাও তাদের দাপুটে সময়গুলো পঞ্চাশ-ষাটের দশকে ফেলে এসেছে। এই হারানো দিনের সুরের মাঝেই এক দক্ষিণ আমেরিকান পা রাখলেন তুস্কানিতে। মাথাভরা অবাধ্য চুলের শক্তপোক্ত এই আর্জেন্টাইন তরুণের ফুটবল খেলায় কিন্তু মাকিয়াভেলির বিচক্ষণতা কিংবা বতিচেল্লির পেলব সৃষ্টিশীলতা ছিলো না, বরং জান্তব এক আগ্রাসনে প্রতিপক্ষকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতেন আটলান্টিকের ওপারের এই স্ট্রাইকার। দু’বার বিশ্বকাপজয়ী দেশের জাতীয় দলের হয়ে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ডটা মেসি ভেঙ্গে দেবার আগ পর্যন্ত নিজের দখলে রেখেছিলেন তিনি, বিশ্বকাপের আসরে তাঁর চেয়ে বেশি গোল আছে মাত্র সাতজনের। গ্যাব্রিয়েল ওমার বাস্তিস্তুতা - একজন আর্জেন্টাইন, একজন ফ্লোরেন্তিনো, একজন জাত গোলশিকারী।
 
  • সান্তা ফে’তে জন্ম নেয়া বাস্তিস্তুতার অবশ্য ফুটবলার হবার কথা ছিলো না, বাস্কেটবলের দিকেই ঝোঁক ছিল বেশি। কিন্তু ১৯৭৮ সালে ঘরের মাঠে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে জেতার পর ফুটবল খেলাটার প্রেমে পড়ে যায় ন’বছর বয়সী গ্যাব্রিয়েল। স্থানীয় দল রেকঙ্কিস্তার হয়ে আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে খেলার সময় প্রতিপক্ষ নিউয়েলস ওল্ড বয়েজের কোচের নজরে পড়ে যান। কালক্ষেপণ না করে সেই কোচ দলে ভেড়ান বাতিস্তুতাকে। কোচের নামটা বলতে পারবেন? মার্সেলো বিয়েলসা। তবে নিউয়েলের হয়ে শুরুতেই ছন্দপতন। নিজের শহর, পরিবার ছেড়ে এর আগে কখনো যে বাইরে থাকেননি বাতিস্তুতা, তাই অনুশীলনে মোটেও মন আসছিল না। তবে মাত্র এক মৌসুমে খেললেও ভবিষ্যতে চলার রসদটা জুগিয়ে নিয়েছেন এর মধ্যেও। বাতিস্তুতার মতে বিয়েলসা নাকি তাঁকে ফুটবলের সবকিছু শিখিয়েছেন, সবকিছু। ২৮ ম্যাচে ৮ গোল, নতুন ক্লাব, এবার রিভার প্লেট। তবে মৌসুমের মধ্যেই কোচ বদল হলো, নতুন কোচ পাসারেল্লার অধীনে বাতিস্তুতার সুযোগ কমে গেলো। ২৪ ম্যাচে ৪ গোল, আবার ক্লাব বদল, নতুন গন্তব্য রিভারের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বোকা জুনিয়র্স। এবারও শুরুটা মনমতো হলো না, নিজের পজিশনের বাইরে খেলানো হচ্ছিল তাঁকে। অনুমিত চিত্রনাট্য মেনে আবার কোচ বদল, তবে এবার সেটা গ্যাব্রিয়েলের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এলো। অস্কার তাবারেজ এসে তাঁকে পছন্দের পজিশনে ফিরিয়ে আনলেন, ফলাফল? মৌসুমের সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে ১৯ গোল্, বোকা জিতে নিলো চ্যাম্পিয়নশিপ।

