• ফুটবল

স্বপ্নের রঙ্গমঞ্চে রোনালদো কাব্য

পোস্টটি ১৯৩৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ফুটবল রোনালদো লুইস নাজারিও দি লিমাকে দু’হাত ভরেই দিয়েছে। দুটো বিশ্বকাপ, দুটো কোপা আমেরিকা, কনফেডারেশন্স কাপ জিতেছেন ব্রাজিলের হয়ে; ক্লাব ফুটবলে অবশ্য অর্জনের তালিকাটা কিছুটা ছোটই বলতে হয় – বলার মতো ট্রফি হিসেবে একখানা লা লিগা আর ইউয়েফা কাপই সম্বল। ব্যক্তিগত অর্জনে আবার নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেনঃ তিনবার ফিফার বর্ষসেরা হয়েছে, দুটি ব্যালন ডি’অরও আছে, আছে বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল, গোল্ডেন শ্যু, ইউরোপীয় গোল্ডেন শ্যু সহ একজন মর্ত্যমানবের পক্ষে ফুটবলে যা যা জেতা সম্ভব তার সবগুলোই একে একে ঝুলিতে পুরেছেন রোনালদো। সেলেসাওদের বিখ্যাত হলুদ জার্সি গায়ে ৯৮ ম্যাচে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬২ গোল তাঁর, ২০১৪ সালে সেই ব্রাজিলের বিপক্ষেই সেমিফাইনালে গোল করে বিশ্বকাপে সবোর্চ্চ গোলদাতার তালিকায় “ও ফেনোমেনো” কে দুই নম্বরে নামিয়ে দিয়েছেন মিরোস্লাভ ক্লোসা। তবে এমন আলোক রোশনাইয়ের আড়ালে আঁধার যে নেই সেটা বললে ভুল হবে। প্যারিসের সেই রাতে তিনি রহস্যজনকভাবে অসুস্থ না হলে হয়তো বিশ্বকাপের জন্য আরো চার বছর অপেক্ষা করতে হয় না ব্রাজিলিয়ানদেরকে। তবে রোনালদোর বুক চিরে বেরিয়ে আসা সবচেয়ে বড় দীর্ঘশ্বাসটা নিশ্চয়ই চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ট্রফির জন্য বরাদ্দ। ক্যারিয়ারজুড়ে ইউরোপের নামীদামী সব ক্লাবের হয়ে খেললেও এই শিরোপাটা অধরাই থেকে গেছে দক্ষিণ আমেরিকান কিংবদন্তির। অথচ এই টুর্নামেন্টের এক ম্যাচেই রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে মুগ্ধতা ছড়িয়েছিলেন রোনালদো, এতোটাই যে মোহাবিষ্ট ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের গ্যালারি তাঁকে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানিয়েছিল।

 

গল্পটা বলতে গেলে ২০০৩ সালের এপ্রিলের ২৩ তারিখে ফিরে যেতে হবে। ঐ দিন লা লিগা আর প্রিমিয়ার লিগের দুই “দৈত্য” রিয়াল মাদ্রিদ আর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এক রোমাঞ্চকর ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল। কোয়ার্টার ফাইনালের আগের লেগে সান্তিয়াগো বেরনাবাউয়ে রিয়ালের কাছে তিন গোল খাওয়ার পরও সবেধন নীলমণি হিসেবে স্পেন থেকে একটি মহামূল্যবান অ্যাওয়ে গোল নিয়ে ফিরতে পেরেছে ইউনাইটেড। বর্ষীয়ান কোচ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনও সেই গোলে ভর করেই সেমিফাইনালে ওঠার আশা ব্যক্ত করেছিলেন। তাই এই ম্যাচকে ঘিরে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের বাতাসে রোমাঞ্চের রেণু উড়ে বেড়াচ্ছিল। রিয়ালের গ্যালাক্টিকোসদেরকে যে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের গিগ্‌স-ভ্যান নিস্টলরয়রা যে ছেড়ে কথা বলবেন না সেটা অনুমিতই ছিল। তবে ম্যাচের ১২ মিনিট জেতে না জেতেই প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়ার উপক্রম হলো ম্যানকুনিয়ানদের। ম্যাচের ১২ মিনিটে মাদ্রিদ বক্সের সামনে ভেরনের পা থেকে বল কেড়ে নিলেন ফরাসি মায়েস্ত্রো জিনেদিন জিদান। এরপর মাঝমাঠে রবার্তো কার্লোস আর স্টিভ ম্যাকম্যানাম্যানের সাথে পাশের ত্রিভুজ খেললেন। সেখান থেকে ফিগোর পা ঘুরে ফের বলের নিয়ন্ত্রণ নিলেন জিদান। মাঠের বাঁ প্রান্তের পার্শ্বরেখা ঘেঁষা জায়গা জিদান মাঝবৃত্তে দাঁড়িয়ে থাকা গুতিকে বল এগিয়ে দিলেন। সুযোগের গন্ধ পেয়ে মার্কার রিও ফার্ডিনান্ডকে ছিটকে ফেললেন রোনালদো। গুতির বাড়িয়ে দেওয়া বলকে পাশ কেটে এগিয়ে যেতে দিলেন। যথেষ্ট গতি থাকা সত্ত্বেও বিশ্বের সবচেয়ে দামী ডিফেন্ডার ফার্ডিনান্ড কোনোভাবেই রোনালদোর সাথে কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। দৌড়ে বক্সের ভেতর ঢুকেই ডানপ্রান্ত থেকে আচমকা ফার্স্ট টাইম শট নিলেন ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার। শটটি কাছের পোস্টে থাকা সত্ত্বেও ইউনাইটেড গোলপ্রহরী ফ্যাবিয়ান বার্থেজ পরাস্ত হলেন, দুই লেগ মিলিয়ে ৪-১ এ এগিয়ে রিয়াল তখন রীতিমত উড়ছে। দুই হাত প্রসারিত করা রোনালদো বুঝি যেন তাঁদের নেতা। ৪৩ তম মিনিটে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ম্যাচে সমতায় ফেরালেন রুড ভ্যান নিস্টলরয়।