6e8f4b1d423e4ce9a79bf4ee2c6ad480

 
  • ১৯৯১ সালটা বাতিস্তুতার জন্য বদলে যাওয়ার বছর। জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক, এরপর কোপা আমেরিকা, টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা (৬) হওয়া। আলফিও বাসিলের অধীনে আলবিসেলেস্তের বিখ্যাত আকাশী-সাদা জার্সি গায়ে তাঁর খেলা নজর কেড়েছিল ফিওরেন্তিনার সভাপতির। ২.৫ মিলিয়ন ইউরো দামে রেনেসাঁর শহরে পাড়ি জমালেন “বাতিগোল”, ফিওরেন্তিনার সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আড়াই মিলিয়ন ইউরো। শুরু থেকেই বাতিস্তুতা-ফ্লোরেন্স প্রেমটা জমে গেলো, ১৩ বার লক্ষ্যভেদ প্রথম মৌসুমে। কনফেডারেশন্স কাপ খেললেন আর্জেন্টিনার হয়ে, ২ ম্যাচে ২ গোল করে টুর্নামেন্টের যৌথ সর্বোচ্চ গোলদাতা, কাপ গেলো আর্জেন্টাইনদের ঘরে। ইউরোপে ফিরে আবার গোলের ফুলঝুরি , এবার গোলের সংখ্যা ১৬। কিন্তু অবধারিতভাবে গ্যাবি-লা ভায়োলা ভালোবাসার মধ্যে খলনায়ক হয়ে এলো অবনমন। তৃতীয় স্থানে শেষ করা পার্মার চেয়েও বেশি গোল করে সিরি বি তে নেমে গেলো তুস্কানির ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি। সমর্থকদের মনে তখন করুণ সুর, ধনিক শ্রেণীর অর্থের পেশীর কাছে গ্যাব্রিয়েলের সাথে প্রিয় ক্লাবের বিচ্ছেদ দেখতে হবে। তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে থেকে গেলেন বাতিস্তুতা, ১৯৯৩-৯৪ মৌসুমে ১৬ গোল করে আবার দলকে প্রথম বিভাগে তুলে আনলেন। এরপর গোলের রথ একবার ছুটতে যে শুরু করলো থামাথামির নাম নেই। এরপর ছয় মৌসুম ফিওরেন্তিনার হয়ে খেলেছেন বাতিস্তুতা, এর মাঝে সেরি আতে ২০ গোলের কাছাকাছি থাকতে পারেননি মাত্র একবারই (১৯৯৬-১৯৯৭, ১৩)। ব্যক্তিগত অজর্ন নিয়মিতই আসছিল – ১৯৯৮ সালে আর্জেন্টিনার বর্ষসেরা ফুটবলার হলেন, ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালে পরপর দু’বছর ফিফা একাদশে ছিলেন, ব্যালন ডি’অরের তালিকাতেও প্রথমদিকেই ছিলেন। কিন্তু ক্লাবের হয়ে অজর্নের খাতাটা ভরে ওঠেনি, আট মৌসুম খেলে একবার করে সেরি বি (১৯৯৩-৯৪), কোপ্পা ইতালিয়া (১৯৯৫-৯৬), সুপারকোপ্পা ইতালিয়ানা (১৯৯৬) তাঁর নামের প্রতি মোটেও সুবিচার করে না। ত্রিশোর্ধ্ব ফুটবলারের জন্য দলবদলের তৎকালীন রেকর্ড গড়ে (৩৬.২ মিলিয়ন ইউরো) তাঁকে দলে ফাবিও কাপেল্লোর রোমা। ১৯৮৩ সালের পর থেকে জিয়াল্লোরসিদের লীগ জেতা হয়নি, বাতিস্তুতা কী পারবেন সেই শিরোপা তেষ্টা মেটাতে?

 