GettyImages-52891668-ronaldo

 “রেড ডেভিল” সমর্থকদের মনে নিশ্চয়ই ক্ষীণ আশা জেগেছিল,  কিন্তু বিরতির পর খেলা শুরু হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সেটা হওয়া। গোলের নৈপথ্যের কারিগর সেই জিদান, বক্সের সামনে হাফস্পেসে দাঁড়িয়ে ওভারল্যাপ করা “পকেট ডাইনামাইট” রবার্তো কার্লোসকে খুঁজে নিলেন জিদান। বাঁ প্রান্ত থেকে কার্লোস কাটব্যাক করলেন ছয় গজি বক্সের ভেতর। বাঁ পা দিয়ে ট্যাপ ইন করে জালে বল জড়ালেন ওঁত পেতে থাকা রোনালদো। ইউনাইটেড ডিফেন্ডার  জন ও’শেয়া আর ওয়েস ব্রাউন কিছু বুঝে ওঠার আগেই কেঁপে উঠল জাল। চিরচেনা সেই তর্জনী নাচানো উদযাপনে মেতে উঠলেন সবচেয়ে কম বয়সী হিসেবে ব্যালন ডি’অর জেতা সাম্বা জাদুকর – ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সমর্থকদের বুকে নিশ্চয়ই সেই উদযাপন শেল হয়ে বিঁধছিল। কিন্তু যেই দলের কোচ স্যার অ্যালেক্স তাঁরা বুক চিতিয়ে লড়তে জানে – প্রতিষ্ঠিত সত্যটা আরেকবার মনে করিয়ে দিলো স্কটিশ কিংবদন্তির শিষ্যরা। ইভান হেলগুয়েরার আত্মঘাতী গোলে সেই রাতে দ্বিতীয়বারের মতো সমতায় ফিরলো দুই বারের ইউরোপ চ্যাম্পিয়নরা।