batistuta-fiorentina-1park

 
  • উইলিয়াম শেক্সপিয়ার তাঁর বিখ্যাত ট্র্যাজেডি “রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট” লিখেছিলেন ইতালির ভেরোনা শহরের পটভূমিতে। কে জানতো একবিংশ শতাব্দীর ঊষালগ্নে তেমন এক বিয়োগাত্মক কাহিনী রচিত হলো ফ্লোরেন্স শহরকে ঘিরে। লীগ শিরোপার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠা রোমার সামনে পড়েছিল বাতিস্তুতার পুরনো ভালোবাসা ফিওরেন্তিনা। ৮০ মিনিট পর্যন্ত ম্যাচটা সমতায়ই ছিল, এরপর মঞ্চে আবির্ভাব “রোমিও” বাতিস্তুতার। তিরিশ গজি দারুণ এক ভলিতে রোমাকে জিতিয়ে দিলেন তিনি, কিন্তু আবেগের উছ্বাসে ভাসার বদলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। ফিওরেন্তিনার সমর্থকেরা সেদিন দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানিয়েছিল তাঁকে, জানিয়ে দিয়েছিল “বাতিগোল”কে তারা ভোলেনি। রোমার হয়ে সেই মৌসুমে সেরি আ জিতেছিলেন ঠিকই, কিন্তু এরপর চোটের থাবায় ক্যারিয়ারটা বেশিদূর এগোতে পারেনি। রোমায় আরো দুই মৌসুম খেলার পর ইন্টারে এক মৌসুম, এরপর কাতারি ক্লাব আল আরাবিতে গিয়ে ক্যারিয়ারের ইতি টানা। জাতীয় দলের জার্সি হয়ে যেন অন্যদের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে থাকতেন সবসময়। ’৯৩ এর কোপা আমেরিকার ফাইনালে গোল করে শিরোপা ধরে রেখেছেন, এরপর বিশ্বকাপের মঞ্চেও আলাদাভাবে নিজেকে চিনিয়েছেন। হতাশায় মোড়া ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে এবং ১৯৯৮ সালের অন্য আশা জোগানো বিশ্বকাপে জ্যামাইকার বিরুদ্ধে হ্যাট্ট্রিক করে একমাত্র ফুটবলার হিসেবে দু’টি ভিন্ন আসরে হ্যাট্ট্রিকের রেকর্ডটা একমাত্র তাঁরই আছে। কিন্তু অরতেগা-ভেরন-সিমিওনেদের সাথে প্রাচ্যে বিশ্বকাপ খেলাটা বাতিস্তুতাদের জন্য দুঃস্বপ্ন ছিল। মাত্র একটা জয় নিয়ে মার্সেলো বিয়েলসার দল প্রথম পর্ব থেকেই ছিটকে পড়লো, ম্যাচশেষে বাতিস্তুতার কান্নাটা এখনো অনেক আর্জেন্টাইন সমর্থকদেরকে তাড়িয়ে ফেরে। তবে এতেই বিশ্বকাপে সবচেয়ে গোল করা আর্জেন্টাইনের তালিকায় প্রথম নামটা “অ্যাঞ্জেল গ্যাব্রিয়েল’ এরই। শক্তিমত্তায় কারো চেয়ে কম ছিলেন না বাতিস্তুতা, বক্সটাকে ভালোমতো শাসন করতেন। তবে তাঁর মাহাত্ম্য ছিলো আগুন ঝরানো শটগুলোতে, ৩০ গজ হোক, ২৫ কিংবা ২০ যে কোন দূরত্ব থেকেই জাল ছিঁড়ে ফেলার ক্ষমতা ছিল। ২০০০ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের গ্রুপর্বে তাঁর ৩৫গজি শটটাকে ওল্ড ট্রাফোর্ডের ভরা গ্যালারিকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল।
 
দিন ফুরিয়ে গেলে মানুষ নাকি ব্যবসায়ী কিংবা ধনকুবেরদেকে মনে রাখে না, বরং শিল্পীরাই অমরত্বে সুধা পান করার সুযোগ পান। আজ থেকে পাঁচশ বছর আগের ফ্লোরেন্সের সেই পুনর্জাগরণের অগ্রদূত শিল্পীরা এখনো অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছে। স্থাপত্যকলা, শিল্পকলা কিংবা চিত্রকর্ম – এসব দেখার জন্য আজো লাখো লাখো মানুষ দুয়োমো, পিত্তি প্রাসাদ, পালাতসো ভেক্কিয়ো কিংবা সান্তা ক্রসি গীর্জার সামনে ভিড় জমায়। শিল্পীর কদর দিতেও জানে ইতালীয়রা, ফ্লোরেন্সে বাতিস্তুতার মূর্তি সেই বার্তাই দেয়। তুস্কানির পাহাড়ের আড়াল হতে ভোরের সূর্যরশ্মি যখন দুয়োমোর কমলা রঙয়ের গম্বুজে উঁকি দেয়, সেই আলোর কিছুটা বরাদ্দ থাকে গ্যাব্রিয়েল ওমার বাতিস্তুতার নিশ্চল এক প্রতিচ্ছবির জন্য। একজন আর্জেন্টাইন হিসেবে শিল্পকলার শহরে এমন সম্মান পাচ্ছেন একজন ফুটবলার, ফুটবলভক্ত হিসেবে সেটা আপনাকে শিহরিত করারই কথা!