process

রোনালদো অবশ্য সেরাটা শেষের জন্য তুলে রেখেছিলেন। খেলার বয়স তখন এক ঘণ্টা ছুঁইছুঁই করছে। মাদ্রিদ মিডফিল্ডার ক্লদ ম্যাকালেলে দুইজনকে দারুণভাবে কাটিয়ে লুইস ফিগোকে পাস দিলেন। আলতো ছোঁয়ায় সামনে থাকা রোনালদোর কাছে বল পাঠয়ে দিলেন ফিগো। বামদিকে যাবেন এমন ভঙ্গি করে ডানে ঘুরলেন রোনালদো। ফিগোকে ঠেকাতে তাঁর সাথে দৌড়ে গেলেন মিকায়েল সিল্ভেস্ত। সামনে কিছুটা ফাঁকা জায়গা পেলেন মুন্ডিতমস্তক ফরোয়ার্ড। শট আসছে অনুমান করে ওয়েস ব্রাউন পড়িমরি করে স্লাইড দিলেন। কিন্তু নাইকি মারকিউরিয়াল ভ্যাপরের বিষ কী জিনিস সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন বার্থেজ। ২৫ গজ দূর থেকে ডান পায়ের ইন্সটেপ দিয়ে মারা শটটাতে যথেষ্ট গতি ছিল আবার দারুণভাবে বাঁকও নিলো সেটা। ফুটবলে একই শটে এই দুইয়ের মেলবন্ধন বেশ বিরলই বলতে হবে। গোলের মাঝবরাবর দাঁড়ানো বার্থেজ ঝাঁপ দিলেন কিন্তু তাঁকে ফাঁকি দিয়ে বাঁ দিকের পোস্টের ভেতর দিয়ে বাঁক নিয়ে ঢুকে গেলো শট। “থিয়েটার অফ ড্রিম্‌স” এক ক্ষণজন্মা প্রতিভার আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। রোনালদোকে এক অলস জাদুকরই বলতে হবে, গেজ্ঞেনপ্রেসিংয়ের এই যুগে যখন ফরোয়ার্ডরা প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদেরকে ক্লোজ ডাউন করে রক্ষণকার্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সেখানে নিজের খেলোয়াড়ি জীবনে রোনালদো এসবের ধার ধারতেন না। প্রতিপক্ষের পায়ে বল থাকলে দুলকি চালে হাঁটাচলা করতেন তিনি, অনেকবার তো নিছক দাঁড়িয়েই থাকতে দেখা গেছে তাঁকে। কিন্তু গোলের ধারেকাছে এলেই ভোল পাল্টে হয়ে যেতেন পুরোদস্তুর শিকারী। ক্যারিয়ারজুড়ে এতোসব অসামান্য কীর্তির মাঝেও উত্তর ইংল্যান্ডের সেই রাতটা আলাদা হয়ে আছে আরো একটি কারণে। ৬৭ তম মিনিটে রোনালদোকে উঠিয়ে সান্তিয়াগো সোলারিকে মাঠে নামাবার সিদ্ধান্ত নিলেন মাদ্রিদ কোচ ফ্যাবিও ক্যাপোলো। চতুর্থ রেফারির হাতে ধরা বোর্ডে লাল হরফে ১১ নম্বর ভেসে উঠতেই টাচলাইনের দিকে হেঁটে এগোচ্ছিলেন রোনালদো। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের পুরো গ্যালারি দাঁড়িয়ে সম্মাননা জানালো এই জীবিত কিংবদন্তিকে। প্রায় দেড় লাখ হাতের সমবেত তুমুল করতালির শব্দে তখন কান পাতা দায়। সেই অভিবাদনের জবাব দেবেন কী, অভূতপূর্ব এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে যেন কিছুটা অপ্রতিভা দেখাচ্ছিল রোনালদোকে। এরপর বদলি হিসেবে নেমে জোড়া গোল করে (যার দ্বিতীয়টি এসেছিল ২০ গজি দারুণ এক ফ্রী-কিক থেকে) ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে জিতিয়েছিলেন ডেভিড বেকহাম – তবুও দুই লেগ মিলিয়ে ৬-৫ গোলে জয়ী “লস ব্লাংকোস”রা। কিন্তু ম্যাচের হিসাবনিকেশ এখানে গৌণ – কারণ সেই রাতটা যে শুধুই রোনালদোময়।

article-2251052-00635D2000000258-946_1024x615_large

হাঁটু বারবার বাগড়া না বাঁধালে রোনালদোর খেলোয়াড়ি জীবনে আরো অনেক অর্জন থাকতো এটা যেমন সত্য, তেমনি যা কিছু অর্জন করেছেন তাতেই সর্বকালের সেরাদের কাতারে যে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে পারবেন সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিনতে রিবেইরোর রাস্তায় খেলে বড় হওয়া রোনালদো পরে বিশ্ব মাতিয়েছেন, হাসি ফুটিয়েছেন কোটি ভক্তের মুখে। ফোকলা দাঁতের হাসি আর তর্জনী নাড়িয়ে সেই উদযাপনে শুধু রিয়াল, বার্সা, মিলান, ইন্টার বা মিলান সমর্থকদের মনই নেচে ওঠেনি, আপামর ফুটবলভক্তদের কাছেই “ও ফেনেমেনো” এক আবেগের নাম। ১৭ বছর আগে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের সেই রাতের কীর্তিগাথা তাই এতটুকুও মলিন হয়নি আজো, যেমনটি হননি রোনালদো নিজেও। সেদিন ফুটবল সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়েছিলেন রোনালদো, তাই ইংরেজ ধারাভাষ্যকার মার্টিন টাইলারের সাথে গলা মিলিয়ে বলতে হয়ঃ “ওয়াচ ইট, ড্রিংক ইট ইন।“